প্রবন্ধ ।। পঞ্চানন কর্মকার ও বাংলা অক্ষর ।। শৌনক ঠাকুর
পঞ্চানন কর্মকার ও বাংলা অক্ষর
শৌনক ঠাকুর
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকের কথা। উইলিয়াম কেরি নৌকায় মালদহ যাচ্ছেন। প্রাণচঞ্চল হুগলি নদী। ঝিরঝিরে বাতাস। দু'ধারের প্রকৃতি যেন আঁকা ছবি। সাহেবের মন কিন্তু অশান্ত। চিন্তা একটাই। কিভাবে ছাপার অক্ষর তৈরি হবে? কিভাবেই বা ধর্মীয় বই বিলি হবে? মালদহ পৌঁছে ছাপাখানার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। স্থির করলেন মালদহের কাছাকাছি মদনাবতী অঞ্চলের খিদিরপুরে তিনি একটি ছাপাখানা তৈরী করবেন। কিন্তু ছাপাখানা তো হল। সমস্যা হলো অক্ষর তৈরীতে। বিস্তর খরচ। হিসাব করে তিনি পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। আবার বিলেত থেকে যে হরফ আনবেন তাই যথেষ্ট ব্যয়বহুল। খবর নিয়ে জানতে পারলেন এক একটা হরফ ঢালাই করতে খরচ পড়বে ১৮ শিলিং। (শিলিং হলো ব্রিটিশ মুদ্রা।) দশহাজার বইয়ের জন্য মোট খরচ ৪৩,৭৫০। তার উপর তো পরিবহন খরচ রয়েছে। হতাশ হয়ে পড়লেন। বই ছাপানোর কাজ থেকে পিছিয়ে আসবেন ভাবছেন এমন সময় ব্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন পঞ্চানন বাবু। পঞ্চানন কর্মকার। তিনি তখন কোলব্রুকের সহযোগী। সাহেব কিছুতেই দক্ষ, অনুগত পঞ্চাননকে ছাড়তে রাজি নন। আবার না ছাড়লেও কেরী আশাপূরণ হবে না। বহু চেষ্টার পর কোলব্রুক শেষে রাজি হলেন। পঞ্চানন হরফ পিছু দর একটাকা চার আনা পয়সায় কাজ করতে রাজি হলেন ; —----
"পঞ্চানন হরফ পিছু দর দিলেন একটাকা চার আনা।"
("পঞ্চানন কর্মকার: হাতেই ছাপার হরফ পেল বাংলা": গৌতমবসু মল্লিক)
হাতে চাঁদ পেলেন কেরী সাহেব। জুটি তৈরি হল।
পঞ্চানন কর্মকার এর আগে চার্লস উইলকিন্স সাথে একসাথে কাজ করেছেন। পঞ্চানন কর্মকারের সাথে চার্লস উইলকিন্স সাহেবের পরিচয় পর্ব সম্পর্কে জন ক্লার্ক মার্শম্যান লিখছেন, —--- "Soon after the establishment of the press at Serampore, the native blacksmith Punchanon, who had been in instructed in the art of punch - cutting by Sir Charles Wilkins, to whom allusion has been made in a former chapter, came to the missionaries in search of employment."
('The Life and Times of Carey Marshman and Ward': Jon Marshman)
১৭৭৮ সালে হ্যালহেড ইংরেজি ভাষায় 'A Grammar of the Bengali Language' গ্রন্থটি লেখেন। সাহেবের পুরো নাম ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। এদিকে চার্লস উইলকিন্স হ্যালহেড সাহেবের লেখা বইটি মুদ্রণের ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। সারথী পঞ্চানন তো রয়েছে। পঞ্চানন বাবুর প্রযুক্তি জ্ঞান ও হরফ নির্মাণের দক্ষতাকে কাজ লাগালেন উইলকিন্স। ছেনিতে কাটা কাটা বাংলা অক্ষর ঢালাই করে এই বই মুদ্রিত হয়েছিল। মেসিন সচল রাখার জন্য চলনশীল ধাতু ব্যবহার করা হয়। এইগুলো তৈরি করতে তাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল। শুধু পরিশ্রম নয়, মেধা, উপস্থিত বুদ্ধির জোরে তিনি অসাধ্যসাধন করলেন। কাজগুলো এতটাই সূক্ষম যে যথেষ্ট ধৈর্য, অধ্যাবসার প্রয়োজন হয়েছিল।
বই ছাপা হল। পর্যাপ্ত অর্থ প্রাপ্তিও হলো। খুশি হলেন বড়োলাট। বড়োলাট মানে তৎকালীন বড়োলাট ওয়ারেন হেস্টিংস। তার ইচ্ছে হলো কলকাতায় একটি প্রেস স্থাপন করবেন। ১৭৯৯ সালে উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকারের সাহায্যে সাহেবের বাঞ্ছা পূর্ণ হলো।
এই কর্মকারবাবু কিন্তু কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন না। হুগলি জেলার সন্তান। ১৮০৪ সালে তৎকালীন হুগলির ত্রিবেণীতে তার জন্ম হয়। পড়াশোনা ওখানেই। পূর্বপুরুষ ছিল লৌহ কর্মকার। 'লিপিকার' এদের পদবী ছিল (এই নিয়ে মতান্তর রয়েছে)। এদের আদি নিবাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে এদের কোন পরিবার জিরাট-বলাগড়ে বসতি স্থাপন করেন। বিশেষ কারণে পরে তারা হুগলি ও পরে শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করেন। তবে ছোট থেকেই সূক্ষ্ম নকশা অঙ্কনে পঞ্চাননের উৎসাহ ছিল। নকশায় ছোট ছোট কাজ তিনি অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতেন।
কেরি সাহেবকে অনেকক্ষণ অপেক্ষায় রেখেছি। পঞ্চাননের সঙ্গে কেরি সাহেবের কুশল বিনিময়ের পালা সাঙ্গ হলে তারা আসল কথাটায় এলেন। সাহেব ইচ্ছেটাও জানালেন। সবকিছু ঠিকঠাক হলো। পঞ্চানন শ্রীরামপুর প্রেসে কাজ করতে রাজি হলেন। সালটা ১৭৯৯। প্রথমে পুরোনো মেসিন দিয়ে কাজ শুরু হলো (এই মেসিনটি ছিল জর্জ উডনির দেওয়া)। তৈরি হলো শ্রীরামপুর প্রেস। শুরু হলো পঞ্চাননের পরিশ্রম, নিষ্ঠা, কর্মকুশলতা। নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার হতে থাকে। কম সময়ে অনেক বেশি অক্ষর ছাপা হতে শুরু করে। অক্ষরের ডিজাইনেও আসে আধুনিকতা। দেখতে দেখতে এই প্রেস এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর তৈরীর কারখানায় পরিণত হয়।
এখান থেকে ১৮০১ সালে ছাপা হয় বাইবেলের বাংলা অনুবাদ। কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত সহ বিভিন্ন গ্রন্থ। 'দি গসপেল অব সেন্ট ম্যাথ্যু' অনুবাদ 'মঙ্গল সমাচার ম্যাতিয়ুর' নামে ছাপা হয়। পাঠ্য পুস্তক, গল্প গ্রন্থ, ইতিহাসমূলক গ্রন্থ, জ্ঞানবিজ্ঞানের গ্রন্থ, প্রকাশিত হতে থাকে। একের পর এক পর একটা বই। যেন একটা বিপ্লব ঘটে গেল।
শুধু বাংলা অক্ষর তৈরীতে তিনি সীমাবদ্ধ থাকলেন না। তৈরি হলো দেবনাগরী ভাষার হরফ। কাজ আরও নিখুঁত হলো। দেবনাগরী হরফে সংস্কৃত ব্যাকরণ মুদ্রিত হলো। সালটি ১৮০৩।
"Panchanan developed a set of devnaguri script, the first Nagori type to be developed in India."
(Panchanan Karmakar's biography)
একে একে বোপদেবের মুগ্ধবোধ, সংস্কৃত বিভিন্ন গল্প, নীতিমালা সহ বিভিন্ন বই প্রকাশ পেতে থাকে।
এভাবে একে একে আরবি ফারসি বর্মি, তেলেগু, মারাঠি, চীনা সহ প্রায় ১৪ টা ভাষার হরফ তৈরি হলো। এই প্রেসের কাজের পরিসংখ্যান দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এইজ প্রেস ৩০ বছরে ২,০০,০০ কপি বই ৪০টি ভাষায় ছাপিয়ে ছিল। কাজগুলো ছিল প্রায় নির্ভুল। টাইম অব ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, "In 30 years, the Serampore mission press printed over 2,00,00 copies of books in 40
languages." (TOI: 9 Feb, 2012)
বাংলা ভাষার ছাপার ইতিহাসে প্রথম চলনসই বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় ছাঁচ তৈরির অগ্রদূত পঞ্চানন কর্মকার। কিন্তু চার্লস উইলকিন্সের সাথে এতদিন কাজ করার পরেও সাহেব এই গুণী মানুষটির নাম কোথাও উল্লেখ করেননি। এমনকি এদেশেও তাকে নিয়েও সেভাবে কোন গবেষণা হয় নি। সেটাই আশ্চর্যের। সজনীকান্ত দাস এই বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
* পঞ্চাননের জীবন কাহিনী আমাদের প্রয়োজনের পক্ষে খুব বেশি নয়।"
("বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস": সজনীকান্ত দাস)
যাক সে সব কথা। বাংলা অক্ষর নির্মাণ ও ছাপার ইতিহাসে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাই এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, তিনি বাংলা ছাপার অক্ষরের ইতিহাসে পথিকৃৎ।
ঋণ স্বীকার
১. "Panchanan Karmakar's biography" :
২."The Life and Times of Carey Marshman and Ward" : Jon Marshman)
৩. পঞ্চানন কর্মকার: হাতেই ছাপার হরফ পেল বাংলা": গৌতমবসু মল্লিক)
৪. আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়
৫. "বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস": সজনীকান্ত দাস
৬. "বাংলা সাহিত্যের পরিচয়: ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়
৭. "History of Bengali literature: Sen Sukumar"
…………….
শৌনক ঠাকুর
গ্রাম +পোঃ - দক্ষিণখন্ড
থানা - সালার
জেলা - মুর্শিদাবাদ