গল্প ।। বিশ্বাস ।। শৌনক ঠাকুর
বিশ্বাস
শৌনক ঠাকুর
(১)
খবরটা শুনেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ল সুমিত্রা। হাত থেকে পড়ে গেল মোবাইল। ওপার থেকে তখনও ভেসে আসছে শুভর কন্ঠ — ''হ্যালো … হ্যালো…. শুনতে পাচ্ছ…. পাচ্ছ… সুমি… সুমি… হ্যালো….'। কোন কথায় কানে যাচ্ছে না সুমিত্রার তখন। শরীর জুড়ে অস্থিরতা। মন চঞ্চল। হৃদযন্ত্র ছন্দহীন। পৃথিবীতে তো কত মানুষই রয়েছে। কত মানুষই তো কত কুকর্মের সাথে যুক্ত। কই তাদের তো কিছু হয় না। এই মানুষটার ক্ষেত্রেই এ রকম হল ? ওর কপালেই এমনটা জুটল? উপরের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরের সাথেই বলে উঠল , "সত্যি ঈশ্বর তোমার চোখ পাথরের।"
এক্ষুনি বেরোনো দরকার। গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়েই থমকে গেল সুমিত্রা। এই অবস্থায় ড্রাইভ করা ঠিক হবে না। একে এই বিপদ, তার ওপরে আবার যদি কিছু ঘটে যায়। প্রায় ২৩০ কিলোমিটার রাস্তা। কালনা থেকে ফারাক্কা। নিতাইকে ফোন করল। নিতাই ড্রাইভার। জানালো আধ ঘণ্টার মধ্যেই আসছে। নিতাই খুব ভালো গাড়ি চালায়। খুব বিশ্বস্ত।
বিশ্বস্ত কথাটা মনে হতেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল সুমিত্রা। সঙ্গে একটু হাসি। উপহাস বলায় সমীচীন। বিশ্বাস করেই ওই মানুষটা মানে সমুদ্রের এই অবস্থা। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ বাক্যটি যথার্থ। তবে যুগ অনুযায়ী একটু সংশোধনের প্রয়োজন। যাচাই করে তবেই বিশ্বাস করা ভালো। দূর কি যা তা বকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথাটা কাজ করছে না। চোখে মুখে জল দিল। বেশ খানিকটা জলও খেল। তারপর দক্ষিণ দিকে জানলাটা খুলে একটু দাঁড়াল। সমুদ্রর সাথে পরিচয় হয়েছিল স্কুলে জয়েন করার প্রথম দিন। একই দিনে জয়েন করেছিল ওরা। ওরা মানে সমুদ্র সরকার আর সুমিত্রা রায়। হেডস্যারের ঘরে পেনটা এগিয়ে দিয়ে সমুদ্র বলেছিল , "আপনি আগে সই করুন। এক মিনিটের জন্য হলেও আপনি আমার সিনিয়র।"
(২)
কলিং বেলটা বেজে উঠল। চিন্তায় ফাটল ধরল সুমিত্রার। নিতাই এসে গেছে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে ছাড়তে ছাড়তে মোটামুটি ন'টা বেজে গেল। সিটে মাথা রেখে দু'চোখ বুজে ফেলল সুমিত্রা। ঘটনাটির কিছুই মেলাতে পাচ্ছে না। বারে বারে মনে হচ্ছে কেন এমন ঘটল। কেনই বা সমুদ্র এভাবে ফাঁদে পড়ল। বন্ধ চোখের কালো ক্যানভাসে তখন ভেসে উঠেছে ফারাক্কার সেই সব দিনগুলো। গঙ্গার ধার ধরে একসাথে হাঁটা। সেই লগ গেটে বসে থাকা। কত গল্প। খুনশুঁটি কত। সন্ধ্যায় গান্ধীঘাটে ফুচকা, বাদাম, আর মাঝে মাঝে ঝালঝাল আলু কাবলি। ধীরে ধীরে প্রেম। বিয়ে।
"দিদি তেল ভরতে হবে তো" নিতায়ের কথায় অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে সুমিত্রা।
—- "হ্যাঁ হ্যাঁ। পেট্রোলপাম দেখে দাঁড় করাও। তুমিও কিছু টিফিন করে নাও।"
—"আচ্ছা। আপনি কিছু খাবেন না?"
— "না। আমি শুধু চা খাব।"
চায়ে চুমুক দিয়েই মনে পড়ে গেল সেই মালদায় আদিনা দেখতে যাওয়ার ঘটনাটি। সমুদ্র একেবারেই গরম চা খেতে পারে। মালদা স্টেশনে ট্রেন ঢুকে গেছে। আর ও তাড়াহুড়ো করে চা খেতে গিয়ে গরম চায়ে ঠোঁটটা পুড়িয়ে ফেলল। বেশ কয়েকদিন ভুগেছিল।
আহিরনের নতুন ব্রিজ দিয়ে তখন গাড়ি ছুটছে। সুমিত্রা যখন ফারাক্কায় ছিল থাকত তখনই এটি তৈরি হচ্ছিল। এখন পিলারের ওপর দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। ডিভোর্সের পর সুমিত্রা আর বিয়ে করেনি। কালনাতে ফ্ল্যাটে একাই থাকে। সমুদ্রর সঙ্গে ডিভোর্সের মামলা চলাকালীন মিউচ্যুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিল কালনা হাই স্কুলে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সমুদ্র। সুমিত্রা অবশ্য সেদিন স্কুলে যায়নি। শরীরটা ভালো ছিল না। শুরু হল অবান্তর কথা। সুমিত্রার চরিত্র নিয়ে নানান ধরণের শ্লেষমূলক মন্তব্য। সুমিত্রা অবশ্য নীরব ছিল। ভেবেছিল একটু মাথা ঠান্ডা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এটাও বুঝেছিল স্কুলে হয়তো কেউ ওকে পিন করেছে। উল্টোপাল্টা বুঝিয়েছে। এমনিতেই ওর সেন্টিমেন্ট একটু বেশি। যাচাই না করেই সব কিছু বিশ্বাস করে নেয়। কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে ততই অশান্তির ঝাঁঝ জোরালো হতে থাকে। একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় সুমিত্রার। সেও দু'চার কথা বলে। সেই রাত থেকেই শুরু হল আলাদা শোয়া। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকল। বাড়ির ঝামেলা পৌঁছালো স্কুলে। একসময় শুধুমাত্র সন্দেহের বশে ভেঙে গেল তাদের সুখের সংসার। চরিত্র নিয়ে মিথ্যা কলঙ্ক দিয়েছিল সমুদ্র। দেখতে দেখতে দশটা বছর পার হয়ে গেল।
"দিদি দিদি ফরাক্কা বাস স্ট্যান্ড চলে এসেছি। এখন কোথায় যাব?" ড্রাইভারে কথায় চোখ খুলল সুমিত্রা। জানলা দিয়ে একবার দেখে নিল। সেই চির পরিচিত জায়গা। তারপর নরম গলায় বলল,
"হ্যাঁ থানায় চলো।"
"থানায়!" একটু অবাক হয়েই প্রশ্নটা করে ফেলল ড্রাইভার নিতাই।
"হুঁ" সুমিত্রা সংক্ষিপ্ত উত্তর।
ছোট্ট ব্যারেজটা পার হয়ে ডান দিকে গঙ্গাকে রেখে গাড়ি থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তবে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে কি রকম জমজমাট ছিল ব্যারেজ বাজার। এখন অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে।
(৩)
"তোমাকে কে খবর দিল?" জেলের ওপার থেকে প্রশ্ন করল সমুদ্র।
"শুভ" কিছুটা উপহাসের সঙ্গেই বলল সুমিত্রা।
"শুভ!" রীতিমতো বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল সমুদ্র।
"কেন? তোমার প্রিয় বন্ধু। প্রাণের বন্ধু। ওর কথা তো তোমার কাছে বেদ বাক্য। এত বিশ্বাস করো ওকে। তা তোমার বিপদের দিনে সেই বিশ্বস্ত বন্ধুটি কোথায়?" সুমিত্রা বলল।
"বিশ্বাস" শব্দটি উচ্চারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল সমুদ্র।
ক্ষনিকের নীরবতা।
তারপর ধীরে ধীরে শুরু করল সমুদ্র, "ওই নাটের গুরু। আমার এ অবস্থার জন্য ওই দায়ী। এত বিশ্বাস করতাম ওকে। ভাইয়ের মতো ভালবাসতাম। স্কুলের কত গোপন কথায় ওকে শেয়ার বলতাম। আমি যে স্কুলের TIC হয়েছি ও এটা মেনে নিতে পারেনি। এত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার পরেও বুঝতে পারেনি ও আমায় সরিয়ে নিজে বসতে চাইছে ওই চেয়ারে।"
একটু থেমে আবার সমুদ্র বলল, "ও তো আমাকে বলতেই পারতো আমি রেজিগনেশন দিয়ে দিতাম। কি দরকার ছিল আমার মিথ্যে মামলা ফাঁসানোর তাও কিনা আবার নারীঘটিত কেসে।"
তারপর জোর হাত করে সুমিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে ''তুমি বিশ্বাস করো আমি এ ধরনের কাজ করিনি সবই ফলস মিথ্যা।"
সুমিত্রা কেবল তাকিয়ে আছে। লোহার দন্ডে মাথা ঠুকতে ঠুকতে সমুদ্র বলছে ,"সব গেল। সব। সব। মান সম্মান। সব..সব…"
"আর আমাদের সম্পর্ক?" কথাটা শেষ না হতেই দৃঢ় স্বরে বলে উঠল সুমিত্রা। সমুদ্র অবাক চোখে তাকাল সুমিত্রার দিকে। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দে বেরিয়ে এল , "মানে?"
"জানো না ওর কথায় বিশ্বাস করেই তো তুমি আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করলে। পদে পদে অবিশ্বাস করতে থাকলে। তিক্ততায় পরিণত হলো আমাদের সম্পর্ক। নিজের বিচার বুদ্ধি হারিয়ে কেবলমাত্র ওর কথাতেই ভেঙে ফেললে সুখী সংসার। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ডিভোর্সের মামলা ফাইল করলে ওরই কথায়।" কথাগুলি একটানা বলে হাঁপাতে লাগল সুমিত্রা।
টকটক করে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। ক্যাঁচ শব্দ করে স্টিলের চেয়ার সরানোর একটা আওয়াজ এল।
চোখ মুছে সুমিত্রা আবার বলল, "ভয় নেই। তবে তুমি সেদিন আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি। আমি কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করি। আজও। এবং আমি নিশ্চিত তুমি এ কাজ তুমি করতে পারো না।" দুচোখ দিয়ে অঝরে জল ঝরে পড়ছে সমুদ্রের তখন । হাতে হাত রেখে আলতো চাপ দিয়ে সুমিত্রা বলল "ধৈর্য রাখ। ভরসা রাখো। আমি তো আছি। একসাথে লড়াই করবো। সুবিচার হবেই।"
………………………………………
শৌনক ঠাকুর
গ্রাম +পোঃ - দক্ষিণখন্ড
থানা - সালার
জেলা - মুর্শিদাবাদ