একজন মন্ত্রীর একদিন
রানা জামান
বাহিরের চাকচিক্য দেখেই বুঝা যায় বাড়িটা কোনো মাননীয় মন্ত্রীর। এক একর জমির উপর সাড়ে তিনতলা বাড়ি। লিফট আছে। বাড়িটা পল্লী বিকাশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত। বর্তমান মন্ত্রীর নাম আফতাব উদ্দিন জোয়ার্দার।
আফতাব উদ্দিন জোয়ার্দার মধ্যবয়স্ক এবং মাথাভর্তি টাক। একসময় ওঁর মাথাভর্তি চুল ছিলো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পড়তে থাকে মাথার চুল। মাথায় চুল ধরে রাখার জন্য কী না করেছেন উনি;যে যা বলেছে তাই মেখেছেন মাথায়; এমনকি গোবরও মেখেছেন চুলে। গরুরু গোবর না, হাতির গোবর! হাতি কলাগাছ বেশি খাওয়ায় ওর গোবরে নাকি উর্বরা শক্তি বেশি! কিন্তু চুল বিরূপ হয়েই থাকলো ওঁর প্রতি। এখন মাথা স্টেডিয়ামের মতো ফাঁকা, চারদিকে কিছু চুল আছে। চারদিকের চুল লম্বা করে টাক ঢাকার চেষ্টা করেন এখনো; কিন্তু বাতাস ঢেকে রাখতে দেয় না টাক! তবে বাহিরের লোকজন তাঁর পাকা দাড়ি ও টাক দেখতে পায় না- মন্ত্রী সবসময় দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে রাখেন এবং বাইরে বের হবার সময় পরচুলাটা পরে নেন। কালো পরচুলা, বয়সের প্রথমে মাথায় যেমন কপাল ঢাকা চুল ছিলো; পরচুলাটা তেমনই। মনে খুঁত খুঁত থাকলেও ভালো লাগে। আফসোসের ব্যাপার হলো: ছোটকালে টাক দেখলে মাথায় চাটি মারতে ইচ্ছে করতো ওঁর। সমবয়সীদের মাথায় চাটি মেরেছেনও; আর এখন..। ওর টাক দেখে নিশ্চয়ই কারো না কারো চাটি মারতে ইচ্ছে করে! পরচুলা থাকায় বাইরের লোকের চাটি না পড়লেও বাসায় নাতিরা চাটি মারে হরহামেশা! তখন রাগ দমিয়ে রেখে হাসেন; সাথে হাসে স্ত্রীসহ বাড়ির সবাই।
তো কোনো সভা বা বাইরে যাবার তাড়া না থাকলে সেদিন মাননীয় মন্ত্রী দেরিতে ঘুম থেকে উঠেন। আজ কোনো সভা নেই, বাইরে যাবার তাড়া নেই; তাই দেরিতে ঘুম থেকে জাগার প্রোগ্রাম সেট করা আছে মাথায়। কিন্তু সকাল ন'টায় মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করায় মন্ত্রী ঘুম থেকে জাগতে বাধ্য হলেন।
মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন জোয়ার্দার মোবাইল ফোনটা তুলে এন্টার বাটন টিপে কানে ঠেকিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন, সকালে ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে ফোন। কে হে তুমি?
কলার বললো, দাড়ি কি কামানো হয়েছে মাননীয় মন্ত্রী?
আজ কোনো মিটিং নাই তাই দাড়ি কামাই নাই। এটা জানার জন্যই কি ফোন করেছো? কে হে তুমি?
মাথায় কি উইগ আছে এখন?
মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন টাকে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, বাসায় থাকাবস্থায় মাথায় উইগ পরি না।
তারপর? পেটটা কি ঠিক আছে?
কী হবে পেটের আমার? রাতে বিন্দাস খেয়েছি চিকেন পোলাও, সাথে হট চিলি বোরহানি।
কিন্তু আপনার না ওসব খাওয়া নিষেধ! কী করলেন আপনি মন্ত্রী মহাশয়! আপনার তো এখন পেট ব্যথা শুরু হয়ে যাবে!
মাননীয় মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন জোয়ার্দার বুঝতে না পেরে বললেন, আমার পেট ব্যথা করবে কেনো?
আপনার না অমন খাবার পেটে সয় না! তাছাড়া যাতে সকালে ঘুম থেকে জাগার সাথে সাথে পেট ব্যথা করে সেরকম দাওয়াই মেশানো হয়েছিলো রাতে ঐ খাবারে!
তখনই শুরু হলো মন্ত্রীর পেটব্যথা। মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন পেট ধরে উ আ করে কাউকে ডাকতে যাবে তখন ও প্রান্ত থেকে কলার ফের বললো, উহু কাউকে ডাকা যাবে না!
আফতাব উদ্দিন উ আহ ভুলে বললেন, কেনো? কেনো ডাকা যাবে না?
আপনার প্রিয় নাতি আমার পাশে বসে চকলেট খাচ্ছে। বিশ্বাস না হলে নাতির কণ্ঠ শুনেন।
তখন মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন মোবাইল ফোনে নাতির কণ্ঠ শুনতে পেলেন। নাতি উল্লসিত কণ্ঠে বললো, এই আঙ্কেলটা খুব ভালো নানুভাই। অনেক চকলেট দিয়েছে।
তখন ঐ কণ্ঠটি বললো, এখন বিশ্বাস হলো মাননীয় মন্ত্রী?
আমার নাতি তোমার কাছে গেলো কিভাবে? কে তুমি? নাম কী তোমার?
আপনার নাতিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে মাননীয় মন্ত্রী!
কী বলছো তুমি! কত টাকা চাও?
গুড পুলিশের ভয় না দেখানোয়! পুলিশকে বললে বা পুলিশ টের পেয়ে গেলে আপনার নাতির একটা একটা করে আৃ্ঙ্গুল কেটে আপনার কাছে পাঠানো হবে।
না না, পুলিশকে কিছুই বলবো না! টাকার এমাউন্ট বলো!
টাকা চাই না আমরা।
তাহলে কী চাও? কেনো আমার নাতিকে কিডন্যাপ করেছো?
আমার নির্দেশনাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হলে আপনার নাতিকে ছেড়ে দেয়া হবে!
ঠিক আছে। তুমি বলে যাও! তার আগে বলো কে তুমি? কী নাম তোমার?
আমার নাম..আমার জগডঙ্গমঙ্গ বিশাখাপট্টম খাট্টোলা চান্দ্রিক!
কী বলছো তুমি! এতো খটোমটো নাম তোমার। আমি টয়লেট থেকে এসে বাকি কথা শুনবো তোমার! নইলে কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে!
কলার বললো, নষ্ট কাপড়ের বদগন্ধ আমি সইতে পারি না! আমি লাইনে আছি। আপনি তাড়াতাড়ি কাজ সেরে আসেন মাননীয় মন্ত্রী!
মাননীয় মন্ত্রী আফতাব উদ্দীন জোয়ার্দার মোবাইল ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে ছুটলেন ওয়াশরুমের দিকে। কিছুক্ষণ পরে কমোড ফ্লাশ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুলে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মোবাইল ফোনটা কানে ঠেকিয়ে বললেন, তুমি এখনো লাইনে আছো হে খটোমটো নামের বদমানুষ?
কলার শব্দ করে মৃদু হেসে বললো, থাকবো না মানে! আপনাকে আজ রিয়েলিটি দেখাবো!
বেশ। এবার বলো কী করলে তুমি আমার নাতিকে ছেড়ে দেবে।
আপনার পরনে এখন কী আছে? নাইটড্রেস না অন্যকিছু?
বেলকো ট্যাপ লাগানো লুঙ্গি আর হাফহাতা গেঞ্জি।
লুঙ্গিতে বেলকো ট্যাপ কেনো মাননীয় মন্ত্রী? বুঝতে পেরেছি। আপনি যা পরে আছেন তা নিয়েই বেরিয়ে পড়ুন বাসা থেকে। মোবাইল ফোনটা সবসময় কানে ঠেকিয়ে রাখবেন। আমি যেভাবে যেখানে যেতে বলবো, সেভাবে সেখানে যেতে থাকবেন। গড়বড় করলেই নাতি শ্যাষ!
না না! তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই আমি সেখানে যাচ্ছি!
হাফহাতা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরেই বেরিয়ে পড়লেন পল্লী বিকাশ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় আফতাব উদ্দিন জোয়ার্দার। বাড়ির লোকজন ওঁর পিছু নিলে হাত তুলে ওদের থামিয়ে দিলেন। ড্রাইভার জিপ স্টার্ট দিলে গালে চড় মেরে এগিয়ে গেলেন প্রধান ফটকের দিকে। ফটক দিয়ে বের হতেই পুলিশ প্রটেশান স্যালুট ঠুকে তৈরি। ধমক দিয়ে ওদের থামিয়ে ফের পেটে কাপড় পড়ায় পেট চেপে রেখে দ্রুত হাঁটছেন সামনের দিকে। স্কুটারে যাওয়া যাবে না; কোনো খালি রিকসা পাওয়া যাচ্ছে না-কিন্তু একটা রিকসায় উঠতে হবে। অবশেষে পাওয়া গেলো একটা খালি রিকসা। তাড়াহুড়ো করে রিকসায় উঠতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে গেলেন মন্ত্রী। পায়ের ব্যথার কাছে ভুলে গেলেন পেটের ব্যথা। রিকসায় উঠে বসতেই পেটের ব্যথাটাও অনুভূত হতে থাকলো। বড় রাস্তায় এসে রিকসা ছেড়ে অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য। তবে আগে উঠতে হবে মহেন্দ্রতে। উঠে দেখলেন সিট নেই-ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। নেমে গেলেন নির্ধারিত স্থানে। যাত্রী বোঝাই বাস এলো একটা। ওটাতেই উঠতে হবে। ঝুলে গেলেন বাসের হ্যান্ডেল ধরে। কিন্তু যাত্রীর চাপে ঝুলে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে মন্ত্রীর জন্য। কোনোমতেই আর ধরে রাখতে পারছেন না বাসের হ্যান্ডেল-ফসকেই গেলো। তখনই একটা হাত ওঁকে জড়িয়ে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে ঠেলে দিলো উপরের দিকে। মন্ত্রী যাত্রী ঠেলেঠুলে দরজা থেকে উঠে গেলেন উপরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তেই এক যাত্রী কনুই দিয়ে গুঁতা দিলো ওঁর পেটে।
ওক শব্দ করে ব্যথা সামলে মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন বললেন, পেটে কনুই দিয়া গুঁতা মারলেন কেনো? কী করলাম আমি?
লোকটি ফের কনুই দিয়ে মন্ত্রীর পেটে গুঁতো দিয়ে বললো, আপনি পা দিয়া আমার পা মাড়ায়া দিছেন! বাসে উঠছেন নড়াচড়া কম করবেন আর পা-টা সামলায়া রাখবেন!
মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন নিজ পরিচয় দিতে গিয়ে থেমে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন: তার মানে ওকে কেউ চিনতে পারছে না। কারণ কী? মাথায় উইগ না থাকায় এবং দাড়ি কামানো না থাকায়! লোকটা আমাকে দিয়ে আর কী কী কাজ করাবে? নির্দেশিত স্থানে ঠেলেঠুলে বাস থেকে নামতে পারলেন আমাদের মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন জোয়ার্দার।
তাকিয়ে দেখেন সামনে একটা সরকারি হাসপাতাল। মন্ত্রী হয়ে সরকারি হাসপাতালে ঢুকবেন, যেখানে কোনো চিকিৎসা হয় না, ঔষুধ থাকে না? তখন মোবাইল ফোনে নির্দেশনাটা এলো-এই হাসপাতালেই ঢুকতে হবে।
আশেপাশে একবার তাকিয়ে ঢুকে গেলেন হাসপাতালে। কোথায় যাবেন এখন? সাদা এপ্রন পরা গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো একজনকে আসতে দেখে মনে মনে বললেন: এ নিশ্চয়ই ডাক্তার! একে জিজ্ঞেস করি। নিকটে এলে ওকে পেটের ব্যথার কথা বললে টিকিট কেটে ইমার্জেন্সিতে যেতে বললেন।
এককজনকে জিজ্ঞেস করে টিকিট কাউন্টারটা কোথায় জেনে নিলেন। লম্বা লাইন! পেট ও পায়ের ব্যথা দুটোই যন্ত্রণা দিচ্ছে খুব! লাইনে না দাঁড়িয়ে কাউন্টারের কাছে গেলে লাইনে দাঁড়ানো সামনের লোকগুলো ওকে গালিগালাজ করতে করতে ঠেলতে ঠেলতে একেবারে পেছনে পাঠিয়ে দিলো। অগ্যতা লাইনেই দাঁড়াতে হলো মন্ত্রী আফতাবউদ্দিনকে সবার পেছনে। ধীরে ধীরে কাউন্টারে এসে টিকিট কেটে জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখেন ওখানেও লাইন। সামনে গিয়ে লাভ নেই-ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দেবে! লাইনে থেকেই এগিয়ে গেলেন মন্ত্রী।
কর্তব্যরত ডাক্তার মন্ত্রী আফতাব উদ্দিনের পায়ের আঘাত দেখে বললেন, বুড়ো বয়সে সাবধানে রিক্সায় চড়তে হয়। পায়ের এক্স--রে করতে হবে। ফ্রাক্চার হয়ে থাকলে ভোগাবে আপনাকে।
মন্ত্রী নাক-মুখ কুচকে বললেন, আগে আমার পেটের ব্যথাটা ঠিক করে দেন। আর সহ্য করতে পারছি না।
রাতে কী কী খেয়েছে শুনে ডাক্তার ভর্ৎসনা করে বললেন, এই বয়সে পোলাও-কোর্মা কোনোমতেই খাওয়া যাবে না। আপনার পায়খানা হওয়া দরকার। এই ট্যাবলেটটা খেলেই পায়খানা হতে থাকবে; তখন ব্যথা থাকবে না।
মন্ত্রী আফতাব উদ্দীন জোয়ার্দার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে পেটের ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করতে করেত বললেন, সকাল একবার পাতলা পায়খানা হয়েছে ডক্টর।
গুড! কিন্তু তাতে হবে না। যা খেয়েছেন রাতে তাতে পেট আরো খোলাসা হওয়া দরকার। যান! টয়লেটের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করবেন। বুড়ো বয়সে কাপড় নষ্ট করলে বড় বিড়ম্বনা হবে সবার জন্য! পায়খানা হবার পর আসবেন। আপনার পায়ের এক্স-রে করতে হবে।
মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন ঔষধের কাউন্টার থেকে ট্যাবলেট নিয়ে এদিক ওদিক তাকালো কলার পানের পানি কোথায় পাওয়া যাবে বলে দিলে। মন্ত্রী এগিয়ে গেলেন সেদিক। একটু ইতস্তত করে শিকলে আটকানো বারোয়ারি মগে পানি নিয়ে দুটো ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। একটু পরই পায়খানার চাপ পড়লো তলপেটে। টয়লেটে গিয়ে বমি হবার জোগার ওর। এতো নোংরা আর দুর্গন্ধ। উপায় নেই! নির্দেশনা মোতাবেক এই টয়লেট-ই ব্যবহার করতে হব ওকে! নাতির জন্য কত কিছু করতে হচ্ছে ওকে!
শুরু হয়ে গেলো মন্ত্রী আফতাব উদ্দিনের পায়খানায় যাওয়া। টয়লেট থেকে বের হয়ে বাইরে যেতে না যেতেই ফের পায়খানার চাপ পড়তে থাকলো পেটে। পায়খানা করতে করতে কাহিল হয়ে বাইরে এসে ধপাস করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। লোকজন ছুটে এলো ওঁর দিকে। লোকজনের ভিড়ে নাতিকেও দেখতে পেলেন চকলেট খাওয়া অবস্থায়। একরাশ প্রশান্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রী আফতাব উদ্দিন মনে মনে ভাবলেন: আমজনতা এতো কষ্ট করে!
=========================
সংক্ষিপ্ত ঠিকানা:
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ