মুক্তগদ্য ।। সংকটের দিশারী কাজী নজরুল ।। পাভেল আমান
0
জুন ০১, ২০২৫
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
সংকটের দিশারী কাজী নজরুল
পাভেল আমান
জন্মের ১২৬ বছর পরেও বাঙালি মানসে তিনি এখনো তার কালজয়ী সৃষ্টিশীলতার মাঝে বিদ্রোহী সত্তা মানবতাবাদ সাম্য চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনাকে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে চরমভাবে বিরাজিত। সম্প্রীতিকে মনেপ্রাণে লালন করে শোষণ বৈষম্য লাঞ্ছনাহীন সমাজ গড়তে সারা জীবন বাজি রেখেছিলেন। নানা ঘাত প্রতিঘাত লড়াই সংগ্রাম দগ্ধতা যাতনায় মোড়া নজরুল যেন হয়ে উঠেছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিসত্তায় জারিত রক্ত মাংসে গড়া মানবতার মূর্ত প্রতীক। নজরুল মানুষের কবি। তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে মানবতার সুর। মানবতার প্রতি অভ্রান্ত বিশ্বাসে তিনি কাব্য সাধনায় নিয়োজিত হয়েছেন। মানুষের ব্যথা ও বেদনা তাঁকে গভীরভাবে অভিভূত করে। তাই মানুষকে নির্যাতিত ও অপমানিত হতে দেখে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে বলে তাঁর বিশ্বাস। তাঁর মতে, "মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।" সমাজে যারা নির্র্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, অবহেলিত তারা তাঁর কবিচিত্তকে আকৃষ্ট করেছে। কুলি, মজুর শ্রমিক, জেলে, চাষী তাঁর মধ্যে গভীর দরদের সঞ্চার করেছে, তিনি গভীর মমত্বে ও আশ্চর্য দরদে তাদের ছবি এঁকেছেন কাব্যে। কবির ভেতর যে প্রধান গুণগুলো দেখা যায় সাম্যবাদী অসাম্প্রদায়িক; নারী মুক্তির আহবায়ক ও বিদ্রোহী- এসবের মূলে রয়েছে তাঁর মানবতাবাদী বেদনা।নজরুলের অসংখ্য কবিতা আসলে প্রেরণার বীজমন্ত্র। হৃদয়ে আওড়ালেই শক্তি আসে। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বাংলার হিন্দু মুসলমানের পক্ষ থেকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মনুষ্যত্বের সত্যকে তুলে ধরতে গিয়ে নজরুল হিন্দু মুসলমানের ঐক্য কামনা করে বলেছেন, 'কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি শুধুমাত্র হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।' কবি ছিলেন একজন নিখাদ প্রেমিক। তিনিই বলেছেন, মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ তূর্য। কবিতায় তিনি কখনো সমাজের প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আবার কখনো প্রেম ছড়িয়েছেন। প্রেম তো যুগে যুগে প্রবহমান ধারা। সেখানেও তার মন্ত্র প্রবহমান। আজ আমাদের এই উপমহাদেশেই শুধু নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেড়ে গেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ। বেড়েছে ধর্মীয় সংকীর্ণতা। নিজের নিজের ধর্মরক্ষার অজুহাতে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বাড়ছে আক্রমণ। এসময় নজরুলের এই পঙ্ক্তিগুলো তীব্রভাবে উচ্চারণ করা প্রয়োজন- 'হায় রে ভজনালয়,/তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!/মানুষেরে ঘৃণা করি/ও যারা কোরআন বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!/ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,/যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!- মূর্খরা সব শোনো,/মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!' ব্রিটিশ শাসনকালের তুলনায় এখন ধর্মীয় সন্ত্রাস আরও অনেক বেশি বেড়েছে।কবি যে বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সমাজ প্রতিষ্ঠায় আজও সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যতদিন সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন কবির স্বপ্ন পূর্ণ হবে না। আর কবিও তত বেশি প্রাসঙ্গিক থাকবেন। পরিশেষে আমরা এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে একদিকে ধর্মীয় বিদ্বেষ বিভাজন অস্থিরতা অসহিষ্ণুতা উগ্র জাতীয়তাবাদ ঠিক সেই মুহূর্তেই মনুষ্যত্বের চেতনাকে জাগ্রত করে আমাদের আরো বেশি একে অপরকে বেঁধে বেধে থাকতে হবে। কবির জন্মদিনে শুধুমাত্র প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে তার সম্পর্কে গালভরা কথা বলেই তাকে স্মরণ করা হয় না যতক্ষণ না আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তার চিন্তাভাবনা আদর্শকে মেনে চলতে পারছি। আসুন আমরা প্রত্যেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মানবতার চেতনা অসাম্প্রদায়িক ভাবনাকে লালন করে তার সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরে দেখানো পথেই এগিয়ে চলি এখানেই আমাদের উত্তরণের অভিমুখ।
===================
পাভেল আমান
হরিহরপাড়া
মুর্শিদাবাদ