পুস্তক পর্যালোচনা ।। অণুগল্প সংকলন: পুঞ্জ মেঘের পানসি ।। সম্পাদনা: বিশ্বনাথ প্রামাণিক ।। পাঠ প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
গ্রন্থ: পুঞ্জ মেঘের পানসি (অণুগল্প সংকলন)
পাঠ প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক, কৃষ্ণনগর
বইবাজারে অণুগল্প সংকলনের অভাব নেই, কিন্তু কথাকাহিনির (বিশ্বনাথ প্রামাণিক) সম্পাদনায় নবপ্রভাতের ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত সম্পূর্ণ নতুন স্বাদের অণুকাহিনী সম্বলিত পুঞ্জ মেঘের পানসি ভিন্ন চেতনায় ভাস্বর। বর্তমান সময়ের চাহিদা মিটিয়ে লেখা ৮৪টি উৎকৃষ্ট অণুগল্পকে দু'মলাটে বন্দি করবার কৃতিত্ব তাই নেহাত কম নয়। নবীন, প্রবীণ, বিখ্যাত, স্বল্পখ্যাত এবং এবং উঠতি গল্পকারগণও তাঁদের লেখনীর সেরা ফসল উপহার দিয়ে সম্পাদক মহাশয় তথা কথাকাহিনিকে সহযোগিতা করেছেন সুন্দর এই সংকলনটির অবয়ব গড়ে তুলতে।
সংকলনের শুরুতেই প্রাজ্ঞ লেখক-সম্পাদক শ্রী কালিদাস ভদ্র রচিত ধূপকাঠি গল্পটির গন্ধ ম ম করতে থাকে পাঠকের মনোভূমি জুড়ে। তরুণ মান্না ভিন্ন আঙ্গিকে লিখেছেন নাম তার অণু যার শেষ লাইনে দুরন্ত চমক। চন্দন মিত্র-র লুকিংগ্লাস আজকের সমাজের অবিকল প্রতিচ্ছবি – সনিষ্ঠ পাঠকও লুকিংগ্লাসে তার মুখ দেখতে গিয়ে হয়তো অনুভব করবেন কাঁচটা বেশ ঝাপসা লাগছে! মুক্তি দাশের খোঁজাখুঁজি আবার হালকা চালে লেখা অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়ের একটি লেখা। সবিতা বিশ্বাসের আত্মগ্লানি পড়ে হয়তো আপনি, আমি, সবাই কিঞ্চিৎ আত্মগ্লানিতে ভুগবো কন্যাসন্তানকে এখনও অনাদর করবার জন্য — পরে যথারীতি আবার ভুলেও যাবো সেসব। সমাজ বসুর ছাদ আর একটি উৎকৃষ্ট অণুসাহিত্য যা পাঠককে ভাবাবে। দেবাশিষ চক্রবর্তীর বড়দিন গল্পটি পড়ে পাঠকের গলার কাছটায় একটা কষ্টের দলা উথলে উঠলেও হয়তো বলে উঠবেন- শাবাশ! এণাক্ষী কয়াল মণ্ডলের ছায়াবৃত্ত গল্পটিও পাঠককে ভাবাবে, খুব ভাবাবে। ইয়াসমিন বানুর উৎসর্গ গল্পটি কবিতার মতো সুন্দর। তীর্থঙ্কর সুমিতের মরচের দাগ গল্পটি চাবুকের মতো আছড়ে পড়ে পাঠকের মনোভূমিতে — যেন একটা শব্দ হয় - শপাং! তারপর প্রেম, বন্ধুত্ব, সততা... সবকিছুর শেষে সাদা পোশাকে মরচের দাগ লেগে যায়। শাশ্বত বোসের ঠিক বৃষ্টি নামার পরে গল্পটি পাঠকের মনে দাগ কাটবে। মোবাইল সর্বস্ব আধুনিক যুগে মানুষের মোবাইল সর্বস্বতাকে চাবুক মেরে লেখা স্টুপিড গল্পটি (সন্তু চ্যাটার্জি) মোবাইল-আসক্ত পাঠকের গালে এক তুমুল চপেটাঘাতের মতো আছড়ে পড়ে। হালকা চালে লেখা এপ্রিল ফুল গল্পটিকে গল্পকার অঞ্জনা দেব রায় বিশ্বাসযোগ্যভাবেই নির্মাণ করছেন – কাজেই তা পাঠকের ভালো লেগে যায়। অমিত ঐশ্বর্যের অধিকারীণিও ফুটপাতের ফুটো-কড়ির অধিকারীণিকে যে হিংসা করতে পারেন – তা অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপিত করছেন গল্পকার রাজশ্রী দে তাঁর গরম ভাত গল্পে। সুমিত মোদকের চাণক্য গল্পে আবার রূপকের ছোঁয়া যা গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। প্রতিমা সেনগুপ্তর 'আকাশপ্রদীপ' একটি অত্যাশ্চর্য নির্মাণ। প্রেমকে উপজীব্য করে শ্যামল হুদাতীর লেখা প্রেমপত্র চেনা-জানা ছকেও সাবলীল এবং মনোগ্রাহী। বশীকরণের প্রেক্ষাপটে রচিত 'মন-ছটফটি' ভিন্নধর্মী সুপাঠ্য একটি গল্প যার শেষ লাইনটি বিদ্যুৎ চমকের মতো গল্পের তান্ত্রিকের অন্তঃস্থলকে প্রকট করে দেয়। মাত্র সত্তর শব্দে লেখা শুভশ্রী দাসের ভোর গল্পটি কবিতার মতোই চমৎকার। জীবন কুমার সরকারের ব্যতিক্রম গল্পটির শেষ লাইনেই বাজিমাত - আমি যে মিথ্যে বলতে শিখিনি!
এভাবে গল্প থেকে গল্পান্তরে অত্যাশ্চর্য সব চমক। বস্তুতপক্ষে হঠাৎ বিদ্যুৎচমকে চারপাশ আলোকিত হয়ে চরাচর আবার অন্ধকার হয়ে গেলেও মনের মধ্যে যেমন আলোকের রেশ থেকে যায় তেমনই সব সুনির্বাচিত অণুগল্পগুলি পাঠক মনে নিয়ে আসে ভিন্ন ভিন্ন তাৎক্ষণিক দ্যোতনা যার রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ, বহুসময়, বহুদিন …। সংকলনটি পড়তে পড়তে বেশ বোঝা যায় মাননীয় সম্পাদক মহাশয় লেখকের অনুভববেদ্যতাকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দিয়েই অণুগল্পগুলি নির্বাচিত করেছেন আর সেই কারণেই সংকলনটি একটি উৎকৃষ্ট সংকলন হয়ে উঠেছে। আর এতোগুলো উৎকৃষ্ট অণুগল্পকে দু'মলাটের ভিতর গ্রন্থিত করে পাঠককে উপহার দেওয়ার কৃতিত্বকে এতোটুকু অগ্রাহ্য করা যায় না। এছাড়াও কথাকাহিনি ধন্যবাদার্হ হবেন এই কারণে যে — বহু কবিকে দিয়েও তাঁরা লিখিয়ে নিয়েছেন উৎকৃষ্ট সব অণুগল্প — যা ফিরে পড়বার মতো সুন্দর এবং স্বমহিমায় ভাস্বর। উদাহরণস্বরূপ চন্দন চক্রবর্তী (ঝরে যাওয়ার আগে), বিদ্যুৎ মিশ্র (ছুরি), সুতপা সোহহং (হাওয়া), মানস চক্রবর্তী (প্রদীপের নীচে), দয়াময় পোদ্দার (ছিন্নশিকড়, ঝরাপালকের রং এবং কল্পিত কথকতা) প্রমুখের কথা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া বাংলাদেশের ইসমত আরা সুপ্তি উপহার দিয়েছেন চমৎকার একটি গল্প ফাঁদ যেখানে ভয় আছে, সংশয় আছে, নিরাপত্তাহীনতা আছে; অথচ সবচেয়ে শেষে আছে মানবতার জয়। মৃত্যুকে উপজীব্য করে লেখা প্রদীপ কুমার সামন্তের ছন্দপতন গল্পটিও অত্যন্ত চমৎকার একটি অণুগল্প। সোমা মজুমদার তাঁর জীবন গল্পে কলমের জাত চিনিয়েছেন। একই কথা প্রযোজ্য অনুরাধা দেব (সিগন্যাল), অরুণ কুমার সরকার (কাঙ্খিত হাত), লক্ষ্মণ চন্দ্র নস্কর (শেষ সুবাস), অন্তরা ঘোষ (বাজি), ব্রজ গোপাল চ্যাটার্জি (বন কুঁখড়ার ডাক), শংকর ব্রহ্ম (থাপ্পড়), অঙ্কিতা পাল (সেদিন গোধূলি বেলায়), মহুয়া বসু (অযোনিসম্ভূতা), সুমিত মোদক (চাণক্য), তমেকা ঘোষ (আলোয় ফেরা) প্রমুখ গল্পকারের ক্ষেত্রে। চমৎকৃত হওয়ার মতো অণুগল্প লিখেছেন গোপাল বাইন। নিরাশাহরণ নস্করের 'দর্শন' গল্পটি ফিরে পড়বার মতোই সুন্দর — গল্পটি একটি মন্দির, পুরোহিত ও মন্দিরের পরিচারিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে; বস্তুতপক্ষে মন্দির দর্শন করতে এসে গল্পকথক যা দর্শন করে যান তা জেনে পাঠককে মর্মিত হতেই হয়; আর সেইখানেই অণুগল্পটির প্রকৃত সার্থকতা। কাজল আচার্যের দমকা হাওয়ায় গল্পটিও একটি উৎকৃষ্ট নির্মাণ। বিশ্বনাথ প্রামাণিকের 'আয়না' গল্পটিও পাঠকের কুর্ণিশ পাওয়ার যোগ্য — আয়না গল্পটিতে আমরা দেখতে পাই পৈতৃক বাড়িতে থাকা একটি বড়োসড়ো সাবেকি আয়নাকে, যেটিকে গল্পকথক তার প্রয়াত মায়ের একখানা পুরনো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছেন, কারণ তিনি আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারেন না; টানটান গল্পটি পাঠককে গল্পের শেষ লাইন পর্যন্ত নিয়ে যায়, অথচ ছোটগল্প পড়ার মতো একটা অতৃপ্তি যেন পাঠকের মনে লেগেই থাকে, আর তখনই গল্পটি একটি সার্থক অণুগল্পে পরিণত হয়। সত্যিই একটি চমৎকার নির্মাণ বিশ্বনাথ প্রামাণিকের 'আয়না'।
তবে সংকলনের সব গল্পই যে মানোত্তীর্ণ এমনটি কিন্তু নয়। কিছু গল্প পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে – গল্পটি লেখকের আরও মনোযোগ দাবী করে, দাবী করে সময়। আবার সংখ্যায় কম হলেও দু-একটি গল্প পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে কাহিনী অনেকটা আরোপিত যা গল্পটিকে দানা বাঁধতে দেয়নি। আবার দু-একটি গল্পের কাহিনী বলিষ্ঠ হলেও নির্মাণশৈল্পীর দুর্বলতা তাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তুলেছে।
এতদসত্ত্বেও মুক্তকণ্ঠে বলা যায় – এতোগুলো সুপাঠ্য, ফিরে পড়বার মতো উৎকৃষ্ট গল্প দু-মলাটে বন্দি করা মোটেও সহজ কাজ নয় যা করে দেখিয়েছেন কথাকাহিনির বিশ্বনাথ প্রামাণিক মহাশয়। তাঁর বলিষ্ঠ সম্পাদকীয় কলমটি সংকলনের আরেকটি বড়ো সম্পদ। সেইসঙ্গে চমৎকার প্রচ্ছদ, উৎকৃষ্ট কাগজ, নির্ভুল ঝকঝকে ছাপা, চমৎকার বাইন্ডিং — সংকলনটিকে আরও আকর্ষণীয় ও মনোগ্রাহী করে তুলেছে। আমরা, পাঠকরা কথাকাহিনির পরবর্তী সংকলনের দিকে তাকিয়ে সাগ্রহে অপেক্ষা করবো।
========================
সম্পাদনা: বিশ্বনাথ প্রামাণিক
প্রকাশক: নবপ্রভাত, কলকাতা-১৪৪
প্রকাশকাল: নভেম্বর'২০২৪
মূল্য: ১৩০ টাকা।