জাগো মা
সুচন্দ্রা বসু
ছোটবেলায় আমার পুজো শুরু হতো মহালয়া থেকে । ভোর বেলায় উঠে মহালয়া শোনা আর মহালয়ার পরে শুধু দিন গোনা, আর কত দেরি পুজোর। স্কুলে গেলেই কার কটা জামা জুতো হয়েছে সেই নিয়ে আলোচনা। আমরা ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবার । পুজোয় দু-তিনটে জামা হত। বন্ধুদের মুখে বারো চোদ্দটা জামার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যেত।
বাবা অফিস থেকে ফিরতেন ক্লান্ত শরীরে, কিন্তু হাতে থাকত পুজোর বাজারের তালিকা। মা প্রতিদিন নতুন করে যোগ করতেন— "একটা শাড়ি তো লাগবে, গঙ্গার মাকে দিতে
হবে। ওর বাচ্চাদের জামাকাপড়ের কী হবে? ওদিকে আবার পাড়ার চাঁদাও দিতে হবে।"
বাড়িটার ভেতর তখন যেন উৎসবের গন্ধে ভরে উঠত। আমি বলতাম— "আমার, নতুন জামা কবে আসবে?" মা হাসতে হাসতে বলতেন— "দশমীর আগে যদি দোকান থেকে তুলে আনতে পারি, তাই তো ভাগ্য। তবুও তোমরা খুশি থাকো, দেবী মায়ের মাসে নতুন কিছু না কিছু হবেই।"
সন্ধেবেলা পাড়ার ছেলেরা মাঠে ঢাক বাজাতে শুরু করত। ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসত ঘরের জানালা দিয়ে। পড়াশোনায় মন বসত না, বুকের ভেতর ধকধক করত— কবে দেবী আসবেন?
মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েনের ভেতরেও পুজো যেন ছিল আলোর মতো।
পুজোর মাস মানেই শুধু খাওয়া-দাওয়া বা ঠাকুর দেখা নয়, তার আগে এক বড়সড় ধাক্কা — চাঁদা তোলা।
আমাদের পাড়ায় পুজোর আগে তখন প্রতিটা বাড়িতে সন্ধেবেলা যেত দু'তিনজন করে যুবক, হাতে খাতা আর রসিদের বই। দরজায় কড়া নাড়ত যেই,অমনি মা একটু বিরক্তি নিয়ে বলতেন— "আবার এল নাকি? এই নিয়ে তো তিনবার এল এ মাসে।" বাবা হেসে উঠে বলতেন— "ওরে ধুর, পুজোর সময় তো খরচ হবেই। তবে শোনো, এ বছর একটু সাবধানে দিতে হবে।"
চাঁদার টাকার পরিমাণ নিয়েই আসল বচসা। রসিদ হাতে দেওয়া হতো, তার পাশেই লেখা থাকত— ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২০০ টাকা। কেউ যদি কম দিত, তাহলে গলির আড্ডায় শোনা যেত— "আরে ওদের এত বড় বাড়ি, এত কম দিল কেন? লোকদেখানো ধনীদের স্বভাবই ওরকম।" কেউ আবার দিত ইচ্ছেমতো বেশি, শুধু নিজের নামটা বড় অক্ষরে প্যান্ডেলের গায়ে লিখে রাখার জন্য।
আমার বাবা ছিলেন একেবারে মেপে দেওয়ার লোক। তিনি হাসিমুখে বলতেন— "আমাদের সামর্থ্য যতটা, ততটাই দেব। পুজো সবার, কিন্তু পেটের ভাত কেড়ে দেবী মা খুশি হবেন না।"
একবার তো মনে আছে, পাড়ার মোড়ের আড্ডায় বড়সড় ঝগড়াই লেগে গেল। হরিদা চেঁচিয়ে বলছিলেন— "আমাদের নাম বোর্ডে এত ছোট করে লিখেছ কেন? আমি তো একশো এক টাকা দিয়েছি!" এই চাঁদার বচসা নিয়েই পুজোর উত্তেজনা আরও বেড়ে যেত।
আজকালকার মতো কোটির হিসেবি বাজেট, নামী শিল্পীর নকশা, আলো-ঝলমলে থিম— এসবের কিছুই ছিল না তখন। আমাদের ছোট্ট পাড়ার দুর্গাপুজো হত একেবারে সহজ সাজে। বাঁশের কাঠামোতে খড় আর দড়ি বেঁধে, তার ওপরে রঙিন কাপড় টানিয়ে তৈরি হত প্যান্ডেল। কখনো লাল-নীল প্লাস্টিকের ঝালর, কখনো বা কাগজ কেটে বানানো ফুল— এটাই ছিল সাজসজ্জার ভরসা।
সন্ধেবেলা যখন রঙিন বাল্বগুলো জ্বলে উঠত, মনে হত পুরো পাড়া যেন আলোকমালায় ঝলমল করছে। বিদ্যুতের লাইটও তখন সস্তা ছিল না, তাই বেশি লাগানো যেত না। একটার পর একটা ছোট বাল্ব, লাল-সবুজ-হলুদ রঙে জ্বলতে-নেভাতে থাকত। সেই আলোয় দেবীর প্রতিমা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠত।
"প্রতিমার চোখে দৃষ্টিদান হলে আর কোনো সাজসজ্জার দরকার হত না।"
আজকের দিনে যখন বিশাল থিম প্যান্ডেল দেখি, তখনও মনে পড়ে যায় সেই ছোট্ট গলির বাঁশের গন্ধ, রঙিন কাগজের ঝালর, আর মাটির প্রদীপের আলো।
মহালয়ার ভোর থেকেই ঘরে ঘরে আনন্দের স্রোত বইত। "জাগো দুর্গা, জাগো দুর্গতিনাশিনী"— মনে হত, দেবী মা সত্যিই পৃথিবীতে নেমে এসেছেন। আমরা দিন গুনতাম, ঠাকুর দেখতে বেরোনো হবে সেই
অষ্টমীতে। নতুন জামাটা আলমারি থেকে বের করে পড়ে নিতাম। মা চুলে ফিতে বেঁধে দিতেন, কপালে টিপ পরিয়ে দিতেন, আর বলতেন— "এবার দেবীর কাছে প্রার্থনা কোরো, যেন সারা বছর মন ভালো থাকে।"
ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখতে যাওয়া সহজ কাজ ছিল না। বাবার হাত ধরে যেতাম প্রতিমা দেখতে । ধুনুচির ধোঁয়া, ধূপের গন্ধ আর কানে ঢুকে যাওয়া ঢাকের আওয়াজে চারিদিক গমগম করত।
পরিচারিকা গঙ্গার স্বামী, যিনি প্রতিমা গড়েছিলেন, তাঁর চোখে ভাসত অদ্ভুত গর্ব— "এই তো আমার হাতে গড়া মা, আজ সবাই মাথা নত করছে।"মা হাত জোড় করে প্রার্থনা করতেন— "আমাদের সংসার যেন সুখে চলে মা, বাচ্চাদের ভালো রাখো।"
ঠাকুর দেখা শেষে ফেরার পথে আমরা খুশিতে গাইতাম— "আবার আসছে বছর।" পাড়ার আলোগুলো তখনও ঝলমল করছিল, আর মনে হত এই আনন্দ যেন চিরকাল থাকে।
দুর্গাপুজো মানেই খাওয়াদাওয়ার উৎসব। সারা বছর আমরা যতই টানাটানির সংসারে থাকি না কেন, পুজোর দিনে খাবারের আয়োজনেই যেন মন ভরে যেত।
অষ্টমীর দিন সকালে মণ্ডপে লাইন দিয়ে সবাই খেত প্রসাদ। নবমীতে কলাপাতার ওপর পরিবেশন করা হতো গরম গরম খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনভাজা আর টক। বালতি থেকে কড়াইচামচ দিয়ে পরিবেশন করার শব্দ, সঙ্গে ঢাকের আওয়াজ আর মানুষের উল্লাস— সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে।
"আহা! খিচুড়র এতো দারুণ স্বাদ!
"এ স্বাদ দেবীর আশীর্বাদে মেশানো। তারপর বিকেলের দিকে মা রাঁধতেন মাংসের ঝোল। মাংসের গন্ধে গোটা পাড়ার বাতাস যেন ঝাল-মশলার উষ্ণতায় ভরে উঠত।
গঙ্গা-ও সেদিন আমাদের বাড়িতে খেত। যদিও প্রথমে অস্বস্তি করত। মা জোর করে বলতেন— "তুই আমার মেয়ে গঙ্গা, পুজোর খাওয়ায় তোকে বাদ দিই কেমন করে?" গঙ্গার মুখের হাসি তখন দেবীর প্রতিমার মতোই দীপ্তি ছড়াত।
পুজোর দিনগুলোয় খাওয়া দাওয়া মানেই ছিল মিলেমিশে থাকা। কে কতটা পেল, কে আগে খেল— এসবের কোনো হিসেব ছিল না।
দশমীর দিনে সিঁদুর খেলার পর যখন মা'য়ের চোখে জল এসে যেত, এই আনন্দ চিরকাল আমাদের সঙ্গে রয়ে যাবে।
শারদোৎসবে পাড়ায় রাতজাগা যাত্রাপালাও অনিবার্য ছিল । দশমীর রাতে বাঁশ দিয়ে গাঁথা মঞ্চ, উপরে টিনের ছাউনি, চারপাশে রঙিন কাগজের ফানুস, সামনের দিকে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো— এভাবেই গড়ে উঠত আমাদের ছোট্ট স্টেজ। সামনে শতরঞ্জি বিছিয়ে দর্শকরা বসত, কেউ আবার খালি মাটিতেই বসত।
ঘোষক মাইকে বলতেন— "আজকের পালা— সীতাহরণ। নায়ক রামচন্দ্র, নায়িকা সীতাদেবী, খলনায়ক রাবণ!"
তারপর শুরু হত ঢাক আর কাঁসরের কর্কশ তাল। আলো নিভে গিয়ে হঠাৎ মঞ্চ আলোকিত হলে যেন অন্য এক জগৎ খুলে যেত। রঙচঙে সাজে অভিনেতারা প্রবেশ করতেন— কণ্ঠের টান, সংলাপের ভঙ্গি, হাতের ভঙ্গিমা— সবই ছিল আমাদের কাছে জাদুর মতো।
রামের বনবাস, সীতার হরণ, হনুমানের লাফ— সবকিছু এত প্রাণবন্ত যে মনে হত চোখের সামনে সত্যিই ঘটছে। যখন মঞ্চে রাবণ প্রবেশ করল সোনার লঙ্কার সাজে, আমরা নতুন চোখে তাকালাম। মনে হল, এ কেবল গল্প নয়— এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বিশাল ইতিহাস, যেটা আমাদের আপন করে নিয়েছে।
একবার নাটক শেষে পাড়ার বৃদ্ধা নকুল কাকু বলতে শুরু করলেন— "এক মাড়োয়ারি ছেলে, নাম গুর্মুখ রায়। বয়েস তখন মাত্র বাইশ। বিনোদিনী নামে এক অসাধারণ অভিনেত্রীর জন্য সে বানিয়েছিল থিয়েটার। সবার উদ্দেশ্য ছিল বিনোদিনীকে সমর্থন দেওয়া। তখনকার দিনে এক পতিতা থেকে অভিনেত্রী হওয়া মেনে নিতে পারেনি সমাজ। তাই প্রথমে নাম রাখা হয়েছিল বিনোদিনীর নামেই— বিনোদিনী থিয়েটার। কিন্তু সমাজের বিরোধিতায় পরে বদলে গেল নাম— হয়ে গেল স্টার থিয়েটার। আর সেই স্টার থিয়েটারেই গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক মঞ্চস্থ হত, বিনোদিনী-গৌরী-অমৃতলালের মতো অভিনেতারা ইতিহাস গড়েছিলেন।"
মনে হচ্ছিল, যাত্রাপালার মঞ্চ হঠাৎ মিলিয়ে গিয়ে চোখের সামনে উঠে এল উনিশ শতকের কলকাতা। যেখানে এক তরুণ ব্যবসায়ী, এক সমাজবঞ্চিত নারী আর এক দুঃসাহসী থিয়েটার আন্দোলন মিলেমিশে তৈরি করেছে বাংলা নাট্যজগতের স্বর্ণযুগ।
=============