গল্প ।। নববধূর অন্তর্ধান ।। রানা জামান
নববধূর অন্তর্ধান
রানা জামান
বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে রয়েল। কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় একটু ভয়ও লাগছে। কী হবে? সফল হতে পারবে তো? ওর বন্ধুদের অনেকের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওরা হরহামেশা চলে যায় আনন্দ উপভোগ করার জন্য। ওকে বলেছে বহুবার; কিন্তু ওর মন সায় দেয় নি। ধর্মীয় কিংবা মানসিক দ্বিধা ওকে সীমানা ডিঙোবার অনুমতি দেয় নি। তবে স্বপ্নদোষ হয়েছে! এতে কী ওর কোনো হাত আছে? চরম উত্তেজনা সংযমে রাখতে না পেরে মাঝেমধ্যে গোসলখানায় হাতে স্খলন করেছে। আজ বেড়াল মারার প্রথম পরীক্ষা!
বন্ধুরা রয়েলকে ঘিরে হাসছে এবং বিভিন্ন ধরনের কথা বলে ঠাট্টা-মসকরা করছে। কথাগুলো শ্লীলের চেয়ে অশ্লীল বেশি; তবে এই অবস্থায় এমন কথা বা শব্দই ঠিক! বন্ধুদের কোনো কথার জবাব দিতে না পারায় লজ্জায় রয়েলের কান দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুরা ওকে বাসরঘরের দরজার সামনে এনে ঠেলে দিলো ভেতরে। পড়তে গিয়েও নিজকে সামলে নিলো রয়েল। ঘরের দরজা আটকে বিছানায় তাকিয়ে কণেকে ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখে মনে প্রশ্ন আসতে থাকলে একের পরে এক:
প্রশ্ন এক: নাটক সিনেমায় দেখেছে কণে বাসরঘরে খাটের উপর লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকে। ওর নববধূ ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে কেনো?
প্রশ্ন দুই: ও কি ফিরে গিয়ে বন্ধুদের জিজ্ঞেস করবে এ অবস্থায় করণীয় কী?
প্রশ্ন তিন: এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে গেলে বন্ধুরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে। সেজন্য বধূর পাশে শুয়ে পড়বে?
প্রশ্ন চার: বাসররাতে বেড়াল মারার কী হবে তাহলে?
প্রশ্ন পাঁচ: এই বেড়াল পরের রাতে মারলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে?
রয়েল মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে খাটের পাশের টেবিলে রেখে পানিভর্তি গ্লাসটা তুলে নিঃশব্দে পুরো পানি পান করে গ্লাসটা একটু শব্দ করে রাখলো টেবিলের উপরে। নববধূ নড়াচড়া না করায় রয়েল ভ্রু কুচকে মনে মনে বললো: সত্যসত্যই ঘুমিয়ে গেলো নাকি? পা টিপে বিছানায় উঠে উঁকি দিয়ে বধূর নিমিলিত আঁখি দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যেনো ও! দ হয়ে শুয়ে পড়লো নববধূর পাশে। কক্ষে আলো জ্বলতেই থাকলো। বুকের উপর থেমে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থেকে নববধূর নাম মনে করার চেষ্টা করতে করতে মুদে নিলো চোখ। এবং ঘুমিয়ে গেলো একসময়।
পরদিন সকাল দশটার দিকে রয়েলের ঘুম ভাংলো অনবরত কলবেল ও চেঁচামেচির শব্দে। মনে হচ্ছে ওর কাঁচা ঘুম ভাংগানো হয়েছে। পরনের লুঙ্গি খুলে থাকায় বিছানা থেকে নামার সাথে সাথে লুঙ্গি চলে গেলো পায়ে! এখানে বলে রাখছি: রাতে বা দিনে যখনই ও ঘুমায়, তখন ওর পরনের লুঙ্গি খুলে যায়! ও চট করে বিছানায় তাকিয়ে নববধূকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লুঙ্গিটা তুলে ফের পরে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলে ওর চক্ষু চড়কগাছ!
বাড়ির লোকজনের সাথে পুলিশ; অথবা পুলিশের সাথে বাড়ির লোকজন! পুলিশের সংখ্যা বেশি থাকায় দ্বিতীয় বাক্যটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বিয়ের পরদিন বাড়িতে পুলিশ কেনো? ওর আত্মীয়-স্বজনে কেউ পুলিশে চাকরি করে না! কী বিপদ এলো এখন? নতুন বৌ-এর সাথে এখনো ওর একটা কথাও হলো না! বাসর রাতের বেড়াল মারা তো দূর কী বাত!
রয়েল মুখ জুড়ে কৃত্রিম হাসিতে ভর্তি করে বললো, বিয়ের খাওয়া-দাওয়া তো রাতেই শেষ হয়ে গেছে! নাস্তার এখনো অনেক দেরি!
সাব-ইন্সপেক্টর অজিত বললো, বাসররাতের পরদিন নতুন বরের এমনই হয়! সময় জ্ঞান থাকে না! এখন বাজে দশটা। সবাই নাস্তা খেয়ে ফেলেছে। অবশ্য আমরা নাস্তা খেতে আসি নাই।
তাহলে কী কাজে আসছেন দারোগা সাহেব?
এসআই অজিত বললো, থানায় একটা ফোনকল আসছে যে আপনি আপনার নববধূকে খুন করেছেন!
দারোগা অজিতের কথায় বাড়ির সকলে হয়ে গেলো হতভম্ব। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রয়েল বললো, কী বলছেন স্যার! এখনো নববধূর সাথে আমার কোনো কথাই হয় নাই! টাচও করি নাই! আমি বাসরঘরে ঢুকার পর হতে ওভাবে ঘুমাচ্ছে।
সাব-ইন্সপেক্টর অজিত রয়েলকে ধাক্কা দিয়ে দরজা থেকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে সরাসরি চলে গেলো বিছানায় শুয়ে থাকা নববধূর কাছে। নববধূর গায়ে হাত দিয়ে চিৎ করে থমকে গেলো দারোগা অজিত! এটা কোনো নারীর শরীর না, একটা সোমত্ত নারীর পুতুল বিয়ের শাড়িতে মুড়ানো!
রয়েল মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে ভয়ে। এটা পুতুল না হয়ে রক্তাক্ত মৃতদেহ হলে ও এখন কোথায় থাকতো? হাজতখানায় নিয়ে পুলিশ প্যাদানি দিতে থাকতো স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য। মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশের প্যাদানি একটি মোক্ষম অস্ত্র এবং এটাতে পুলিশ খুব পারঙ্গম। মনে মনে সুরা ইয়াসিন পড়ে দিতে থাকলো বুকে ফুঁ। ঘটনা শোনে গতরাতের বন্ধুরাও ছুটে এসেছে। ইতোমধ্যে রয়েলের শ্বশুরবাড়ির লোকজনও চলে এসেছে। ওদেরকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে না হলেও মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে- সবাই অধোবদনে। নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করলো প্রথমে সাব-ইন্সপেক্টর অজিত।
এসআই অজিত সবাইকে একবার দেখে বললো, কী মেজাজ নিয়ে এলাম, আর কী দেখছি এখানে! এভাবে ঠাট্টা করার কোনো মানে হয়। তাও আবার পুলিশের সাথে।
রয়েলের এক বন্ধু সাজিদ বললো, ব্যাাপারটা ঘটলো কিভাবে? কণে কখন পালিয়ে গেলো? আর এতো বড় পুতুলটা ঢুকালো কিভাবে এতো লোকের দৃষ্টি এড়িয়ে?
রয়েলের আরেক বন্ধু অদিত বললো, মেয়ের বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই এটা জানে। ওদের জানিয়েই মেয়েটা পুতুল রেখে পালিয়েছে!
কণের বাবা আজহার উদ্দিন মাথা না তুলেই বললেন, না না! আমাদের মেয়ের এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।
রয়েলের মা তাহমিনা কিছুটা রুক্ষ কণ্ঠে বললেন, আপনি কিছু জানেন না বললে কী হবে বেয়াই সাহেব? আমাদের মান-মর্যাদা সব ধূলায় মিশিয়ে দিয়ে গেলো আপনার মেয়ে।
অদিত বললো, থানাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাব-ইন্সপেক্টর অজিত বললো, কোনো পক্ষ মামলা না করলে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেবো না। এমনতেই থানা মামলায় জর্জরিত। আর একটা কথা, পুতুলের গায়ে কোনো গয়না নাই।
বিস্মিত হয়ে তাহমিনা বললেন, কী বলছেন আপনি দারোগা সাহেব! আমরা ওকে আট ভরি সোনার গয়না দিয়েছি।
এবার কণের মা নাফিসা বললেন, আমরাও জিনিয়াকে পাঁচ ভরি সোনার গহনা দিয়েছি। এবাড়ির সবাই জানে তা।
এসআই অজিত বললেন, এর মানে হচ্ছে মেয়েটা তেরো ভরি সোনার গয়না নিয়ে পালিয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় তের লাখ টাকা!
ভগ্নকণ্ঠে রয়েল বললো, এটা একটা ঠাণ্ডা মাথার চুরি!
একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এখনই একটা রহস্যের সমাধান করে দিতে পারি।
সাব-ইন্সপেক্টর অজিত ভদ্রলোককে চিনতে পেরে বললো, প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল যে! গন্ধ শুঁকে ঠিকই হাজির হয়ে গেছেন!
সবাই তাকালো প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েলের দিকে। রাফায়েল বললেন, বিয়ে থেকে শুরু করে পুরো ব্যাপারটা পৃ-প্লান্ড। পুতুলটা এভাবে আনা হয় নি, তাই কেউ দেখতে পায় নি। এটা একটা রাবারের পুতুল। ওটাকে কণে তার ভ্যানেটি ব্যাগে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে এনেছেন এবং ফুলিয়ে বাতাস ভরে বড় করে নিজের গায়ের বিয়ের বসন পরিয়ে নিজে যেনতেন কাপড় পরে সহজেই বেরিয়ে গেছেন বিয়ে বাড়ি থেকে।
রয়েল বারান্দা থেকে নেমে রাফায়েলের সামনে এসে বললো, আমার পক্ষ থেকে আপনাকে নিয়োগ দিলাম। এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলে আপনাকে রেমুনারেশন স্বরূপ এক ভরি সোনার গহনার সমপরিমাণ টাকা দেয়া হবে! কোনো অগ্রিম দেয়া হবে না! রাজি থাকলে আমার সাথে হাত মেলান।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল রয়েলের সাথে হাত মেলালে এসআই অজিত মৃদু হেসে চলে যেতে থাকলো থানার দিকে। অন্যরাও তাই।
রাফায়েল বললেন, আপনি আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন মিস্টার রয়েল। আমি থানার মতো পক্ষপাতমূলক তদন্ত করবো না এবং সত্য উদ্ঘাটন হবে, ইনশাআল্লাহ!
রয়েল বললো, আমি আপনার সুনামের কথা শুনেছি রাফায়েল ভাই। তাই মোটা অঙ্কের রিমুনারেশন দেবার ঘোষণা করেছি। অগৃম না দেবার জন্য ক্ষমা করবেন।
রাফায়েল বললেন, একটা এগৃমেণ্ট করতে হবে আপনার ও আমার মধ্যে।
কিসের এগৃমেণ্ট?
যাতে পরে আপনি অস্বীকার করতে না পারেন যে আমাকে তদন্তের অনুমতি দেন নি। তাহলে আমি আইনি সমস্যায় পড়ে যাবো।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে দুই পাতার একটি ছাপানো দলিল বের করে বললেন, আমি এগৃমেণ্টের একটা ফরমেট বানিয়ে নিয়েছি। তদন্তের বিষয়, তারিখ ও টাকার অঙ্কটা বসিয়ে নিলেই হয়ে যাবে।
প্রয়োজনীয় শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে রয়েলের দিকে বাড়িয়ে ধরে রাফায়েল বললেন, একবার দেখে সাইন করে দিন। দুই কপি আছে। আমি সাইন করার পরে এক কপি আপনাকে দেবো।
রয়েল চুক্তিনামাটা হাতে নিয়ে একবার দেখে দস্তখত করে রাফায়েলের হাতে দিলো।
রাফায়েল কাগজটা নিয়ে দস্তখত করে এক কপি রয়েলকে দিয়ে নিজের কপিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রয়েলের সাথে শেকহ্যান্ড করে চলে এলেন বাড়িতে।
হালিমা খাতুন দরজা খুলে বললেন, নতুন কোনো কাজ পেয়েছো? না পেয়ে থাকলে ভ্যানে তরকারি নিয়া ব্যবসা শুরু করো। এতে দৈনিক লাভের টাকা পাবে!
কিশোরী মেয়ে লতিফা বাবার পাশে এসে বললো, তুমি সুযোগ পেলেই বাবাকে অপমান করো!
হালিমা খাতুন ধরা গলায় বললেন, অপমান করি না, সত্য কথা বলি! বাংলাদেশে প্রাইভেট ডিটেকটিভের ভাত নাই! এই কথাটা বুঝেও তোর বাবা ঐ পথ ছাড়লো না। কী টানাটানি করে যে এই সংসার চালাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ইচ্ছা করে সংসার ছেড়ে চলে যাই। তুই না আসলে কবেই চলে যেতাম!
রাফায়েল মাথা নিচু করে চলে গেলেন ভেতরে। ড্রয়িংরুমে ফলস পার্টিশান দিয়ে চেম্বার বানিয়ে নিয়েছেন রাফায়েল। রাফায়েল চেম্বারে ঢুকে ব্যাগটা ছোট টেবিলটায় রেখে হাতলবিহীন কাঠের চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলেন রয়েলের কেসটা নিয়ে।
• জিনিয়া অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিয়েটা সেরেছে
• উভয় বাড়ি থেকে পাওয়া গয়নাগুলো হাতে পাবার জন্যই রয়েলের বাড়ি পর্যন্ত এসেছে; অর্থাৎ ওর টাকার দরকার ছিলো
• জিনিয়ার সাথে একজন ছেলে আছে
• ছেলেটা কে? নিশ্চয়ই জিনিয়ার প্রেমিক
• এই ভাগ্যবান প্রেমিকের নাম কী?
• জানতে হলে যেতে হবে জিনিয়ার বাড়িতে। শুভস্য শিঘ্রম!
• ঠিকানা? রয়েল জানে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল সিল্কের কুর্তা পরেন। এটা বহু বছরেও ছিঁড়ে না এবং ইস্ত্রি করতে হয় না, পকেটও থাকে তিনটা। ফুটপাত থেকে এটা কবে কিনেছিলেন বলতে পারবেন না। ডানদিকের নিচের পকেট থেকে মান্দাতা আমলের একটি নকিয়া বাটন ফোন বের করলেন। কি-বোর্ডে অক্ষর মুছে গেছে কবেই এবং পর্দায় দাগ পড়তে পড়তে হয়ে গেছে ঝাপসা! কবে রিচার্জ করেছিলেন মনে নেই রাফায়েলের। রয়েলকে মিসড কল দিলেন একটা। কিন্তু রয়েল কল ব্যাক করলো না। বেশ কয়েকবার মিসড কল দেবার পরে একসময় কল না ঢুকলে রাফায়েল ভ্রু কুচকে মনে মনে বললেন: নিশ্চয়ই ফোনে কোনো সমস্যা হয়েছে; আমাকেই যেতে হবে। কাউকে কিছু না বলে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
যদের আয় কম, তাদের মিতব্যয়ী হতে হয়। যারা এই সূত্র মানে না তাদের দূর্ভোগ প্রতিপদে এবং মৃত্যুও ঘটে পথে-ঘাটে। রাফায়েল মিতব্যয়ী। ওঁ কখনো রিক্সায় চড়েন না। দূরের যাত্রায় বাস ব্যবহার করে থাকেন। কখনো সিএনজি বা ট্যাক্সিতে চড়েন না। রাফায়েল হাঁটছেন রয়েলের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মে মাসের প্রখর রোদ মাথার উপর। ছায়া প্রবিষ্ট হয়ে আছে অবয়বে। একটা ছাতা থাকে ওঁর ব্যাগে। প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। এখন তিনি ছাতা মাথায় হাঁটছেন। রয়েলের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেলো বারোটা। দারোয়ান জানালো বাড়িতে কেউ নেই। বিষন্নতা কাটাতে সবাই বেড়াতে গেছে কুয়াকাটায়। দারোয়ান আরো জানালো সকালের গণ্ডগোলের সময় রয়েলের মোবাইল ফোনটা খোয়া গেছে। অপরিচিত কাউকে ফোন নম্বর দেয়া বারণ আছে।
দারোয়ানের নিকট থেকে এক গ্লাস পানি পান করে ঘুরে দাঁড়াতেই রাফায়েলের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। কুর্তার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে দেখতে পেলো এসআই অজিতের কল। ফোনটা গ্রহণ করলে অজিত ওঁকে এক্ষুণি থানায় যেতে বললো। রাফায়েল দিক পরিবর্তন করে থানার দিকে হাঁটতে লাগলেন। থানা বেশি দূরে না। হেঁটে দশ মিনিট এবং রিক্সায় চড়লে জ্যামে আটকা পড়লে পনেরো/বিশ মিনিট!
থানার সিপাই থেকে শুরু করে বড়বাবু পর্যন্ত সবাই রাফায়েলকে চেনে। গুটিকয়েক সিপাই ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এবং অফিসারগুলো করে হিংসা! গৃষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে দশ মিনিট হাঁটতেই ওঁর জামা ঘামে ভিজে লেগে গেছে শরীরের সাথে। কর্তব্যরত সকল সিপাইকে সালাম দিতে দিতে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চেম্বারের দিকে যেতে থাকলেন তিনি। চেম্বারের সামনে এসে তাকালেন নামফলকের দিকে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বদল হয়নি। নওয়াজেশ আলি, ইন্সপেক্টর। দরজায় কর্তব্যরত সিপাই ওঁকে দেখে মৃদু হেসে মাথা নেড়ে ভেতরে যাবার জন্য ইশারা করলো।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল ডান হাতে পর্দা একপাশে সরিয়ে ঢুকে সালাম জানালেন, আসসালামু আলাইকুম! আমি রাফায়েল, প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার ডাক পেয়ে চলে এসেছি স্যার!
ভদ্রমাথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর নওয়াজেশ আলি মোবাইল ফোনে একটা ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিলেন। সালাম শুনে দরজায় রাফায়েলকে দাঁড়ানো দেখে বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না। কারণ, রাফায়েলকে ওর পছন্দ না হলেও উপরে ওর খুব কদর। নওয়াজেশ বললেন, আপনি এখানে কেনো প্রাইভেট ডিটেকটিভ?
অপ্রস্তুত হেসে রাফায়েল বললেন, দারোগা অজিত স্যার আমাকে থানায় আসতে বললেন যে!
এক নববধূর লাশ পাওয়া গেছে সিংড়া নদীর পাশের জঙ্গলে। অজিত গেছে সেখানে। আপনি চলে যান। সিংড়া নদী এখান থেকে পনেরো কিলো দূরে। আপনি যাবেন কিভাবে?
রাফায়েল বললেন, বাসে চলে যাবো স্যার! অজিত স্যারকে বলে দেন যেনো সুরৎহাল করলেও লাশটাকে না সরায়। লাশটা কিভাবে পড়ে আছে, এর উপর অনেক প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে।
ঠিকাছে, ঠিকাছে! আমি বলে দিচ্ছি! আপনি দ্রুত চলে যান!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল থানা থেকে বের হয়ে কিছুদূর এসে একটি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালেন। দ্বিতীয় বাসটায় চড়ে সিটে বসে ভাবতে লাগলেন: শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে মেরে ফেললো! কত আশা নিয়ে বাসরঘর থেকে পালিয়ে গেলো প্রেমিকের সাথে সুখে ঘরকন্না করবে বলে। কিছু কিছু প্রেমিক কেনো যে এতো নিষ্ঠুর হয়! সিংড়ায় পৌঁছালে রাফায়েল বাস থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে চলে এলেন নদীর পাড়ে গড়ে উঠা জঙ্গলে। অনেক লোক দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের একটু ভেতরে একটা জায়গায়। জঙ্গলের বাইরে বালিতে পুলিশের একটি পিকাপ দাঁড়িয়ে আছে।
লোকের ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সাব-ইন্সপেক্টর অজিত ওঁকে দেখে বললো, বেশ দেরি করে ফেলেছেন ডিটেকটিভ রাফায়েল! পোস্টমর্টেমের জন্য লাশকে দ্রুত মর্গে নিতে হবে।
রাফায়েল জিজ্ঞেস করলেন, লাশ শনাক্তের জন্য কেউ আসে নাই এখনো অজিত স্যার?
এসআই অজিত বললো, আমি অবাক হচ্ছি ফোন করার পরেও কেউ এখনো আসছে না কেনো?
রাফায়েল বললেন, আমি একটু দেখি লাশটাকে।
রাফায়েল পকেট থেকে দুটো রাবারের হাতমৌজা বের করে পরে এগিয়ে গেলেন লাশের দিকে। লাশটা কাত হয়ে খানিকটা দ-এর ভঙ্গিতে পড়ে আছে। গায়ে সেলোয়ার-কামিজ এবং সেগুলো শুকনো। এর মানে শিকারকে পানিতে নেয়া হয়নি, বা শিকার দুষ্টুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি! তাহলে শিকারকে অন্য কোথাও মেরে নিরাপদ ভেবে এখানে ফেলে গেছে। লাশের হাত ও মুখ কিঞ্চিৎ ফ্যাকাসে দেখা যাওয়ায় রাফায়েল পকেট থেকে একটা আতস কাঁচ বের করে লাশের হাত, হাতের মেহেদি ও মুখমণ্ডল পরখ করে সোজা হয়ে এসআই অজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ লাশ কোনো নববধূর লাশ না!
চমকে উঠে দারোগা অজিত বললো, কী বলছেন আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল? ভেবেচিন্তে মন্তব্য করুন!
এই লাশ কমপক্ষে দুই দিনের পুরানো এবং কোনো মর্গ থেকে আনা হয়েছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন অজিত স্যার, লাশের শরীর ও মুখটা খানিকটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে এবং হাতের মেহেদি যেনতেন করে দেয়া, ভালো রংও হয়নি! আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য সাজানো হয়েছে।
তখন একটি গাড়ির শব্দ পাওয়া গেলে সবাই তাকালো পেছনে। গাড়ি থেকে অনেকগুলো লোক দৌড়ে আসতে থাকলো জঙ্গলের দিকে। কাছাকাছি এসে কাঁদতে লাগলো সবাই।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল ওদের দিকে ফিরে বললেন, কান্না করার প্রয়োজন নাই। এ লাশ আপনাদের মেয়ের না! তবু আপনারা লাশের চেহারা দেখে নিশ্চিত হোন!
একসাথে সবার কান্না গেলো থেমে। লোকজন সরে গেলে সবাই ভেতরে ঢুকে লাশের চেহারা একবার দেখেই নাফিসা বললেন, এ লাশ আমার জিনিয়ার না!
নববধূ অন্তর্ধান রহস্য নিষ্পত্তি করা গেছে ভেবে এসআই অজিত খুশিতে বগল বাজাচ্ছিলো। রাফায়েলের কথায় কিছুটা হতোদ্যম হলেও কণের বাড়ির লোকদের শনাক্তে ওর প্রত্যাশার বেলুন গেলো একেবারে চুপসে।
রাফায়েল অজিতের সাথে করমর্দন করে মাথা নুইয়ে হাঁটছেন আর ভাবছেন। এটা কি কোনো কাকতালীয় ঘটনা? তখন ওঁর মনে পড়ে গেলো শিকারের মাতৃপরিবার এখানে আছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঠিকানাটা নিলেই হয়! পিছিয়ে এসে নিজ পরিচয় দিয়ে ঠিকানা নিয়ে হাঁটতে লাগলেন। বলে এলেন এক ঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে আসছেন।
জিনিয়ার মাতৃ-পরিবারের গাড়িটা ফুস করে ওঁর পাশ দিয়ে চলে গেলো। রাফায়েল বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন। কিছু খাওয়া দরকার। বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে কয়েকটা চা-স্টল ও একটা ছাপড়া রেস্টুরেন্ট আছে। রাফায়েল রেস্টুরেন্টে ঢুকে হাল্কা নাস্তার পরে এক কাপ রং-চা পান করে উঠলেন একটা বাসে। জিনিায়ার মা-বাবাদের বাড়ি গো-ধূলি নগরে। এলাকাটা আবাসিক হিসেবে নতুন গড়ে উঠছে। সবাই ওঁর জন্য অপেক্ষা করছিলো। একক একটা সোফায় বসে রাফায়েল তাকালেন সবার দিকে। সেদিন জিনিয়ার মা ও বাবাকে সপ্রতিভ মনে হলেও আজ কেমন যেনো অপ্রতিভ লাগছে। জিনিয়ার ছোট বোন মুনিয়াকে সপ্রতিভ লাগছে; চিলতে অপ্রকাশিত একটা হাসি খেলে যাচ্ছে ওর মুখমণ্ডল জুড়ে। আজহারউদ্দীন ও নাফিসাকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ওদের চলে যেতে বলে মুনিয়াকে বসতে বললেন।
মুনিয়া একটা সোফায় বসলে রাফায়েল ড্রয়িংরুমের দরজাট ভেজিয়ে দিয়ে ওর মুখোমুখি বসে বললেন, তুমি জিনিয়ার চেয়ে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ছোট। ঠিক?
মুনিয়া মুখে স্মিত হাসি ধরে রেখেই ইতিবাচক মাথা নাড়লো।
তোমরা দুই বোন। আর কোনো ভাই বা বোন নেই তোমাদের। ঠিক কিনা?
আমরা দুই বোন, আবার ভাই-বোনও।
বলেই মুনিয়া জিভে কামড় দিয়ে মনে মনে বললো: এ আমি কী বলে ফেল্লাম!
এটা কেমন কথা মুনিয়া?
মুনিয়া দ্রুত বললো, স্লিপ অব টাঙ্গ-এ বলে ফেলেছি স্যার!
রাফায়েল মুনিয়ার দিকে আরেকটু ঝুঁকে বললেন, মাঝে মধ্যে স্লিপ অব টাঙ্গ-এ সত্য কথা বের হয়ে আসে! আমার বিশ্বাস জিনিয়ার অন্তর্ধানের বিষয়ে তুমি সবকিছু জানো। আমার ধারনা জিনিয়া এখন খুব বিপদের মধ্যে আছে। তুমি সব খুলে না বললে ওকে বাঁচাতে পারবো না!
মুনিয়া নড়েচড়ে বসে বললো, আমি সিক্রেট একটা শর্তে বলতে পারি।
কী শর্ত?
আমার মা-বাবাকে বলতে পারবেন না যে আমি আপনাকে বলেছি।
ঠিক আছে, বলবো না। এবার বলো!
জিনিয়া অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষ। হিজড়, বৃহন্নলা!
রাফায়েল বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বলছো তুমি মুনিয়া!
জিনিয়াকে নিয়ে আব্বু আম্মুর খুব কষ্ট। প্রথম সন্তান। এরপরে কয়েকবার মৃত সন্তান প্রসব হবার পরে আমার জন্ম হয়। আমি বুঝ হবার পর হতে দেখে আসছি আব্বু আম্মু জিনিয়া বুবুকে ছেলে হিসেবে বড় করতে চেয়েছে; কিন্তু জিনিয়া মেয়ে সেজে থাকতেই পছন্দ করতো।
তাহলে বিয়েটা হলো কিভাবে ওর?
মুনিয়া মুচকি হেসে বললো, আমার নয়া দুলাভাই কিছুটা এজেড হওয়ায় বিয়ে পাগলা হয়ে গিয়েছিলো। জিনিয়া বুবুকে দেখতে এসে মুগ্ধ হয়ে বুবুকে পছন্দ করে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেলে। আব্বু আম্মুর চাপে ছেলেপক্ষের সামনে কণে সাজতে রাজি হলেও বিয়ে করতে রাজি ছিলো না আপু। ও তো জানতো বাসররাতে ওর আসল রূপ ফাঁস হয়ে যাবে। তাই বাসররাতে জিনিয়া বুবু পালাবার প্ল্যান করে।
ওকে সাহায্য করেছে কে? কী নাম তার? তুমি কি তাকে চেনো?
আমি শুধু ওর নাম জানি। ও-ও একজন বৃহন্নলা। ওর নাম বৃটনি।
মুনিয়ার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল বেরিয়ে এলেন বাইরে। মনে মনে বললেন: বৃটনির খোঁজে হিজড়াপল্লীতে যেতে হবে আমাকে।
একটা মোটরবাইকের পেছনে চড়ে রাফায়েল চলে এলেন হিজড়াপল্লীতে। জটলা দেখে ভ্রু কুচকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন ওদিকে। ভেতরে ঢুকে যা ভাবেন নি তা-ই হতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। একটা হিজড়া রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে মাটিতে; সম্ভবতঃ মারা গেছে। পাশে রক্তমাখা ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে আরেক হিজড়া। ওকে দেখে চিনতে পারলেন রাফায়েল। মুনিয়াদের ড্রয়িংরুমে ওর ছবি দেখেছেন।
রাফায়েল ওকে বললেন, এ কী করলেন আপনি জিনিয়া! বৃটনিকে খুন করে ফেললেন?
জিনিয়া হাতের ছোরা দিয়ে মৃত বৃটনিকে দেখিয়ে বললো, ও বৃহন্নলা না! ও একটা চিট! আমার গয়নাগুলো নিয়ে পালাতে চেয়েছিলো। এই হিজড়াপল্লীর অনেকেই চিট! বাদাইম্যা পুরুষগুলো হিজড়া সেজে মানুষ ঠকাচ্ছে!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ রাফায়েল ফোন করে থানার ওসিকে ঘটনা জানালে দশ মিনিটে চলে এলো পুলিশ। সাথে জিনিয়ার পরিবার।একটু পরে রয়েল এলো একটা হেলিকপ্টারে। জিনিয়ার আসল পরিচয় শুনে জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই পড়ে গেলো রয়েল।
========================
রানা জামান
ঠিকানা: আনিলা টাওয়ার
বাড়ি#১৮-১৯; সড়ক#৩; ব্লক#আই;
বড়বাগ(ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের পেছনে) মিরপুর-২;
ঢাকা-১২১৬; বাংলাদেশ