পরাবাস্তুবাদ ও বাংলায় জীবনানন্দ দাশের কাব্যচর্চা
রণেশ রায়
১. পরাবাস্তুবাদ বলতে আমরা কী বুঝি
অধিবাস্তবতা বা পরাবাস্তুবাদ (Surrealism) হলো মানুষের এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে সচেতন ও অবচেতন মনের পারস্পরিক ক্রিয়া শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টিতে এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দেয়। বস্তুজগতের সীমানা পেরিয়ে কল্পনা ও স্বপ্নের যে বিশেষ অঞ্চল, পরাবাস্তুবাদ সেই অঞ্চলকেই শিল্প সাহিত্য বিশেষ করে কাব্য সাহিত্যের বিচরণ ক্ষেত্র করে তোলে। এখানে বাস্তবতার সঙ্গে মনোজগতের স্বপ্নলোকে এক সেতুবন্ধন ঘটে।
পরাবাস্তুবাদ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি কবি গুইলাম অ্যাপোলিনার (1917)। এরপর আন্দ্রে ব্রেটন (১৮৯৬–১৯৬৬) এই আন্দোলনের মুখ্য তাত্ত্বিক হয়ে ওঠেন। ১৯২০-এর দশকে প্যারিস-কেন্দ্রিক এই আন্দোলন দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও চিত্রকলায় বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। ব্রেটনের Manifesto of Surrealism তখনকার প্রথাগত শিল্পচিন্তার বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ ছিল।
পরাবাস্তুবাদীরা বিশ্বাস করতেন—
বিজ্ঞানের অপব্যবহার,যুদ্ধের ভয়াবহতা,, সমাজে যান্ত্রিক যুক্তিবাদের দমননীতি q
মানব সমাজকে ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দেয়।
এই সবকিছুর বিরুদ্ধে মানুষের অবচেতন মনই সবচেয়ে বড় সত্য ধারণ করে। তাই তারা শিল্পকলাকে সকল নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে তুলে এনে মানবিক চেতনার পুনর্জাগরণে গুরুত্ব দেন।
২. শিল্প-সাহিত্যে কল্পকথা ও কল্পচিত্রের দ্বন্দ্বমূলক ভিত্তি
সাহিত্য কেবলমাত্র স্বপ্নবিলাস বা অলস কল্পনার প্রকাশ নয়। মানুষ প্রকৃতির অংশ—তার রয়েছে দুটি দিক:
বহির্মুখী দিক (বস্তুজগত)
অন্তর্মুখী দিক (মনোজগত)
মানুষ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুজগতকে উপলব্ধি করে, আর সেই উপলব্ধি স্নায়ুতন্ত্রে প্রতিফলিত হয়ে মনোজগতে কল্পচিত্র তৈরি করে। সাহিত্যিক সেই কল্পচিত্রগুলোকে ভাষা, ছন্দ, রূপক ও চিত্রকল্পে সাজিয়ে শিল্পে রূপ দেন।
এখানে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ—
বস্তুজগত মনোজগতকে প্রভাবিত করে
মনোজগত আবার বস্তুজগতকে নতুনভাবে বুঝতে সাহায্য করে
এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় কল্পকথা, যা বাস্তবতার ভিত্তিতে, কিন্তু শিল্পীর ব্যক্তিগত চেতনায় রঞ্জিত হয়ে সাহিত্য হয়ে ওঠে।
দুই ধারার মতভেদ আমরা দেখি—
(ক) ভাববাদী দর্শন (Hegelian):
→ মনোজগত প্রধান, বস্তু তার প্রতিফলন
→ সাহিত্যিকের কল্পনাই সত্যের উৎস
(খ) বস্তুবাদী দর্শন (Marxist):
→ বস্তুজগত প্রধান, সাহিত্য তার প্রতিফলন
→ সাহিত্য সমাজের পরিবর্তনের হাতিয়ার
→ শ্রেণী নিরপেক্ষ সাহিত্য নেই
পরাবাস্তুবাদ এই দুই চরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে অবচেতনের মুক্ত উন্মোচন এবং বাস্তবতার গভীরতর সত্য উদ্ঘাটন করতে চায়।
৩. পরাবাস্তুবাদের বিকাশ: ডাডা থেকে ব্রেটন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর ডাডাবাদীরা যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে অরাজক কল্পলোকের আশ্রয় নেন। কিন্তু ব্রেটন মনে করেন—
কেবল কল্পনা নয়,
কেবল যুক্তি নয়,
বরং অচেতন ও বাস্তবতার সমন্বয়েই সত্যিকারের শিল্প জন্মায়।
ডাডাবাদী বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে পরাবাস্তুবাদ তাই এক নতুন নান্দনিক সত্যের সন্ধান করে। পল এলুয়ার্ড, পিয়েরে রেভার্ডি প্রমুখ কবি অবচেতন মুক্তির কাব্যরীতি গড়ে তোলেন। চিত্রকলায় বোশ, গোয়া, শাগাল, রেডন, দ্য চিরিকো প্রমুখের কাজ পরাবাস্তব কল্পবিশ্বকে সমৃদ্ধ করে।
অনেকে মার্ক্সবাদী না হয়েও মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হন—যেমন, পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ।
৪. বাংলায় পরাবাস্তুবাদ: জীবনানন্দ দাশের কাব্যবিশ্ব
বাংলা কবিতায় পরাবাস্তুবাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম জীবনানন্দ দাশ।
তিনি বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতাকে এক রহস্যময়, অন্তর্মুখী, স্বপ্নবিম্বিত কল্পজগতে রূপান্তর করেছেন—যা পুরো কবিতাকে পরাবাস্তব সুরে তুলে দেয়।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় নিজের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাকে ধরেছেন মানব সমাজের এক নৈশব্দ্য একাকীত্বের মধ্যে। এই একাকীত্বের আড়ালে লুকানো ভয়ঙ্কর বাস্তবতা পাঠককে এক ধরনের হতাশার সঙ্গে পরিচয় করায়। রাতের অন্ধকারে, চিরপ্রশান্ত ঘুমের স্থবিরতায় তিনি মৃত্যুর মাঝে মুক্তির খোঁজ করেছেন।
তিনি জীবনকে বহু দিক থেকে উপস্থাপন করেছেন—প্রাণীজগৎ ও প্রকৃতির রূপক ব্যবহার করে মানব চেতনার সংকট, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নময় যাত্রা ফুটিয়ে তুলেছেন। বাস্তবতার সীমারেখা অতিক্রম করে, নিজেকে কল্পিত জগতে নিয়ে গেছেন, যাকে আমরা তার অধিজগৎ নামে চিনি। কবিতার গঠন এবং ভাষার স্বতন্ত্রতা জীবনানন্দকে পরাবাস্তবধারার (Parabastu) এক শক্তিশালী প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তিনি তাঁর বাস্তবতাকে রহস্যময় কল্পজগতে নিয়ে যান কবিতা সৃষ্টির তাগিদে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে কল্পগতের এক সূক্ষ যোগসূত্র স্থাপিত হয় যা পরাবাস্তুবাদের কেন্দ্রবিন্দু। জীবনানন্দ সেই কল্পোজগতে মুক্তির সন্ধান করেন।
জীবনানন্দ দাশের প্রতিটি কবিতা এক চিত্রকল্প আঁকে যার প্রচ্ছদে ধরা পড়ে এই ইহজগৎ যা প্রকৃতি আর প্রাণীজগৎ নিয়ে গঠিত হয়। কবিতায় ব্যবহৃত্ব হয় অসংখ্য প্রতীকী উপমা ও রূপক। কবি বিচরণ করেন এক রহস্যময় কল্পজগতে যা তাঁর পরাবাস্তুবাদের দর্শনের এক উর্বর মনোভূমি। বাস্তব ধর্মী হয়ে তিনি নির্বাসিত হন এক অচিন কল্পলোকে। ভাববাদ তাঁকে গ্রাস করে বলে মনে করা হয়।
জীবনানন্দের কবিতায় পরাবাস্তবতার লক্ষণ
১. নৈঃশব্দ্য, একাকীত্ব ও ভয়াবহ বাস্তবতা
—রাতের অন্ধকারে, স্থবির ঘুমে, মৃত্যুর মতো মুক্তির আকুলতা।
২. প্রকৃতি ও প্রাণীজগতের বিস্ময়কর রূপক
—শঙ্খচিল, শালিখ, বনলতা, হরিণ, নদী, জোনাক—সবই তাঁর কল্পজগতের প্রতীকচিত্র।
৩. চিত্রকল্প নির্মাণে শিল্পীর মতো স্পষ্টতা
তার মানসপটে কবিতা যেন একটি মুহূর্তের চিত্র, যা পাঠকের মনে প্রতীকি আঘাত তৈরি করে।
৪. বাস্তব–অবাস্তবের মিশ্রণ
→ বাস্তব থেকে নির্বাসন
→ ভাবনায় এক অধিজগত
→ কল্পনা-প্রসূত অথচ সত্যের গভীর স্তর
৫. সংক্ষেপে গভীর উন্মোচন
"আজ পৃথিবীর গভীর অসুখ"—
এক বাক্যে পরাবাস্তব মর্মবাণী।
জীবনানন্দ তাই বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিনিধি।
৫. নীরেন্দ্রনাথ থেকে সমকাল: ধারার বিস্তার
জীবনানন্দের পর—
আবদুল মান্নান সৈয়দ, সমীর রায়চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ কবিরা বাংলা কবিতায় পরাবাস্তুবাদের আংগিক বিস্তৃত করেন।
বর্তমান কালে—
আল শাহারিয়ার জিদনি, মারজুক রাসেল, সাইম রানা, মাদল হাসান, বিজয় আহমেদ, আমজাদ সুজন প্রমুখ কবির লেখাতেও আংশিকভাবে এই ধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়।
আধুনিক কবিতায় ঘটনাকে কাহিনির মতো বিশদ বর্ণনা না করে—
→ অনুভূতি,
→ চিত্রকল্প,
→ বিমূর্ততার মাধ্যমে
এক মুহূর্তের হঠাৎ চমক সৃষ্টি করাই পরাবাস্তবধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
যেমন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কলকাতার যীশু কবিতায়—
"ঝাঁকামুটে… সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু"—
এ যেন এক স্থিরচিত্র, একটি "মুহূর্ত", একটি মনস্তাত্ত্বিক ঝটকা।
এই কৌশল জীবনানন্দের কাছ থেকেই সবচেয়ে গভীরভাবে আসে।
৬. উপসংহার
জীবনানন্দের কবিতা কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি বা নিছক কল্পকথা নয়—
বরং বাস্তব, স্বপ্ন, স্ববিরোধ, একাকীত্ব, অস্তিত্ব ও মুক্তির এক সমন্বিত শিল্পরূপ।
তিনি বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে অবাস্তবতার দিকে যাননি—
বরং বাস্তবতার গভীরতর, অদৃশ্য স্তরকে উন্মোচন করেছেন অবচেতনের আলো দিয়ে।
এই জন্য জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার অগ্রগামী কবি,আর তাঁর কাব্যচর্চা আধুনিক বাংলা কবিতাকে এক সম্পূর্ণ নতুন দিকে নিয়ে গেছে।
পরাবাস্তুবাদী অধিজগৎ
রাতের নিস্তব্ধতায়, জীবনের শূন্যতায়
বাস্তবতা খেলা করে অচিনলোকের আঙিনায়
কোন এক কল্প-উদ্যানে,স্বপ্ন আমাকে নিয়ে যায়----
প্রস্ফুটিত হরেক রকম ফুলের বাহার সেথায় ।
আমি খুঁজে ফিরি মুক্তি সেই অচিনলোকে—
আমার একাকিত্ব, আমার হতাশা
ঘুমায় সেই অচেতন স্বপ্নপুরীতে,
মহাশান্তির আঁধার আমাকে ঢাকে কালো চাদরে।
ঘুম ভাঙতেই দিনের আলো ঝরে পড়ে—
সকল রঙ, সকল সৌন্দর্য কোথায় মেলায়।
আমি ফিরি আমার সুখ-দুঃখের বস্তু জগতে,
যেখানে আবার বাস্তবতার ছায়া ঘনায়।
বস্তুলোক ফিরে আসে আমার চেতনায়,
চিনতে পারি বন্ধু স্বজনে।
আমি নিজেকে খুঁজে পাই সুখ-দুঃখের আঙিনায়,
সংগ্রাম—সেটাই যে সত্য জীবন অঙ্গনে।
কিন্তু আমি মুক্তি চাই—
আমি নিয়ে যাই আমার বন্ধু স্বজনে,
কাক, পক্ষী, চিল, প্যাঁচা, নদী, নালা—
সকলেই আমার সঙ্গে, নতুন নিবাসে।
আমি শুনি ঘুম পারানি গান
কোকিল কণ্ঠে বসন্তের রক্তরাগ
হরিণের প্রতি প্যাঁচার অনুরাগ
নরম গাছের মাথায় সবুজের বিরাগ।
আমার নিঃসঙ্গ প্রেম, আমার সঙ্গিনী,
সে আমার সারথি, কল্প-যাত্রায়।
কল্পলোকের কল্পশয্যায় বাসর আমার,
চিরনিদ্রা সে, মুক্তির বাসর শয্যায়।
=================
