Click the image to explore all Offers

গল্প ।। আত্মকেন্দ্রিক ।। মাখনলাল প্রধান

 

 আত্মকেন্দ্রিক  

মাখনলাল প্রধান     


আমি যখন একা একা হেঁটে চলি , তখন রাস্তাটা আমার পায়ের শব্দকে কেবল প্রতিধ্বনি করে না—মনে হয় ওটা কোথাও লিপিবদ্ধ হচ্ছে । কে বা কারা সেই রেকর্ড রাখছে আমি জানি না , তবে যতবার সাহার চায়ের দোকানের দিকে এগোই , ততবার মনে হয় আমার পদক্ষেপগুলো যেন কারও অফিসের ফাইলে সাজানো হচ্ছে , যেমন দফতরে নথি সাজানো হয়।
সাহার দোকানটা সামান্যই—একটা টিনের ছাউনি , কয়েকটা বাঁশের বেঞ্চ , আর কাচের শোকেসে মশলাদার বিস্কুট । তবুও আশ্চর্যের ব্যাপার , আমি যতবার সেখানে যাই , দোকানটা আমাকে একইভাবে অভ্যর্থনা জানায় না । কোনো কোনো দিন মনে হয় দোকানটা ছোটো হয়ে এসেছে , বেঞ্চগুলো ঠেসে রাখা , বসার জায়গা নেই । আবার কোনো কোনো দিন , দোকানটা অস্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হয়ে যায় , বেঞ্চের পর বেঞ্চ , আলো-ছায়ার খেলা , যেন একটা অনন্ত কক্ষ যেখানে গল্পগুলো নিজেদের মতো বসে আছে ।
বেঞ্চে ছেলেরা বসে থাকে । তাদের মুখে একধরনের আলো ঝলমল করে—আলোর উৎস আমি খুঁজে পাই না । তারা নিজেদের গল্পে ডুবে থাকে । সেই গল্পগুলো এমন , যেগুলো নাকি কেবল তাদের জন্যই , অথচ আমি যখন হাঁটতে হাঁটতে আসি , আমার পদক্ষেপের শব্দ যেন তাদের আলোচনায় অনাহূত ঢুকে পড়ে । একজন হঠাৎ মুখ তুলে আমার দিকে তাকায়। তার চোখে বিস্ময় নেই , আবার অস্বস্তিও নেই। যেন আমাকে দেখাই তার দায়িত্ব ছিল , কিন্তু আমাকে চিনতে না পারা তার কর্তব্য । এক সেকেন্ডের জন্য সে তাকায় , তারপর চোখ নামিয়ে আবার গল্পের রহস্য রোমাঞ্চে ঢুকে যায় ।
তাদের আলোচনা প্রতিদিনের সুখ-অসুখ , তুমি -আমি ঘিরে , কিন্তু আমার কানে সেগুলো অর্থহীন শব্দদঙ্গলের মতো ভেসে আসে । কেউ বলে, "আজ বাজারে ভাল মাছ পাওয়া গেল না।" অন্যজন বলে, "কালকের খেলাটা দারুণ জমবে ।" কিন্তু আমার মনে হয় , এরা আসলে গোপন সংকেত আদান-প্রদান করছে। তাদের প্রতিটি শব্দের পেছনে অদৃশ্য এক তদন্তকারী দল দাঁড়িয়ে আছে । আমি যত বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনি , তত বেশি বুঝতে পারি , তাদের প্রতিটি বাক্য আমার নামেই সাবধানতা অবলম্বন করে ।
আমি ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি টের পাই , অথচ নিজেকে আটকাতে পারি না । এই দোকানের আলোচনাগুলোতে আমার জন্য একটা অদৃশ্য চেয়ার বরাদ্দ করা আছে । আমি যদি বসি , গল্পগুলো বদলে যাবে ; আমি যদি নাও বসি , তবু আমার নাম আলোচনার আড়ালে থেকে যাবে ।

প্রাচীরের পাশে প্রেমিকযুগলরা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের ঠোঁট নড়ে, কিন্তু শব্দ আসে না । আমি দূর থেকে দেখি , তবু আমার কানে ভেসে আসে সেই নিঃশব্দ কথা , এবং অবাক হয়ে শুনি—তারা যে প্রতিজ্ঞা করছে , তাতে আমার নাম জড়িয়ে আছে । যেন আমি তাদের সম্পর্কের সাক্ষী নই , বরং সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো কাগজপত্রে আমার স্বাক্ষর জরুরি ।
একটা ঝুঁকে থাকা গাছের আড়ালে সাইকেলে  ভর করে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে । আমি ওকে চিনি না , অথচ মনে হয় বহুদিনের পরিচিত । সে সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেয় , আর সেই ঘূর্ণন থেকে যেন একটা ছোটোগল্প তৈরি হয়ে যায় । গল্পটা হাস্যরসে ভরা , ফিসফিসে গড়া , কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে আমাকে ঘিরে ধরে। আমি না চাইলেও সেই গল্পের চরিত্র হয়ে যাই। আমার নাম যেন অজান্তেই সেখানে লেখা হয়ে যায়।
আমি বুঝতে পারি, এগুলো কোনো সাধারণ দৃশ্য নয় । এগুলো একেকটা প্রমাণপত্র, যেগুলো দিয়ে আমার অদৃশ্য বিচার চলছে ।

ফেরার পথে দেখি , সাহার বউ বাসন ধুতে ধুতে একা একা বকবক করে। তার গলার স্বর ধারালো। প্রতিটি শব্দ যেন আমার অপরাধ তালিকার একটি নতুন ধারা তৈরি করছে । আমি বসে শুনি—যেন ওর ভাষায় আমার ভবিষ্যৎ রায় ঘোষণা হচ্ছে । অথচ কেউ ওকে থামায় না।
বেঞ্চের ওপর গলগলিয়ে আলো ঝরে পড়ে। আলোটা কেবল আলো নয়—এটা যেন একটা অফিসিয়াল সাক্ষী । সে সবকিছু নথিভুক্ত করছে । আমি নড়তে চাই , কিন্তু পারি না। আলো আমার নড়াচড়া আটকে রাখে।
এমন সময় হঠাৎ এক শূন্যতা নেমে আসে। সেটা এত ভারি যে আমি হাঁটতে পারি না । আমার শরীর ভারি হয়ে যায় , যেন নিজের ভেতরেই ধসে পড়ছি। আমি বেঞ্চে বসে পড়ি । মনে হয় বেঞ্চটা আমাকে নিজের অংশ বানিয়ে নিয়েছে । আমি ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকি। আমার হাত-পা , মুখ সবকিছু মুছে যাচ্ছে। আমি শুনতে পাই—আমার নাম নিয়ে তাদের গল্প চলছে , কিন্তু আমি সত‍্যিই জানি না আমি কে ?
শূন্যতার ভেতর আমি উপলব্ধি করি—আমি হয়তো বহু আগেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলাম। কেবল এই শহর, এই চায়ের দোকান, এই ছেলেদের আলোচনা, সাহার বউয়ের বকবক, প্রেমিকযুগলের প্রতিজ্ঞা—সব মিলে একটা নাটক মঞ্চস্থ করছিল । নাটকের কাহিনি একটাই : আমার বিলীন হওয়া ।
আর আশ্চর্যের বিষয় , আমি এতে বিরক্ত নই । আমি জানি না আমি খুশি কিনা , কিন্তু অদ্ভুতভাবে মনে হয় এই নাটক চলতেই থাকবে । আমি শুধু একটি দৃশ্য , যার প্রমাণ রাখতে হবে । আমার বিলীন হওয়া হয়তো আসলেই গল্পের সমাপ্তি নয় , বরং শুরুর প্রথম পর্ব ।
আমি তখন স্থির হয়ে বসে থাকি । আলো আমার উপর ঝরে পড়ে । দোকান থেকে ভেসে আসে অস্পষ্ট ফিসফিসানি । শহর ঘুমোতে যায় , অথচ আমি জানি আমি কোনোদিন ঘুমোতে পারব না—কারণ আমি এখন চায়ের দোকানের বেঞ্চ , আলো , আর গল্পের অদৃশ্য কেন্দ্রবিন্দু।
=======================

Makapal pradhana
Suka tapally , boral
Kol-700154

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.