বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। সেদিনের এক দিন ।। আব্দুল্লাহ আল নোমান

 

সেদিনের একদিন

 আব্দুল্লাহ আল নোমান
 
 

সারি সারি অসংখ্য বাঁশ। বিশাল এক বাঁশবাগান। বাঁশবাগানটি পূর্বদিক  থেকে গ্রামটিকে আড়াল করে রেখেছে। সৈন্যরা যেভাবে চর্মনির্মিত কিংবা সংকর ধাতজাত ঢাল ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষার্থে সচেষ্ট থাকে ঠিক তেমনি বাঁশবাগানটি যেন একপ্রকার ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। যা কিনা সূর্যালোকরশ্মিকে প্রতিহত করতে চাচ্ছে। কিন্তু তা সম্ভবপর না। সৈন্যরা  যেমন কৌশলে কৌশলে শত্রুর বৃহৎ-প্রাচীর ভেদ করে শত্রুর ঘাঁটির চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক অনুরূপভাবে সূর্যের আলোকরশ্মির ছিটেফোঁটা বাঁশবাগানের পাতা- কচি পাতা-লালচে পাতার পাশ ঘেষে গ্রামে প্রবেশ করে। আসলে বিষয়টা ফুটবল খেলার মতো,যেখানে একপক্ষের খেলোয়াড় অপর পক্ষের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে গোল করে। কিন্তু মানুষ এরকম হাজার গোলেও সন্তুষ্ট হতে পারছে না। কারণ এখন শীতকাল। সূর্যের ছিটেফোঁটা রশ্মি দিয়ে গা গরম হবার নয়। তাই, গ্রামের মানুষ রোদ পোহানোর জন্য প্রাচীর ভেদ করছে। কেউ কেউ ইতোমধ্যে প্রাচীর ভেদ করে অগ্রপথিকের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তা নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করেনি। তার অনেক কারণ হতে পারে। যেমন- প্রথমত, এটি ইতিহাস তৈরির মতো উপযুক্ত স্থান নয়। দ্বিতীয়ত, ইতিহাস তখনই সৃষ্টি হয়, যখন কেউ নতুন কিছু উদ্ভাবন করে অথবা কোনো কিছু আবিষ্কার করে। আর, এরপরে আবিষ্কারক/ উদ্ভাবকের দেখানো পথে অন্য মানব চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। কিন্তু এখানে অগ্রপথিকের পথ পদচিহ্ন দেখে দেখে কেউ আসছে না। একেক জন আসছে একেক পথে। সর্বোপরি, ইতিহাস তৈরি করতে গেলেও ভেজাল কারন কে যে বীর তা বোঝাও মুশকিল। তবে শুনেছি এরূপ অহেতুক ইতিহাস বা রেকর্ড তৈরির জন্যেও নাকি পৃথিবীতে সুযোগ রয়েছে। তবে এখানকার কেউ তার হদিস পায়নি, আর তারা সেই হদিসের অনুসন্ধানেও নেই। কারন তাদের কেউকেউ এখন চেয়ারে বসে আছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে।  কেউবা এই শীতের সকালের মেদুরে মাদুর পেতে বৃথা ঘুমানোর চেষ্টায় নিয়োজিত। এমন একটা সময়-অসময়ে চিৎকার শোনা যাচ্ছে- বাদশা, বাদশা। রোদ পোহানো দলের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো- আব্বা  যাচ্ছি।


বাদশা  বাড়ির পথ ধরল। আর তার পিতা, তার পাতানো মাদুরে বসে পড়লো। ইতোমধ্যে অনেকেই বাড়ি চলে গিয়েছে। বাদশার পিতা বাবর খাঁ ধীরে ধীরে চাচা-ভাতিজাদের সাথে গল্পে মেতে উঠল।


সকাল সাড়ে নয়টা । খাওয়া দাওয়া সেরে স্কুল ড্রেসটা পরে বই-খাতা গুছিয়ে নিচ্ছে বাদশা। বাদশার বন্ধু জাহিদ হাসান ফটক-দ্বারে দাঁড়িয়ে হাক-ডাক পারছে- কইরে বাদশা, তাড়াতাড়ি নে।


বাদশা মা রাফিয়া খানম টিফিন বাটিটা ছেলের হাতে তুলে  দিলেন। বেড়িয়ে গেল বাদশা স্কুলের উদ্দেশ্যে। তাদের গ্রাম সহজপুরের পাশের গ্রাম হোসেনপুর। সেখানেই তার স্কুল। স্কুল ফটকের সামনে বড় বড় করে লেখা 'হোসেনপুর  বালক উচ্চ বিদ্যালয়'। বাদশা ও জাহিদ দুজনেই ক্লাস নাইনের ছাত্র।


প্রত্যাহিক সমাবেশ শেষে যথারীতি শুরু হলো ক্লাস। রুমের সামনের বেঞ্চগুলো অনাদৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে শ্রেণি শিক্ষক ইমরান ইসলাম রেগে গেলেন। তার রাগ দেখে বেঞ্চগুলো পূরণ হয়ে গেল। বাদশা সামনে বসতে চাচ্ছিল না। তবু বন্ধুরা এক-রকম কুট-কৌশলে তাকে সামনে বসিয়ে দিয়ে কোনো একটা অঘটন দেখার অপেক্ষায় বসে ছিল। বাদশা ভাবল, এই ক্লাসটার পরে আবার পূর্বের  স্থানে ফিরে যাবে। কারণ সামনের বেঞ্চে বসলে পদে পদে বিপদ বিশেষ করে তার মতো ছাত্রের জন্য। কিন্তু, সমস্যার সৃষ্টি হলে হলো। শ্রেণি শিক্ষক বললেন, আমি কিন্তু মাঝে মাঝে ক্লাসটা দেখে যাব। আর যদি কোনো ওলট-পালট দেখি তাহলেতো বুঝতেই পারছো কি হতে পারে। সবাই জানে কি হতে পারে। সকলে স্যারের হাতে থাকা বেতটার দিকে একপলক তাকিয়ে অস্বস্তির নিরব নিশ্বাস ফেলল। ক্লাস শেষ হলো। ছাত্ররা আবার আগের মতো তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল। এক গ্রুপে ভদ্র মেধাবী ছাত্ররা অন্য গ্রুপে চঞ্চল ও হালকা মেধাবী ছাত্ররা, আর আরেক গ্রুপে সাংঘাতিক দুষ্ট ছেলেরা দল বেঁধে বসে পড়ল।


বাদশা  ২নং গ্রুপের সদস্য যদিও গ্রুপের অন্যদের বৈশিষ্ট্যের সাথে তার বৈশিষ্ট্যের যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য বিরাজমান। তাই সময়ে সময়ে বন্ধুরা তাকে ভয়ও দেখায়। এক অর্থে সে কাপুরুষও বটে। যার প্রমাণ আজও মিলল। স্যার চলে যাওয়ার পর সকল ছাত্র নিজ নিজ গ্রুপে গিয়ে বসলেও বাদশা অনড়। সে শ্রেণি শিক্ষকের ভয়ে ঐ  জায়গাতেই বসে রইল। তার গ্রুপের জাহিদ, তৌসিফ,  রনি, মারুফ, খোকন তাকে ডাকলেও সে গেলো না।


বনে-জঙ্গলে হিংস্র পশুকূল  শিকারকে ধরার নিমিত্তে নিজেকে অবগুণ্ঠিত করে রাখে। যাতে শিকার পালিয়ে না যায়। কিন্তু, এদিকে বাদশা নিজেকে অবগুণ্ঠিত করে রাখতে চাইছে যাতে শিক্ষকের হাতে ধরা না পড়ে। কারন এখন আব্দুর রাজ্জাক স্যারের ক্লাস। ক্লাসে  ঢুকতেই সকলে সালাম জানাল। স্যার ক্লাসে এসে বললেন, সকলের মনে আছেতো... ব্যাপারটা। তখনি সকলে একসাথে বলতে লাগল-জ্বি, স্যার। 

আজ স্যার গানিতীক সমস্যার সমাধান করতে দেবেন না পারলে কি হতে পারে তা সকলেরই জানা। ত্রিবিধ প্রহার।


বিষয়টি হলো এরকম-

যদি হয় গোড়ায় গলদ,

 বিশ প্রহার খাবে সে বলদ! 

যদি হয় মধ্যে ভূল,

 দশ প্রহার কড়ায়-গণ্ডায় হবে উশুল!

 যদি হয় শেষে ভূল-চুক, 

পাঁচ প্রহার খাবে সে, ভয়ে ধড়ফড় করে সকলের বুক!


ত্রিবিধ প্রহারের নিয়মগুলো সকলেরই জানা ছিল। তবে ক্লাস শুরুর আগে সকলে ত্রিবিধ প্রহারের যে পঙক্তিগুলো আওড়ায় তার রচক সম্পর্কে  আজও  কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কে ছিল সেই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি? সে তখন কোথায়? এরকম অজস্র প্রশ্নের উত্তর সকলেরই অজানা। আর ছাত্ররা তা জানতেও চায় না। কারণ প্রহার খাওয়ার সময় ঐ রচনাকারীকে বড়জোর  পাগলছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কিন্তু, তবুও ঐ পঙক্তিগুলোর রচকের তত্ত্ব অনুসন্ধানের কৌতূহলটা নিবৃত হয় না। কিছু  ছাত্র মনে করে, স্যারই এই পঙক্তিগুলোর রচক। তবে, অধিকাংশের মতে স্যারও জানেন না এই পঙক্তিগুলোর রচক কে? ছাত্ররা একাধিক বার স্যারের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল, স্যার ঐ পঙক্তিগুলোর রচয়িতা কে? স্যার শুধু বলেছিল, কি জানি, , কে যে সেই রচক? তাই, এই কথা বারবার প্রতিয়মান হয় যে, এর রচক আব্দুর রাজ্জাক স্যার ভিন্ন অন্য কেউ। এর রচক যে স্বয়ং আব্দুর রাজ্জাক স্যার নন-এই বিষয়টি আরো নানাভাবে প্রমাণিত হয়। যেমন- যিনি কবিতা লেখেন তার মুখ দিয়ে হরহামেশা কবিতার লাইন বের না হলেও মাঝে মাঝে হয়। আবার, যিনি কবি লেখেন তিনি কখনোই একটি কবিতা বা কয়েকটি পঙক্তি লিখে ক্ষান্ত হন না। কবির এই বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি বৈশিষ্ট্যও আব্দুর রাজ্জাক স্যারের মধ্যে নেই। শুধু যে তাই, তা কিন্তু না। তিনি ভুল করেও কখনো একটা পঙক্তি পর্যন্ত  আওড়ান না। তাহলে, এই বৃহৎ সমস্যার সমাধান কে করবে, কে এর সত্যতা যাচাই করবে তা কেউ জানে না। তবে সকলে জানে, স্যার এখন গানিতীক সমস্যার সত্যতা যাচাই করবেন। স্যার বলে উঠলেন, কি রে। সকলের সমাধান করা শেষ? আর মাত্র ২০ মিনিট বাকি, সকলের খাতা দেখতে হবে যে। গ্রুপ-১ এর ভেতর থেকে সরবে, সজোড়ে আওয়াজ এলো, জি স্যার! শুরু করেন। আর এদিকে ভয়ে বাদশার হৃৎপিণ্ডের কম্পনমাত্রা বেশির থেকে বেশিরতর  হতে লাগল। এমতাবস্থায়, বাদশা যেন কিছুটা কূল খুঁজে পেল যখন স্যার বললেন, আজ পেছন থেকেই শুরু করি। খোকন, দেখা দেখি কি করলি! কে যে কিল-ঘুষি,আর কে যে চপেটাঘাত খাচ্ছে,কিংবা  যষ্টির প্রহার খাচ্ছে বাদশার তা দেখার জো নেই। কারণ বাদশা নিজে অংক করতে পারেনি। তাই সে মাথা নিচু করে বিপদের প্রহার গুনতে লাগল। এক মিনিট,  দুই মিনিট করে ইতোমধ্যে পনেরো মিনিট কেটে গেল। বাদশা একদৃষ্টিতে ক্লাসের ঘড়িটার দিকে থাকিয়ে নিজের চরম বিপদের কথা স্মরণ করতে লাগল। মনে মনে বলতে লাগল, আল্লাহ এবার বাঁচিয়ে দাও। আল্লাহ, আল্লাহ।


ঘড়িতে ১১:৫০ মিনিট। ঘণ্টা বেজে উঠল।

বাদশার মনের গহীনে একটু আনন্দের উচ্ছ্বাস। কিন্তু, তা সকলের নজরে আসছে না। কারণ বাদ পড়া ছাত্ররা এখনো ভয়ে ভয়ে আছে। কি জানি কি হয়! না কিছু হলো না। তারা আজকে রক্ষা পেল বেদম-প্রহারের হাত থেকে। বাদশা রুটিনটার দিকে তাকিয়ে আরো একটু নিশ্চিন্ত হলো। বাদশা বলল- বাঁচা গেল  আর কোনো রাগী স্যারের ক্লাস নেই। এবার মনে হয় পেছনে যাওয়া যায়। কিন্তু, ইমরান স্যারের ব্যাপারটার কি হবে। এতো ভাবলে চলবে না। টিফিনের পর মুঈনদের সাথে বসব।


তৃতীয় ক্লাস শেষে টিফিন পিরিয়ড পেরিয়ে শুধু হলো ৪র্থ পিরিয়ড। বাদশা মুঈনের পাশে বসা। যে ভদ্রভাবে বসে ছিল। যাহোক, একে একে ৫ম, ৬ষ্ঠ পিরিয়ড পেরিয়ে সকলের ৭ম পিরিয়ডে অবস্থান। এটিই শেষ ক্লাস। আর এরপরেই ছুটি। ক্লাস শুরু হয়েছে।


ক্লাসের পেছনে বসা আবীর ও মারুফ একটু গন্ডগোল করল । পলাশ স্যার আসন থেকে উঠে পেছনের বেঞ্চের সামনে চলে আসলেন। বললেন, ' কে এমনটা করল রে? কে,এই ছেলেটা নাকি?বাদশাকে দেখিয়ে বললেন। কি নাম তোর রে?কোথায় বাড়ি? তাড়াতাড়ি বল। 


হঠাৎ বাদশা এতগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিব্রতবোধ করল। সে বলল, আমার নাম বাদশা।।

ঠিক এসময়ে বাদশার গ্রুপের ছেলেরা প্রতিবাদ করে বলল, না স্যার এর নাম বাদশা রিফক খান।


কি নাম। রিফক খান ? এটা আবার কেমন নাম?-

স্যার বললেন। কিরে আসলেই কি তোর নাম রিফক খান? বাদশা বলল, না মানে জি স্যার। বাদশা রিফক খান। 

পলাশ স্যার বিজ্ঞানের শিক্ষক। আজও তিনি বিজ্ঞান পড়াতে এসেছেন। আজ তিনি খাদ্য সম্পর্কে পড়াচ্ছেন। পলাশ স্যারের ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে প্রশ্ন করাটা স্বভাব । আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। তিনি বাদশার নাম নিয়ে প্রশ্নেরজাল তৈরি করলেন। এদিকে বাদশার মুখ শুকিয়ে আসছে। স্যার,  বাদশাকে জিজ্ঞেস করল- এই, তোরা কোন খাঁনরে? দেশি খাঁন না পাকিস্তানি খাঁন?। বাদশা প্রথম প্রশ্নটি শুনতে পায় নি।  বাদশা,দ্বিতীয় প্রশ্নটি শুনে একরকম হেসে জবাব দিল,স্যার, আমি ব্রয়লারই বেশি খাই। তার কথা শুনে ক্লাসসুদ্ধ সকলে হাসল। বাদশা কিছুক্ষণ পর বিষয়টি বুঝতে পারল। এক্ষেত্রে বাদশার অপরাধ যে গুরুতর তাও কিন্তু না। কারণ ক্লাসে খাদ্য সম্পর্কেই পড়ানো হচ্ছিল। তাই এইরকম? গন্ডগোল।  আর বাদশার মতো ছেলের ক্ষেত্রে এটি একটি অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।


এভাবে একরকম হাসাহাসির মধ্য দিয়ে ক্লাসের সমাপ্তি ঘটল। সকলে বাড়ি চলে গেল। ধীরে ধীরে বেলা  ডুবে গেল। চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেল।


নামঃ আব্দুল্লাহ আল নোমান

 ঠিকানা: খানসামা, দিনাজপুর, বাংলাদেশ।

দিনাজপুর সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত।




Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.