গল্প ।। পিকনিকের রকম সকম ।। দীপক পাল
পিকনিকের রকম সকম
দীপক পাল
আমার এই দীর্ঘায়ু জীবনে কতবার যে পিকনিকে যেতে হয়েছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। মধ্য কলকাতায় জন্ম আর বড়ো হয়েছি বলে আমার অনেক পিকনিক সেখানে থাকতেই হয়েছিল। প্রথম দুটি পিকনিক ছাড়া আর গুলো সব নিরুপদ্রব ভাবে সম্পন্ন হয়েছিল ও আনন্দও পেয়েছিলাম খুব। এগুলোতে আমাদের সবার প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড ছিল। এরপর দুর্গাপুরে চাকরির সূত্রে পাঁচ বছর পিকনিক করেছিলাম, সেখানেও আমার নিজস্ব কিছু কর্মকাণ্ড ছিল। কিন্তু কলকাতার অফিসে বদলি হয়ে এসে প্রথম বছরটা বাদ দিলে, পরে যে সব পিকনিকে গিয়েছিলাম সেগুলোতে খালি উপস্থিতি আর সময়মতো খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে হতো না। এ ছাড়া খালি ঘুরে বেড়াও, ক্রিকেট ব্যাডমিন্টন খেল। অফিসের পিকনিক হলে যা হয় আর কি। কিছু কিছু লোক সারাদিন তাস পেটায়। ব্রেকফাস্ট আর চা খেয়ে তাস খেলতে বসে পরে। পিকনিকের আনন্দ তারা ওতেই পায়। আমি অবশ্য ও দলে পড়ি না। এই সব পিকনিকের কথা আমার প্রায় সবটা কেনো প্রায় পুরোটাই মনে নেই। তবে কয়েকটা পিকনিকের কথা আমার সারা জীবনই মনে থাকবে। সেগুলোই এখানে বলতে চাই। আপনাদের হয়তো ভালো লাগবে না, আর সেটাই স্বাভাবিক।
এলাকার বাইরে আমার প্রথম পিকনিকের কথাই বলি। আমার বন্ধু বিশ্ব এর অফিসের এক বন্ধু থাকতো বজবজ লাইনের নুঙ্গী স্টেশনের বাটানগর ছাড়িয়ে অনেক ভিতরে। তার নাম ছিল মদন, সে ছিল বিবাহিত। সে তার বাড়ির কিছুটা দূরে এক গাছ গাছালি ও পাখ পাখালির পরিবেশে একটা স্পট ঠিক করে দেয়। সেই রান্না বান্নার সব ব্যবস্থা করে রাখবে। সেখানে আমরা নিজেরাই সব ব্রেকফাস্ট এবং রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে নেব। পরে দেখেছি মদনবাবুর রান্নার হাত মোটামুটি ভালই। যাই হোক, আমরা সব উৎসাহ সহকারে দোকানের কেনা কাটা করে, এমনকি দই মিষ্টি সমেত সব কিছু আমাদের ছোট ঘরের খাটের তলায় রেখে দিয়েছিলাম। পরদিন পিকনিক। সকাল ছটায় সব বন্ধুরা এসে উপস্থিত। দুই বন্ধু বড়ো রাস্তায় টাক্সি ধরতে চলে গেলো। তিনটে ট্যাক্সি পর পর দাঁড় করানো হলো। তারা কেউ ভিতরের রাস্তায় ঢুকতে চাইলো না। আমরাই ধরাধরি করে ঘর থেকে সব জিনিসপত্র বার করে নিয়ে ট্যাক্সিগুলোতে উঠালাম। আমার বাবা আরো দুতিন জন বয়স্ক লোক একসাথে দাঁড়িয়ে আমাদের উপদেশ দিচ্ছিলো আর মজাও করছিল। ট্যাক্সি গুলোতে আমরা উঠে যেতেই ট্যাক্সি স্টার্ট দিয়ে একটা চাকা ঘুরেছে কি ঘোরেনি, জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আমাদের পাশের ঘরের মেসোমশাই একটা হাত ওপরের দিকে তুলে আমাকে ডাকতে ডাকতে প্রায় ছুটে আসছে। আমি ড্রাইভারকে থামতে বলে ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়াতেই উনি কাছে এসে বললেন, ' আরে তোমরা তো সর্ষের তেলের টিনটাই নিয়ে যাও নি, রান্না হবে কি দিয়ে?' । হটাৎ মনে পড়লো তাইতো দু একটা জিনিষ সমেত সর্ষে তেলের টিন তো বড়ো ঘরের খাটের তলায় রেখে ছিলাম। ট্যাক্সিতে তোলার সময় কেউ আমরা তা খেয়াল করি নি আশ্চর্য। এক বন্ধুকে নিয়ে গিয়ে সেগুলো আবার ট্যাক্সিতে তুললাম। মেসোমশাইকে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়িতে উঠলাম।
ওই পিকনিকের পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৬৩-৬৪ সালে হবে। আমার একবন্ধু শ্যামল নিউ ব্যারাকপুরের এক বাগানবাড়ি ঠিক করলো পিকনিকের জন্য। খুব সুন্দর ও খোলামেলা ছিল সে বাগানবাড়ি। একদল লোক আছে পিকনিকে যায় শুধু সারাদিন তাস খেলার জন্য। সেটাতেই তাদের পিকনিকের আনন্দ। আর একদল আছে ব্রেকফাস্ট সেরেই গোটা বাগানবাড়ি এবং তার বাইরে ঘোরাঘুরি করে, ক্রিকেট ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলে আনন্দ করে। আমি ঠিক এই দলেই পড়ি। কেউ কেউ আবার রান্না করার জায়গায় বসে হাত লাগায়। আমার একবন্ধু ছিল, কালিদাস, সে ছিল ঠিক ঐ দলে। জামা প্যান্ট ছেড়ে একটা গামছা পরে খালিগায়ে মুরগি কেটে সেগুলোকে সুন্দর করে ছুলে টুলে কেটে কুটে রাখতো। এখানেও তাই করলো। কিছুক্ষণ বসে যখন রান্নার ঠাকুর কড়াইতে মাংস কষাতে শুরু করেছে তখন কালিদাস উঠে তার হাত থেকে খুন্তি কেড়ে নিয়ে নিজেই মাংস রান্না করতে লাগলো। কিন্তু আমি জানতাম ও খুব ঝাল খায় তাই ওকে বললাম, ' দেখিস মাংসটা যেন খেতে পারি '। ও বলে, ' দেখবি খেয়ে চিরকাল মনে থাকবে '।
এরপর খাওয়ার পালা। সবাই আমরা বসলাম খেতে। কালিদাস কিন্তু বসলো না। রান্নার জোগাড়েরা আমাদের পরিবেশন করছে আর কালিদাস বড়ো মাটির গ্লাসে আলাদা আলাদা করে মাংস ঢালছে। পরিবেশন কারিরা সবার থালার পাশে পাশে সাজিয়ে দিচ্ছে। যখন মাংস খাওয়ার পালা এলো তখন ভাতের ওপর ঝোল ঢেলে মুখে একটা মাংসের টুকরো ঢুকাতেই যেনো মনে হলো জ্বলন্ত কয়লার টুকরো মুখে ঢুকিয়েছি ভুল করে। মুখ থেকে টুকরোটা ফেলে দিয়ে ধীরে ধীরে সব জলটা খেয়ে আবার জল চাইলাম। খেয়াল হলো আমি কাঁদছি, দেখি সবাই আমরা একসাথে কাঁদছি। চোখ নাক দিয়ে সবার জল পড়ছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। রান্নার ঠাকুর দৌড়ে গিয়ে চিনির ঠোঙ্গা নিয়ে আসলো। সবাই খাবলা খাবলা চিনি খাচ্ছে। বিশ্ব আর বুটো বলে চলেছ, ' যাহ, এ খাওয়া যায় না, যাহ এ খাওয়া যায় না '। সোমেন আর তুতুন এক গ্লাস জলে এক টুকরো মাংস ডুবিয়ে আঙ্গুলে ঘষে ঘষে সাদা করে নিয়েও খেতে ব্যর্থ হলো। আমি কালিদাসকে বললাম, ' কালি তুই ঠিকই বলেছিস, তোর এই মাংসের কথা আমার চিরদিনই মনে থাকবে বুঝলি? কালি বললো, ' আমি কি করবো, ঠাকুর যে মাংসে আগে শুকনো লংকার গুঁড়ো দিয়েছে সেটাতো আমায় বলে নি আর আমিতো একটু ঝাল দি, তাই দুয়ে দুয়ে এই অবস্থা।' আধ পেট খেয়ে সবাই আমরা উঠে পড়লাম করুন চোখে মাংসের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে। বাকিরা সবাই একটু খেল, আর সবটা বড়ো একটা গর্তে ফেলে দেওয়া হলো। আর সেগুলো গর্তে ফেলতেই আট দশটা কুকুর ঝাঁপিয়ে এসে পড়লো ওই খাবারের ওপর। মারামারি কামড়াকামড়ি হলো কত কুকুরগুলোর মধ্যে। দুটো বড়ো কুকুর আর সব কুকুরদের হটিয়ে আগলে রাখলো মাংস গুলোকে কিন্তু খেতেও পাড়ছে না। তবু অনেকক্ষণ আগলে রেখে রণে ভঙ্গ দিল। এরপর যেই কুকুরগুলো দূরে দাঁড়িয়ে ছিল তারাও চেষ্টা করে চলে গেলো। কালিদাসকে আমি আবার বললাম ' দেখলি কালি, কি রান্না করেছিস, কুকুরগুলো পর্যন্ত খেতে পাড়লো না।' ও বলে, ' আমি কিন্তু চোখের জলেও ভালো খেয়েছি।' সবাই ওকে গালাগালি দিচ্ছে 'পিকনিকটা মাটি করে দিলি তুই।' ও খালি হাসে তবু।
এরপর আর এক কাণ্ড। ফিরে যাবার আগে ছাদে উঠেছি সবাই। একতলা বাগান বাড়িটা কোনো রেলিং ছিল না ছাদে। অশোক বলছিল ছাদ থেকে রাস্তাটা বেশ কাছে, লাফিয়েই নামা যায়। ব্যাস, লাগে গেলো বাজি। ও লাফিয়ে নামলো, ও যথারীতি পায়ে প্রচণ্ড চোট পেলো। পরদিন এক্স রে করে জানা গেলো পা ভেঙ্গে যায়নি কিন্তু, ক্র্যাক হয়েছে বড়ো।ব্যান্ডেজ করে পরে থাকলো বাড়িতে।
এরপর কলকাতা অফিসের একটা পিকনিকের কথা না বললেই নয়। সালটা ছিল ১৯৮৪। সেবার ওই পিকনিক করতে গিয়ে খুব বিপদে পড়তে হয়েছিল। সেই বিপদের কথাই এখন বলবো। আমাদের অফিসের অন্য এক সেকশনে সুবিনয় চৌধুরী নামে একটি ছেলে ছিল। ছেলেটি ছিল লম্বা আর সুন্দর এবং খুব আলাপী। কিন্তু ছিলনা কোনো পার্সোনালিটি আর সিন্সিওরিটি। কিন্তু ও ছিল সবার প্রিয়, ওর সুন্দর ব্যবহারের জন্য। ও কখনো রাগতো না, বা রাগলেও ঠিক বোঝা যেত না সেটা। এক দিন ডিপার্টমেন্টে পিকনিকের কথা উঠলো ঠিক সেই সময় সুবিনয় কি একটা কারণে সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বলে উঠলো, ' সুনন্দাদি, আমাদের মাকরদাতে ভালো বাগানবাড়ি আছে, সেখানে পিকনিক করতে পারেন যদি রাজী থাকেন।' শ্রীদেব বললো, ' তোর বাড়ি থেকে কত দূর?' ' একটা বেশ কাছে, বেশ সুন্দর, তবে আরো ভিতরে আরো আছে।' ' দেখ তাহলে। ডোবাবি নাতো?' ' আরেনা ' কথা হলো রান্নার জোগাড় যন্ত্র ওই করবে, তাছাড়া মাছ মাংস ডিমের ব্যবসথাও রাখবে। সঙ্গে দু/একজনকে রাখতে বলা হলো যারা ওর সঙ্গে জোগাড় যন্ত্র করবে। সাত আটজন মহিলা সমেত মোট জনা তিরিশেক হবে।
পিকনিকের দিন সকালে কথামত আমি আর বিমালদা, যিনি ছিলেন এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, সকাল আটটার আগেই মাকরদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা দিলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিমলদা বললো,
-' আরো আগে আসলে মনে হয় ভালো হতো বুঝলি। সুবিনয় সব ঠিক ঠাক সামলাতে পারছে কিনা কে জানে? আমরা লোকতো কম না। সময় মতো ব্রেকফাস্ট না হলে ভীষন মুস্কিল হবে। যা ল্যালা ক্ষ্যাপা ছেলে একটা।'
-' ওই দেখুন বিমলদা, ওই দোকানে সুবিনয় ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।' আঙ্গুল তুলে দেখালাম।
-' এই সুবিনয়, তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? ' বিমলদা খানিকটা অবাক হয়ে কিন্তু রাগত স্বরে বললো।
-' আপনি এসে গেছেন বিমলদা। দেখুননা ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে এমন কান্না কাটি জুড়ে দিয়েছে, তাই ওকে নিয়েই পাঁউরুটি কিনতে বেড়িয়েছি।'
-' ঠিক আছে ঠিক আছে। কিন্তু পিকনিকের কতটা এগিয়েছিস সেটা আগে বল। পরের ট্রেনেই তো সব দলে দলে আসছে। এসেই তো সবাই ব্রেকফাস্ট চাইবে। ছেলেকে রেখে এখুনি চল পিকনিক স্পটে।'
হাঁটতে হাঁটতে আমরা সুবিনয়ের বাড়ির কাছে এসে পড়লাম। বিমলদার এতগুলো প্রশ্নে ও কেমন যেন মিইয়ে গেলো। মিন মিন করে বললো,
-' শুক্রবার অফিস থেকে গিয়ে দেখলাম. আগামী দুই শনি আর রবিবার বুক্ হয়ে গেছে বাগানবাড়িটা।'
-' তোকে যে এত আগে থেকে বলা হলো তা এতদিন তুই কি করছিলি। আমারতো একটা টেলিফোন আছে, কেন তুই জানাস না? অফিসের অনেকেরই তো বাড়িতে টেলিফোন আছে। কেনো তুই জানাস নি?'
-' আসলে আমার ছোট্ট ডাইরিটা, যাতে আমার সবার টেলিফোন নম্বর গুলো টোকা ছিল সেটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ছেলেটা যা দুষ্টু হয়েছে কি জানি ও বাইরে কোথাও ফেলে দিয়েছে কিনা।'
-' একদম ফালতু কথা বলবি না বলে দিলাম। এখুনি সবাই এসে পড়বে। সবাই যদি একটা করে থাপ্পর মারে তোকে, তবে তখনি তোকে হাসাতালে পাঠাতে হবে।'
-' সকাল থেকে বিমলদা এক ফোঁটা চা খাওয়া হয় নি। চলুন না ওপরে গিয়ে একটু চা খেয়ে আসবেন।'
-' তুই কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস? এতবড় একটা দায়িত্ব কেন তুই নিতে গেলি যদি না পারবি? অ্যাই, ছেলেকে ওপরে গিয়ে রেখে আয় আগে। তারপর অন্য কথা।' সুবিনয় ছেলেকে নিয়ে ওপরে চলে গেলো। কি যে করা যায় সেই নিয়ে চিন্তা করছি আমরা। কোথাও গিয়ে যদি একটু বসার মত জায়গা পাওয়া যায় তাহলে নাহয় সেঁকা পাঁউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে সবাই ফিরে গিয়ে কোথাও দুপুরের খাওয়া খেয়ে নেব। ওদিকে দূরে দেখা যাচ্ছে, বাদবাকিরা গলপো করতে করতে আসছে। কিন্তু তেনার দেখা নেই এখনও। একটা অপদার্থ। ভাবতেই এসে গেল। বিমলদা ভয়ানক রেগে গিয়ে বললো,
-' অ্যাই, এত দেরি করলি কেন তুই। চা খেয়ে এলি?'
-' ওপরে গিয়ে দেখি চা হয়ে গেছে। বউ চা না খাইয়ে ছাড়লো না কিছুতেই। আপনাদের তো বললাম ওপরে গিয়ে চা খেতে। আপনারা তো রাজী হলেন না।'
এদিকে পিকনিকের দলবল সবাই এসে গেলো।
-' নে এবার সামলা তুই কি করবি এখন।'। আমি বলি,
-' আপনারা সব পিকনিক স্পটে এসে গেছেন সময় মতো ঠিক। পিকনিক হবে সুবিনয়ের বাড়ির ছাদে। তবে ব্রেকফাস্ট এখনও তৈরি হয়নি। আপনাদের তৈরি করতে হবে। কারণ বাগানবাড়ি অনেক চেষ্টা করেও সুবিনয় একটাও জোগাড় করতে পারে নি।'
ব্যাস, হৈ চৈ লেগে গেলো। সবাই সুবিনয়কে গালাগালি দিতে শুরু করলো। সুনন্দাদি বললো,
-' কি সুবিনয়, কী বলছে সব?'
- ' ছাড়ুন তো ওদের কথা। চলুন না এই রাস্তা দিয়ে যাই একটা না একটা ঠিক পেয়ে যাবো।' শ্রীদেব বললো,
-' তাহলে তো মাছ মাংস কিছুই কেনা হয়নি।'
-' সব হবে, চল না তুই আগে স্পটটা ঠিক করি।'
-' যদি পিকনিক না হয় তবে তোর জীবন তো আমার হাতে, টের পাবি দেখবি কেমন।'
-' বলছি তো একটা ব্যবস্থা ঠিক হবেই। চল না সামনে।'
সবাই মিলে হাঁটতে থাকলাম। সুবিনয়ও সবার গালাগালি খেতে খেতে চললো। ও সে সব কিছুই গায়ে মাখছে না। যেতে যেতে রাস্তার বাম দিকে একটা ভাঙ্গা বাগানবাড়ি দেখা গেলো। মেন গেটের এক দিকের গ্রিল নেই, আর এক দিকের গ্রিল কাত হয়ে রয়েছে। অবশ্য গেটের দিকে যাবার দরকার নেই। কারণ গার্ড ওয়ালের মধ্যখানের অনেকটা পোর্শন একেবারেই ধুলিস্যাৎ। শর্ট কার্ট হয়ে গেছে ভিতরে পোড়ো বাগান বাড়িতে ঢোকার। ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো সামনেই একটা বড়ো পাকা শেল্টার অতি পুরনো। সিমেন্টের বেঞ্চগুলো ভেঙেচুরে গেছে। আর নিচে ঝরা পাতায় বোঝাই হয়ে আছে। ডান দিকে একটা ভাঙ্গা উনুন, তার থেকে ছাই গড়িয়ে পড়েছে, এছাড়া একটা এঁদো পুকুর আছে। একেবারে নোংরা। তার সিঁড়িগুলোও ভাঙা ও বিপদজ্জনক, কারোরই পছন্দ হলো না। কিন্তু অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে কি করা যাবে।
সুবিনয় কোথা থেকে দুটো লোক জোগাড় করে আনলো। একজনকে ভার দিল ঝাঁট দিয়ে সমস্ত ভালো করে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার করতে। তারপর গুল কয়লা এনে যত্ন করে উনুনটাকে পরিষ্কার করে ধরিয়ে দিতে। দ্বিতীয় জনকে ভার দিল বড়ো বালতি করে আগে দু বালতি খাবার ও রান্নার জল এনে দিতে। তার আগে ডেকোরেটরের কাছে গিয়ে আমার নাম করে বড়ো একটা তেরপাল ও বসার জন্য দু তিনটে চাদর নিয়ে এসে সুন্দর করে পেতে দিবি। তারপর আরো জল তুলতে হবে এবং এদের তোরা দুজন রান্নায় সাহায্য করবি। আমি বাজারে যাচ্ছি, যাওয়ার পথে ডেকোরেটরের সাথে কথা বলে যাবো। কয়লাওয়ালাকেও বলে যাবো। এরমধ্যে সুবিনয়ের এক বন্ধু এসে হাজির হলো। সুবিনয় তাকে দেখে বললো,
- ' যাক তুই এসেছিস তাহলে। চল আমি তোর সাথে সবার আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। আমি দীপককে নিয়ে একটু বাজারে যাচ্ছি। তুই এদিকটা একটু সামলে দিস কেমন?'
সুবিনয় সবার সাথে একটু আলাপ করিয়ে দিল।
- 'এর নাম সুনীল, আপনাদের সব রকম সাহায্য করবে সুনীল। আমি দীপককে নিয়ে বাজার থেকে মাছ মাংস আনার ব্যবস্থা করছি।'
সুবিনয়ের সাইকেলের পিছনে বসে বাজারে গেলাম। কিন্তু মাংস পাওয়া গেলো না। রুই কাতলা মিলিয়ে মাছ কাটিয়ে নিলাম মাথা ও ল্যাজা নেবো না এই চুক্তিতে। এসে দেখলাম তেরপাল এর ওপর সাদা চাদর বিছিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে সব ব্রেকফাস্ট করছে আর জমিয়ে গল্পে মেতে আছে। কেউ কেউ তাস খেলায় মেতে আছে, কিন্তু তাদের মুখও চলছে। উনুনের ওপর ডাল ফুটছে। সুবিনয় সবার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো,
- ' দেখ ভাই মাছ এনেছি, এখন সুনীলকে নিয়ে মুরগীর খোঁজে যাবো। ব্রেকফাস্ট করেই বেরোবে আবার।'
এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি স্বরাজদা তাস খেলা থেকে মুখ তুলে বললো, ' মুরগীর ব্যবস্থা তোমায় যে ভাবেই হোক করতে হবে। মুরগি ছাড়া কি পিকনিক হয়। যাও এখুনি বেরিয়ে পরো।' তীর্থাদা হাসতে হাসতে বললো,
- ' তোমরা সুবিনয়কে যাই বলনা কোনো এমন একটা অদ্ভুত পোড়ো বাগানবাড়িতে বসে পিকনিক করার এক অন্যান্য অভিজ্ঞতা হওয়া এ কিন্তু কম কথা নয়। হয়তো এখান থেকে ফিরে যাওয়ার মধ্যে যদি সন্ধ্যে হয়ে যায় তবে হয়তো ভূতেদেরও দেখা পেতে পারি ভাগ্যে ঘটলে।'
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমরা বেরিয়ে পড়লাম মুরগির খোঁজে। সুনীলের জানাশোনা দুটো পোল্ট্রি ফার্ম আছে। সেখানে পেলে আনা হবে। ওদের দুজনেরই সাইকেল আছে। আমি আবার সুবিনয়ের সাইকেলের পেছনে চাপলাম। চললাম মুরগির সন্ধানে। কিছুক্ষণ পরে একটা বাড়ির সামনে ব্রেক কশা হলো। দেখলাম বাড়ির ছাদে পোল্ট্রির খাঁচা। সুনীল বাড়ির ভেতরে ঢুকে 'এই মনা, এই মনা ' বলে ডাকলো।
একটা ছেলে ওপরে সিঁড়ির কাছে এসে বললো, ' কি বলছিস সুনীল বল?'
- ' এই, মুরগি পাওয়া যাবে কয়েকটা?'
- ' এখন বলছিস তুই, আগে বলতে পারলি না? তোর জন্য রেখে দিতাম। সব বিক্রি হয়ে গেছে কাল রাতের মধ্যে। কয়েকটা বাচ্চা মূরগী পরে আছে । ওগুলো তো দেওয়া যাবে না। তোরা উদয়ের কাছে গিয়ে দেখ ওখানে পেয়ে যেতে পারিস।'
- ' যাই গিয়ে দেখি পাওয়া যায় কিনা। সুবিনয় বাজারে গিয়েছিল। পায় নি। ওখানেও সব বিক্রি হয়ে গেছে।'
ওখানে থেকে বেরিয়ে আর এক বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। সুনীল ওই একই কায়দায় বাড়ির ভিতরে ঢুকে ' উদয় উদয় ' বলে হাঁক পড়লো। একটা ছেলে, মনে হয় ওই উদয়, বেরিয়ে এসে সব শুনে বললো,
- ' দেখ, আমারও অনেক মুরগি বিক্রি হয়ে গেছে, অল্প কিছু পরে আছে। তোদের পছন্দ হলে নিয়ে যা, চল ছাদে। সদলবলে ছাদে গেলাম। ওখান থেকে কয়েকটা মুরগি নিয়ে আবার বাজারে গেলাম। বাজার বন্ধ প্রায়। ওখানে একজনকে রাজী করিয়ে মাংস কাটিয়ে পিকনিক স্পটে ফিরলাম। ঘড়িতে তখন বারোটা চল্লিশ। সবাই খুশী। পিকনিক আরো জমে উঠলো। যদিও সব কিছু খুব দেরি হয়ে যাওয়ায় মাংসটা ভালো সেদ্ধ হয় নি, তবুও সবার খেয়ে উঠতে উঠতে সাড়ে চারটে বেজে গেলো। তারপরে কিছু কিছু কাজ থেকেই যায়। সেই কাজগুলো শেষ করে যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন প্রায় ছটা বাজে। সুবিনয় ও সুনীল আমাদের সাথে স্টেশনে গিয়েছিল। স্টেশানে পৌঁছে সুবিনয় বললো, ' স্বরাজদা, বিমলদা সুনন্দাদি, আপনারা সবাই খুব চিন্তা করছিলেন, কিন্তু দেখলেনতো শেষ পর্যন্ত পিকনিকটা কতো ভালো হলো।'
-০-০-০-০-০-০-০-০-
Address :-
---------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Daimond Harbour Road,
Kolkata-700104.
Contacts : 9007139853
-------------------