Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। চাবি ( পরিচ্ছেদ - ২ ) ।। সপ্তদ্বীপা অধিকারী

 

 চাবি 

সপ্তদ্বীপা অধিকারী 

 
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

প্রেম


বেডরুম দুটো দুটোই পাশাপাশি পশ্চিমদিকে লাগোয়া ব্যালকনি দুটো বেডরুমের মাঝে দরজা আছে ইচ্ছে করলে বন্ধ  করা যায় সেই দরজা ইচ্ছে না করলে খোলাও রাখা যায় কিন্তু ব্যালকনির মাঝখানে কোনো ভাগ নেই একদম টানা অনেকটা জায়গা নিয়ে গ্রিল  লাগানো ইচ্ছে হলেই সেটা খুলে অস্তগামী সূর্যের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে যা ত্রিপর্ণার ভীষণ ভাল্লাগে মেঝেতে কৃত্রিম ঘাসের আস্তরণ এমনকি দেওয়ালেও দুই পাশে দুটো জুটের তৈরি দোলনা সিলিং এর সাথে লোহার হুক দিয়ে ঝোলানো মাঝখানেও দুটো বড়ো বড়ো লোহার হুক অর্থাৎ ইচ্ছে করলে ওরা দুই কপোতকপোতী পাশাপাশি দোলনায় দুলতেও পারবে ত্রিপর্ণা যত দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে অমল তাকে এতোটাই গুরুত্ব দেয়! ত্রিপর্ণা ভাবতেও পারে নি অথচ এই ফ্ল্যাট তৈরির শুরু থেকেই তার অনেক যন্ত্রণা ছিল অমলেশকে সে যতবারই বলতে গেছে কেমন করে ফ্ল্যাট সাজাবে, কী কী আসবাবপত্র রাখবে অমলেশ তার কথা পাত্তাই দেয় নি গম্ভীরভাবে বলেছে--"আমার উপর বিশ্বাস নেই? কী মনেহয় আমি পারব না,না?"

প্রথম প্রথম ত্রিপর্ণা বুঝিয়েছে --"দেখো, প্রতিটা মানুষের আলাদা আলাদা ভালোলাগা, আলাদা পছন্দ আর বাড়ি মানুষ বারবার করে না এই একবারই তো করছি সমস্ত অর্থ ব্যয় করে, যেখানে যা ছিল সব বিক্রয় করে এই বাড়ি বানাচ্ছি তো আমার মতামতের মূল্য নেই? "

অমলেশও তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছে তবে অতি সংক্ষেপেশেষের দিকে তো ত্রিপর্ণা রাগারাগিও করেছে কিন্তু অমলেশ মানে তাঁর অমলকে সে এক বিন্দুও তার কোনো কথা শোনাতে পারে  নি ত্রিপর্ণা ভেবেই রেখেছিল যে যেদিন ওকে অমলেশ বাড়ি দেখাতে আনবে সেইদিন সে পরিষ্কার বলে দেবে বলবে --"আমি এই বাড়িতে থাকব না! তখন পই পই করে বলেছিলাম শোনো নি আমার কথা! আমার এই খাট পছন্দ নয় - আলমারি একদম ভাল্লাগে না! বাথরুমের শাওয়ারের জলের তোড় থাকবে না কিন্তু জোর থাকবে জানালা আরো বড়ো লাগত" ইত্যাদি

যেদিন অমলেশ বলেছে --"কাল তোমাকে নিয়ে যাব ফ্ল্যাট দেখাতে সক্কাল সক্কালই যাব" সেই মুহূর্ত থেকে ত্রিপর্ণা রাগে ফুসছে অপেক্ষা করেছে ফ্ল্যাটে ঢোকবার মুহূর্তটা আসুকভেবেছে মনে মনে কিন্তু ব্যাপারটা যে এভাবে উলটে যাবে তা সে কল্পনাতেও আনেনি ঘরের রঙও ত্রিপর্ণার দারুণ ভাল্লেগেছে সে এইরকম মিষ্টি আবছা আকাশি রঙ দারুণ পছন্দ করে

দুটো বেডরুমে দুরকম রঙের আসবাবপত্র একটাতে পুরো সাদা সাদা মানে একদম দুধ সাদা খাট দুধ সাদা আলমারি দুধ সাদা ড্রেসিং টেবিল দুধ সাদা ছোট্ট দুটো টুল রয়েছে বেডরুমে সেগুলোও দুধ-সাদাবিছানার পালঙ্ক দুধ-সাদা তার উপর দুধ সাদা রঙের চাদর পরিপাটি করে পাতা চাদরের  উপর সুন্দর কাজ করা তাও দুধ সাদা মাথার কাছে একটা জল-চৌকি সেটাও দুধ-সাদা টেবিল ক্লথও তাই দুটো সাদা গ্লাস গ্লাস দুটোতে সুন্দর কারুকাজ গ্লাসের উপরে যে হাল্কা,পাতলা ঢাকা দেওয়া রয়েছে তাও দুধ সাদা

অন্য রুমটাতে সবই খয়েরি গাঢ় খয়েরি খাট থেকে শুরু করে যেখানে যা কিছু আছে সবই খয়েরি

ত্রিপর্ণা বারবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছে টাকা-পয়সা যোগাড় করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তাদের দুজনকেই দুজনেরই শ্বশুরবাড়ি গ্রামে সেই সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে অনেক মিথ্যে নাটকের আশ্রয় নিতে হয়েছে অনেক ঘুষ দিতে হয়েছে সেই সব যন্ত্রণার কথা ভুলে গেল ত্রিপর্ণা

অমলেশ ত্রিপর্ণার হাত ধরে এবার ছাদে নিয়ে চলল ত্রিপর্ণা প্রথমে ভেবেছিল, ছাদে হয়ত অমলেশ অন্য কোনো গাছ লাগিয়েছে ত্রিপর্ণার স্বপ্ন টবে গাছ লাগানো

ছাদে এসে সে দেখে যে তারা একটা জঙ্গলে প্রবেশ  করল চারিদিকে গাছ! টবে এত্তো সুন্দর সুন্দর  গাছ,  গাছে গাছে ফুল!

ব্যালকনিতে অর্ধেক উঁচু করে পাঁচিল তোলা সেই পাঁচিলের উপরের অংশে বড়ো বড়ো ছিদ্র অর্থাৎ ফাঁপা পাঁচিল ভিতরে মাটি দেওয়া স্বাভাবিক রোদ এবং বৃষ্টি পাওয়ায় কী অসাধারণ সব ফুলের গাছ হয়েছে! আর গাছে গাছে ফুল ভর্তিটগর,জুঁই,হাস্নুহেনা,রজনীগন্ধা এবং তার অত্যন্ত পছন্দের কামিনী কামিনী গাছ দুটো দুই কোনায় গাছ গুলো নিয়মিত পরিচর্যা হয় একদম সাদা সাদা ফুলে ভর্তি প্রতিটা গাছ প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে এই বাংলো বাড়িটা বানিয়েছে অমলেশ ত্রিপর্ণা ফুলের গায়ে হাত বোলায়, চুমু খায়! তার আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ বলে --"আচ্ছা,বাথরুম কোথায়?" অমলেশ ইশারা করে ত্রিপর্ণা ছুট্টে যায় অমলেশের ইশারা অনুসরণ করে যেতে যেতে ভাবে এবার অমলেশ নির্ঘাত হেরে যাবে কারণ এই বাথরুম নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা ছিল অমলেশের পক্ষে তা জানা অসম্ভব! সে বাথরুম-লাগোয়া একটা রুম চেয়েছিল যেখানে সে ফেসিয়াল,স্পা,ম্যানিকিওর,প্যাডিকিওর ইত্যাদি করবে ত্রিপর্ণা ঢুকেই দেখে কোথায় বাথরুম! তো বিশাল একটা বিউটি পার্লার! দুই সিটের ব্যক্তিগত পার্লারই করে দিয়েছে তার অমলেশ তার জন্য ত্রিপর্ণা অমলেশের দিকে চাইল একবার ভীষণ ইচ্ছে করছে তার তখন অমলের কাছে যেতে অনেক কষ্টে সে নিজেকে দমন করল কিন্তু অমলের বুঝতে কিছুই বাকি থাকল না ত্রিপর্ণা  ভিতরের হাতল ঘুরিয়ে একটা দরজা খুলল ভিতরেই বাথরুম! তার মনের মতোই শাওয়ার, বাথটাব ইত্যাদি পরিষ্কার ঝকঝকে সে কলের মুখ ঘোরালো জল পড়বে বেগে কিন্তু যেই জলের চাপ থাকবে না ঝর্নার মতো হালকা পাতলা রেশমি জলের ধারা থাকবে শরীরে প্রেমিকের আদরের মতো ঝরে পড়বে জল একটুও চাপ লাগবে না অথচ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আপাদমস্তক! ত্রিপর্ণা বেশ খানিকক্ষণ শাওয়ারের জলের ধারার তলায় হাত পেতে পরখ করল! বাইরে থেকে অমলেশ নক করল--"কী গো,এখনো তো তোমার কিচেনই দেখলে না?" ত্রিপর্ণা চমকে উঠল ঠিক ঠিক আসল তো কিচেন সে বেরিয়ে এল

কিচেনে ঢুকেই সে সত্যি সত্যি অবাক হয়ে গেল! যা ভেবেছিল একদম তাই করেছে অমলেশ সে কিচেনটাকে একদম অত্যাধুনিক করতে চেয়েছিল কোত্থাও কোনো হাঁড়ি-কড়াই-বাসন চোখে দেখা যাবে না এমন কি দেখা যাবে না কোনো  কৌটোও সমস্তটাই থাকবে কাঠের পাটাতনের আড়ালে দেখল সে তাকিয়ে তাকিয়ে সত্যিই বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে এটা রান্নাঘর আয়তনে প্রায় পাঁচশত স্কয়ারফিটের রান্নাঘরের পুরো দেওয়ালই কাঠের বক্স দিয়ে মোড়া যা কিছু সরঞ্জাম সমস্তই ভিতরে বাইরে সিমেণ্টের স্ল্যাবের উপর কৃত্রিম ফুলের টবতাতে বড়ো বড়ো সবুজ পাতায় নানারঙের ফুল মৃদু মধুর সুগন্ধে মনে হতেই পারে যে এটা পুজোর ঘর ত্রিপর্ণার পক্ষে আর ধৈর্য ধরা অসম্ভব মনে হচ্ছে সে তার অমলের কাছে যেতে চাইছে ভীষণভাবে ভালোবাসায় বুক ভরে উঠেছে তার সে বুঝতে পারছে যে অমলেশ তাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে এই যে সব আর্থিক সচ্ছলতা বা বৈভব এর পিছনে তার প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে এভাবে সাজাতে পারত না অমলেশ তাকে একটাও কথা জিজ্ঞাসা না করেও কীভাবে পারল এভাবে সাজাতে! হঠাৎ পিছন ফিরেই ত্রিপর্ণা অমলেশকে জড়িয়ে ধরল অমলেশ হাসতে লাগল মিটিমিটি ত্রিপর্ণা বলল--"কী করে জানলে আমার পছন্দ? এতো খুঁটিনাটি? "

অমলেশ বলল--"আসলে আমি সত্যিই জানতাম না সেদিন "সুমনের সাথে একঘণ্টা" অনুষ্ঠানে বলল তো! সেই থেকেই তো আমি জানি!"

ত্রিপর্ণা হেসে ফেলল

তারপর কী মনে করে বলল--"তোমার-আমার সম্বন্ধ জন্ম-জন্মান্তরের!"

অমলেশ বলল--"তুমি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করো?"

ত্রিপর্ণা বলল--"অবিশ্বাসই বা করি কী করে? শিল্পে-সাহিত্যে-কল্পনায় এবং ভালোবাসায় যার এমন নিশ্চিন্তের অবস্থান, তাকে অস্বীকার করি কেমন করে?"

অমলেশ বলল--"সব বুঝলাম কিন্তু কল্পনাটা বুঝলাম না যে!"

ত্রিপর্ণা গভীর থেকে বেরিয়ে এল--"তোমাকে ভালোবাসি! খুব ভালোবাসি! তোমাকে ছাড়া জন্মান্তরেও অন্যকে গ্রহণ করার চিন্তা যে পীড়া দেয়,অমল!"

অমলেশ ত্রিপর্ণার মুখটা তুলে ধরল

তারপর অবাক হয়ে বলল--"একী? তোমার চোখে জল কেন পর্ণা? কাঁদছো? কিন্তু কেন?"

ত্রিপর্ণা বলল--"বুক পরিপূর্ণ হলে যে চোখও ভরে যায় অমল!"

অমল ত্রিপর্ণার মুখ-চুম্বন করে বলল--"চোখ বন্ধ করো "

ত্রিপর্ণা বলল--"কী?"

অমলেশ বলল--"বলছি চোখটা বন্ধ করো!"

ত্রিপর্ণা বলল--"কেন গো? আরো কিছু  দিতে বাকি আছে বুঝি?"

অমলেশ  বলল--"বন্ধ করো না!"

ত্রিপর্ণা  চোখ দুটো বন্ধ করল

অমলেশ ত্রিপর্ণার ডান হাতটা ধরে বলল--"হাতটা পাতো!"

ঠিক সেই সময়  ঘটল ঘটনাটা ছাদের গাছে এক দলা অচেনা অন্ধকার উড়ে এসে বসল আর

ত্রিপর্ণা  বন্ধ চোখে অল্প হেসে হাত পাতল

সেই অচেনা অন্ধকারের শরীর অনেক রক্ত আর হাহাকার দিয়ে তৈরি ত্রিপর্ণা

 টের পেল তার অমল তার করতল চুম্বন করল

হাহাকার আর রক্ত দিয়ে তৈরি অন্ধকারের দলাটা  একটা গাছ থেকে অন্য একটা গাছে উড়ে এল আর অদ্ভুতভাবে তার শরীরের অন্ধকার আয়তনে বেড়ে গেল

ত্রিপর্ণা টের পেল তার  করতলের উপর তার স্বপ্ন, তার আশা, তার সাধনা, তার ইচ্ছে, তার খুশি তার অমল  তার নিজের  পরিপূর্ণটুকু তুলে দিয়েছে!

ঠিক সেই সময় ছাদের অন্ধকারের দলাটা  বিশ্রী শব্দ করে ডেকে উঠল আর একই সঙ্গে

ত্রিপর্ণা হাসতে হাসতে বলল--"মুঠো খুলি?

 

ত্রিপর্ণা আর অমলেশের জীবনে এখন অমরাবতীর সুখ বিরাজ করছে গত সাতদিন ধরে ওরা প্রায় সর্বক্ষণ কাছে কাছে থাকছে তাদের যোগ্যতার বাইরে গিয়েও এই বিশাল ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখা এবং তার বাস্তবায়নে উভয়ে উভয়ের কাছে চরম আদরণীয় হয়ে উঠেছে সেদিন অমলেশ যখন ত্রিপর্ণার হাতে  ফ্ল্যাটের চাবি দিয়েছিল এবং ত্রিপর্ণা বন্ধ চোখ মুঠো খুলে তা দেখেছিল খুশিতে লাফিয়ে উঠে অমলেশকে জড়িয়ে ধরেছিল অমলেশের দানের কাছে তার ভালোবাসা নতজানু হয়েছিল কারণ এই দানের প্রতিটি পরত ছিল মোলায়েম ভালোবাসায় মোড়া অমলেশ তখনো ত্রিপর্ণাকে তার সমস্তটুক দেখায় নি সে অপেক্ষা করেছিল এই অপেক্ষা ছিল তার কাছে আসলে ত্রিপর্ণার ভালোবাসা আবিষ্কারের এক গহিন নেশা আসলে সে ত্রিপর্ণার ভালোবাসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ভালোবাসা সবসময়ই অন্ধ আর সেই অন্ধ ভালোবাসা যদি ব্যক্তিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়, তাহলেই হয়ত এমন একখানা বাংলো করার স্বপ্ন দেখা যায় এবং তা বাস্তবায়িতও করা যায় সেদিন সকালে তখন সাড়ে ছয়টা মতো বাজে ত্রিপর্ণা তখনো শুয়ে অমলেশের বুকের উপর ত্রিপর্ণার ফর্সা নরম হাত যেন কতোই না ঘুমাচ্ছে অমলেশ টের পায় ত্রিপর্ণার ঘুম আর ঘুমের ভান সে চেনে সেও কিচ্ছু বলে না জেগে জেগে দুজনেই ঘুমিয়ে থাকার নাটক করে ত্রিপর্ণার একান্ত কামনা অমলেশ জেগে ওকে ডাকুক একটু নিরামিষ আদরও  তো করতে পারে কিন্তু অমলেশ তো ঘুমাচ্ছে ঘুমন্ত মানুষ কেমন করে আদর করবে? অমলেশ মনে মনে সব বোঝে আর মুচকি মুচকি হাসে যখন সাতটা বেজে গেছে ত্রিপর্ণা আর পারল না আড়ামোড়া ভেঙে নিজেই নিজের ঘুম ভাঙাল তারপর চোখ না খুলেই বলল--"অমল... অমল...!"

অমলেশকে ত্রিপর্ণা অমল বলে সে বলুক অমল বলুক, বলুক অথবা মলও বলতে পারে কথা সেটা নয় কথা হলো এইটাই যে, ত্রিপর্ণা মানে তার পর্ণা তাকে অমল বলে ডাকলেই আর ওর মধ্যে থাকে না! এইটা যে কীভাবে সম্ভব, ভেবে পায় না অমলেশ ভীষণ ইচ্ছে করছে ত্রিপর্ণাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে কিন্তু তবুও সে দূরেই থাকল চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে রইল তো পড়েই রইল ত্রিপর্ণা ঘড়ির দিকে চেয়েই ঝট করে উঠে পড়ে কী দ্রুত যে সে রেডি হল তা সে

কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না বেরবার সময় ডাকল--"কিগো অমল! ওঠো আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে চললাম" অমলেশও আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে  চাইল "ইসসসস! আটটা বেজে গেছে!!" সেও বিছানা ছেড়ে নীচে নামল ততক্ষণে ত্রিপর্ণা ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে অমলেশের আটটায় বেরলেই হয় কিন্তু ত্রিপর্ণার সাতটাতেই বেরতে হয় ত্রিপর্ণা লেট করল বেরতে অমলেশ রান্না ঘরে গিয়ে দেখল ত্রিপর্ণা চাও করেনি খাওয়ার সময় পায় নিবানাবারও অমলেশেরও সময় হল না সেও রেডি হয়ে বের হল মনটা সারাদিন তার খচখচ করতে লাগল বেচারা ত্রিপর্ণা! অমলেশ দুপুরের দিকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করবে ভাবল কিন্তু তারপর যথারীতি ভুলে গুলে খেয়ে নিল ত্রিপর্ণা শত কাজের মধ্যেও ঠিক ফোন করল ফোনটা পেয়েই অমলেশের মনে পড়ল মনে পড়ল যে তারই ফোন করার ইচ্ছে ছিল! ত্রিপর্ণা বলল--"কী করছো?"

অমলেশের বলতে ইচ্ছে করছিল--"ভাবছি তোমাকে!" কিন্তু বলল--"এইতো অফিসে...! তুমি কী করছো?"

ত্রিপর্ণা বলল--"কী খেলে ব্রেকফাস্টে? লাঞ্চ করেছো?"

অমলেশ বলল--"শোনো না ফোনটা এখন রাখছি কেমন! একটু চাপে আছি...! পরে করছি তোমাকে"

ত্রিপর্ণা জানে অমলেশকে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয় সামনেই প্রোমোশানের একটা সুযোগ আসছে এবং এই ব্যাপারে সে অত্যন্ত সিরিয়াস সে তাই নিজেই ফোন কেটে দেয় অমলেশ মনে মনে হাসে তার কাজের চাপ আছে কথা তো ঠিকই কিন্তু স্ত্রীকে দুদণ্ড সময় দিতে পারবে না? তুমি কী করছ বা কী খেয়েছো বা কখন আসছ বাড়ি এইগুলো জিজ্ঞাসা তো করতেই পারত অমলেশ কিন্তু থাক সে ভাবে মনে মনে একটু বেশি করেই আগুন জ্বলুক দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে পুড়তে দারুণ লাগে বিয়ের পর কই সেইভাবে ত্রিপর্ণাকে সে কখনোই পায় নিম্যাট্রিমনিয়ালে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ে একদিকে রূপ-সৌন্দর্য আর  অন্যদিকেও যোগ্যতা আর  অর্থের সাথে বিয়ে সব কিছুকে অস্বীকার করে দুটো মানুষের কাছে আসার যে তীব্রতা তা তার আর ত্রিপর্ণার মধ্যে নেই যেভাবে পিয়া...! না না অমলেশ ওর কথা এক বিন্দুও ভাবতে চায় না শুধু সেই হঠাৎ করে পিয়া যেভাবে চেপে ধরেছিল অমলেশকে সেইটা অমলেশ ভুলতে পারে না মনেহয় জীবনেও  ভুলতে পারবে না সে পিয়াকে কখনোই ভালোবাসে নি পিয়াই তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে তো? অমলেশের কোনো দোষ নেই শুধু সেই যে আকর্ষণ, সেই যে নিবেদন, সেই যে বুকের সাথে চেপে ধরা, সেই যে হাহাকার করে কান্না...  অনুভূতির নিবিড়তায় একাকার হয়ে যাওয়া দুটো শরীর! এইটা মাঝে মাঝে মনে পড়ে! আর কিছু নয় অমলেশ চায় তার পর্ণাও তাকে ঠিক ওইভাবে জড়িয়ে ধরুক ওইভাবে ভালোবাসুক পিয়াকে যদি ভালোই বাসত, তাহলে পিয়াকেই

বিয়ে করত অমলেশ ভাবে মনে মনে পিয়ার থেকে ত্রিপর্ণা অনেক  বেশি সুন্দরী পিয়ার গায়ের রংটা বেশ চাপা লেখাপড়াতেও  ত্রিপর্ণা অনেক বেশি ভালো অনেক বেশি স্যালারি পায় সুতরাং পিয়াকে ভালোবাসার কোনো প্রশ্নই আসে না নিজের চিন্তাতে নিজেই হেসে ফেলে অমলেশ সে কি নিজেকেই নিজের যোদ্ধা ভাবছে না? কিংবা নিজের সাথেই নিজে লুকোচুরি খেলছে না? আরে না না এসব আসলে পর্ণাকে গভীরভাবে ভালোবাসার পরিণাম অমল ভাবে

অফিস থেকে ফিরছে অমলেশ আজও সে দেরি করে ফেলেছে গাড়িতে বসেই ত্রিপর্ণাকে ফোন করবে ভেবে ফোনটা হাতে তুলেছে সবে, আর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপর্ণার ফোন অমলেশ ফোনটা ধরেই বলল--"অনেকদিন বাঁচবে! ফোনটা নিয়ে তোমাকেই করতে যাচ্ছিলাম...! আর তখনি তুমিই ফোন করলে!" ত্রিপর্ণা হাসল

বলল-- "কখন আসছো?" অমলেশ বলল--"এইতো জাস্ট বেরলাম অফিস থেকে কিছু আনতে হবে?"

ত্রিপর্ণা বলল-- "না কিচ্ছু আনতে হবে না শুধু তুমি এলেই হবে!"

অমলেশ হাসল বাড়ি এসেই অমলেশ দেখে যে ত্রিপর্ণা গা ধুয়ে পরিপাটি করে ঘরটা গুছিয়েছে ঘরে কিছু একটা সুগন্ধী জ্বালিয়েছে খুব সুন্দর মিষ্টি একটা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা ঘরে অমলেশের পুরো ঘরে, ঘরের গন্ধের ভিতরে, জানালায়, দরজায়, সোফায়, ত্রিপর্ণার চোখের চাউনিতে,মুখের কথায়, অথবা না বলা কথায় সর্বত্র সে ত্রিপর্ণার অনুচ্চারিত ভালোবাসা দেখতে পায় মনে মনে সে খুব  উপভোগ করে দুই মিনিটের বিছানায় ব্যবহারে এই সমস্ত কিছু যেন নষ্ট হয়ে যায়! সৃষ্টিকর্তার কেমন সৃষ্টি! শরীর আর মন একে অপরের পরিপূরক অথচ এতো কেন বৈরিতা? মনের পরিপূর্ণতায় শরীরের আগমন নাকি শরীরের পরিপূর্ণতায় মনের নির্গমন? অমলেশ অনেক ভেবেছে আসলেই অনেক ভাবে কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারে না সেভাবে প্রেম-ট্রেম কখনো করা হয়ে ওঠেনি পড়াশোনার চাপে অন্য কিচ্ছু ভাবেও নি ভালো রেজাল্ট করতে হবে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এর বাইরে আর কিছু সে ভাবেওনি পড়াশুনা শেষ হতে না হতেই চাকরি এবং চাকরি হতে না হতেই মামা আর মামি মিলে ম্যাট্রিমনিয়ালে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্রী খোঁজা শুরু অনেক পাত্রীর মধ্য থেকে ত্রিপর্ণাকে নির্বাচন করা এবং নির্দিষ্ট করার পিছনে শুধু তার রূপ নয়, ওই বয়সে ত্রিপর্ণার স্যালারিটাও ঈর্ষা করারই মতো ত্রিপর্ণার সাথে যোগাযোগ হবার পর কথা বলতে শুরু করেছে তারা অনেক কথাই হয়েছে অনেক ছবি আদান-প্রদানও হয়েছে কিন্তু সত্যি কথা বলতে ভিতরে ভিতরে একটা অসম্ভব টান কোনোদিন সে অনুভব করেনি হ্যাঁ, বিয়ে করতে হবে তো করতে হবে সে হোমো বা গে নয় বিয়ে একটা মেয়েকেই করতে হবে  বেশ সুন্দরী মেয়েকে ত্রিপর্ণা একজন সুন্দরী মেয়ে ঠিক এইটুকুই ছিল তার অনুভূতি যদি ত্রিপর্ণার চাইতে আরো বেশি সুন্দরী এবং বেশি মাইনের পাত্রী পেতো যে কোনো মুহূর্তেই বিয়ে ভেঙে দিতে

দ্বিধা করত না অমলেশ অমলেশ ত্রিপর্ণার মতো যোগ্য তাই অন্য কাউকে মনে করে নি বিয়ের ঠিক হয়ে গেলে দেনা-পাওনার কথা বলতে একটু ইতস্তত করেছে অমলেশ কারণ আজকাল সব জায়গাতেই মেয়েদের পণ দেওয়া অপরাধ বলে গণ্য হয় অবশ্য ত্রিপর্ণা যা আয় করে তাতেই সারাজীবন সংসারের কাজে লাগবে তবুও ভেবেছিল অমলেশ বিয়ের ঠিকই  হয়ে গেছে তখন, কথাবার্তা বলছে দুজন ফোনে ভিডিও কলে উভয়েই উভয়ের পছন্দ-অপছন্দ শেয়ার করেছে ভাল্লেগেছে অমলেশের দেখা করেও ভালোই লাগল কিন্তু দেনা-পাওনার কথাটা কেমন করে বলবে বলে যখন ইতস্তত করছিল অমলেশ তখনই ত্রিপর্ণাই মুশকিল আসান করে দিল সে- বলল যে, ওর মাকে যেন আমাদের তরফ থেকে পণের টাকা, অন্যান্য দান-সামগ্রী এবং আত্মীয়দের সব্বাইকে প্রণামি  দেবার জন্য মোটা টাকা চাওয়া হয় শুনে অমলেশ পুলকিত হয়ে উঠেছিল এবং বুঝে গেছিল যে তারা একেবারেই রাজযোটক বিয়ের কার্ড ছাপার কাজ তখন কমপ্লিট, ঠিক সেই সময় পিয়া হঠাৎ একদিন ফোন করল

"কী রে, কী সব শুনছি! তোর নাকি বিয়ে!"

অমলেশ বলেছিল--"হ্যাঁ রেবিয়েটা করেই নিচ্ছি"

অবাক হয়ে পিয়া বলেছিল--"ইয়ার্কি মারিস নাতো!"

অমলেশ বলেছিল--"ইয়ার্কি কেন মারব? বিয়েটা কি ইয়ার্কি মারার জিনিস?"

আর কোনো জবাব দেয়নি পিয়া অমলেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল--" তুই আসিস কিন্তু দাঁড়া তোকে আমার হবু বউএর পিক পাঠাচ্ছি"

পিয়া লাইনটা কেটে দিয়েছিল আর অমলেশ পিয়ার হোয়াটসঅ্যাপে ত্রিপর্ণার ছবি পাঠিয়েছিল

এরপর প্রায় তিন-চার দিন পিয়া আর ফোন টোন করেনি অমলেশ ভেবেছিল সময়-টময় পাচ্ছে না হয়ত ত্রিপর্ণার ছবিটা সিন হয়েছিল যদিও

চারদিন বাদে পিয়া আবার ফোন করেছিল

"এই অমু,দেখা করবি একবার?"

অমলেশ বলেছিল--"এখন তো সময় হবে নারে! অফিস তারপর পর্ণার সাথে প্রায় দিনই দেখা করতেই হয়, তারপর ধর বিয়ের বিভিন্ন বাজার-টাজার...! কেন রে? বিশেষ কিছু?"

পিয়া কেমন করে যেন বলেছিল--"আর কোনোদিন বলব না আজও বলতাম নাকিন্তু মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে একবার দেখা করি একবারতোকে কিছু বলার আছে বেশি সময় নেব না এই ধর পাঁচ মিনিট...! কিংবা দুই মিনিটেও হয়ে যাবে আসবি?"

অমলেশ বলল--"আচ্ছা ঠিক আছে বলছিস যখন...! কিন্তু ফোনেই বললে ভালো হতো রে! সত্যি বলছি পিয়া, একদম সময় পাই না..!"

পিয়া বলেছিল--"দুই মিনিটের জন্য প্লিজ অমু!"

অমলেশ দেখা করেছিল কিন্তু দুই মিনিট নয় সেই দেখা করাটাই একটা আস্ত পৃথিবী হয়ে রয়ে যাবে সারাজীবন ওর চোখে অমলেশ আগে ঘুণাক্ষরেও বুঝত পারে নি

অমলেশ অফিস থেকেই সোজা গিয়েছিল সারা গায়ে ঘেমো গন্ধ জামার ক্রিজ নষ্ট হয়ে কুঁকড়ে মুকড়ে ছিল চুল গুলো হুড়োনাড়া...! অমলেশের কিছু মনেও হয় নি দেখা তো করবে পিয়ার সাথে ছোটোবেলার বন্ধু ক্লাস নাইন থেকে এক সঙ্গে পড়াশুনা করেছে গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে পার্কটাতে ঢুকেছিল অনেক দিনই পিয়া  আর এই পার্কে দেখা করেছে আড্ডা-ফাড্ডা মেরে ফুচকা খেয়ে চলে যেতঅমলেশ দেখল কথা দিয়েও পিয়া আসেনি ফোন করল রিং হয়েই গেল ধরল না কেউ ফোন অমল ভাবল যে সে একটু অপেক্ষা করেই যাবে দেরি হতেই পারে কিন্তু সেটা তো বলতেই পারত পিয়া এখনো ফোন ওঠাচ্ছে না! আশ্চর্য! দুই তিনবার ফোন করল অমল ফোন ধরল না পিয়া এবার অমলেশ হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করল--"কীরে,আসার কথা বলে এলি না ফোনটাও ধরছিস না..! আমি এসেছি তো!"

কোনো জবাব দিল না সিনও হচ্ছে না! অমল আরো একবার ফোন করল এবার লিখল--"আমি চলে যাচ্ছি ফালতু ফালতু আমার সময়টা নষ্ট করলি..! "

লিখে অমলেশ সবে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে ঠিক সেই সময়, যেন একটা দমকা বাতাসের মতো কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর বুকের মধ্যে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরল তখন সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে কিন্তু চিনতে এতটুকুও অসুবিধা হয়নি অমলেশের! হতভম্ব হয়ে গেল সে শুধু অনুভব করল হু হু হু হু করে কেঁদে যাচ্ছে পিয়া একটাও কথা বলল না পিয়া একটাও না অমলেশের জামাটা ভিজে গেল ভিজল ওর জামার ভিতরে বুকের উপরের  চামড়াটাও

পিয়া কিন্তু কিচ্ছু বলল না যেমন এসেছিল হঠাৎ ঠিক তেমনই হঠাৎ চলে গেল তারপর অমলেশকে সমস্ত জায়গা থেকে ব্লক করে দিলঅমলেশের বিয়েতেও আসে নি বন্ধুদের অমলেশ জিজ্ঞাসা করেছিল

"পিয়া এলো না কেন রে  জানিস কেউ?"  কেউ বলতে পারল না পিয়ার কথা

ত্রিপর্ণার চিৎকার ভেসে এল --"কীগো,আর কতোক্ষণ থাকবে বাথরুমে? "

অমলেশের হাসি পেল খুব মনে মনে বলল--"যতক্ষণ না আমাকে পিয়ার মতো করে জড়িয়ে ধরবে, ততক্ষণ"

মুখে বলল--"আসছি...এক মিনিট!"

আর মনে মনে ভেবে অবাক হল এই ভেবে যে, সে পিয়ার কথা সকালে ভাবতে শুরু করেছিল আসলে কেমন করে সারাদিন সে পিয়াকে বুকে করে বয়ে বেড়িয়েছে ভাবতেও অবাক লাগছে সে এই মুহূর্তে মনেও করতে পারছে না যে সে সারাদিনের সমস্ত কাজ কখন করল? কখন অফিস গেছে,কখন ফিরেছে তার মনেই পড়ছে না

ঠিক এইভাবে সে ত্রিপর্ণাকে চায়

 

ত্রিপর্ণা সেদিন ডিনার টেবিল সাজিয়েছিল নিজেইঅমলেশের প্রিয় পদ রান্না করেছিল আলু পোস্ত, বিউলির ডাল আর তেল কই সঙ্গে ছিল শশা,গাজর আর পিঁয়াজের স্যালাড শশা,গাজর আর পিঁয়াজের টুকরোগুলোকে কেটে মিকি মাউস বানিয়েছিল ডাইনিং এর আলো নিভিয়ে মৃদু মোমের আলোয় খেতে ডেকেছিল স্নান করে ডাইনিং এসেই অমলেশের দারুণ ভালোলাগায় মন ভরে গেছিল দুজনে নিবিষ্ট হয়ে সুস্বাদু খাবার খাওয়ার পর ত্রিপর্ণা বলেছিল--"তুমি বেড রুমে যাও আমি আসছি" অমলেশ বেডরুমে বালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ভাবছিল ভাবছিল আজই নাহয় ত্রিপর্ণাকে ভরিয়ে দেবে তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ছয় বছর এতোদিনে  সে অনেকবারই ত্রিপর্ণাতে আত্মগমন করেছে খুব স্বাভাবিকভাবেই কখনো তো সেই অনুভূতিটা আসেনিকিন্তু কেন আসেনি? সেকি তবে পিয়াকেই ভালোবাসে? পিয়াকেই যদি ভালোবাসে তাহলে পিয়ার জন্য তার মধ্যে কোনো বিরহীর যন্ত্রণা বোধ তো নেই! আছে শুধু সেই কামনা! ওইভাবেই ভালোবাসতে চায় সে কিন্তু পিয়াকে নয় ত্রিপর্ণাকেত্রিপর্ণা সেদিন একটু পরে এসেছিল আরো মোহময়ী সাজে রাত পোশাকটার গলার ভি আকারের মুখটা নেমে গেছিল ত্রিপর্ণার বুক ছাড়িয়ে অনেক নীচে পর্যন্ত ঘরে ছিল হালকা রাত-আলো ত্রিপর্ণা চুলগুলো খুলে রেখেছিলঅমলেশের চোখে নেশা এসেছিল ঠিকই কিন্তু পিপাসা কোথায়? পিপাসা নেই তার! কেন যে এমন হয় তার? অমলেশের মনে হল আরো একটু সময়ের দরকার আরো আগুন জ্বলুক ত্রিপর্ণা তার একদম বুকের কাছে বালিশে মাথা ছোঁয়াতেই অমলেশ বলে ওঠে--"পর্ণা,তোমার মনে আছে, কেমন করে এই ফ্ল্যাটের টাকা যোগাড় করেছিলাম?"

অমলেশ ইচ্ছে করেই যেন ত্রিপর্ণাকে তার কাছে আসাটা বন্ধ করে দিল কারণ সে জানে,

এই বিষয়টা পর্ণার খুব আদরের একটা যুদ্ধ জেতা অনুভূতি অমলেশ জানে তার পর্ণাকে সে ইচ্ছে করেই তাই এই বিষয়ে অনুপ্রবেশ করালো

পর্ণা বলল--"মনে আবার থাকবে না?"

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিল--"তোমার-আমার সমস্ত সোনার গয়না বিক্রি হল তাছাড়া জমানো যা কিছু ছিল সব...সমস্তই গেল! তাতেও কিচ্ছুই হতো না যদি তোমার সম্পত্তিটা না বিক্রি হত!"

অমলেশ বলল--"হ্যাঁ, আমার সম্পত্তি বিক্রির পুরো কৃতিত্ব তোমার তুমি ওইভাবে সব সামলে নেবে সত্যি সত্যি ভাবতেও পারিনি আমি"

ত্রিপর্ণা বলে--"নাহলে কী আর করতাম বলো ছাড়া আর তো কিছুই করারও  ছিল না"

অমলেশ বলে--"হ্যাঁ অবশ্য তার জন্য তোমাকে কম কষ্ট করতে হয় নি আমি তো ভাবতেও পারি না তোমার ওই শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে...!"

অমলেশ হাসতে থাকে ত্রিপর্ণা ভাবতে থাকে তারা ওই ফ্ল্যাটের, শোবার ঘরে রাত আলোর বিছানা ছেড়ে চলে যায় পরানপুরে মুহূর্তের মধ্যে

একদম আচমকা একদিন বিকেলে চোখের সামনে ছেলে আর ছেলের বউকে দেখে হকচকিয়ে গেলেন প্রভাদেবী ছেলে তাঁকে কখনো ফোন টোনও করে না বিশেষ মাঝে মাঝে অবশ্য আসত সে ওই ধান পেকে গেলে বা আমের মরশুমে কখনো বা পুকুরে জেলে নামিয়ে মাছ ধরিয়ে সেই টাকা নিতেই আসত প্রভা দেবী কিচ্ছু বলতেন না! মনে মনে কষ্ট পেতেন কী না তাও তিনি বলতে পারবেন না তবে সন্ধে বেলায় ঠাকুরের কাছে প্রদীপটি জ্বেলে দিয়ে গলবস্ত্র হয়ে ওদের মঙ্গল ভিক্ষে করতেন যা পেয়েছেন তাতেই তিনি সুখী না পেয়েই যে মানুষটা সুখী হতে পারেন, তাঁকে বেশি কিছু দিলে যেমন অবাক হয়ে যান, প্রভাদেবীরও তেমনই হয়েছিল ছেলের দিকে একবার আর খুব সুন্দর একখানা শাড়ি পরে ঘোমটা দেওয়া বউএর দিকে একবার চাইছিলেন অবাক আর সুখের যুগপৎ ধাক্কায় প্রথমটা কথা বলতে পারেন নিতারপরই তাড়াতাড়ি করে ডাকলেন--" বাপির মা, কম্নে গিয়েচ? ইদিক পানে এসো দিকি... দেখে যাও কেডা এইয়েচ"

ত্রিপর্ণা শাশুড়িকে প্রণাম করে বলে--"ভালো আছেন মা?"

মা বউমার থুতনি ছুঁয়ে চুমু খান বলেন--"মোর ভালো থাকা তো  তোঞগা হাতে মা!"

ত্রিপর্ণা বুঝতে না পেরে তাকায় বৃদ্ধার মুখপানে

বৃদ্ধা হাসেন--"তোঞগা দুটিতে ভালো থাকলিই মুই ভালো থাকি মা!"

ত্রিপর্ণা অমলেশকে ইশারা করে প্রণাম করতে অমলেশ মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয় ত্রিপর্ণা মুখ চেপে বলে--"মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো"

অমলেশ পাত্তাই দেয় নাপ্রভাদেবী বলেন--"থাক মাপায়ে হাত দে ভক্তি ছেদ্দা না দেকালিও চলবে ভক্তি ছেদ্দা তো মনের ব্যাপার তাই না?"

এক মুহূর্তে গ্রামে রটে গেল যে অমলেশ তার বউ নিয়ে মায়ের কাছে এসেছে বাচ্চারা দলে দলে বউ দেখতে এল তাদের বিয়েটাও হয়েছিল শহরের বাড়ি ভাড়া করে ফলে ত্রিপর্ণাকে নতুন বউএর মতোই সবাই দেখতে আসছিল প্রভা দেবী বল্লেন--"তোরা এখন যা দিনিবিকেলে আসিসকোন এতোটা পথ উজান বেয়ে এইয়েচে ওদের একটু জিরুতে দে"

কৌতূহলী বাচ্চারা যেতে চায় না প্রভাদেবী বলেন--"বউমা,তুমি ঘরের ভেত্রে যাও একটু তো খবর দে আসবা মা! বলোতো কোতায় তোঞগা বসতি দেই কোম্নেই বা শুতি দি"

ত্রিপর্ণা শুনেছিল অমলেশের কাছে যে তাদের পূর্বপুরুষ জমিদার ছিল কিন্তু এইরকম বিশাল বাড়ি তাদের তা অমলেশও বলেনি আর সে কল্পনাও করেনি সে বলেছিল--"কেন মা? এই বাড়িতে ঘরের তো অভাব নেই"

বৃদ্ধা বলেন--"তা ঠিক ঘরের অভাব নেইকো কিন্তুক সব তো খালি খালি পড়ে রইয়েচ মা ব্যভার না  করলি নতুন জিনিসও নষ্ট হয়ে যায় আর এতো তিন পুরুষ আগেকার তৈরি"

বলতে বলতে মাঝবয়সি বাপির মা এলেন ভদ্রমহিলার কোমরে কাপড় জড়ানো হাতে ঝাঁটা আঁচল খুলে ঘাম মুছতে মুছতে তিনি বলেন--"দরজা খুলে ঝাঁট-পাট দিচি, মুচিচি এবার তোঞগা পচন্দ হলিই হয়

প্রভাদেবী এতোক্ষণে চেয়ার ছেড়ে ওঠেন

বাপির মা ওমনি চিৎকার করে ওঠেন--"ছেলে-বউমা এইয়েচ বলে আনন্দে নিজির খেয়াল রাখছো নাকো তুমি!"

প্রভাদেবী বলেন--"আরে না মুই ঠিক আছি শীত আসতি  দেরি আছে এখনো" বলে তিনি ত্রিপর্ণা আর অমলেশের ঘরের দিকে যান দেখে শুনে বাইরে এসে বলেন--"বউমা,যাও ঘরে গিয়ে বসোদিনি  ভালোই  পোষ্কার করেচ মনেহয় না খারাপ লাগবে যদিও আমি পোষ্কার দে্কতি পাই নে চক্ষে

ত্রিপর্ণা আর অমলেশ সেই ঘরে ঢুকে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেল অনেক পুরানো বাড়ি ইটের গায়ের প্লাস্টার খসে খসে পড়েছে অনেক উঁচু সিলিং সেখান থেকে বকের মতো লম্বা পায়ের সিলিং ফ্যান ঝুলছে একখানা খাট তো নয়, আসলে পালঙ্ক উপরে গদির উপর গদি একদম নতুন বিছানার চাদর পুরানো,রঙ চটা কিন্তু ঝকঝকে মেঝে এক কোনে একদম নতুন সোনি টিভি পালঙ্কের পাশে ঝকঝকে গ্লাসে খাবার জল ঘরটা অনেক বড়ো এক পাশে পালঙ্ক আর অন্য পাশে দোলনা

 

 

সোফার পরিবর্তে ত্রিপর্ণা দরজা বন্ধ করে চেঞ্জ করল বাইরে বেরিয়ে বলল--"মা,তোমাদের বাথরুম কোথায়?"

প্রভাদেবী বলেন--"তোঞগা ঘরের পাশেই  রইয়েচ ওটা নতুন করা হইয়েচ"

ত্রিপর্ণা বাথরুমে ঢুকে অবাক হয়ে গেল বেরিয়ে এসে বলল--"কী চমৎকার বাথরুম!"

প্রভাদেবী বলেন--"হুম তোমার থালি ভাল্লেগেচ "

ত্রিপর্ণা বলল--"মা,দুপুরে কী রান্না হবে বলুন আমি করছি"

প্রভাদেবী বলেন--"তোমার কী মাথা খারাপ হইয়েচ বউমা? বাপির মা সব করব্যানি তেবে রান্নাঘর-ভাঁড়ার ঘর সব ওইদিকি রইয়েচ তুমিও  যাতিই পারো দেখতিই পারো কী খাবে না খাবে বাপির মারে বলতিই পারো"

ত্রিপর্ণা আসলে সব ঘুরে ঘুরে দেখতে চায় কী কী আছে তার কতোটাকার সম্পত্তি

দুপুরে এলাহি খাওয়া-দাওয়ার পর একটু শুয়েছিল দুজনে চারটে বাজতে না বাজতে কেউ ডাকতে আরম্ভ করল

" বউমা দরজা খোলো!"ত্রিপর্ণা প্রথমেই বিশ্রীভাবে চিৎকার করতে যাচ্ছিল জীবনে কোনোদিন কোনো প্রয়োজনে তাকে কেউ বিরক্ত করেনি মানে সে বরদাস্ত করেনি পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল সে গলায় মধু ঢেলে বলল--" আসছি!"

বলে ঘোমটা-টোমটা দিয়ে বাইরে বার হল

একজন অপরিচিত কেউবাপির মা বা তার শাশুড়ি মা নয় ভদ্রমহিলার সাথে একজন যুবতী মেয়ে বেশ সুন্দর দেখতে ত্রিপর্ণা অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে খানিক দেখল এইরকম জঙ্গলের মধ্যেও এতো সুন্দরী মেয়ে হয়? বাপরে! যেন দুধে আলতা রঙ! কী অপূর্ব চোখ দুটো! আর তার চাউনি! কোঁকড়া কোঁকড়া চুলগুলো হাত খোঁপা করে বাঁধা ভদ্রমহিলা বল্লেন--"হাঁ করে দেখছো কী! শিজ্ঞিরি করে ভেত্রে নে যাওপাড়ার বউঝিরা এই এল বলে!"

ত্রিপর্ণা ঠিক মতো বুঝতে পারে না অমলেশ ভিতর থেকে বলে--"গ্রামের মানুষেরা তোমাকে দেখতে আসবে তাই মাসি তোমাকে সাজুগুজু করে নিতে বলছে"

মাসি ওমনি উঁকি মেরে বলেন--"আচ্ছা আপনি তাইলি ভেত্রে  আচেন!"

বলে একটু হাসেন তারপর গটগট করে ভিতরে ঢুকে যান অমলেশের কান ধরে টান দিয়ে বলেন--"খুব বাজে কাজ করিচিস বুড়ো বিয়েতে  মোদের নেমন্তন্য না করে!"

অমলেশ বলে--" আরে ধুত্তেরি! এখানে এই ধ্যদ্ধেড়ে গোবিন্দপুর আমার বন্ধুরা কেউ আসতে পারত না সেই জন্যই তো...!"

বিয়েটা এই গ্রামের বাড়িতেই করতে বলেছিলেন প্রভা দেবী কিন্তু অমলেশকে বোঝাতে পারেন নি গ্রামের মানুষগুলো আশাহত হয়েছিলেন অমলেশকে তাঁরা নিজের ছেলে বলেই মানতেন সেই অমলেশ বিয়ে করল একা একা তাই খুব কষ্ট পেয়েছিলেন এই সহজ সরল মানুষগুলো সেই যন্ত্রণা ভুলতেই এইরকমভাবে আপন করে টেনে নিতে চেয়েছিলেন বুকে কিন্তু অমলেশের মধ্যে পার্থিব অনুভূতি ছাড়া সব অন্ধকারতাই

বুড়ো বলে ডেকে আপন করতে চাওয়া ভদ্রমহিলার মুখটা মুহূর্তে কেমন পানসে হয়ে উঠল

ত্রিপর্ণা বলল--"নাগো কাকিমা! ওর মুখের কথাই এরকম! তখন গ্রামের কাউকে বলতে পারেনি বলেই এখন আসা তুমি কিছু মনে করো না গো ওর কথায়!"

কাকিমা সঙ্গে সঙ্গে এক গাল হাসি দিয়ে বল্লেন--"মুই ঝানি মা  ও্ররামই ছোটো থেকেই" ত্রিপর্ণাকে কনে বউএর মতোই সাজানো হল এবং বিকেল থেকেই গ্রামের লোকজন তাকে দেখতে আসতে লাগল নতুন বউএর মুখ দেখে সকলেই কিছু না কিছু উপহার দিল শাশুড়ীর খুব বড়ো একটা সিন্দুক আছে সেটা খুলে তিনি অনেক গয়না পরিয়ে দিলেন তাঁর বউমাকে ত্রিপর্ণা এসেছিল সম্পত্তি দখল করতে কিন্তু সবাই চলে যাবার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেই সে দখল করে নিল সুখ যে কখন কোন সিন্দুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে তা সত্যিই কেউ জানে না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ত্রিপর্ণা অবাক হয়ে নিজেকে চিনতে চেষ্টা করতে লাগল মাথায় একটা খোঁপা খোঁপায় জড়ানো ফুলের মালাসিঁথিতে চওড়া সিঁদূর মাথায় টায়রা-টিকলি গলায় সোনার চিক থেকে শুরু করে হাতে বাউটি,কোমরে কোমরবন্ধ সবই সোনার অনেকক্ষণ ধরে ত্রিপর্ণা নিজেকে দেখল তারপর একটা একটা করে গয়না খুলে রেখে দেয় নিজেদের আনা বাক্সে খোঁপা খুলতে গিয়ে দেখে খোঁপার মাঝখানে সোনালি রংএর চিরুনি খুলে পাশে রেখে অমলেশকে ডেকে সে বলল--"এগুলোও কি সোনার?"

প্রভাদেবী বলেন--"হ্যাঁ গো মা! মোগা  এই  গে্রামের সবারই সোনার মন নতুন বউকে কেউ গিলটি করা সোনা দেয় নাকো"

ত্রিপর্ণা বলল--"আসুন মা বসুন না প্লিজ"

প্রভাদেবী বলেন--" গেরা মের সব্বাইই তোমার খুব প্রশংসা করতেচ আমার পোড়া কপাল এই চোখে আর দেখ্তি পালাম না তোমার মুখখানা!"

ত্রিপর্ণা বলে--"কেন মা কথা বলছেন কেন?"

প্রভাদেবী বলেন--"চোকে যে কিছুই দেখি নেকো মা!"

ত্রিপর্ণার খেয়াল হল যে খুব মোটা কাঁচের চশমা পরে্ন উনি

ত্রিপর্ণা বলল--"কিন্তু মা ডাক্তার দেখালে সেরে যেতেওতো পারে!"

প্রভাদেবী বলেন--"আমাদের এই পরানপুর গেরামে সব পাবে তুমি গোলা ভরা ধান,পুকুর ভরা মাছ,গোয়াল-ভরা গরু আর পেরেম-ভরা মানুষির মন! কিন্তুক একটাও পাশ করা ডাক্তার পাবে না্কো মা! এই গেরাম থেকে ডাক্তার,উকিল কি কম বেরগেচকিন্তুক কেউ আর এই  পোড়া গেরামে ফিরে আসে নাকো!"

ত্রিপর্ণা কী বলবে ভেবে পায় না

অমলেশ বলে--"আমি মানে আমরা তো থাকতেই এলাম!"

শুনেই প্রভা দেবী কেমন একটা গলায় বলে ওঠেন--"সেই ঝোন্যিই তো গেরামের মানুষির এতো ভালোবাসা পাচ্ছো তোমরা!"

বলতে বলতে তিনি চোখে সাদা আঁচল চাপা দিলেন

ত্রিপর্ণা বলে--"না মা আর কাঁদবেন না আপনি"

এরপর থেকে সত্যিই ত্রিপর্ণা অন্নপূর্ণা হয়ে উঠল যেন বাড়িতে বহুদিক থেকেই আয় হয় যেমন বছরে একবার তেঁতুল বিক্রি হয়,ডাব-নারকোল, তাল, আম ইত্যাদি তাছাড়া ধান বা চাল বা গম অথবা পুকুরের মাছ ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে সারা বছর ধরে বিক্রি হয় প্রভাদেবী এতোদিনে নিজের লোক পেয়েছেন তিনি পুটপুট করে ত্রিপর্ণাকে সমস্ত বলতে থাকেন বৃদ্ধাকে সব্বাই ঠকাতো নিজে চোখে না দেখলে যা হয় আর কী! ত্রিপর্ণার সাথে এই জায়গাতে এমন মিলে গেল যে দুজনে মা-মেয়ের মতো সম্পর্ক হয়ে গেল বৃদ্ধা ত্রিপর্ণার গায়ে হাত বোলান আর বলেন--"আমার মা দুজ্ঞাকে, মা অন্নপূর্ণাকে একটু চোখের দেকা দেখতি পালাম নাকো মা! এই দু: আমার মরণের পরেও যাবে নাকো!"

ততদিনে সিন্দুকের চাবি ত্রিপর্ণার আঁচলে

সে বলে--"কে বলেছে আমাকে দেখতে পাবে না? চলো তোমায় কলকাতায় নিয়ে যাব ভালো ডাক্তার দেখাব"

বৃদ্ধা চুপ করে থাকেন রাতে তাঁর সুখের কান্নায় বালিশ ভেজে মনে মনে তিনি ত্রিপর্ণাকে আশীর্বাদ করেন

প্রভাদেবী যখন নিজের মেয়ের মতোই ত্রিপর্ণাকে আশীর্বাদ করেন, ভালোবাসেন, এমন একটি মেয়ের সাথে তাঁর ছেলের বিয়েতে নিজেকে ধন্য মনে করেন ঠিক তখনি ত্রিপর্ণা সিন্দুক খুলে দলিল বার করে রাতের বেলায় হ্যারিকেনের আলোয় দুইজনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয় কোথায় আছে কতোটুকু জমি, কোথায় কতোটুকু পুকুর কোথায় বা আমের বাগান পরিমাণ দেখে চমকে যায় অমলেশবলে--"কোনোদিন খোঁজ নেইনি জানতাম অনেক প্রচুর কিন্তু কতোটুকু তা জানতাম না!

আসলে একদম ছোটো থেকেই তো হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছি ছুটিছাটায় আসতাম"

পরদিন ভোরে অমলেশ বাড়ির দলিল নিয়ে কলকাতায় রওনা হয়

প্রভাদেবী বলেন--"বউমা,বুড়ো কোথায় গেল?"

ত্রিপর্ণা বলে--"ওর এতোদিন কামাই করলে অনেক অসুবিধা মা! কয়েকদিন বাদে আবার আসবে"

প্রভাদেবী বলেন--"তা ভালো করোচ তুমি না গিয়ি"

বলে তিনি একটুক্ষণ কিছু যেন ভাবলেন তারপর বললেন--

"বউমা একটা কতা বলব?"

ত্রিপর্ণা বলে--"বলুন না মা!"

প্রভাদেবী বলেন--"তোমার চাকরি না করলি কী হয় বলোদিন? দেকো তোমার শ্বউরির ঝা  আচ  তাই খেয়ে শেষ করতি পারবা নাকো তোমরা আমি বলি কি,তুমি বরং এইখানেই থেকি যাও!"

ত্রিপর্ণা বলে---"আমিও তেমনই ভাবছি মা তবে আগে তোমার চোখটা দেখিয়ে আনি তারপর আর যাব না মা!"

প্রভাদেবী হাত জোড় করে ঈশ্বরের কাছে ছেলে-বউমার জন্য প্রার্থনা করেন ওদের জন্য সর্ব সুখ  কামনা করেন আর পুরোহিত ডেকে একদিন ওদের মঙ্গল কামনায় পুজোও দেন আর সেইদিনই নিজের গর্ভজাত সন্তান সমস্ত সম্পত্তির দানপত্র লেখা দলিল দিয়ে যায় ত্রিপর্ণার হাতে প্রভাদেবী কিছুই জানেন না তিনি তাঁর বুড়ো যে এসেছিল তা টের পেয়েছিলেন কিন্তু পরদিন ভোরে তার সাড়াশব্দ না পেয়ে জানতে চাইলেন--"বউমা,কাল রেতে বুড়োর গলার আওয়াজ শুনলাম ঝেন!"

ত্রিপর্ণা বলে--"হ্যাঁ,মাএসেছিল কাল আপনার চোখের ডাক্তার দেখানোর জন্য আপনার কিছু কাগজপত্র লাগবে আমি কাল রেডি করে রেখেছিলাম তাই নিতে এসেছিল"

বৃদ্ধার একবারের জন্যও মনে অন্যরকম কিছু আসে নিতিনি বরং সারাদিন যারাই তাঁর বাড়িতে এল, প্রত্যেককে বলতে লাগলেন--"আমার বউমা আমার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী পিতিমে ঝেন মুইও কলকাতায় যেতিচি বউমা বলেচ মোর চোখ আবার ঠিক হয়ি যাব্যানি" বলেন আর অশ্রু মোছেন

বাপির মা বলে--"বউমাকে দেখতে ঝেমন, বউমার মনটাও তেমন!"

প্রভাদেবী বলেন--"কো্নো জন্মে হয়ত পেটে ধরিস্লুম..!"

বাপির মা বলে--"এতো সুখের কথা গো কাঁদো কেন গো তুমি? কয়জন এমন বউমা পায়?"

প্রভাদেবী চোখ মোছেন আর বলেন--"সেইটাই ভেবে পাইনেকো বাপির মা চোখ অন্য কোনো কাজ করে নাকো  কিন্তুক দে্ক কেঁদে ভাসাতে পারে কেমন!”

 

পরের সপ্তাহেই অমলেশ ফোন করে জানায় যে কাস্টমার রেডি ইচ্ছে করলে ওই মুহূর্তেই অমলেশ বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারে।। ত্রিপর্ণা বলে--"আমিও রেডি মাকে নিয়ে আসছি তুমি গাড়ি পাঠিয়ে দাও"

অমলেশ বলে--"এই দাঁড়াওদাঁড়াও মাকে নিয়ে আসছো মানে? তুমি জানো মায়ের পিছনে খরচ কতো? চোখে ছানি পড়েছে না চিরজীবনের মতো অন্ধ হয়ে গেছে ভগবান জানেন! দেখলেই তো হাঁটুর ব্যথায় মাঝে মাঝে নড়তে পারে না গ্রামের একটা মেয়ে ওই সময়ে পাশে থাকে সব করে টরে দেয় আর বাপির মাতো আছেই জানো ওই সময় টয়লেটেও যেতে পারে না! বিছানায় করে ফেলে কে সামলাবে এইসব? এখানে আয়া রাখলে তার টাকা গুনতে গুনতে ফতুর হয়ে যেতে হবে আর তুমি যদি ভেবে থাকো যে তুমি চাকরি-বাকরি করবে না, ওই ঘাটের মড়ার সেবা করবে, তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে! মনে রাখবে আমি তোমাকে প্রেম করে বিয়ে করিনি চাকরি করা মেয়ে দেখেই বিয়ে করেছিলাম!"

ত্রিপর্ণা অবাক হয়ে যায় কথা শুনে

বলে--"তুমি ভাবলে কী করে যে আমি হাগুমুতু সাফ করব? ভাবো কী আমাকে? আমার উপর একটুও বিশ্বাস নেই?"

অমলেশের মাথাটা গরম হয়ে গেলে সহজে ঠাণ্ডা হতে চায় না সেটা ত্রিপর্ণা জানে

সে বলল--"তুমি গাড়ি পাঠিয়ে দাও আমি এখান থেকে মাকে নিয়ে বার হবো বলব আমাদের কাছে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাচ্ছি আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমে কথা বলেছি গাড়িতে করে সোজা সেখানে

নিয়ে যাব যাবার পথে দানপত্রে সই করিয়ে নেবো সেখানে ওনাকে রেখে আমি ওই গাড়ি নিয়ে আমার মায়ের কাছে যাব তুমিও ওখানেই এসো আমার প্ল্যান নিশ্চয়ই পরিষ্কার?"

এতোক্ষণে হাসে অমলেশতারপর বলে --"ঠিক আছে কিন্তু আর যে পেরে উঠছি না এই নিরামিষ জীবন আর সহ্য হচ্ছে না পর্ণা!"

ত্রিপর্ণাকে অমলেশ "পর্ণা" বলে ডাকলেই ত্রিপর্ণার দুনিয়াকে নেশা নেশা মনেহয় মনেহয় এই যে ওর মধ্যে একটা "অমল" "অমল" নেশা, এটাকে ছাড়া বাঁচবে না কিছুতেই

বলে--"আমিও আর পারছি না তোমাকে ছাড়া অমল!"

তারপর অমলেশের বৃদ্ধা,অথর্ব, অসহায় মাকে সবার সামনে থেকে জড়িয়ে ধরে দামি গাড়িতে তুলে নিয়ে আসে ত্রিপর্ণা মা তো মা- তিনি ভাবতেও পারেন নি তাঁর গর্ভজাত সন্তান তাঁর সাথে এইরকম একটা চরম নিষ্ঠুরের মতো কাজ করবে 

তাছাড়া বাপির মাকে ছেড়ে আসতেও তাঁর যন্ত্রণা কম হচ্ছিল না সম্পত্তি তো সব ওদেরই ওরাই পেতোকয়েকদিন দেরি তবু সইল না! যখন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে ত্রিপর্ণা চলে আসছিলো, বৃদ্ধা তখনো পুরোটা বোঝেন নি কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কেনই বা এতোগুলো সই করানো হল তাঁকে দিয়ে তিনি কিচ্ছু বোঝেন নি সই যে দলিলের উপর করানো হয়েছে উনি তা বুঝতেও পারেন নি যে বিষয়ের সামান্যতমও সন্দেহ নেই সেই বিষয়টা তাঁর মাথাতেও আসেনি চোখেও  দেখেন না এখন তাছাড়া কে জানে হয়ত, চোখ-কান থাকলে বা ছেলে-বউমাকে চিনলে জোর করে  সই করিয়ে নিত কে জানে হয়ত গায়েও হাত উঠত কে জানে ঈশ্বরেরও হয়ত মায়া লেগেছে হয়ত তিনিও চাননি এর থেকেও বড়ো অপমান হোক এই বৃদ্ধ বয়সে

 দুইজন শিক্ষিত নর-নারী এরপর যায় ত্রিপর্ণার মায়ের বাড়ি সেখানেও শুরু হয় ভালোবাসার নাটক

ত্রিপর্ণা আর অমলেশ কোনো খবর না দিয়েই এসেছে তাই মা অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন বলেন--"কীরে তোরা? সব খবর ভালো তো?"

ত্রিপর্ণা বলে--"হ্যাঁ মা সবই ভালো তোমাদের দেখতে মন চাইল খুব তাই চলে এলাম"

ত্রিপর্ণার মা বিনতা দেবী একটু অবাক হয়ে যান এই মেয়েটা তাঁর ছোটো মেয়ের থেকে অনেক সুন্দরী আর ছোটো থেকেই ভীষণ স্বার্থপর এক রোখা জেদি তাঁর সাথে তাঁর ছোটো মেয়ে সুপর্ণার যেমন ভাব-ভালোবাসা, ত্রিপর্ণার সাথে কখনো এমনটা হয় নিমায়েদের সাথে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের একটু বেশিই হৃদ্যতা জন্মে কিন্তু ত্রিপর্ণার তুলনায় তাঁর ছোটো ছেলে অর্পণের  সাথে তাঁর হৃদ্যতা বরং অনেক বেশি

 

 

ত্রিপর্ণা বলে--"আমি এসেছি তোমার ভালো লাগেনি মা?"

বিনতা দেবী বলেন--"মেয়ের কথা শোনো! ভালো লাগবে না কেন?"

অমলেশ ততক্ষণে  বিনতা দেবীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে ত্রিপর্ণা বুঝতে পারে অমলেশের এই ভক্তি দেখানোটা আসলে  ভড়ং নিজের মায়ের ব্যাপারে অমলেশের বিন্দুমাত্রও সন্দেহ ছিল না তাই সেখানে সে ভক্তির অভিনয়টুকুও করেনি কিন্তু এখানে তো মা নয়,শাশুড়ি! যদি সম্পত্তিটা হাতছাড়া হয়ে যায়! এই চিন্তাতেই অমলেশের শিরদাঁড়া নত হয়েছ সব বুঝতে পারে ত্রিপর্ণা

বিনতা দেবী ওদের বসতে বলেন তাড়াতাড়ি তারপর ছেলেকে ডাকতে থাকেন--"অর্পণ, এইদিকে একটু আয় দেখি বাবা!"

ত্রিপর্ণা ওমনি মায়ের কাছে এসে বলে --"ভাইকে কোত্থাও পাঠাতে হবে না মা"

বিনিতা দেবী বলেন--"কী যে বলিস তুই পর্ণা! জামাইকে কি আজেবাজে জিনিস খেতে দেওয়া যায়?"

ত্রিপর্ণা তার স্বামীর দিকে কটাক্ষ করে বলে--"এই ব্যাগটা রান্না ঘরে রেখে এসো না!"

অমলেশ তখুনি বড়ো একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে রান্না ঘরের দিকে যায় বিনতা দেবীর খুব ভালো লাগে মেয়ের কথায় এতোটাই গুরুত্ব দেয় জামাই দেখে সব মায়েরই ভালো লাগবে তিনি মাথায় ঘোমটা দিয়ে রান্না ঘরে যান মেয়েদেরও ডাকেন সুপর্ণা দিদিকে দেখে খুব বেশি খুশি হয় নি অর্পণও না সত্যি বলতে বিনতা দেবীও দেখে ভিতরে ভিতরে ভাবছেন, কী মতলবে এসেছে কে জানে! নিজের পেটের সন্তান তাঁর কিন্তু তিনি তাঁর গোটা জীবনেও এমন চরম আত্মকেন্দ্রিক মানুষ দেখেন নি তাঁরা এমন একটা ভেবেই নিয়েছিলেন যে, এই মেয়ে সংসার করতে পারবে নাকিন্তু কয়েক বছর কেটে যাওয়াতে তিনি একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলেন যাক সংসার করছে ভালোভাবে তাঁর আর কিচ্ছু চাইবার নেই ঈশ্বরের কাছে

সুপর্ণাটাও সুন্দর কিন্তু গায়ের রংটা বেশ চাপা পড়াশোনাতেও দিদির মতো হতে পারেনি তবুও এই মেয়ে নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তা নেই মেয়ে তাঁর সংসারের কাজ জানে সুপর্ণা মানুষকে ভালোবাসতে জানে যে মানুষ ভালোবাসতে জানে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই সে সুখী হয় তাকে তার ভালোবাসার মানুষ ভালো না বাসলেও সুখ নিজেই তাকে খুঁজে নেয় কিন্তু  যে মানুষ ভালোবাসতে জানে না সে কোনোদিন কোনো অবস্থাতেই সুখী হয় না সুখ জিনিসটা তার কিছুতেই হজম হয় না

বিনতা দেবী তাই ভাবছেন যে ত্রিপর্ণা নিশ্চয়ই কিছু একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে এসেছে শ্বশুরবাড়িতে ভাবতে ভাবতে তিনি দেখেন ত্রিপর্ণা ব্যাগ থেকে সবার জন্য খাবার বার করছে সে

নিয়ে এসেছে বিনতাদেবী জীবনেও এতো অবাক হন নি তার ত্রিপর্ণা এতো মনে রেখেছে? ছেলেটা ঝাল ঝাল চপ, সিঙ্গাড়া খুব ভালোবাসে সুপর্ণার আবার রসগোল্লা প্রিয় আর তিনি নিজে বাদাম ভাজা আর চিনির রসে ডোবানো জিলিপি দারুণ পছন্দ করেন তো মেয়ে ঠিক তাই তাইই এনেছে খাবারটা বিষয় নয় তিনি গরিব কথা ঠিক কিন্তু এতোটাও নন যে এক প্যাকেট বাদাম, রসগোল্লা ছেলে-মেয়েকে খাওয়াতে পারবেন না আসলে ত্রিপর্ণা এভাবে তাঁদের মনে রেখেছে? তাঁদের সকলের পছন্দ-অপছন্দ জানে? এইটাই ওনার কাছে বিস্ময় এবং সুখের বিষয় মানুষ যত বিস্মিত হয়, ততই মনেহয় খুশি হয় মায়ের মন! সন্তান যতই বদ হোক মা ভালোবাসার সুযোগ খোঁজেন

বিয়ের পরে হয়ত মাকে সে বুঝেছে বিনতা দেবী মনে মনে ভাবেন মেয়ের উপর রাগ তাঁর

অনেকটাই কমে গেল ঈশ্বরকে ডাকেন তিনি--"ঈশ্বর আমার মেয়েটাকে শুভ বুদ্ধি দিও!"

মেয়ের বিয়েটাও ভালো ছেলের সাথেই হয়েছে ভালো মানে শিক্ষিত সুউপায়ী দুজনের মিল-তাল হয়েছে আর কী চাই? চাকরিটা পাবার পরই মেয়ে একদিন ঘোষণা করল-- "মা,আমি ঠিক করেছি,আমি বিয়ে করব!"

এক বিন্দুও রাখ-ঢাক নেইলাজ-লজ্জা নেই

মা কী বলবেন আর

বলেন--"পাত্র ঠিক আছে  কি?"

মেয়ে রেগে যায়

বলে--"মা, কী ভাবো তুমি আমাকে?"

মা অবাক হয়ে বলেন--" মা, একটা  সুন্দরী, শিক্ষিতা, যুবতী মেয়ের যে প্রেমিক থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?"

মেয়ে বলেছিল--"তুমি অন্য মেয়েদের মতো ভাবো কেন আমাকে মা? পড়াশুনার সময় নো রোম্যান্স!"

মা বলেন--" তা এখন ছেলে কোথায় পাব?"

মেয়ে বলে--"তোমার ভাবতে হবে না ম্যাট্রিমনিয়ালে বিজ্ঞাপন দিয়েছি পেয়েই যাব তাড়াতাড়ি তুমি শুধু বলো তোমার টাকা-পয়সা কেমন আছে টাছে!"

বিনতা দেবী অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে চাইলেন তাঁর বয়স হয়েছে শরীরে রোগ-ব্যাধি এসেছে ওদের বাবা মারা গেছেন সেই কবে কীভাবে তিন ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেছেন

তিনি একা হাতে তা মেয়ে একবারো ভাবল না?

সে সবার বড়ো এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে অসহায় মাকে ছেড়ে বিয়ের কথা ভাবছে? তারপর আবার বলছে টাকা-পয়সা কতো কী আছে বলো!

বিনতাদেবী বলেন--"সে তোর ভাবতে হবে না তুই পাত্র দেখ!"

ত্রিপর্ণার মুখে হাসি ফোটে

আর বিনতাদেবী নির্ঘুম রাত কাটান অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই নেন  জমি তো অনেক আছে বিক্রি করে দেবেন সব তবুও স্বার্থপর মেয়েকে আগে বিয়ে দিয়ে দেবেন নইলে পরের দুটোও একই পথে হাঁটবে

মেয়ে একদিন একটা ছবি দেখিয়ে বলে--"মা কেমন লাগছে দেখো তো?"

ছবিতে ছেলেটাকে বেশ মিষ্টি মিষ্টিই লাগছে

তিনি বলেন--"বিয়ে করবি তুই পছন্দও তোকেই করতে হবে"

 ত্রিপর্ণা বলে--"না,আমার তো বাকি সব কিছুই পছন্দ দেখতেও আমার তো ভালোই লাগছে তবু তোমার চোখে তাকে কেমন লাগবে জানতে চাই"

বিনতা দেবী বলেন--"পছন্দ হলে করে ফেল ভালোবাসা জন্মালে করে ফেল"

ত্রিপর্ণা বলে--"ভদ্রলোকের মোটা মাইনে আছে মা! ভালোবাসা এমনিই জন্মাবে!"

কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিনতাদেবী আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন--"মেয়েটাকে সুখে রেখো ঠাকুর!"

সত্যি বলতে মেয়ের বিয়ের জন্য সাধ্যমতো খরচ করেছিলেন ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার দিকে জোর দিয়েছিলেন খুব যাতে তাঁর মতো অসহায় হতে না হয় তিন তিনজন সন্তান মানুষ করা একজন বিধবার পক্ষে যে কতোখানি মারাত্মক কষ্টের... কতোদিনের উপোসি  যন্ত্রণা হজম করতে হয়েছে তার জন্য, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানেও না, বুঝতেও পারবে নাভেবেছিলেন বড়ো সন্তান হিসেবে সে কিছুটা অন্তত দায়িত্ব নেবে কিন্তু মেয়ে চাকরিতে জয়েন করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল শুধু তাই নয়, বিয়ের সব কিছু ঠিক হবার পর হঠাৎ জামাই বাবাজীবনের এক বন্ধু ফোন করে পণের টাকা, প্রণামি ইত্যাদির এক বিশাল  লিস্ট পাঠায় এখনো ভাবতে গেলে  বিনতাদেবী কেঁপে ওঠেনউপয়ান্তর না দেখে আবার সেই জমিই বিক্রি করেছিলেন তিনি না,জমি বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বলে যন্ত্রণা নয়, যন্ত্রণা তাঁর এখানেই যে এই অতিরিক্ত চাপের পিছনে তাঁরই

গর্ভজাত সন্তানের পরিকল্পনা নেই তো? এই চিন্তা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পান নি আরো দুটো বেকার ছেলেমেয়ে আছে তাঁর অথচ এই ভিটে বাড়িটুকু ছাড়া সব বিক্রি করে দিলেন এক মেয়ের বিয়ের জন্য! তিনি যখন এমন  কামনা করছেন যে সবার বড়ো হবার কারণে সে সংসারের কিছুটা দায়িত্ব নিক, সে তখন ভাই-বোনেরও দাবি আছে এই সংসারে, এই চিন্তায় যতটা নিয়ে নেওয়া যায় ততই তার নিজের লাভ এমনই ভাবছে এত জঘন্য নীচ মনের মেয়েকে তিনিই জন্ম দিয়েছেন সুতরাং তাঁকেই এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ভেবেছিলেন সেই মেয়েই এতো কিছু মনে রেখে দিয়েছে তিনি তাতেই খুশি

পরের দিন মেয়ে ব্যাগ খুলল

 মেয়ে অনেক কিছু নিয়ে এসেছে কিনে মায়ের জন্য গরদের শাড়ি বোনের জন্য শাড়ী, কসমেটিকস, ভাইএর জন্য মোবাইল! আরো কতোকিছু যে খাবার দাবার তার ঠিক নেই মেয়ে এসেই একেবারে হই হই করে বাড়িটাকে যেন ঘুম ভাঙিয়ে দিল যেন বলল "ওই ওঠ সব আমি এসে গেছি!"

বিনতা দেবী ভাবেন মনে মনে --"মেয়ে বিয়ের পর নিশ্চয়ই মাকে চিনেছে"

তিনি নিজের চিন্তায় নিজেই ভেজেন নিজেই কাঁদেন নিজেই হাসেন মেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে--"মা,আমরা এখানেই থাকব তাড়িয়ে দেবে নাতো?"

মা বলেন--"শোনো মেয়ের কথা আমি তাড়িয়ে দেব তোকে? ভাবিস কী তুই আমাকে?"

মা তখন ভেবেছেন যে তাঁর বড়ো জামাইএর নিশ্চিত চাকরিটা চলে গেছে তিনি চুপি চুপি ছোটো দুই ছেলেমেয়েকে  বলেছেন--"তোদের সবার বড়ো আর ওর বর ওদের কখনো অসম্মান করবি না!"

কিন্তু পরের দিন সকালেই তাঁর ভুল ভেঙে যায় মেয়ে-জামাই দড়ি টড়ি দিয়ে কী সব মাপামাপি করছে

বিনতা দেবী বলেন--"কী করছিস?"

মেয়ে বলে--" মা, এইখানে যদি একটা ঠাকুর ঘর করি ধরো, এইখান থেকে এই পর্যন্ত হবে ঠাকুর ঘর আর তুমি তো বলছিলে যে তোমার রান্নাও তুমি আলাদা করতে চাও তারপর ধরো ভোগ রান্না করবে কিংবা তোমার মাঝে মাঝে কীর্তনের দল ডাকার ইচ্ছে তো এইখান থেকে এই পর্যন্ত কীর্তনীয়াদের জন্য একটা  লম্বা হলঘর হল বেশ লম্বা-চওড়া হবে কিন্তু...!"

বিনতাদেবীর চোখে ঘোর লাগা চাউনি এগুলো তো তাঁর স্বপ্ন ওদের বাবা মারা যাবার পর থেকেই তিনি এই স্বপ্ন দেখে আসছেন তাঁর মেয়েটাকে তিনি এতোটাই ভুল বুঝেছিলেন? মেয়ে তাঁর কথা এভাবে ভাবে?

মেয়ে তখন বলছে--" ভাই তোর কাছে কোনো আমিনের নাম্বার আছে?"

অর্পণ বলে--"হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে তো কয়টা নাম্বার চাস তুই?"

ত্রিপর্ণা তখন অন্য একটা জায়গা দেখিয়ে বলে--"ভাই, এইখানে বাবার একটা স্ট্যাচু বসালে কেমন হবে বলতো?"

অর্পণ হাসতে হাসতে বলে--"খুব ভালো হবে রে দিদি!"

ত্রিপর্ণা বলে--"আর এইখানে তোর জন্য একটা ঘর হবে...! আর ওইপাশে হবে বোনের জন্য একটা ঘর!"

বিনতাদেবীর চোখে জল চলে এল

বিধবা হবার পর থেকে তিনি অনেক কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা তো ভুলেই গেছেন যে মেয়েটাকে সবচেয়ে স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক ভাবতেন, আজ সেই মেয়ে তাঁর অন্তরের চাহিদা পূরণ করছেঈশ্বরকে তিনি বারবার ধন্যবাদ জানান রাতে শুয়ে শুয়ে তিনি বহুবছর বাদে আবার তাঁর মৃত স্বামীর মুখটা মনে করে কাঁদতে থাকেন বারবার করে বলেন--"আজ তুমি থাকলে মেয়েটা তোমার সব ইচ্ছেও পূরণ করত! "

বলেন--"আমাদের পর্ণাকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম গোতোমার আশীর্বাদেই মেয়েটা আমার মানুষ হয়েছে"

পরদিন মেয়ে বলে--"মা,জায়গা-জমি সব আমার নামে লিখে দাও!"

বিনতাদেবী হকচকিয়ে যান কী বলছে তাঁর মেয়ে! তিনি একবার ভাবেন--"মেয়ে কি তাহলে সবাইকে পথে বসাবার প্ল্যান করেই এসেছে?"

এই চিন্তা মাথায় এলেও তিনি কটু কথা বলতে পারেন না মেয়ে যে মুখে মধু ঢেলে কথা বলছে মানুষের স্বভাবই এই, মধুর স্বরে বিষ ঢাললেও মানুষ চেটে চেটে খেয়ে নেয়

বিনতা দেবী শান্ত স্বরেই বলেন--"জায়গা জমি বাড়ি ঘর যা কিছু আছে সব তোরা তিন ভাই বোনে সমান ভাগে পাবি তুই একা কেন নিবি? তোরও তো ছেলেমেয়ে হবে তখন বুঝবি!"

ত্রিপর্ণা বলে--"নাগো মা আমি কেন নেবো? তুমি কী ভাবোটা কী আমাকে?"

বলে তার সাথে যোগ করে--"আসলে আমার অফিস নিজের নামে  জমি নইলে লোন দেবে না এখন এই বিশাল কর্মকাণ্ডে প্রচুর টাকা লাগবে তো! লোন তুলতে হবে তো মা; তাই না?"

বলেই চলে সে--"ভাইএর ঘর লাগবে আলাদা বোনের আলাদা আমারও আলাদা!"

বিনতাদেবী বলেন--" বোনের আলাদা ঘর আবার কী হবে? ওর তো বিয়ে হয়ে যাবে! ঘর দিয়ে কী করবে?"

ত্রিপর্ণা বলে--"মা, আমি নাহয় চাকরি করি বোন তো এখনো কিছু পেল না তারপর আমার বরটা তো ভালোই হয়েছে বোনের বর যদি ভালো না হয়? তাহলে? তখন কোথায় যাবে ,মা?"

বলতে বলতে ত্রিপর্ণা কেঁদে ফেলে সুপর্ণাকে বলে--"বোন, আমাকে কথা দে, তুই নিজের পায়ে দাঁড়াবার আগে বিয়ে করবি না!"

সুপর্ণাকে সে জড়িয়ে ধরেজড়িয়ে ধরে সুপর্ণাও সুপর্ণাও কাঁদে সেই কোন ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছেন সেই থেকে সে অনাথ আজ মনে হচ্ছে মাথার উপর এত্তো বড়ো একটা ছাদ রয়েছে তো!

অমলেশ এই সময় বলে--"ত্রিপর্ণা,তোমার লোন নেবার দরকার নেই আমার কাছে তো পরানপুরের জায়গা-জমি-বাড়ি  ঘর- দোর বিক্রির টাকা আছে সেই টাকা দিয়েই করো না কেন!"

ত্রিপর্ণা সোজাসুজি হাসতে হাসতে বলে--"হ্যাঁ,তোমার থেকে টাকা নিয়ে আমি ঘর বানাই দুইদিন বাদে তুমিই বলবে যে, তোমার টাকায় বানানো বাড়িতে তোমার শালা-শালিরা কেন থাকবে? তখন? তখন কী করব আমি?"

কৃত্রিম নাটকে এবার আসে ক্ল্যাইম্যাক্স!

সেন্টূতে এন্টু লাগিয়ে অমলেশ মুখটা করুণ করে বলে--"কী বললে তুমি? আমি তোমার ভাই-বোনকে এমন বলব তুমি ভাবতে পারলে?" বলতে বলতে অমলেশের চোখ ছলছল করে ওঠে

ত্রিপর্ণা অমলেশের হাত ধরে--"না,না আমি অমোন বলিনি তো! সত্যি বলিনি!" বলে

নাটক জমে ক্ষীর হয়ে ওঠে

অমলেশ চোখ থেকে এক ফোঁটা জল ফেলে বলে--"এইজন্য আমি নিজের  সমস্ত সম্পত্তি বেঁচে এখানে এসে উঠেছি? তুমি সব জানো সব তবুও আমায় এমন বললে? তুমি জানো না, আমার কেমন ভাই বোনের সখ? জানোনা, ওদের মুখের দাদা ডাকে আমি শান্তি পাই কতোখানি!"

ত্রিপর্ণা এখন নায়িকার ভূমিকায়

নায়ক এখন অমলেশ

ত্রিপর্ণা বলে--"ঠিক আছে তুমি যা বলবে তাই হবে শুধু কষ্ট পেয়ো না প্লিজ! আমি ওইটা মিন করিনি!"

অমলেশ বলে--"তাহলে তুমি আমার টাকা নেবে না, তাই তো?"

ত্রিপর্ণা বলে--"কেন নেবো না? তোমার আর আমার টাকা কি আলাদা?"

অমলেশ বলে--"তাহলে লোন ক্যানসেল?"

ত্রিপর্ণা নায়িকার মতো হাসে

বলে--"ইয়েস! লোন ক্যানসেল" ত্রিপর্ণা হাসে অমলেশ হাসেসুপর্ণা হাসে অর্পণ হাসে কিন্তু গভীর অন্ধকার নেমে আসে বিনতাদেবীর চোখে!

তারপর আমিন আসে বাড়ি ঘর মাপা হয় কার ঘর কোথায় বানাতে হবে ইত্যাদি মাপজোক করে ঠিক করতে থাকে সেই সময় একদিন বিনতাদেবী সুযোগ পেয়েই ত্রিপর্ণাকে  আড়ালে ডাকেন

বলেন--"খবরদার পর্ণাঅমলেশের টাকায় ঘর বাঁধিস না! আমি তোর নামে সব লিখে দিচ্ছি সত্যিই তো  আজ বাদে কাল সে যদি এমন বলে তাহলে ওদেরও অশান্তি, আর তোর সংসারেও"

ত্রিপর্ণা বলে--"কিন্তু মা যদি জানতে পারে খুব অশান্তি করবে! তুমি জানো না মা, যে তোমার জামাই সুপর্ণা আর অর্পণকে প্রাণাধিক  ভালোবাসে মা! সবাইকে নিয়ে এক সাথে থাকবে বলেই এতোকাল অপেক্ষা করেছে,মা!"

মা অনুনয় করেন--" নারে পর্ণা তুই বরং জায়গা-জমি নিজের নামে করে নে মা তোরা তিন ভাই বোন কারোর দয়ায় দিন কাটাবি না!"

তারপর থেকে বিনতা দেবী নিজেই বারবার মেয়েকে তাড়া লাগান-‘ কীরে কবে করছিস,মা! তাড়াতাড়ি করে তোর নামে লিখে নিস!"

বিনতাদেবীর মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুপর্ণা আর অর্পণকে অমলেশ হয়তো ঘর থেকে বারই করে দেবে

একদিন ত্রিপর্ণা উকিল নিয়ে এসে হাজির সমস্ত জায়গা-জমি নিজের নামে করে নিল

তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে--

" মা,আমার এক বিন্দুও ইচ্ছে ছিল না কিন্তু শুধু তোমার জন্যই এই কাজটা করলামমা,অমলেশ যেন কখনো না জানতে পারে...!"

জমি বাড়ি নিজের নামে হবার পরই ওদের আচরণে পার্থক্য এসে গেল তারপরও আড়াই মাস মতো ছিল ত্রিপর্ণা অমলেশ ওই বাড়িতে প্রোমোটারকে বাড়িটা বুঝিয়ে দিয়েই  নিজেরা দুজন কেটে পড়ে ধরমপুর গাঁ থেকে গ্রামের মানুষগুলির কাছ থেকে

 

মনের মতন ঘর সাজাতে বেশ কয়েক বছর লেগেছে অমলেশের ত্রিপর্ণাকে সুখী করেছে কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় এই সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত লোক পাওয়া যায় না ঠিকে কাজের লোক পাওয়া যায় কিন্তু সবসময় থেকে নিজের বাড়ির মতো, নিজের লোকের মতো করার মানুষ একদমই নেই সবচেয়ে বড়ো কথা প্রচুর টাকা চায় সেই টাকায় সারাজীবন ফল খাওয়া যায় প্রতিদিন টাটকা ফুল কিনে আনলেও সারা জীবন এতো টাকা লাগবে না এরা এত টাকা চায় আর তার চেয়েও বড়ো কথা চুরি হওয়ার আশঙ্কা যাকে রাখা হল সে- একদিন লোকজন নিয়ে চুরি করে পালিয়ে যাবে না এমন বিশ্বস্ত মানুষের বড়োই অভাব ফলে নিজেদের অনুপস্থিতিতে কাউকে রাখার চিন্তা পত্রপাঠ বাতিল একটা মেয়েকে রাখা হয়েছে খুব সকালে আসে বাসি কাজ করে, থালা-বাসন ধুয়েমুছে রান্না করে দিয়ে যায় ওই একবেলাতেই বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ত্রিপর্ণাই করে কিন্তু প্রচুর গাছ লাগিয়েছে অমলেশ সেগুলোকে নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়, জল দিতে হয়সেসব অমলেশ করে কিন্তু রাতে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে বিছানায় আসে অমলেশ ত্রিপর্ণা বুঝতে পারে বলেছে অমলেশকে একটা আলাদা লোক দেখতে অমলেশ খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না খুঁজলেই কি সব পাওয়া যায়? অনেক কষ্টে একজন মালি পাওয়া গেছে কিন্তু তার বিশাল ডিম্যাণ্ড রাজা-বাদশার মতো আচরণ তার চাহিদা মিটিয়েই তাকে রাখা হল তবুও অমলেশকে অনেক পরিশ্রম করতে হয় মাসকাবারি বাজার তো একবার করে সেটাও অমলেশই করে তাছাড়া মাছ, দুধ, সব্জিও করতে হয়প্রায়দিনই কিছু না কিছু লাগেই সামনের বাগানটা অনেক বড়ো বিশাল বিশাল গাছ লাগিয়েছে সেখানে অমলেশ মালির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারে না অমলেশ সে পুরো যত্ন নেবে না বলেই মনেহয় অমলেরগাছগুলো সে যেন সন্তানস্নেহেই মানুষ করছে মাঝে মাঝে ত্রিপর্ণা বলে --"তোমাকে যেতে হবে না মালিই তো আছে অতগুলো করে টাকা দিচ্ছি মাসে মাসে সেকি এমনি এমনি?"

অমলেশ বলে--"না গো তুমি বুঝতে পারছো না আমার গাছগুলোকে বাঁচাতে আসেনি তো ব্যবসা করতে এসেছে গাছ মরে গেলেই আর একটা গাছ নিয়ে আসবে নতুন গাছ আনলেই পয়সা পাবে কিন্তু আমার তো কষ্ট লাগে জানো, সেদিন কী জোরে জোরে কামিনীর ডালগুলো

ছাঁটছিল...!  গাছের কাণ্ড নড়ে যাচ্ছিল গাছের পাতা বা ডাল ছাটতে হয় এমনভাবে যাতে তার শরীরে আঘাত না লাগে আর কাণ্ডে আঘাত লাগলে গাছ কমজোরি হয়ে যায়"

ত্রিপর্ণা বলে--"বাব্বাগাছগুলোকে তুমি এতো ভালোবাসো?"

অমলেশ বলে--"আসলে ওগুলোকে নিজের হাতে তৈরি করেছি...! গত চার বছর ধরে একটু একটু করে কোনো গাছের পাতা কখনো আমি ছাটি না ভাল্লাগে না যদিও কাটতে হয়,খুব সাবধানে"

ত্রিপর্ণা আবার  বলে--"বাব্বাহ! গাছগুলোকে এতো ভালোবাসো? "

অমলেশ বলে--"তুমিও বাসতে এইভাবে নিজের হাতে যদি জল দিতে, গোঁড়া কুপিয়ে দিতে, সার দিতে... তুমিও ভালোবাসতে!"

ত্রিপর্ণা বলে--"সেতো আমি এখনো বাসি কিন্তু আমি আমার প্রয়োজনে গাছকে ভালোবাসি তাতে গাছের কাণ্ড নড়ে গেলে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না আমার বাগান দেখতে সুন্দর লাগা নিয়ে কথা! কাণ্ড নড়ল তো ভারি বয়েই গেল!"

অমলেশ বলে--"এভাবে বোলো না প্লিজ"

ত্রিপর্ণা বলে--"কীভাবে বলছি! গাছ তো নিজেই নিজের পাতা খসায়! অদ্ভুত তো তুমি!"

অমলেশ বলে--"আমি একটুও অদ্ভুত নই গাছ নিজেই নিজের পাতা খসায় তা ঠিক কিন্তু সেটা শুকনো পাতা ওই পাতার কোনো প্রাণ নেই তার সাথে তুমি কাঁচা সবুজ পাতার তুলনা করছো? "

ত্রিপর্ণা বলে-- "হ্যাঁ, তা ঠিককিন্তু তাই বলে গাছ ছেটে সুন্দর করব নাভাববো গাছের ব্যথা লাগছে? এই চিন্তা তুমি ছাড়া আর একজনেরও আছে কী না সন্দেহ!"

অমলেশ বলে--"কাল থেকে তুমি নিজে মালির সাথে থাকবে তুমিও যদি গাছকে ভালো না বাসতে পারো তখন বলো যে কোনো প্রাণীকে কাছ থেকে দেখলেই তাকে ভালোবেসে ফেলবে!"

ত্রিপর্ণার চোখে কৌতুক

"তাই বুঝি? তা এতোটা পড়াশুনা করেছো, কাছ থেকে কোনো  মেয়েকে দেখোনি?"

অমলেশ হকচকিয়ে যায়---"মানে?"

ত্রিপর্ণা হেসে ফেলে বলে--"বাপরে! তোমার চোখ-মুখ  দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো সীতা বা দৌপদীর কথা লুকিয়ে রেখেছো বুকের মধ্যে"

বলে ত্রিপর্ণা হেসে অমলেশের গায়ে ঢলে পড়ে কিন্তু অমলেশের মনে এক অস্থির অস্থির ভাব তো সত্যিই লুকিয়ে রেখেছে বলে দেওয়াই তো উচিত কিন্তু কেন বলেনি আজও  অমলেশ ত্রিপর্ণার কাছে পিয়ার কথা? এখন কি বলবে? কিন্তু  পিয়া তার কাছে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয় যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে নেহাত ওইরকম একটা বিসদৃশ আচরণ করেছিল তাই...! হঠাৎ একটা চিন্তা ভীষণভাবে এল অমলেশের মাথায় সে পিয়াকে নিয়ে অনেক বেশিই চিন্তা করছে সে যদি পিয়ার ঘটনাটা ত্রিপর্ণাকে বলেও দেয় তাহলেই কি আর তার চিন্তায় পিয়া আসবে না? তার বিশ্বাস তারপরেও পিয়া তার চিন্তায় আসবেই অমলেশ বেশ বুঝতে পারছে পিয়া ওর অশান্তির একটা মোক্ষম কারণ এই চিন্তা থেকে অমলেশ বেরতে চায় বেরতে গেলে সোজাসুজি সব ত্রিপর্ণাকে বলতে হবে আর ত্রিপর্ণাকে বলার আগে নিজেকে চিনতে হবে নিজেকে চিনতে গেলে দেখা করতে হবে পিয়ার সাথে নাহ, অমলেশ ত্রিপর্ণার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে না সে শুধু একবার দেখা করবে পিয়ার সাথে কেমন আছে পিয়া কে জানে বহু বছর কোনো খোঁজ-খবরও নেয়নি সে পিয়ার সম্পর্কে বিয়ে করেছে কীনা তাও জানে না! পিয়ার কথা মাথায় আসতে না আসতেই সে যে কেমন করে রাতটা ত্রিপর্ণার পাশে শুয়ে কাটাল বা কখন ঘুমালো অথবা কখন সকালে ঘুম থেকে উঠল, কিচ্ছু মনে নেই তার কেমন যেন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে কেটে গেল তার রাত এবং অফিস সে পিয়ার নাম্বারে ফোন করল শুনল যে সেই নাম্বারটার নাকি কোনো অস্তিত্বই নেই! অবাক হয়ে অমলেশ ভাবছিল আবার কী কথা! পিয়ার নাম্বারের কোনো অস্তিত্ব নেই? সে রাজুকে ফোন করল রাজু, সে আর পিয়া অনেক সময় একসাথে থাকত রাজুর মোবাইলে একবার রিং হতেই সে  অন করলো এবং বলল--"বল কেমন আছিস অমু? এতোদিন বাদে কী মনে করে?"

অমল বলল--"ভালো আছিতোদের খবর কী বল!"

রাজু বলল--"আমাদের আর নতুন কোনো খবর নেই! আমি চাকরি-বাকরিও পাইনি তুই তো ভালো রেজাল্ট করলি, ভালো চাকরি পেলি, ভালো চাকরিওয়ালা এবং  সুন্দরী বউ পেলি..! আমরা শালা বেকার পড়াশুনা করে বাপের পয়সা ধ্বংস করলাম"

বিরক্ত লাগছিল অমলেশের সে বলল--"তোকে একটা দরকারে ফোন করেছি"

রাজু বলল--"তা তুই কী ভাবলি, যে, আমি ভেবেছি তুই বিনা দরকারে ফোন করেছিস? আমাদের খবর নিবি বলে?"

অমলেশ বলল--"মানে? কী বলছিস তুই?"

রাজু বলল--"বাদ দেদরকারটাই বলে ফেল গুরু! "

অমলেশ বলল--"আসলে আমি...!"

অমলেশ বুঝতে পারছে না যে, এতো কেন ইসস্তত করছে একসাথে স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করেছে একসাথে সিনেমায় গেছে মারপিঠ করেছে যখন-তখন ফোন করেছে আর তার একটা মোবাইল নাম্বার চাইতে এতোটাই জড়তা?

রাজু বলল--"যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেল বন্ধুআমার অনেক কাজ আছেতোর মতো তো আয় করতে পারি না কয়েকটা ট্যিউশানি করে সংসারে কিছু একটু দেইআমার এতো সময় নেই রে...!"

অমলেশ বলেই ফেলে--"বলছিলাম তোর কাছে পিয়ার নাম্বার আছে? আমি ফোন করেছিলাম ওর পুরানো নাম্বারটা আর নেই মনেহয়!"

রাজু হো হো করে হাসল

তারপর বলল--"কেন থাকবে না? আমি তো আর সাত বছর পরে ফোন করছি না ওকে? আমাদের এখনো আগের মতোই কথাটথা হয় তো!"

অমলেশ বলল--"নাম্বারটা একটু আমার হোয়াটসঅ্যাপে দিবি?"

রাজু বলল--"অবশ্যই কিন্তু পুরানো বন্ধুদের মনেই যখন পড়ল তখন একদিন যুগলে আয় না! আড্ডা দেই বা তোদের বাড়িতেও যেতে পারি আমি বিয়ে করেছি আমার একটা দুই বছরের মেয়ে আছে যোগাযোগ করলি বলে বলছি এতোসব ভাবিস না যে তোর অপছন্দ হলেও গিয়ে সমস্যা করব"

অমলেশ বলে--"আরে নারে,রাজু কী সব কথা বলিস তুই আমি এমন কখনোই নই!"

রাজু বলে--"বাই দ্য ওয়ে,পিয়া কিন্তু বিয়ে করেনি কাউকে ভালোবাসে তার জন্যই মোবাইল নাম্বার পাল্টিয়েছেআমাকে বলেছে পিয়া যে, সেই ছেলেটাও ওকে ভালোবাসে এবং সেই ছেলেকে নাকি ওর কাছে আসতেই হবে সেইজন্যই মোবাইল নাম্বার পাল্টিয়েছেআমাকে বলেছে বন্ধু-বান্ধব ছাড়া অন্য কাউকে ওর নাম্বার না দিতে চায় না যে সেই প্রেমিক ওর সাথে আর যোগাযোগ করুক"

অমলেশ বলে--"তোর কথার মাথামুণ্ডু নেই পিয়া তার জন্যই বিয়ে করেনি আবার সে ওর কাছে ফিরে আসবেই কারণ সেও পিয়াকে ভালোবাসে তাহলে নাম্বার কেন পাল্টালো? কীরকম কনফিউজিং কথাবার্তা,না?"

রাজু বলে--"হ্যাঁ তো! ঠিকই তো তুই জিজ্ঞাসা করিস! বুঝতে পারিস নাকী দেখিস!"

বলে একটু থেমে বলল--"পিয়ার নতুন নাম্বার দিয়েছি তোর হোয়াতে পুরানোটা আর ব্যবহার করেনা অনুরোধ নাম্বারটা কাউকেই দিবি না"

অমলেশ বলল--"কোনো প্রশ্নই আসেনা অন্য কাউকে নাম্বারটা দেবার"

বলে অমলেশ ফোন কেটে পিয়াকে ফোন করল একবার রিং হতেই

 পিয়া বলল--"বল কেমন আছিস?"

অমলেশ বলল--"আমার নাম্বার তোর নতুন ফোনে  সেভ করা আছে?"

পিয়া বলল--"না থাকলে আর বুঝলাম কী করে! হুম বল এতো বছর বাদে কী মনে করে?"

অমলেশ বলল--" বিয়ে করিস নি কেন? ভালো আছিস? তুই নাকি কাউকে ভালোবেসে একদম দিওয়ানা হয়ে গেছিস? তারজন্যই নাকি তোর এই জীবনের অপেক্ষা!"

পিয়া জোরে জোরে হাসল

বলল--"কতগুলো প্রশ্ন করেছিস জানিস? বাপরে!"

অমলেশ বলে--"উত্তর দে এক এক করে!"

পিয়া বলে--"তোর বউ কেমন আছে বল!"

অমলেশের মনে পড়ে যায় বলে--"বিয়েতে আসিস নি কেনরে?"

পিয়া বলে--"এবার যাব তোর ছেলে মেয়ের মুখে ভাতে বলিস তখন গিয়ে চারদিনের খাওয়া একদিনে খাব"

অমলেশ বলে--"কিন্তু তোর সাথে একদিন দেখা করতে চাই!"

পিয়া বলে--"ঠিক আছে ছুটির দিন তোদের বাড়ি চলে আসব আমি রাজু,রাজুর বউ আর মেয়ে!"

অমলেশ বলে --"আমি আজই তোর সাথে দেখা করতে চাই"

পিয়া বলে--"বাব্বাহ এতো তাড়া কীসের রে?"

অমলেশ বলে--"মাত্র একবার পিয়া! আমার কিছু বলার আছে পাঁচ মিনিটের জন্য আয়! কিংবা দুই মিনিট! প্লিজ পিয়া...! আর  কোনোদিন তোকে বিরক্ত করব না কথা দিলাম"

কথাগুলো বলেই চমকে উঠল অমলেশ! সাত বছর আগে পিয়া ওকে যা যা বলেছিল, এখন ওও ঠিক সেই কথাই বলল হুবহু এক

অবাক হয়ে বেশিক্ষণ থাকতে দিল না অবশ্য পিয়া

বলল--"ঠিক আছে আয়আজই ছটায় দেরি করবি না অমু"

অমলেশ সেদিনের মতো আজও হাজির হল সেই একই পার্কে আজ পিয়া আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল সেই একই জায়গায়

অমলেশ অনেক কিছু বলবে বলে গেছিল ভেবেছিল সে জিজ্ঞাসা করবে কেন সেদিন অমন আচরণ করেছিল পিয়া? তার কি উদ্দেশ্য ছিল? অমলেশ কেন ওই ঘটনাটা ভুলতে পারে না? পিয়া কি যাদু-টাদু জানে নাকি? কিন্তু সে কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করতে পারল না পিয়াও কিচ্ছু বলতে পারল না দুজনের চোখে চোখ মিললেই যেন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল দুজনে দুজনের কাছে

পিয়া আবার ঝাঁপিয়ে পড়লআবার সে হু হু হু হু করে কেঁদে ভাসাল আবার অমলেশের জামা ভিজল আবার জামার নীচের বুকও অশ্রুতে ভিজে গেল এবং এবার অমলেশও পিয়াকে দুই বাহু দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল এবার অমলেশও কেঁদে ফেলল এবার অমলেশ পিয়াকে আরো কাছে চাইল! পিয়াকে সম্পূর্ণ করে পাবার এই তীব্র বাসনা সে আগে বুঝতে পারেনি পার্কের অন্ধকার ঝোপের মধ্যেই সে পিয়াকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল পিয়া বাধা দিল না অমলেশ হয়ে পড়ল হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মানুষ হয়েও অমানুষের মতো অথবা অতিমানুষের মতো তারা খোলা পার্কে সম্পূর্ণ ধরা দিতে বাধ্য হল পিয়ার শরীরের ভিতর যেন তারই জন্য অপেক্ষা করেছে অমলেশ বারবার করে পিয়াকে চুরমার করে দিচ্ছিল যখন, ঠিক সেই মুহূর্তে, ঠিক তখনি ত্রিপর্ণা অমলেশকে ফিশফিশ করে ডাকছিল --"অমল,অমল" বলে আর অমলেশ পিয়াকে আরো জোরে, আরও নিবিড় করে পেতে গিয়ে টের পেল যে সে ত্রিপর্ণার বাহুবন্ধনে সে যুদ্ধের মাঝপথে থামতে জানে না

তারপর কীভাবে যেন এক চিরকালীন জৈব প্রক্রিয়ায় অমলেশ নিজেকে নিংড়ে দিল ত্রিপর্ণার কামনায় এবং সে  অবাক হয়ে ভাবল পিয়া তবে তার কল্পনায় এসেছিল? রাজুও?

তখন রাত শেষ প্রহর তখন বাইরে অমলেশের বাগানের মাথার অন্ধকারের দলাটা আরো বড়ো হয়ে উঠল আরো ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ঠিক সেই সময় ত্রিপর্ণার মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকল--"দিদি,তুই তো আমাদের তোর আর জামাইবাবুর ফোন থেকে ব্লক করেছিস জানিনা কেন তবুও মেসেজ করছি  নতুন নাম্বার থেকে মনে হল জানাতে

 মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে আমাদের ধরমপুর গ্রামে যে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই তা তো তুই জানিস

চলবে----------------        

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.