পুস্তক পর্যালোচনা ।। কাব্যগ্রন্থ: কবিতা মঞ্জরী ।। পাঠ প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
কাব্যগ্রন্থ: কবিতা মঞ্জরী
কবি: পরেশ চন্দ্র রায়
পাঠ-প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
কবি পরেশচন্দ্র রায়ের দ্বিতীয় একক কাব্যগ্রন্থ 'কবিতা মঞ্জরী'। প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ 'কবিতা মালঞ্চ'র সার্বিক সফলতার ভাবালুতা কাটিয়ে কবি যখন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের আঙিনায় পা রাখেন তখনও তাকে সাহস জোগান মফঃস্বল সাহিত্য বাংলা আকাদেমির কর্ণধার হরিসাধন জোয়ারদার এবং প্রকাশক হৈমন্তী জোয়ারদার – তেরী হয় কবিতা মঞ্জুরীকে যন্ত্রস্থ করবার প্রয়াস। অবশেষে ২০২৪ সালের অক্টোবরে পূজাবকাশে কবিতা মঞ্জুরী যখন প্রকাশের মুখ দেখতে পায় তখন কবি পরেশচন্দ্র রায় পঁচাত্তর বছরের একজন বর্ষীয়ান যুবক। কবির লেখা নানা স্বাদের ১১৭ টি কবিতাকে দুই মলাটের মধ্যে বিন্যস্ত করে রচিত হয়েছে সাত ফর্মার 'কবিতা মঞ্জরী'র অবয়ব।
কবি কখনও বিবিধের মাঝে মিলনের মহত্ত্ব দেখতে পেয়ে রচনা করেছেন ভারতীয় সংস্কৃতি, বিবিধের মাঝে মিলন, জাতীয় পতাকা, সংস্কৃতির টান, বাংলা ভাষার রূপ, প্রজাতন্ত্র দিবস, বিজয়ার মিলন প্রভৃতি কবিতা। আবার কখনও বা মানবধর্মের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব লক্ষ্য করে কবি রচনা করেছেন অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন, গীতা সংকলন, একই ঈশ্বর, কালীমাতা, ঈশ্বর সাধনা, ধর্মবোধ, ঈশ্বর সত্তা, ধর্মবোধ চেতনায়, মহালয়া, গীতা পাঠের বন্ধু, ঈশ্বর দর্শন, রথযাত্রা, শ্রীচেতন্য, ভারতীয় সংস্কৃতির নতুন যুগ, শাশ্বত বাণী, ঝুলন ইত্যাদি কবিতা। আবার সেই কবিই সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতাহীনতা, নৈতিক অবক্ষয়, স্বার্থপরতা, ক্রুরতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি দেখে ব্যথিত হয়ে কলম তুলে নিয়েছেন হাতে, আর রচিত হয়েছে ভিন্নধর্মী কবিতাসম্ভার — অমানবিক, ব্যবহার-ই জীবনের পরিচয়, এ কেমন স্বাধীনতা, অবিচার, শিশুপাচারকারী, কিশোরীর বিয়ে, বৈবাহিক হিংসার শিকারে স্বামী, সন্তানের অবহেলায় বৃদ্ধদের করণীয়, ঠকে শেখা ইত্যাদি।
আবার একই সঙ্গে কবি একজন আদর্শ সামাজিক ব্যক্তিত্বের পরকাষ্ঠা হিসাবে রচনা করেছেন ক্রেতাসুরক্ষা বিধি, কর্মে নয় ফলেও আশা, নারী জাগরণ, নতুন যুগ, শান্তির ডাক, শিশু মোবাইলে আসক্ত হলে, সৎসঙ্গ, পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি কবিতা। সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্যের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টিতেও তিনি তাঁর কলমকে হাতিয়ার করে লিখেছেন 'সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য' শীর্ষক বলিষ্ঠ কবিতা। রেগিং (ragging) -এর মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধেও তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সোচ্চার কলম - 'রেগিং হলে'। এভাবে কবি তাঁর নানা বিষয়ক কবিতায় একটা সুস্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন যে – সময়ের পরিবর্তনে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করতে হবে, সেই সঙ্গে সমাজের চিন্তাবিদদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে সমাজ সংশোধনের জন্য। তাই তাঁর কবিতায় যেমন এপ্রিল ফুল, সোনার দাম, বাংলা নববর্ষ, দোলের রং – ইত্যাদির মতো লঘু বিষয় স্থান পেয়েছে, তেমনই অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়েও তাঁর কলম ভীষণভাবেই সচেতন এবং সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে পাওয়া, বাংলা গদ্যের বিকাশ, গোরা উপন্যাসের ভূমিকা, নজরুলের চিন্তাভাবনা, বইমেলার ভাবনা, বিবেকানন্দের অজানা রূপ, মাইকেল মধুসূদন ইত্যাদি কবিতা তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এছাড়া কবি তাঁর কাব্যিক লেখনীতে মেয়েদের জীবনে পরীক্ষা, হিন্দির দাপট, বাতিল নোটের খেলা, ১৯শে মে, টিভি সিরিয়াল ইতাদি বিষয়েও সদর্থক মতামত প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন কবিতায়।
লেখালিখির প্রসঙ্গে কবি নিজেই তাঁর কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন — "মানুষের জীবন প্রথম থেকে অন্তিম পর্ব পর্যন্ত কালের নিয়মে নানা বিবর্তনের ধারায় বিবর্তিত। তার উপর ভর করেই চলেছে এই কবিতার চলা। যখন যেমন মনে স্থান পেয়েছে, সেই অনুসারেই চলেছে এই লেখা। এতে কোন ধারাবাহিকতা নেই। আছে শুধু বৈচিত্রের মধ্যে সমণ্বয়। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে হয়েছে কবিতার বলা। পাঠক কবিতা পাঠে আনন্দ পেলেই হবে এই কবিতা মঞ্জরির সার্থকতা।" কবির বেশ কিছু কবিতা-পঙক্তি অত্যন্ত স্মরণীয় এবং উল্লেখযোগ্য —
১.
আর অর্থ নয় কোন কীর্তি নয়
বার্ধক্যে একটু সান্নিধ্য চাই।
নিজেদের ভাল রাখাটা জরুরী
বেঁধে বেঁধে থাকলেই তা পাই॥ (বার্ধক্যে নিঃসঙ্গ অপেক্ষা)
২.
ভাঙা-গড়ার মধ্যে চলার নামই জীবন।
থামার নাম মৃত্যু।
থামলে চলবে না।
চলতে হবে ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়েই। (চলাই পথ)
৩.
কর্ম যদি ভাল থাকে-
তারা পায় ফুল।
খারাপ কর্ম হলে পাবে
মৌমাছির হুল॥ (শিক্ষক দিবস)
৪.
জীবনের বাঁধন থাকুক অটুট
নিয়ে সাথে সুস্থতা।
থাক বন্ধুত্বের বাঁধন। দূরে থাকুক
মনের যতো বিষণ্ণতা॥ (বাঁধন)
এভাবে কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় পাঠককে দিতে চেয়েছেন কাব্যের দুলুনিসহ টক-ঝাল-মিষ্টি-নোনতা নানারকম স্বাদ।
পরিচ্ছন্ন মনকাড়া প্রচ্ছদ, মজবুত বাঁধাই এবং উৎকৃষ্ট কাগজে ঝকঝকে ছাপা কাব্যগ্রন্থটি হাতে নিলেই মনে অন্যরকম একটা প্রত্যাশা জাগে। তথাপি সতর্ক পাঠকের নজরে পড়বে দু'একটি মুদ্রণপ্রমাদ; যেমন – বোঝা 'বোজা' হয়েছে, সার্থকতা হয়েছে 'স্বার্থকতা', উদ্যম হয়েছে 'উদ্যাম' ইত্যাদি। এছাড়া কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা 'কথার চাবুক' কবিতাটির শিরোনাম সূচিপত্রে 'কথার দাম' হিসেবে ছাপা হয়েছে। এই ছোট্ট ত্রুটিটুকু বাদ দিলে কবি পরেশচন্দ্র রায়ের 'কবিতা মঞ্জরী' কাব্যগ্রন্থটি একটি ঝকঝকে উপস্থাপনা যা পাঠককে ভাবাবে, বোঝাবে, শেখাবে এবং আনন্দ দান করবে।
==================
কাব্যগ্রন্থ: কবিতা মঞ্জরী
কবি: পরেশ চন্দ্র রায়
প্রকাশক: মফঃস্বল বাংলা সাহিত্য একাডেমী
প্রচ্ছদ: আশিক দত্ত
প্রকাশকাল: অক্টোবর'২০২৪
মূল্য - ২০০ টাকা