গল্প ।। বেড়াতে গিয়ে বিপদ ঐ ।। অঞ্জনা মজুমদার
0
মে ০১, ২০২৫
বেড়াতে গিয়ে বিপদ ঐ
অঞ্জনা মজুমদার
মিতিল তার দাদাভাই বিমান আর বাবা মা একসাথে এবারের গরমের ছুটিতে কাশ্মীরে বেড়াতে এসেছে। মিতিল ক্লাস সেভেন আর দাদাভাই ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফার্স্ট ইয়ারে। মিতিলের বাবা দিল্লিতে ভারতীয় কনসুলেট এর পদস্থ কর্তা। সোনমার্গ, গুলমার্গ ঘুরে ওরা টিউলিপ গার্ডেন এসেছে।
কাশ্মীর অসাধারণ সুন্দর। সত্যিই একে কেন ভূস্বর্গ বলে মিতিল আর দাদাভাই বুঝতে পারছে। এরপর ওরা ডাল লেকে একটা হাউসবোটে আজ আর কাল দুদিন থাকবে। কিন্তু টিউলিপ গার্ডেনে একজন পাহাড়ি মানুষ হঠাৎ মিতিলের মায়ের পাশে এসে চুপিচুপি বলল, মাজী, আপলোগ ডাল লেক পর মত যাইয়ে।
মা সীমা দেবী আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়ে বললেন, কে তুমি ? কেন বলছো এসব? বলতে বলতেই লোকটি ছুটে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। বাবা দাদাভাই, মাকে ঘিরে কি হয়েছে, তুমি চেঁচিয়ে উঠলে কেন? মা কাঁদো কাঁদো হয়ে লোকটির কথা বললেন। মিতিল বলল, আমিও শুনেছি। চারিদিকে তাকিয়ে কিন্তু চারপাশে কাউকে দেখা গেল না।
ওদের গাইড কাম ড্রাইভার মহসিন এসে বললো, চলিয়ে মাজী আপলোগ। ফিরতে হবে। আজ তো রাতে হাউসবোটে থাকতে হবে। সাঁঝ হবার আগেই পৌঁছাতে হবে।
মহসিন একটু একটু বাংলা বলতে পারেন। বাবা মহসিনকে লোকটির কথা বলতেই মহসিন একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমরা যাবার পথে সেনা ছাউনিতে আর থানায় কথা বলে যাব।
সেইমতন প্রথমে পথের ধারে সেনা ছাউনির সামনে গাড়ি দাঁড়ালো। মহসিন বেশ পরিচিত মুখ। সেনা কমান্ডার একজন বাঙালি, মেজর রাহুল সেন বাড়ি কলকাতার দমদমে। মিতিলের মতো তাঁর একটা ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ে আছে। মাকে বললেন, দিদিভাই, ভয় পাবেন না। আমরা সবাই সবসময় আপনাদের সাথে আছি। তাও আপনারা লোকাল পুলিশকে একটু জানিয়ে রাখুন।
অতঃপর লোকাল থানা। সেখানে অফিসার মিস্টার গুরুং আশ্বস্ত করলেন যে ওনারা খেয়াল রাখবেন।
মহসিন বললেন, আমাদের ট্যুরিস্টরা আমাদের কাছে অতিথি। অতিথির কোনও অপমান বা ক্ষতি আমরা কাশ্মীরীরা হতেই দেব না।
এভাবে বিকেল হয়ে গেল। একটা শিকারা অপেক্ষা করছিল যেটা ওদের হাউসবোট রেনবো ইন এ পৌঁছে দিল।
হাউসবোটটি খুব সুন্দর সাজানো। দুটি ঘর, দুটি টয়লেট, একটা লম্বা বারান্দায় বেতের চেয়ার টেবিল পাতা। একটা কিচেনও আছে। ঘরে লাগেজ রেখে বারান্দায় বসতেই গরম গরম কফি আর পকোড়া এসে গেল।
তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। চারিদিকে নানা হাউসবোটে আলো জ্বলে উঠেছে। ডাল লেক আলোর মালায় সেজে উঠেছে। দূরে পাহাড়ের ওপর বরফের ওপর চাঁদের আলোয় ঝকমক করছে। মা সব ভুলে বলে উঠলেন, কী সুন্দর! এজন্যই এটা ভূস্বর্গ বলে।
সবাই শান্ত মনে ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে একটু রেস্ট নিতে গেল।
ঠিক রাত নটায় ডিনার সেরে সবাই ঘুমাতে গেল।
পরদিন ভোর ভোর উঠে ভোরের সূর্য উদয় দেখে, তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে শিকারায় চড়ে ডাল লেকের ভাসমান মার্কেট দেখতে গেলেন সবাই। মা গোটা চারেক শাল, আর সবার জন্য গরম জামা আর কিছু ছোট ছোট ম্যাগনেট কিনলেন। আর কিছু শুকনো ফল কিনলেন।
কেনাকাটা সেরে আবার শিকারায় চড়ে ডাল লেকের কিনারায় এসে মহসিনের অপেক্ষামান গাড়িতে চড়ে শ্রীনগরের শঙ্করাচার্য মন্দির, চশমা শাহী এসব দেখা হলে বিকেল হয়ে গেল হাউসবোটের জন্য শিকারা ধরতে।
হাউসবোট রেনবো ইন এর সামান্য দূরে থাকা অবস্থায় পাশ দিয়ে আর একটা শিকারা দ্রুত এগিয়ে গেল। আর তার থেকে একজন লোক ঝাঁপিয়ে মিতিলদের শিকারার চালককে দাঁড় দিয়ে মারতে গেল। মিতিলদের শিকারার চালকের হাত থেকে দাঁড় পড়ে গেল। শিকারা টলমল করে উঠলো। মা আর্তনাদ করে উঠলেন। মিতিল মাকে জড়িয়ে ধরলো। সেই মূহুর্তে অন্য একটা শিকারা থেকে সেনা কমান্ডার গুলি চালিয়ে দিতেই চালক শিকারা উল্টে জলে পড়ে গেল। সেনাবাহিনীর লোকজন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই জনকে ঘাড় ধরে হাউসবোটে তুললেন।
মিতিলদের শিকারার চালক সামলে নিয়ে শিকারা হাউসবোটের সিঁড়িতে লাগিয়ে সবাইকে হাউসবোটে উঠতে সাহায্য করলেন।
সেনাবাহিনীর লোকজন দ্রুতগতিতে পোশাক পরিবর্তন করলেন।
মেজর রাহুল সেন দুজন লোককে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, দেখুন তো দিদি এদের মধ্যে কেউ কি আপনাকে হুমকি দিয়েছিল?
মা একজনকে দেখিয়ে বললেন, এই লোকটি আমাকে ভয় দেখিয়েছিল। অন্য জনকে আমি কয়েকবার ভিড়ের মধ্যে দেখেছি।
লোকটি কটমট করে তাকিয়ে রইল।
ইতিমধ্যে শ্রীনগরের পুলিশ অফিসার এসে পৌঁছে গেছেন। তিনি বললেন, এরা তো কুখ্যাত গুন্ডা। এদের তো স্থানীয় মানুষেরা শ্রীনগর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এখানকার মানুষজন চোর গুন্ডাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখে না।
জোরে একটা চড় মেরে বললেন, তোরা আবার এখানে কোন সাহসে ঢুকেছিস ? কার জন্য কাজ করছিস?
কম বয়সী ছেলেটা কেঁদে বলল, আব্বাকে আবদুল চাচা অনেক টাকা দেবে বলেছে। আমাদের হাউসবোটটা ওই টাকা দিয়ে আমরা ছাড়াতে পারবো। আম্মু খুব বিমার আছে। ডাক্তার দেখাবো।
কিন্তু এদের ওপর হামলা করার দরকার হল কেন?
মিতিলকে দেখিয়ে বলল, এই বহিনকে কিডন্যাপ করতে পারলে টাকাটা পেতাম। আর বহিনকে ছাড়াতে সরকার আমাদের সর্দারকে জেল থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হত। আবদুল চাচা প্ল্যান করেছে।
তাই নাকি? এবার বল্, আবদুল চাচা কোথায় ?
চাচা ওই চশমা শাহীর কাছে থাকবে।
ফোন করে বল্ যে তোরা আধা ঘন্টার মধ্যে যাবি।
কাঁপতে কাঁপতে ছেলেটি ফোন করল।
পুলিশ এর ফোনে ফোনে খবর পেয়ে সেনার সাহায্য নিয়ে আবদুলকে অ্যারেস্ট করা হল।
সন্ধ্যার পরে হাউসবোটে গোলটেবিল কফির আসর বসল। মেজর রাহুল সেন বললেন, একটা বড় ডাকাতদের দলকে গতমাসে ধরা হয়েছিল। তাদের সর্দারকে ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে ক্রমাগত। এবার মিতিলকে কিডন্যাপ করে চাপ দিয়ে সর্দারকে জেল থেকে বের করে আনতে চেয়েছিল।
বাবা বললেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর চেষ্টায় আমরা বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। আর আমাদের শিকারা চালকও খুব সাহসী।
মেজর সেন হাসলেন, ও তো আমাদের লোক। স্থানীয় মানুষ কিন্তু দেশের জন্য জীবনও দিতে পারেন। ওনারাই তো আমাদের ভরসা।
শিকারার চালক আর হাউসবোটের মালিক মিতিলের মা আর মিতিলকে নমস্কার আর বাবা, দাদাভাই এর সাথে করমর্দন করলেন।
মেজর বললেন, এবার আপনারা নিশ্চিন্তে কাশ্মীর ঘুরতে পারেন। আর কেউ আপনাদের বিরক্ত করতে সাহস পাবে না। আর অলক্ষ্যে আপনাদের সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের সেনাবাহিনীর আর পুলিশের।
পুলিশ প্রধান সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বললেন, জয় ভারতমাতার জয়। সবাই একযোগে বললেন, জয় ভারতমাতার জয়।
=====================
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১