ছোটগল্প ।। ছেঁড়া সোয়েটার ।। চন্দন দাশগুপ্ত
0
জুন ০১, ২০২৫
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
ছেঁড়া সোয়েটার
চন্দন দাশগুপ্ত
শীত পড়লেই 'ওঁরা' নেমে আসেন দলে দলে। 'ওঁরা' মানে কিছু পাহাড়ি মানুষ---দার্জিলিঙ, সিকিম,ভুটান আর নেপাল থেকে ওঁরা পরিবারসহ চলে আসেন সমতলে। শিলিগুড়ি- জলপাইগুড়ি সহ সমতলের বহু জায়গাতে ওঁরা মাস তিনেকের জন্য আস্তানা পাতেন। সেখানেই থাকা-খাওয়া-ঘর-গেরস্থালির সাথে দিনরাত চলে শুধু নিপুণ হাতে উলবোনা। একের পর এক তৈরি হতে থাকে নানা রঙের সোয়েটার, কার্ডিগান, জ্যাকেট, টুপি, মোজা, গ্লাভস, মাফলার......আরো কতো কী ! তার সাথেই নিয়মিত চলে বাংলা-হিন্দি-নেপালী ভাষার সাথে মিষ্টি হাসি মিশিয়ে দরদাম আর বিক্রি-বাটা।
শহরগুলোর স্থানীয় মানুষদের কাছে এই অস্থায়ী 'ভুটিয়া মার্কেট' সন্ধ্যাবেলার একটা বেড়ানোর জায়গা। কিছু কেনা হোক বা না-হোক, সপ্তাহে দুতিন দিন সকলেরই একবার ভুটিয়া মার্কেটে ঢুঁ মারা চাই।
রবিবার ছুটির দিন। বিকেলবেলায় বিমান রীতাকে নিয়ে হাজির হল ভুটিয়া মার্কেটে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর একটা সবুজ রঙের সোয়েটার বিমানের বেশ পছন্দ হল। দামটা একটু বেশি, আটশো টাকা চাইছে। তবে এটা ওদের নাইনে পড়া ছেলে টুবলুকে বেশ মানাবে। দরাদরিতে রীতা ওস্তাদ, ভুলভাল নেপালীতে সে বলল,
-----ইয়ো সোয়েটার কো কোয়ালিটি রামরো ছৈন। প্রাইস দোশো রূপিয়ামা দেনু সকছ ?
অর্থাৎ, এই সোয়েটারের কোয়ালিটি ভালো নয়, দুশো টাকায় দিতে পারবেন ?
কিন্তু বহু দরদামের পরেও পাঁচশো টাকার কমে সোয়েটারটা সেই নেপালী মহিলা-বিক্রেতা দিতে রাজি হলেন না। এদিকে বিমান ভাবছিল ওর ছোটবেলার কথা। তখন ওদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। বিমান তখন ক্লাস টেনে উঠেছে। মায়ের দুচোখেই ছানি পড়েছে, অথচ অপারেশন করানোর মতো টাকাই নেই। ওই অবস্থার মধ্যেই তিন চারটি পুরোনো ছেঁড়া সোয়েটার সাবধানে খুলে যতটুকু উল উদ্ধার হয়েছিল, সেসব দিয়েই অনেক কষ্ট করে মা ওকে একটা হাফ সোয়েটার বানিয়ে দিয়েছিল। সেটা পরেই বিমান পরে বেশ কয়েকটা শীত কাটিয়ে দিয়েছে। সেটাই ছিল বিমানের মায়ের হাতে বোনা শেষ সোয়েটার, কারণ তার বছর দুই পরেই মা চলে যান পরলোকে। শেষের দিকে সেই সোয়েটারটা ছিঁড়ে গেলেও মায়ের হাতের শেষ কাজ বলে বিমান এখনো সেটা আলমারিতে গুছিয়ে রেখেছে।
রীতার দর করা সোয়েটারটার সাথে মায়ের বোনা শেষ সোয়েটারের কেমন যেন একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাচ্ছিল বিমান। তাই আর কথা না বাড়িয়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে সে বলল,
-----ব্যস, হো গিয়া। আভি প্যাক কর দিজিয়ে।
সারা রাস্তা রীতা বিমানের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে গজ গজ করতে করতে বাড়ি এল।
ডিনারের শেষে বিমান আলমারি থেকে মায়ের তৈরি শেষ সোয়েটারটা বার করল। তারপর সেটার সাথে আজ কেনা সোয়েটারটা নিয়ে ছেলেকে ডাকল,
------টুবলু এদিকে আয় ! দ্যাখ এটা তোর ঠাকুমার তৈরি করা শেষ সোয়েটার। এটা আমি আট-দশ বছর ধরে পরেছি। আর এটা দ্যাখ্ ! আজকেই আমি আর তোর মা ভুটিয়া মার্কেট থেকে তোর জন্য কিনে আনলাম। দুটোই অনেকটা এক রকম, তাই না রে ?
টুবলু একঝলক দেখেই বলল,
------ধুর ! তোমার ওসব ফালতু সেন্টিমেন্টের কোনও দাম নেই বাবা। আর তোমরা তো জানো, আমি সোয়েটার একদম পছন্দ করিনা, জ্যাকেটেই আমি অনেক বেশি কম্ফোর্টেবল্ ফিল করি।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস নাইনে পড়া ছেলের কথা যেন বিমানের মুখে সজোরে চাবুক মারল। রীতাও চমকে গিয়েছিল ছেলের কথায়। কিন্তু বিমান ওকে ইশারায় চুপ করে যেতে বলল।
সেদিন অনেক রাতে রীতার ঘুমটা ভেঙে গেল। বিমানকে না দেখে সে বিছানা ছেড়ে উঠল। তারপর বেডরুমের লাগোয়া ব্যালকনিতে উঁকি মারতেই দেখতে পেল তার প্রয়াত শাশুড়ির তৈরি শেষ ছেঁড়া সোয়েটারটা হাতে নিয়ে আধো অন্ধকারে বসে বিমান নিঃশব্দে কাঁদছে।
স্বামীকে কিচ্ছু বলল না রীতা। ও জানে, এখন আড়ালে একটু কাঁদলে বিমান কিছুটা হাল্কা হতে পারবে।
===========================
চন্দন দাশগুপ্ত
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা।