গল্প।। আশ্রয় ।। দেবাংশু সরকার
0
জুন ০১, ২০২৫
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
আশ্রয়
দেবাংশু সরকার
বারো বছর পর আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছে শ্যাম। অবশ্য বহুদিন আমেরিকায় থাকলেও দেশে থাকা তার বাবা মায়ের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ। নিয়মিত সে তার বাবা মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। প্রতি মাসে সে বাড়িতে টাকা পাঠায়। দেশের বাড়িতে থাকা তার বাবা মা যাতে কোনও রকম অসুবিধা বা সমস্যায় না পড়ে সেদিকে তার সজাগ দৃষ্টি। কিন্তু কাজের চাপে তার আর দেশে আসা হয় না। তাছাড়া আমেরিকার উন্নত মানের জীবন যাত্রা ছেড়ে এদেশে আসার খুব একটা ইচ্ছা নেই তার। কিন্তু বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্যের কোনও ত্রুটি সে করে না। বিদেশে বসেই সে তার বাবা মায়ের দেখাশোনার সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছে। বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম, রান্নাবান্নার জন্য ঠাকুর চাকর রয়েছে। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে স্থানীয় নার্সিংহোম থেকে চিকিৎসা কর্মীরা এসে তার বাবা মায়ের মেডিকেল চেক আপ করে যায়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নার্সিংহোমে হয়।
কিন্তু মানুষতো অমর নয়। সময়কে সেলাম জানিয়ে একদিন পরলোক গমন করেন তার বাবা। মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে ঘটে যায় অঘটন। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার মায়ের জন্য দুমাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফেরে শ্যাম। কারণ এবার তো তার মা একা হয়ে গেলেন! তাকে দেখাশোনা, তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে আরও কিছু কাজ তাকে সারতে হবে। মাত্র দুমাসের ছুটি পেয়েছে শ্যাম। সব কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন করার পক্ষে দুমাসের ছুটিটা বড়ই কম! কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কারও একজনের বাড়িতে তার মায়ের পাকাপাকি ভাবে থাকার ব্যবস্থা সে করে দিয়ে যাবে। কারণ তার মা কিছুতেই আমেরিকায় যাবেন না। আর এই মুহূর্তে শ্যামের পক্ষেও কাজকর্ম ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে এদেশে চলে আসা সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে এত বড় বাড়িটারও কিছু একটা ব্যবস্থা সে করবে। এরমধ্যে কয়েকজন প্রোমোটারের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। প্রোমোটাররা শ্যামকে বেশ বড় অঙ্কের প্রস্তাব দিয়েছে। পৈতৃক বাড়ির প্রতি একটা টান থাকলেও যুক্তিশীল শ্যাম ভাবে এত বড় বাড়িতে থাকার কেউ নেই, দেখাশোনা করার কেউ নেই, সুতরাং নিকট ভবিষ্যতে অব্যবহৃত হতে চলা বাড়িটাকে ফেলে রেখেও কোনও লাভ নেই। সময় থাকতে থাকতে বিক্রি করে দিয়ে ঝামেলামুক্ত হওয়াই ভালো। বাড়ি বিক্রির টাকাতে তার মায়ের ভরণ পোষণের পাকাপাকি ব্যবস্থাও করতে পারবে।
ভারতে ফেরার কিছুদিন আগে থেকেই শ্যাম পরিকল্পনা করে নিয়েছে যে সে দেশে ফিরে কি করবে। তার পরিকল্পনার মধ্যে আছে, সে দুজন প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলে দরাদরি করবে। যে বেশি দাম দেবে তার সঙ্গে আবাসন তৈরির চুক্তি করবে। তারপর সে যাবে তার মামার বাড়ি। সেখানে তার মামাতো ভাই সুজনের সঙ্গে কথা বলে তার মাকে রাখার ব্যবস্থা করবে। যদিও সুজনের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। তবুও তার মা যেন সুজনের বোঝা না হয় সেইজন্য আর্থিক ব্যবস্থাটাও করে রাখবে। তারপর দেখা করবে তার পিসতুতো ভাই রজতের সঙ্গে। কারণ রজত হচ্ছে তার সেকেন্ড অপশন। সুজন যদি কোনও কারণে তার মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে রজতের উপর ভরসা করতে হবে। তাকে রাজি করাতে হবে। তাছাড়াতো কোনও উপায় নেই। কারণ তার আর এক মাসতুতো ভাই কমলের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। কমলের মত গরীবের হাতে তার মায়ের দায়িত্ব দিয়ে শ্যাম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে না। সব সময়ে তার মাকে নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা থেকেই যাবে। সুজন, রজত দুজনেই যদি একান্তই শ্যামের মায়ের দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে কমলের কথা ভাবতে হবে। কিন্তু কমল অত্যন্ত গরীব। শ্যাম তার মায়ের জন্য যে টাকা কমলকে দেবে, গরীব কমল হয়তো তার নিজের সংসার চালাতে সেই টাকা খরচ করে ফেলবে। তখন তার মাকে হয়তো কষ্ট করে দিন কাটাতে হবে। অতয়েব কমলের কথা ভেবে লাভ নেই। সুজন অথবা রজতের কাছেই তার মাকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
কলকাতায় পৌছেই শ্যাম প্রথমে দেখা করতে যায় প্রোমোটার সনু গুপ্তার সাথে। মধ্য কলকাতায় সনু গুপ্তার সাজানো গোছানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস। রিসেপশনে তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সনু গুপ্তার সঙ্গে দেখা করতে চায় শ্যাম। রিসেপশনিষ্ট শ্যামকে অপেক্ষা করতে বলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডাক আসে। একজন কর্মচারী শ্যামকে সনু গুপ্তার কক্ষে নিয়ে যায়। সনু গুপ্তা সহাস্যে নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে শ্যামকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানিয়ে, সম্মানের সহিত শ্যামকে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসায়।
শ্যাম কিছু বলার আগে সনু গুপ্তা বলতে থাকে, "ওয়েলকাম মিষ্টার শ্যাম রায়। ওয়েলকাম অ্যাট ইয়োর ওন কান্ট্রি। আগে বলুন বহু বছর পর নিজের দেশে ফিরে কেমন লাগছে?"
- "অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে মিষ্টার গুপ্তা। আমার দেশটা অনেক পাল্টে গেছে। দেশে ফিরে নিজের দেশটাকে যেন চিনতে পারছি না! আগে চারিদিক সবুজে সবুজে ভরা ছিল। পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙত। দিঘিতে ফুটে থাকত শালুক, পদ্ম। ডানা ঝাপটাত মরাল মরালি। বসন্তে কোকিলের কুহুতানে মুখরিত হত চারিদিক। মাছরাঙা, ফিঙে, টিয়া আরও কত রকমের পাখি দেখা যেত গাছে গাছে। সেই সবুজ, সেই প্রকৃতি আর নেই। আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না। তার বদলে চারিদিকে কংক্রিটের জঙ্গল। উঁচু উঁচু বহুতলে আকাশ ঢেকেছে। বাতাস আটকেছে। উধাও হয়ে গেছে পাখির দল। পুকুর দিঘিও খুব একটা দেখা যায় না। সব ভরাট হয়ে গেছে। সত্যি বলতে কি আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দেশে ফিরে আমি হতাশ হয়েছি। যে প্রকৃতি দেখার আশায় দেশে ফেরা, সেই প্রকৃতি যেন হারিয়ে গিয়েছে।"
- "এটা হচ্ছে আধুনিক যুগ মিষ্টার রায়। এটাই আধুনিকতা। ইন্টারনেট, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আধুনিক জীবন যাত্রার সুবিধা নেবেন, আবার কোকিলের ডাক শুনবেন, দুটোতো একসঙ্গে হবে না। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হবে। এরপর দেখবেন আরও পাল্টে যাবে পৃথিবী। আরও বদলে যাবে জীবন যাত্রার মান। আধুনিক জীবন যাত্রা কি কেবল পশ্চিম দুনিয়ার মানুষরা উপভোগ করবে, আর আমরা কেবল ফুল, পাখি, গাছ নিয়ে জীবন কাটাব? তাই কি হয় নাকি? আধুনিকতার স্রোত সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া মানুষের জীবন যাত্রা কেমন হবে, মানুষের কোন দিকে যাবে, সেতো আর আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। অতয়েব ওসব ভেবে লাভ নেই। আসুন আমরা আমাদের কাজে মন দিই।"
- "ঠিক ঠিক। মিষ্টার গুপ্তা, আপনি কি এগ্রিমেন্টের পেপার বানিয়ে রেখেছেন?"
- "সব রেডি আছে স্যার। আপনি গ্রিন সিগনাল দিলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।"
- "খুব ভালো। তাহলে আমাকে এগ্রিমেন্টের ড্রাফটের একটা কপি দিন, একটু চেক করে নিই। তারপর সই সাবুদ সেরে কাজ শুরু করা যাবে।"
গুপ্তা তার টেবিলে রাখা একটা ফাইল থেকে এগ্রিমেন্টের খসড়ার একটা জেরক্স কপি বের করে শ্যামকে দেয়। শ্যাম পাতা উল্টে পড়তে থাকে।
সনু গুপ্তার অফিস থেকে বেরিয়ে শ্যাম যায় আর এক প্রোমোটার ব্রহ্মানন্দ রেড্ডির অফিসে। দক্ষিণ কলকাতায় ব্রহ্মানন্দ রেড্ডির ছিমছাম অফিস। ব্রহ্মানন্দ অফিসেই রয়েছে। শ্যামের ফোন পেয়ে নিজে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে শ্যামের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
- "ওয়েলকাম মিষ্টার রায়। এই গরিবের অফিসে আপনাকে সুস্বাগতম।"
- "কি বলছেন মিষ্টার রেড্ডি, এটা গরিবের অফিস! আমেরিকাতেও এতো সুন্দর অফিস আমি কম দেখেছি। আপনার অফিসে এসে আমার খুব ভালো লাগছে।"
- "আমাদের সঙ্গে কাজ করলে আপনার আরও ভালো লাগবে মিষ্টার রায়। প্রথমত আমরা আপনাকে অন্যান্য প্রোমোটারের থেকে অনেক বেশি বেনিফিট দেবো। দ্বিতীয়ত আমাদের কাজের কোয়ালিটি একবার নিজের চোখেই দেখুন। কোলকাতায় অন্তত একশো প্রোজেক্ট আছে আমাদের। তারমধ্যে কয়েকটা ঘুরে দেখুন, দেখলেই বুঝতে পারবেন আমাদের কাজের কোয়ালিটি।"
কথা না বাড়িয়ে ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি বেরিয়ে পড়ে শ্যামকে নিয়ে। তাদের তৈরি কয়েকটা আবাসন ঘুরিয়ে দেখায়। ব্রহ্মানন্দ রেড্ডির কোম্পানির আবাসনগুলো দেখে বেশ ভালো লাগে শ্যামের। তবে শ্যাম একটু দোটানায় পড়ে, সে ভেবে পাচ্ছে না কার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে। তবে দুজনেই খুব নামকরা প্রোমোটার, যে কোনও একজনকে বেছে নিলেই হবে।
একটা সমস্যা মিটল। এবার আর একটা সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করে শ্যাম। তার মাকে কার হেফাজতে রেখে সে নিশ্চিন্তে আমেরিকায় ফিরতে পারবে। তার মায়ের বয়স হয়েছে। হয়ত আর বেশিদিন বাঁচবেন না। হয়তো তার মায়ের মৃত্যুর সময়ে সে থাকবে বহুদুরে। হয়তো এই তাদের শেষ দেখা। ভাবতে গিয়ে তার মনটা ভারি হয়ে আসে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। কঠিন বাস্তবকে মেনে নিতে হবে।
ফোনে আগে কথা বলে রেখেছে। এক রবিবার ছুটির দিন দেখে শ্যাম যায় সুজনের বাড়ি। সুজন কলকাতাতেই থাকে। এক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চ পদে সে কর্মরত। কাজের জন্য মাঝে মাঝে তাকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়। আজ সুজন ঘরেই আছে। শ্যামের জন্য অপেক্ষা করছে।
সুজন একজন ফ্যামিলি ম্যান। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। তিন জনই স্কুলে পড়ে। তবে সুজনকে প্রায়ই কাজের জন্য বাইরে থাকতে হয়। একবার বাড়ি থেকে কাজের জন্য দুরে কোথাও গেলে, কুড়ি পঁচিশ দিনের আগে সে বাড়ি ফিরতে পারে না। তখন তার ছেলেমেয়েরা তাদের মামার বাড়িতে থাকে। সুজন সব সময়ে তার ছেলে মেয়েদের ঠিকমত দেখাশোনা করতে পারে না। এই নিয়ে সুজন বেশ সমস্যায় রয়েছে। তার স্ত্রীকেও সেই কারণে বেশির ভাগ সময়ে বাপের বাড়িতে থাকতে হয়। এজন্য সুজনের স্ত্রীও বেশ বিরক্ত। মাঝে মাঝে সে মেজাজ হারিয়ে ফেলে। অশান্তি শুরু হয় বাড়িতে। কিন্তু আপাতত এই সমস্যা সমাধানের কোনও পথ জানা নেই সুজনের। সে জানে যতদিন না তার ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে ততদিন এই সমস্যা থেকে যাবে।
সকালে শ্যাম সুজনের বাড়ি পৌছাতেই, আগত অতিথিকে নিয়ে হৈচৈ শুরু করে শ্যামের ছেলে মেয়েরা। সুজনের স্ত্রীও শ্যামের কাছে অনেক কিছু জানতে চায় আমেরিকা সম্বন্ধে। বিভিন্ন রকম কথাবার্তার পর শ্যাম মুল প্রসঙ্গে আসে।
কোনও রকম ইতস্তত না করে শ্যাম বলে, "আমার মাকে নিয়ে একটা সমস্যায় পড়েছি।"
- "কি সমস্যা?"
- "তুইতো জানিস আমি অনেকবার বাবা মাকে নিয়ে আমেরিকায় যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা মা কেউ রাজি হননি। কারণ অন্য দেশ, অন্য ভাষা, অন্য কালচারের সঙ্গে এই বয়সে মানিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন। প্রায় অসম্ভব। সেইজন্য আমিও জোর করিনি। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর মা পুরোপুরি একা হয়ে গেছেন। আমিতো চাইছি মাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। কিন্তু এত বড় বাড়িতে মায়ের পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়। কারণ কাজের লোক বা আয়াদের উপর পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। অনেক রকম খারাপ খবর শুনতে পাওয়া যায়। এমনকি একা থাকা বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে খুণ করে কাজের লোকেরা টাকা পয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে চম্পট দিয়েছে এমন খবরও শোনা যায়। সেইজন্য ভাবছি মাকে যদি তোর বাড়িতে রাখা যায়, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে আমেরিকায় ফিরে যেতে পারব। অবশ্য মায়ের ভরণ পোষণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ টাকার ব্যবস্থা করে রেখে যাব, যাতে তোর উপর আর্থিক বোঝা না আসে।"
- "ভরণ পোষণের টাকাটা বড় কথা নয়। কিন্তু আমার পক্ষে তোর মাকে রাখা সম্ভব নয়। কারণ আমি নিজেই মাসের অধিকাংশ দিন বাড়িতে থাকি না। কাজের জন্য বাইরে থাকতে হয়। আমার ছেলে মেয়েরা তখন মামার বাড়িতে থাকে। মাসের মধ্যে কিছুদিন এ বাড়িতে, কিছুদিন মামার বাড়িতে থাকার ফলে ওদের পড়াশোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। বাড়িতে এনিয়ে অশান্তি হচ্ছে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। ফলে বুঝতেই পারছিস আমার সমস্যাটা। তোর মাকে আমার বাড়িতে রাখতে পারলে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করিস। তুই বরং রজত বা কমলের সঙ্গে কথা বল। রজতের বড় বাড়ি, আর্থিক অবস্থাও ভালো। ওদের বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। ওখানে তোর মায়ের দেখাশোনার কোনও অসুবিধা হবে না। তাছাড়া রজত একটা লোভী ছেলে। ওকে টাকার লোভ দেখালে রাজি হয়ে যাবে।"
শ্যাম বুঝতে পারে সুজনের সমস্যাটা। সত্যিই সুজনের পক্ষে দীর্ঘদিন শ্যামের মাকে দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। অতএব রজতের কথাই ভাবতে হবে। তাছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কমলের কথা শ্যাম ভাবছেই না, কারণ কমল বেশ গরীব মানুষ। থাকে অজ পাড়াগাঁয়ে। সেখানের রাস্তা ঘাট ভালো নয়। ভালো ডাক্তার, ভালো হসপিটালেরও অভাব। মাঝরাতে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য তিন কিলোমিটার দুরে সরকারি হসপিটালে যেতে হয়। তাছাড়া গরীবদের সততা নিয়েও শ্যামের মনে সন্দেহ আছে। সে কমলকে অনেক টাকা দিলেও, সেই টাকা যে তার মায়ের প্রয়োজনেই খরচ করা হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
সুজনের বাড়ি থেকে ফিরে শ্যাম রজতকে ফোন করে। তার মাকে নিয়ে একটা চাপা টেনশনে মধ্যে রয়েছে সে। যদি তার মা আমেরিকায় যেতে রাজি হতেন তাহলে কোনও সমস্যাই থাকত না। কিন্তু শ্যামের মা এই বয়সে বিদেশ বিভুঁইতে গিয়ে থাকতে কোনও মতেই রাজি নন।
কোনও রকম ভুমিকা ছাড়াই সে রজতকে বলে, "বাবা মারা যাওয়ার পর মা একদম একা হয়ে গেছেন। জানিসতো, এই বয়সে একা থাকা কত কঠিন! আয়া বা কাজের লোকেদের উপর খুব বেশি ভরসা করা যায় না। আর আমাদের এতবড় বাড়িটা মায়ের একার পক্ষে মেনটেন করা কোনও মতেই সম্ভব নয়। সেইজন্য আমাদের বাড়িটা নিয়ে প্রোমোটারদের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। কারণ পুরানো বাড়ি, কোথাও কোথাও ভেঙে পড়ছে। থাকার কেউ নেই, দেখাশোনা করার কেউ নেই, তাই রেখেও লাভ নেই। এখন তুই যদি আমাকে একটু সাহায্য করিস, মানে আমার মাকে তোর কাছে রাখিস তাহলে আমার খুব উপকার হয়। মায়ের খরচ খরচা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। বাড়িটা প্রোমোটিংয়ে দিয়ে একটা বেশ বড় অঙ্কের টাকা পাব। তার থেকে চল্লিশ লাখ টাকা আমি মায়ের নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেব। সেই টাকার সুদে মায়ের ভালোভাবেই চলে যাবে।
- "হয়তো চলে যাবে। তোর মাকে আমার বাড়িতে রাখতে আমার কোনও অসুবিধা নেই। তবে বয়স্ক মানুষ, যখন তখন অসুখ বিসুখ হতেই পারে। আর অসুস্থ হয়ে একবার নার্সিং হোমে ঢুকলে কয়েক লাখ টাকার ধাক্কা। তাই বলছি চল্লিশ লাখে কি হবে! অন্তত ষাট লাখ টাকা তোর মায়ের নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দে। আর আমাকে নমিনি করে দে। আর তুই তো নিয়মিত আমেরিকা থেকে ভারতে আসতে পারবি না, যখন তোর মা মারা যাবে, আমি নমিনি থাকলে ব্যাঙ্কে কোনও জটিলতার সৃষ্টি হবে না। টাকাটাও নষ্ট হবে না। তোর পকেটে এখন লাখ লাখ ডলার আছে। আমাকে সামান্য কয়েক লাখ টাকা দিলে তোর খুব একটা ক্ষতি হবে না।"
রজতের কথাগুলো শ্যামের ভালো লাগে না। শ্যাম ভাবে রজত খুব লোভী মানুষ। টাকার জন্য সে সব কিছু করতে পারে। হয়তো তার মাকে খুণ করে, তার দেওয়া টাকাগুলো হাতিয়ে নিতে পারে। কেউ কিছু করতে পারবে না। অতয়েব রজতের কথা ভেবে লাভ নেই।
খুব দুশ্চিন্তার পড়ে যায় শ্যাম। এবার সে কি করবে? কিছুই তার মাথায় আসছে না। তবে কি শেষ পর্যন্ত কমলের সঙ্গে কথা বলে দেখবে? কমল খুবই গরীব, সে কি পারবে শ্যামের মায়ের দায়িত্ব নিতে? একজন বাইরের লোকের দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতা কি গরীব কমলের আছে? কিন্তু আর কোনও পথওতো নেই! কমলই শেষ ভরষা। কিন্তু কমলও যদি রাজি না হয়, তাহলে খুবই সমস্যায় পড়তে হবে শ্যামকে।
কলকাতা ছাড়িয়ে, বেশ দুরে, প্রত্যন্ত গ্রামে কমলের বাড়ি। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে দেড় ঘণ্টার পথ। আশা নিরাশায় দুলতে দুলতে শ্যাম বেরিয়ে পড়ে কমলের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় আরও কিছুদুর যেতে হয়। গ্রামের মধ্যে দিয়ে মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলেছে রিকশা। রাস্তার দুপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আম, জাম, বট, অশ্বত্থ, নিম, কাঁঠালের দল। দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে চলেছে শ্যাম। মনোমুগ্ধকর সবুজের সমারোহকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে সে। রাস্তার ধারে কিছু টিন এবং টালির চালের অনুচ্চ বাড়ি চোখে পড়ছে। দুর থেকেই বোঝা যায় বাড়িগুলোতে দারিদ্রতার ছাপ প্রকট। কোথাও কোথাও বাচ্চারা রাস্তা জুড়ে ছোটাছুটি করছে। পুকুর ঘাটে স্নানরতা লজ্জাশীলা মহিলারা চলমান রিকশা দেখে আরও টেনে নিচ্ছে তাদের ঘোমটা। তারপর ঘোমটার আড়াল থেকে অনাবিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্যুট বুট পরা রিকশা আরোহী সহুরে বাবুটির দিকে। এই সলজ্জ দৃষ্টির মধ্যে এক কমনীয় সৌন্দর্যের সন্ধান পায় শ্যাম। যে সৌন্দর্য পশ্চিমী দুনিয়ায় বড়ই বিরল।
রিকশা এসে থামে কমলের বাড়ির সামনে। একতলা পাকা বাড়ি, পাকা ছাদ। সামনে বাঁশের বেড়ায় ঘেরা ছোটো একটা বাগান। শ্যামের থেকে আট বছরের ছোটো কমল। বাবা, মা, স্ত্রী এবং এক ছেলেকে নিয়ে কমলের সংসার। রিকশা থেকে নামতে নামতে শ্যাম দেখে, পরিবারের পাঁচজনই হাসি মুখে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। রিকশাটাকে থামতে দেখেই কমলের ছেলে কিছুটা ছুটে এসে আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। হয়তো অচেনা মুখ দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছে। তারপর বাড়ির বড়দের এগিয়ে আসতে দেখে সেও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে শ্যামের দিকে। শ্যাম তার গাল টিপে আদর করে। তারপর তার মাসি, মেসোমশাই অর্থাৎ কমলের বাবা মাকে প্রণাম করে। বোঝা গেল শ্যাম পশ্চিমী ধারায় অভ্যস্থ হলেও, পুর্বের সংস্কৃতিকে পুরোপুরি ভুলে যায়নি সে। কমলও এগিয়ে এসে প্রণাম করে শ্যামকে। কমলের পিছু পিছু এক গলা ঘোমটা মাথায় কমলের স্ত্রীও এগিয়ে এসে প্রণাম করে শ্যামকে। আদর্শ গ্রাম্য বধূর প্রতিচ্ছবি কমলের স্ত্রীর মধ্যে বিদ্যমান। শ্যাম ভাবে এই লজ্জাইতো নারীর ভূষণ, নারীর অলঙ্কার, নারীর অহঙ্কার। এখানেইতো তফাত পশ্চিমের সঙ্গে পুবের।
সাদর আপ্যায়ণ করে সকলে শ্যামকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায়। মাঝারি মাপের ঘর, তারমধ্যে খুব সাধারণ মানের কিছু ফার্নিচার পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। ঘর জুড়ে একটা মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। এখানে তার মাকে থাকতে হবে! ভাবতে গিয়ে একটু যেন বিষন্ন হয়ে ওঠে শ্যাম।
সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ে মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল শ্যামের। ট্রেনে আসার সময়েও শরীর জুড়ে একটা অস্থিরতা টের পাচ্ছিল সে। এরমধ্যে মাথার যন্ত্রনাটাও বেড়েছে।বেড়েছে শরীরের তাপমাত্রা। শ্যাম অনুভব করছে তার জ্বর আসছে। কথাটা বলতেই কমল শ্যামের কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখে সত্যিই জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শ্যাম।
শুরু হয়ে যায় হৈচৈ। কমলের হাঁক ডাকে কয়েকজন প্রতিবেশী এসে হাজির হয়। এবার শ্যামকে নিয়ে যেতে হবে কোনও ডাক্তারখানায়। তাকে সুস্থ করার জন্য অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন। কমলের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনজন প্রতিবেশী তাদের মোটর বাইক নিয়ে হাজির হয়। আরও বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী এসে ভিড় করে কমলের বাড়িতে। বেশি দেরি না করে ডাক্তারখানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কমলরা। একটা মোটর বাইকের চালকের পেছনে বসে শ্যাম। শ্যামকে ধরে তার পেছনে বসে কমল। আরও দুটো মোটর বাইকে চারজন প্রতিবেশী চলে পেছনে পেছনে।
দুকিলো মিটার দুরের এক ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয় শ্যামকে। চিকিৎসা হয়। ডাক্তারের বাবু অভয় দিয়ে বলেন যে ভয়ের কিছু নেই। সাধারণ ভাইরাল ফিভার। তবে বুক কফ জমে আছে, সেইসঙ্গে রয়েছে ইনফেকশন। তাই সম্পুর্ণ সুস্থ হতে চার পাঁচ দিন সময় লাগবে।
ডাক্তার দেখিয়ে কমলরা যখন বাড়ি ফেরে শ্যাম তখন জ্বরে প্রায় বেঁহুশ। ডাক্তার বাবুর নির্দেশ অনুযায়ী শ্যামের সেবা শুশ্রুষা শুরু হয়। সময় মত ওষুধ খাওয়ানো, কপালে জলপট্টি দেওয়া, যাবতীয় সেবার দায়িত্ব ঘুমনিদ্রা ত্যাগ করে একার হাতে সামলাতে থাকে কমলের স্ত্রী। পাড়া প্রতিবেশীরাও নিয়মিত যাতায়াত করছে, খোঁজ খবর নিচ্ছে। সব সময়ে বাড়িতে লোকজনের ভিড়। উদ্বিগ্ন মানুষগুলো চাইছে শ্যাম যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে।
কমলের স্ত্রীর অক্লান্ত সেবায় ধিরে ধিরে সুস্থ হয়ে ওঠে শ্যাম। আমেরিকাতেও কয়েকবার অসুস্থ হয়েছিল সে। হসপিটালেও ভর্তি হতে হয়েছিল। সুস্থও হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই নিঃস্বার্থ, মমতা মাখানো আন্তরিক সেবা সে ঐ উন্নত দেশে পেয়েছিল বলে মনে করতে পারছে না! এমনকি তার বিদেশিনী স্ত্রীর কাছেও এই আন্তরিকতা সে পায়নি, যেটা সে পেল কমলের স্ত্রীর কাছে। কেবল তাই নয়, কমলের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যে আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতা সে পেয়েছে, সেটা তার কাছে অভাবনীয় মনে হয়েছে।
সুস্থ শ্যাম ভাবছে তার মাকে তার থেকে দুরে কোথাও যদি রাখতে হয়, তাহলে কমলের বাড়ির থেকে ভালো জায়গা আর কোথাও নেই। কারণ একমাত্র কমলের কাছে, বিশেষ করে কমলের স্ত্রীর হেফাজতে রেখে সে নিশ্চিন্ত মনে আমেরিকায় ফিরতে পারবে।
নেই নেই নেই। অনেক কিছুই নেই এই অজ গ্রামে। অর্থ নেই, বৈভব নেই, উন্নত চিকিৎসা নেই, আরও অনেক কিছুই নেই এখানে। নেই শিক্ষা, নেই রুচিশীলতা। কিন্তু যে আন্তরিকতা, যে সহমর্মিতা, পর কে আপন করে নেওয়ার সে শুভ ইচ্ছা এই গ্রামের মানুষদের মধ্যে সে দেখেছে সেটা অন্যত্র বড়ই বিরল। শ্যাম অনুধাবন করতে পেরেছে, অর্থ, বিত্ত, বৈভবে নয়, মানুষের পরম সুখের ঠিকানা অন্যত্র। যে সুখ অতি আধুনিক উন্নত সমাজে সে খুঁজে পায়নি। সেই সুখ লুকিয়ে আছে এই অশিক্ষিত, গ্রাম্য, চাষাড়ে মানুষগুলোর মধ্যে। শ্যাম ভাবে যদি কোনও দিন আমেরিকা ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে এদেশে ফিরে আসার সৌভাগ্য তার হয় তাহলে কোনও ঝাঁ চকচকে সহরে নয়, সে বসত করবে এই অজ গাঁয়ে।
।। সমাপ্ত ।।
দেবাংশু সরকার,
ঠিকানা - 34/10/A,M.G. ROAD,
BUDGE BUDGE,
KOLKATA - 700137.