মিসেস সেন
সুদীপ্ত পারিয়াল
মিসেস সেনের ইচ্ছে ছিল সাইকোলজি নিয়ে পড়ার। কিন্তু ক্লাস নাইনে ওকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বড্ড ভালো গান করতো ও, দুটো ছবিতে অভিনয়ও করেছে, দুর্ভাগ্যবশত সেই ছবির আসল রিল নষ্ট হয়ে গেছে। যে রিলগুলো এখন দেখতে পাওয়া যায় তাতে ওনাকে দেখা যায় না।
সত্যজিৎ রায় তখন তিন কন্যার জন্য মনিমালিকা খুঁজছেন, মিসেস সেনের বয়স ধারে কাছে ছিল। ইচ্ছে ছিল একবার ওনার বাড়িতে যাওয়ার। বাবা খবরটা শুনতে পেয়েই বিয়ে ঠিক করে ফেলল ওর। সেই থেকে বাবার উপর রাগ। বিদায়ের সময় মাকে বলে এসেছিল, এ বাড়িতে এ জন্মের মত আর আসব না।
মেয়ের এমন জেদ আর এলোই না আর কোনদিন। বাপ-মা শেষ নিঃশ্বাস অবধি আর তাদের সম্ভাবনাময় কন্যাটিকে আর দেখতে পেল না।
তারপর যা হয় আর কি, মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে স্বামীর সাথে কেটে গেল কুড়িটা বছর। ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে বড় হয়েছে। এই সময় থেকে নতুন অধ্যায় শুরু হল জীবনে।
স্বামী হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকেই চলে গেল। ছেলে তখন ১১ বছর। মেয়ে সবে মাধ্যমিক দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি বলতে জ্যাঠা, শ্বশুর, কাকা, শ্বশুররা; ওর নিজের শ্বশুর শাশুড়ি নেই। স্বামীর কোন ভাইবোনও ছিল না।
একটা স্কুলে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ নিল মিসেস সেন। এক বছর মতন ভালো ভাবে কাটলো। কিন্তু ওই যে বলে কপাল! মেয়েটা বিয়ে করে পালালো।
বলত বটে, পাড়ার একটা ছেলেকে ওর ভালো লাগে। উনি বলতেন আগে ভালো করে পড়াশোনা করো তারপর ওসব হবে। নিজে মাধ্যমিক দিতে পারেনি বলে বড় আক্ষেপ ছিল, মেয়ে মাধ্যমিক পাস করার পর খুব আনন্দ পেয়েছিল মিসেস সেন।
ছেলেমেয়েগুলো পড়াশোনা শিখে মাথা তুলে দাঁড়াবে সমাজে ওদের আলাদা করে নাম হবে, এটুকুই তো প্রাপ্তি। সেই দিন মিসেস সেন বুঝতে পেরেছিল মা হওয়ার কত জ্বালা।
আবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে, নিশ্চিন্ত বলতে মাথার উপর একটা নিশ্চিন্তির ছাদ। ছেলেটা পড়াশুনাতে ভালো কিন্তু পরিবেশ এতটাই নোংরা বড় ভয় লাগে মিসেস সেনের। নিজেকে কিভাবে এই পঙ্কিল পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে হয়, মেয়েটা তো কোন কালে বুঝলো না, ছেলেটা বুঝবে তো?
ছেলে বড় হলো, মিসেস সেনের বুড়ো হলে চলবে না। স্কুলের বাচ্চারাও ভালোবেসে ওকে মিসেস সেন বলেই ডাকে। ওদের আদুরে গলার সেই সম্ভাষণ বড় ভালো লাগে।
মাথায় রাগ চলে গেছিল যেদিন ছেলেটা প্রথম মদ খেয়ে ঘরে ঢুকলো। ওদের বাবার কিন্তু এই ধরনের অভ্যাস কোন দিন ছিল না। তিন পুরুষের পুরোহিত বংশ তারা। পুজো-আচ্ছা করেই, খায়। ছেলেটাকে সেদিন জুতো দিয়ে মেরেছিল।
স্কুলে এসে রোজকার মতন বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ডিসস্টেন্স এডুকেশন শুরু হবে। দু-তিন বছর হল, নতুন ক্লাস হয় বিকেলের দিকে। বয়সের গাছ পাথর নেই এমন সব লোকজনেরা এসে পড়ে। একই স্যার-দিদিমণি। যারা নানা কারণে সময় মতন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক শেষ করতে পারেনি, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা।
প্রথম যখন ব্যাপারটা শুরু হল তখন থেকেই ওর মনের মধ্যে ইচ্ছে ছিল ভর্তি হওয়ার। কিন্তু ওই যে বলে কপাল! মোটা অংকের একটা টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। তারপর এই বয়সে জটিল অংকের হিসেব, আর কি মাথায় ঢুকবে?
টিফিনের সময় ফিমেল স্টাফদের জন্য টিফিন কিনে আনে মিসেস সেন। কাবেরীদি বলেন, আজ এত গম্ভীর কেন?
কিছু না, দিদি।
বললেই হবে কিছু না। কি হয়েছে? ছেলের জন্য চিন্তা করছো? আবার কিছু কান্ড ঘটিয়েছে নাকি সে?
না না সব ঠিক আছে।
কথাটা এতটাই বজ্রকঠোর ছিল, কারোরই বুঝতে অসুবিধা হলো না, কিছুই ঠিক ছিল না।
রিটায়ার করার সময় হয়ে গেছে অনেকদিন। যদিও মিসেস সেন কখনও সরকারি কর্মচারী ছিলেন না। এখন ছেলেটা তার মায়ের সাথে থাকেও না। বুড়ো বয়সে একা একাই সবকিছু করতে হয়। বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হয় এই বয়সে। কি দরকার ছিল ওর বিয়ে দেবার? তার থেকে যদি মনিমালিকার ভূমিকায় অভিনয়টুকু করা যেত, তাহলে লোকে অন্তত ওর মুখখানা মনে রাখত।
চোখে জল চলে আসে। গল্পটি দিদিমণি-স্যারেরা সব জানে। তারা বলে, তুমি আবার শুরু করতে পারো মিসেস সেন! দেখছো না তোমার থেকেও বয়স্ক কত মানুষেরা রোজ আসে। তাহলে তুমি কেন পারবে না? পড়াশোনাটা কমপ্লিট কর। টাকার জন্য ভাবতে হবে না, তার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।
দিদিমণিদের উদার মানসিকতা মিসেস সেনের মনকে মজবুত করলেও, কোথায় যেন পিছিয়ে পড়েছে মনের জোর। কার জোরে পড়বে? কি হবে নতুন করে পড়ে? কি হবে একটা নতুন কাগজ তৈরি করে? আত্মতৃপ্তির বেশি আর তো কিছু নয়। এই যে ছেলেমেয়েগুলোর মাঝে সারাটা দিন কেটে যায়, এটাই কি অনেক নয়!
আরেকদিন আরেকটা কান্ড ঘটলো। ছেলে-মেয়ে দুজনেই একেবারে যৌথভাবে এসে হাজির। তাদের বাবার সম্পত্তির অংশ লিখে দিতে হবে তাদের নামে। বলতেই পারতো মিসেস সেন, এ বাড়িতে এসে থাকো, সব পাবে। বাড়ি থেকে চলে গিয়ে অংশ দাবি করো না। এই বাড়ি আমার একার নয়। বাড়ি বিক্রি করে, ছেলে-মেয়েদের দেওয়া হয়েছে।
হেডমাস্টার মশায়ের হাতে-পায়ে ধরে স্কুল বাড়িতেই রাত্রিযাপনের অনুমতি আদায় করেছে মিসেস সেন। বলেছে আমাকে যা দেন তার থেকে কম দেবেন। না দিলেও ক্ষতি নেই।
ওকে বঞ্চিত করার মানসিকতা হেডমাস্টার মশাই-এর নেই। অফিসঘরের ছোট্ট একটা অংশে ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আগে এখানে সাইকেল-টাইকেল রাখা হতো। এখন সেটাই পরিষ্কার করে একটা তোষক পেতে সে থাকে। একদিকে ছোট্ট একটা জনতা স্টপ জ্বালিয়ে রান্না করে। সকালবেলা খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে, নিজের দু'বেলার রান্না সেরে, স্কুল পরিষ্কার করতে করতে বাচ্চারা আসতে শুরু করে। তারা যাওয়ার পর বড় বাচ্চারা, তারপর বুড়ো বাচ্চারা। সময় কখন যে কেটে যায়, বুঝতেই পারে না মিসেস সেন।
সোমবার হেডমাস্টার মশায়ের ঘরে গিয়ে একটা মোটা খাম টেবিলে রেখে স্যারের চোখের দিকে চোখ দিয়ে মিসেস সেন বলে, স্যার, আমার বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে।
স্যার অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। বাড়ি বিক্রির টাকা স্যারকে দেওয়া কেন? স্কুল বাড়ির উন্নতিকল্পে টাকাটা ব্যয় করতে চায় কি মহিলা?
ওনার ব্যক্তিত্ব এতটাই ঋজু, যে ওঁর চোখের দিকে চোখ দিয়ে কেউ কথা বলতে পারে না। সেই ব্যক্তিত্ব আজ যেন সরাসরি সঞ্চারিত হয়েছে মিসেস সেনের মধ্যে।
উনি বললেন, পুরো গল্পটাই গুরু-চন্ডালিকায় ভরা স্যার। কি করব বলেন? লেখাপড়া তো শিখিনি। বাড়ি বিক্রি করে, ছেলে-মেয়েদের দিতে, আমার বরাতে খুব কম টাকাই পেয়েছি। যা পেয়েছি তাতে আমার এই গল্পটা ছাপা যাবে না?
স্যার অবাক হয়ে বলেন, কিসের গল্প?
আমি আমার জীবনী লিখেছি। আপনি একটু ঠিকঠাক করে দেবেন, স্যার।
স্যার অবাক! তাকেই কেন নির্বাচন করা এই কাজের জন্য? আরও বলেন মিসেস সেন।
... আর ভাবলুম মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েই যায়। এত পরীক্ষা তো দিলুম, আর এই পরীক্ষাটা যদি ফেলও করি, তাহলে আর কোন দুঃখ থাকবে না। তারপরও যদি কিছু বাঁচে তখন আমার সোনামণিদের জন্য সেটা খরচ করবেন। এই কটা টাকায় এত সব যদি না হয়, তাহলে আমি মাধ্যমিকে ভর্তি হব না।
=====================
লেখক: সুদীপ্ত পারিয়াল
ঠিকানা: ধাড়সা ব্রাহ্মণ পাড়া, জি আই পি কলোনি, হাওড়া – 711112