Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। নতুন আলোর দিশা ।। দীপক পাল

 

নতুন আলোর দিশা  

দীপক পাল 



- ' ওগো, এবার পুজোর বাজার হবে কবে? বিশ্বকর্মা পুজোতো এসে গেল। আশেপাশে সব
বাড়ীতে লক্ষ্য করছি পুজোর বাজার অনেকেই শুরু করে দিয়েছে। আমাদের কবে হবে?'
উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে সঞ্চিতা সোহমকে। সোহম সঞ্চিতার দিকে না তাকিয়ে বললো,
- ' দেখি কি হয়।' 
- ' তার মানে, এটা আবার কেমন কথা। আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি গতবারে বাবা-মাকে ঠিক
ভাল জামা কাপড় দিতে পারিনি। এবার কিন্তু একটু  ভাল কোয়ালিটি দিতে হবে। তাছাড়া
ছোট বোনটাকেও এবারে একটা ভাল শাড়ী দিতেই হবে, বুঝলে কিছু? সে তুমি আমায়
কিছু দাও বা না দাও তাতে আমি কিছু মনে করবোনা। তোমার মা-বাবাকেও ভাল জামা
কাপড় দেওয়া চাই। নিজের মা-বাবা বলে কথা।' এ কথা বলে সে রান্নাঘরে ঢুকলো।
            এদিকে সোহমের চোখে অন্ধকার হলো আরও গভীর। কেন জানি সঞ্চিতাকে
সে কারখানায় লক আউটের কথাটা বলতে পারছে না। মনে করেছিল খুব শীঘ্রই
লক আউট উঠে যেতে পারে। তাই প্রতিদিনই ঘর থেকে অফিস টাইমে সে বেরিয়ে পড়ে।
সে বাসে না চড়ে  হেঁটে কারখানার গেটে গিয়ে বসে। কলিগদের সাথে বসে দুঃখের কথা
ভাগ করে নেয়। সবার সাথে স্লোগান সাউটিং দেয় আবার বসে। ভারে করে চা খায়।
একসময় উঠে পড়ে। এলোমেলো রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তারপর ঠিক সময় বাড়ী ফেরে।
সঞ্চিতা মনে হয় কিছু বুঝতে পারেনা। মনে মনে এখন সে আন্দোলনে আর আস্থা
রাখতে পারছে না। একটা কথা আছেনা,  খাচ্ছিলো তাঁতী তাঁত বুনে মুসকিলে পড়লো
এঁড়ে গরু কিনে। কারখানার মালিক পুজোর সময় কিছু অগ্রিম দিত। পরে সেটা মাসে
মাসে বিনা সুদে কেটে নিত। তাতে করে পুজোয় কেনাকাটা কিঞ্চিত হলেও সুবিধা হতো।
এবার কারখানার লোক ও অফিসে কর্মরত সব লোকজন মিলে দাবী করলো অগ্রীম না
এক মাসের মাইনে বোনাস হিসাবে দিতে হবে। মালিক মানতে রাজী হলোনা। অনেক
মিটিং করেও মালিক পক্ষ কোনমতে বোনাস দিতে রাজি হলোনা। কারখানার লোকেরা
গো স্লো শুরু করলো। অফিসেও তাই। কাজের মাঝে সবাই স্লোগান দিতে থাকলো। এই
করে কিছুদিন চলার পর অবশেষে একদিন শ্রমিক ও অফিসের বাবুরা এসে দেখে
অফিসের গেটে মস্ত তালা ঝুলছে আর তার সাথে কারখানা লক আউটের নোটিস
ঝুলছে। কারখানার মালিকের বাড়ী গিয়ে দেখে সেখানেও তালা ঝুলছে। এক বিহারী
পালোয়ান ফটকে একটা বড়ো তালা লাগিয়ে ভেতরে এক গাছের ছায়ায় টুলের
ওপর বসে আড়মোড়া ভাঙছে। তার কাছে কোন খবর পাওয়া গেলনা। শুধু এইটুকু
বোঝা গেল তেনারা সব কোথায় বেড়াতে গেছে অনেক দিনের জন্য।
            সোহম বিয়ে করেছে বছর দুয়েক হলো প্রায়। আগে দাদার কাছে থাকতো।
মা বাবাও দাদার সাথে থাকে। ও প্রেম করে হঠাৎ একদিন সঞ্চিতাকে বিয়ে করে
বসলো। জায়গার অভাব তাই একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করলো। রান্নাঘরটা
খুব ছোট। বাথরুম কমন বাড়ীয়ালার সাথে। তার আবার দুই মেয়ে। তাই বাথরুম
নিয়ে বেশ সমস্যা হয়। কিন্তু সঞ্চিতা শত অসুবিধার মধ্যেও নিজেকে ঠিক মানিয়ে
নিতে পেরেছে। সে জানে তার স্বামীর আয় খুবই সীমিত। তাতে তার কোন দুঃখ নেই।
সোহম আগস্ট মাসের মাইনে পেয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের মাইনে পাবে কিনা ঠিক
নেই। সেটা পাওয়ার কথা পুজোর মুখে অর্থাৎ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। শোনা
যাচ্ছে অফিসের কেশিয়ারের কাছ থেকে যে মালিকের ব্যাঙ্কে যে ব্যাঙ্কের সাথে লেন
দেন হয় অফিস অ্যাকাউন্টসের সেখানে যথেষ্ট টাকা আছে যাতে সেপ্টেম্বরের বেতন
আরামসে হয়ে যায়। কিন্তু মালিকের লিখিত অর্ডার চাই। মালিকতো পলাতক
অর্ডার আসবে কি করে। তাই সে খুব টেনেটুনে চালাচ্ছে। সঞ্চিতা একদিন বলে,
- ' আজকাল তুমি ঠিক ঠাক বাজার করছো না। খাওয়াও তোমার খুব কমে গেছে।
কথাও বিশেষ বলোনা। সব সময় একটা কেমন আনমনা ভাব। তোমার এখন মাছ
খাওয়া একান্ত প্রয়োজন, সেটা তুমি আন না। কিন্তু কেন বলতো? আয়নাতে তুমি
নিজের চেহারাটা একটু দেখ গিয়ে। আমি আর কিছু বলবো না।'
            সোহম উঠে পরে। জামা কাপড় পরে অফিস টাইমে ঠিক বেরিয়ে পড়ে।
আজকে সে কারখানার দিকে আর গেল না। হাঁটতে হাঁটতে সোজা ময়দানে প্রবেশ
করলো। মাঠ দিয়ে সোজা হেঁটে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের  উল্টো দিকের মাঠে
গিয়ে রুমাল পেতে বসলো। আজকাল সে বাসে চড়েনা। হাঁটাটাই সম্বল করেছে
সে। বসে বসে নানা চিন্তা মাথায় ভীড় করে এলো। মনে মনে ভাবলো এতদিন তো
সঞ্চিতাকে বলেনি যদি সে ভয় পেয়ে যায়। তাছাড়া ও যদি দুজনেরই মা বাবাদের
বলে দেয়, তার চেয়ে না বলাই ভাল। আজ কিন্তু সে অন্য চিন্তাই করলো। ভাবলো
সত্য কথাটা সঞ্চিতাকে বলে দেওয়াই ভাল। সত্যের সামনা সামনি হওয়াটা এখন
খুব দরকার। সঞ্চিতা নিশ্চয়ই অত অবুঝ হবেনা। ও মনে হয় কোন কিছু আঁচ
করতে পেরেছে। আজকে বাড়ী ফিরে কারখানার লক আউটের কথা ওকে ধীরে
সুস্থ বলতেই হবে। ওর পরামর্শটা শোনা একান্তই দরকারি। উঠে পরে সোহম।
খানিকটা এদিক সেদিক ঘুরে সোজা হেঁটে বাড়ীর রাস্তা ধরলো। আসলে সোহমের
চৌরঙ্গীর ফুটপাথ ধরে হাঁটতে খুব ভালবাসে। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা যেন এই ফুটপাথ। 
 সন্ধ্যেবেলা চা সহযোগে দুজনে মুড়ি খেতে খেতে সোহম ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে,
- ' সঞ্চিতা, তোমায় একটা খুব খারাপ খবর দেব, তুমি কতটা মনে প্রাণে সেটা                                                নিতে পারবে আমি ঠিক জানিনা। কিন্তু যেটা বলবো সেটা আমাদের পক্ষে খুবই                                                     বেদনাদায়ক হলেও কথাটা একদম সত্যি।'
- ' কি এমন খারাপ খবর গো যা খুব বেদনাদায়ক?' শঙ্কিত হয় সঞ্চিতা। ' কদিন
ধরে তোমার কান্ড কারখানা দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়েছি। কিন্তু কি ব্যাপার?'
- ' জান এবার আমরা কারখানার মালিকের কাছে দাবি রেখেছিলাম যে আমরা
কোন অগ্রীম চাইনা আমাদের এক মাসের বেতন পুজা বোনাস হিসাবে দিতে
হবে। স্বাভাবিকভাবেই মালিক তাতে রাজী হয়না। চলে কাজের গো স্লো নীতি।
আর তার সাথে চলে স্লোগান সাউটিং। একদিন অফিসে গিয়ে দেখি অফিসের
গেটে বিরাট তালা ঝুলছে আর তার সাথে লক আউটের নোটিস। মালিক নো
পাত্তা। বাড়ীতে নেই। বাড়ীর সবাইকে নিয়ে কোথায় পালিয়েছে। কিন্তু যাবে সে
কোথায়? এক দিন না একদিন ফিরতেই হবে তাকে। তবে পুজোগুলোর মধ্যে
সে হয়তো ফিরবে না। আমাদের পেটের ভাত সে মেরে দিয়েছে। কি যে করি।'
- ' কিন্তু মালিক ফিরলেও কারখানা যদি আর না খোলে। আমাদের তাহলে কি
হবে বল? আমার পেটের বাচ্চাটাকে আমি বাঁচাবো কি করে বলো?'
- ' কি বলছো সঞ্চিতা, সেটা আবার কবে হলো, কৈ কোনদিনতো জানাও নি।'
- ' আমারতো অনিয়মিত হয় তাই বুঝিনি আগে কিন্তু দিন পনের ধরে বুঝতে
পারলাম। তোমাকে বলবো কি তোমার হাবভাব দেখে আমার ভয়ই করছে।
এখন দেখছি ভয়টা অমূলক নয়।' সোহম হতাশ হলেও মনটাকে শক্ত করলো।
- ' আচ্ছা আমি কঠিন পরিশ্রম করে দুজনে প্রতিজ্ঞা  করে আমাদের বাচ্চাকে
পৃথিবীর উজ্জ্বল  আলোয় নিয়ে আসতে পারি না?'
- ' পারবো নিশ্চয়ই পারবো তোমার সাথে একযোগে পরিশ্রম করে, প্রমিস।'
            দুজনের চোখেই এক উজ্জ্বল আশার আলো ছড়িয়ে পড়লো।
 ---------------------------------


Address :-
----------------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8,  Flat-1B ,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.