বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। সুষুমার মুখ ।। তপন মাইতি



সুষুমার মুখ 

তপন মাইতি


সুষুমা আবারও ক্লাস সেভেনে ফেল করল।ঠিক মত প্রতি বছর পাশ করলে এবছর মাধ্যমিক দিত।যদিওবা আগেকার মত পাশ ফেল প্রথা নেই।তবুও কপিলবাবু কিন্তু সেই মান্ধাতার আমলের নিয়ম ধরে রেখেছেন। তিনি এটাই মনে করেন যে একটা ক্লাসে না পাশ করলে ওপর ক্লাসে তোলা মানে পড়ুয়াকে সদ্য সমাজের সহমরণ চিতায় ঠেলে দেওয়া।তিনি কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন যে আমার মেয়ে পরীক্ষায় না পাশ করলে কখনও উপর ক্লাসে তুলব না।শুধু পাশ করে ডিগ্রি বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। আমার মেয়েকে তো কোন অসুবিধার মধ্যে  রাখিনি?কিসের অভাব ওর?মুখে বলা মাত্রই সব কিছু এনে দেওয়া হয়।সুষুমা পাঁচমাথার মোড়ে তপন স্যারের টিউশনে যায়।সুষুমাকে বলতে গেলে দেখতে শুনতে বেশ ভাল।কথাবার্তায়  মাধুর্য আছে। যেন সাদাটে গোলাপী পরি।এতদিনে যে কতজন পথে রাস্তা আটকেছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। মোড়ে টিকা টিপ্পুনি ঝাঁড়ি মারে।ফলো করে বাড়ি অবধি আসে। কথা বলার চেষ্টা করে।ফোন নম্বর চায়। বাইকে চরকির মত ঘোরে ছেলে ছোকরারা।মেলায় যে দোকানে যায় ভিড় জমিয়ে দেয়। অর্ণব হচ্ছে স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং স্কুল টপার।মনে মনে সুষুমার প্রেমে পড়েছে। সুষুমাকে বলতে পারছে না।মহালয়ার দিন। পিতৃপক্ষ অবসান এবং মাতৃপক্ষের সূচনা  শুভক্ষণ।টিউশনে আজ অন্যান্য দিনের থেকে ছেলেমেয়েদের সংখ্যা আপাতত বেশ কম।সুষুমাকে ডেকে অর্ণব হাসিমুখে বলল ভেতরে ভেতরে দারুণ ভয়। 'এই শোন সুষু?'সুষুমা কিন্তু হঠাতে রাগে না।সে একগাল হেসে বলল এই নামে তুমি আমায় ডাকবে না!অর্ণব বলল একটা কথা ছিল বলব? অনুমতি পেলে বলতে পারি।আমার হাতে তেমন সময় নেই। বলে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল।তাড়াতাড়ি বল কি বলবে?এই কথাটা বলতে একটু সময় লাগবে।আমার বাবা মা বকাবকি করব সুষুমা বলল?তোর ভালোর জন্যে একটা কথা বলব শুনতে চাইলে বলতে পারি।ঘরে যেতে দেরি হলে হাজার প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতে হবে।কি বলবে তাড়াতাড়ি বল অর্ণবদা।সুষুমা যা ঠাহর করেছিল কথাটা সেইদিকে না গিয়ে অন্যদিকে গেল।বল তুমি স্কুল টপার তোমাকে সম্মান করি।শ্রদ্ধা করি।আমায় একটু পড়াতে?বাবাকে বলে টিউশন যোগাড় করে দেব।সত্যি কথা বলতে কি আর একটা ক্লাসে কত বছর থাকব বল?আরে না রে সুষু থুড়ি এই কান ধরেছি আর এই নামে বলব না। সুষুমা হেসে ফেলল।যেন কোন কৌতুহলী মেঘ কাটিয়ে সূর্য পৃথিবীর নতুন মুখ দেখল।অর্ণব বলল হাসলে তোর টোল পড়া গালটা বেশ সুন্দর রেঙে ওঠে।তোর স্মার্ট ফোন আছে না?আমার ল্যাপটপ আছে।একদিন সময় করে আসিস। তোকে ভার্চুয়াল জগতটা বুঝিয়ে দেব।ফেইসবুক টুইটার ওয়াটস অ্যাপ ইউটিউব ইনস্টাগ্রাম মেইল গোগুলে ক্রোমে তোর আই ডি খুলে দেব।যা দেখতে একটু আধটু ছবি দিলেই ভাইরাল হয়ে যাবি। তোর মুখ যা সুন্দর আর যা দেখতে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সাহিত্য সমাজ লুফে নেবে।যদিওব রূপের চেয়ে আমার কাছে গুণের অগ্রাধিকার বেশি।তবু বলছি ওতে ইনকাম করতে পারবি সাবস্ক্রাইব লাইক কমেন্ট সেয়ার হলে কি হয় সব বুঝিয়ে দেব।ফোন নম্বরটা দিতে দিতে সুষুমা অর্ণবের চোখের দিকে একটু অন্যরকম ভাষা পড়ে নিতে অসুবিধা হল না।অর্ণবদা তোমাকে অনেক বিশ্বাস করে নম্বরটা দিলাম কাউকে দেবে না কিন্তু!এই করে বাবার মোবাইলের পাঁচটা সিম কার্ড পাল্টানো হল। সময়ে অসময়ে ছেলেদের ফোন আসত বিরক্তি হত।বাড়িতে এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়।আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবে অর্ণবদা।একটু ভেবে চিন্তে কাজ করবে কিন্তু।আজ দীপাবলি বিকেলে সকলে বাজারের ওপর ঠাকুর দেখতে গেছে। বাড়িতে শুধু অর্ণবের মা আছে।ফোন করল সুষুমাকে।ও অনেক কোন কিন্তু করে এল। অর্ণব একের পর এক পই পই করে বুঝিয়ে দিল এবং খাতায় নোট করে দিল যাতে কোন অসুবিধা না হয়। 
তারপর শুরু হল সুষুমার ভার্চুয়াল জগৎ।একের পর এক ছবি পোজ ভিডিও অডিও আপলোড করার সাথে সাথে অর্ণবের কথা মত ভাইরাল হতে লাগল। সুষুমা এভাবে সত্যি সত্যি সেলিব্রেটি হয়ে গেল।এখন শুটিং এ ব্যস্ত থাকে।চার চাকায় বডি গার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।ছোট্ট পর্দায় সিরিয়ালের জন্য ডাক পড়েছে। 
আর অর্ণবের মত মেধাবী ছেলে এত এত রাত জেগে পড়াশোনার পর দশ বারো ঘণ্টার ডাউটি করে দশ হাজার টাকায়!অবসর সময়ে সুন্নিষা রয় হরফে সুষমা ব্যানার্জি ভাইরাল ভিডিও দেখে সময় কাটিয়ে তৃপ্তি পায়। সুষুমার সেই সুন্দর মুখের গ্ল্যামারে পাগল স্যোসাল মিডিয়া অর্ণব তো অনেকগুলো কবিতা লিখে হয়ে গেছে।এখন সুষুমা আর ফোন করে না অর্ণবকে...
২)বাস্তব নায়ক 
তপন মাইতি

তন্ময় মণ্ডল সদ্য বি.এ পাশ করল।পড়াশোনায় খুব ভাল না হলেও খারাপ নয়।মোটামুটি চলে যাবে।ফরমাল পোশাক ইন্টারভিউ দিতে এসে ভুবনপুর নামে এক মফস্বল অফিসে কাজ পেল।মাইনে দশ হাজার টাকা।অফিস থেকে চার কিমি দূরে ভুবনপুর জংশন রেলওয়ে স্টেশন। পাতলা ঘনবসতি। ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর।দোকানপাট অফিস আদালত।ইলেকট্রিক জলব্যবস্থা সুব্যবস্থার উন্নতির পরিকল্পনার পর্ব চলছে।আস্তে আস্তে এখানকার মানুষের চাষবাসের ঝোঁক কমছে।পাশাপাশি পাকা ঘরবাড়ি গজিয়ে উঠছে।অর্জুনতলা এমন একটি জায়গার কথা বলছি।যেটা গ্রামের  চেয়ে উন্নত কিন্তু শহরের ছোঁয়া পৌঁছেছে মাত্র। অফিসের কাছাকাছি ভাড়াটে বাড়িতে থাকে।আশে পাশে দু একটা হাতে গোনা মুদীখানা সেলুন দোকান থাকলেও  নিত্য প্রয়োজনীয় জন্য অটোতে কিংবা টোটোতে বা সাইকেলে স্টেশনে যেতে হয়।সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার ছেলে তণ্ময়।থাকা খাওয়া পকেট খরচ,সংসার খরচ,চালাতে তাকে টেনেটুনে চলতে হয় অনেক।তবুও সে তুলনা করে যে কাজটার জন্য তার আগের চেয়ে ভালো আছে।এখানে রাত যত ঘন হয়।গাড়ি সংখ্যা কমতে হয় কোন দরকার পড়লে।অটোওয়ালার ফোন নম্বর রেখে দিয়েছে।ফলে বিপদে আপদে একটু বেশি মানে টাকা দিয়ে যেতে হয়।গাঁয়ের ছেলেরা বড় ভদ্র হয় বলে মনে হয়।সেটা বাইরের থেকে নাটক ভাবলেও সত্যিই যারা জেনেছে তারা জানে ছেলেটা সত্যি সত্যি সৎ প্রকৃতির ভালো ছেলে। আশে পাশে চা দোকানে যায় লোকেরা জিজ্ঞেস করে ছেলেটা বেশ ভাল সুন্দর।নাম ঠিকানা নেয়।কি কাজ করে জিজ্ঞাসা করে।বাড়িতে কতজন আছে?ক'বিঘা জায়গা জমিন?ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কত ?এল আই সি আছে?ছেলেটার খুব গরীব হওয়ার দরুন দশ বছরের প্রেম ভেঙে বিয়ে করে নিয়েছে স্কুল মাস্টারকে। ছেলেটা বুকের কষ্ট নিয়ে ভেবেছে।বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছি তখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই ছাড়ব।নেশাভাঙে একদম হাত দেয় না।লোকজনের সাথে ভালো ভাবে মিশতে মিশতে পরিচয় হয়।সম্বন্ধ আসে।তাদের প্রশ্ন,বিয়ে করে মেয়েকে এখানে রাখবে না ওখানে?গ্রামের বাড়িতে না শহরের ভাড়াটে বাড়িতে?নাইট ডিউটি আছে কিনা? সেখানে ফোন অ্যালাও আছে কিনা?ছেলে একটু বেঁটে রোগা কালো!বেসরকারি চাকরি। মোটামুটি মাইনে হলেও এখনকার বাজারে তা সামলানো বড়ই কঠিন?বাড়ির ব্যাকগ্রাউন্ড তেমন ভালো নয়।এসব করতে করতে তিরিশ পেরিয়ে গেল। অর্জুনতলার মানুষজন যে শহুরের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ঘুরছে।দেখে মনে হয় না তারা খারাপ আছে। পাশে হ্যাপি ভ্যালি গভর্নমেন্ট দপ্তরের প্রযেক্ট শুরু হয়েছে।পাঁচ বছরের পর এর ভোল আমুল পরিবর্তন হয়ে যাবে আশা করা যায়।এই আশায় আনুষঙ্গিক দোকানপাট ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট হচ্ছে গজিয়ে উঠছে।বিকেল সন্ধ্যায় ছেলে ছোকরা আর বাইক গাড়িতে রোমান্স দেখে চোখ নামিয়ে হেঁটে হেঁটে ভাড়াটে বাসায় ফেরে তণ্ময়। তাকে কে বলছে এসব গ্রামে হয় না। এখন গ্রামও পিছিয়ে নেই। ওদিকে যা অসুবিধা।বর্ষায় জলজেটির যা দুরাবস্থা। কি ভয়ংকর!তন্ময় কিন্তু খুব পরিশ্রমী ছেলে। আর যা দিন দিন হু হু করে বাজার দর বাড়ছে, মুদ্রাস্ফিতি বাড়ছে, বাড়ির ভাড়া বাড়ছে,ইলেকট্রিক বিলের মিটার বাড়ছে।অফিস যাওয়া আশার খরচ বাড়ছে।সেই হারে চাকরির বেতন বাড়ছে না।অথচ আট ঘণ্টা কাজের কথা বলে দশ বারো ঘণ্টা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।ও টির সংখ্যা বাড়ছে।ফলস্বরূপ তন্ময়ের দুরাবস্থা বাড়ছে ক্রমশ। সে তখন দেখলে আরলি কিংবা ইজি মান্থলি কিংবা ইয়ারলি ইনস্টলমেন্ট নিয়ে ল্যাপটপে অ্যাণ্ড্রয়েড বারো আই নাইন জেনারেশনের ল্যাপটপ এবং আনুষঙ্গিক কিনে দোকান করল মাল্টি পারপাসে। সে দেখে ভাবল সি বি এস সি বোর্ডের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।তার ডানপাশে বই এড কলেজ। তার একটু পেছনে বেসরকারি বি টেক কলেজ।তার বাম দিকে একটি মানসিক আরগ্য হাসপাতালের বিল্ডিং উঠছে।ফলে সে একটি সাইবার ক্যাফ খুলে বসল।ওদিকে চাকরি হল আর অফিস শেষে সাইবার ক্যাফ চালু করে বেশ কদিনে সঞ্চয় করে নিল।তন্ময়ের জীবন এমনভাবে জড়িয়ে গেল যে আর জন্মভিটাতেই যাওয়ার সুযোগ পায় না।গ্রামের সংসারে বাবার ওষুধ পথ্য মায়ের আকুতি কান্না ভাইদের আবদার।সবাই-এর দেখভাল করে দূর থেকে।তণ্ময়ের ছোট্টবেলা থেকে আর্থিক সংকট হলেও এখন সেটা নেই।তবুও সে ভুলতে পারে না। সেই হাসি মুখ। মায়ের গালে চুম খেয়ে বলত আমার সোনা একদিন মস্ত বড় মানুষ হবে। ভাইদের সকাল সকাল স্কুল টিউশনে ছেড়ে দিয়ে আসা সাইকেলে। পুজোয় পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখতে যেত একসাথে। এখন সে স্থির করল।স্টেশনের পাশে কাঠা প্রতি তের লাখ টাকা দিয়ে ঘর তৈরি করবে।আর সেই ঘরে গ্রামের বাবা মা ভাইরা থাকবে। কিছু করার নেই। জীবিকা আর জীবনের তাগিদে এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে তাকে ভুবনপুরের অর্জুনতলার ভোট তালিকায় নাম লেখাতে হয়। কোন কিছু করার নেই থাকেও না।বাস্তব এভাবে হয়েই যায়।এভাবে গ্রাম্য জীবনের মানুষজন ভালোবাসার পিতৃভিটেকে ছেড়ে শহর কেন্দ্রিক হতে বাধ্য হয়।আর প্রান্তিক মফস্বলের মানুষজন দেখে মহানগরের স্বপ্ন। অথচ তণ্ময়ের মনে পড়ে খুব সেই ছেলেবেলার ঘর....যেন বাস্তবের নায়ক।
=======================

নামঃ তপন মাইতি
ঠিকানাঃ গ্রামঃ পশ্চিম দেবীপুর; পোঃ দেবীপুর; থানাঃ মৈপীঠ কোস্টাল; জেলাঃ দঃ২৪পরগণা; পিন-৭৪৩৩৮৩; পশ্চিমবঙ্গ। ভারতবর্ষ।যোগাযোগঃ 9679159597

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.