মুক্তগদ্য ।। কবি সুকান্ত আজও সমান প্রাসঙ্গিক ।। অনিন্দ্য পাল
0
জুন ০১, ২০২৫
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
কবি সুকান্ত আজও সমান প্রাসঙ্গিক
অনিন্দ্য পাল
রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ দাশের পর বাঙালির অন্যতম প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিতার জিন নিয়ে জন্মেছিলেন কিনা বলা যায় না, কিন্তু তাঁর যে কবি-দৃষ্টি ছিল, ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি তা নিয়ে কোন মতভেদ থাকার কথা নয়। সুকান্ত কবিদের স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন মানেননি, তিনি নিরিবিলি, নির্জন গৃহকোণে কবিতার বোধন করতেন না, তাঁর কাব্য-উপাদান ছড়িয়ে ছিল জনসাধারণের মধ্যে, ভিড়ের মাঝে ডুবে গিয়ে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন খিদেতুর মানুষের হৃদয়-স্পন্দন। গত শতকের পাঁচের দশক শুরু থেকে তাই সুকান্ত ভট্টাচার্য ছড়িয়ে পড়েন বাংলার ঘরে ঘরে, জনপ্রিয়তায় অগ্রজ কবিদের খানিকটা পিছনেই ফেলে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন হয়ে উঠেছেন বাঙালির সাংস্কৃতিক দেবতা, বাঙালি তাঁকে বিগ্রহের মত মাথায় করে রাখল আর সুকান্তকে ঘরের ছেলের মত জড়িয়ে ধরল বুকে।
সুকান্ত লিখেছেন,
" আমার হৃদযন্ত্রে ঘা লেগে প্রতিধ্বনিত হয় কয়েকটি কথা: পৃথিবী মুক্ত জনগণ চূড়ান্ত সংগ্রামে জয়ী" -- সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই ফুটে উঠেছিল তাঁর প্রতি পংক্তিতে। প্রকৃতি এবং সৌন্দর্যের আকর্ষণ তাঁর ছিল কিন্তু সব চেয়ে বেশী টান অনুভব করেছেন মানুষের স্পন্দনের। মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার, অমানবিকতা তাঁকে মুহুর্মুহু আঘাত করেছিল, সেই আঘাত বুকে নিয়ে তিনি যেমন কলম তুলে নিয়েছিলেন, তেমনি ছুটেও বেড়িয়েছেন কখনও রাঁচী, কখনও সাঁওতাল পরগণা, আবার কখনও গেছেন কাশী কখনও চট্টগ্রাম। প্রকৃতির টানে, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভালোবাসলেও অন্তরের নিবিড় টান ছিল মানুষের প্রতি, তাই মেজ বৌদিকে লেখা একটা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, " কবি বলে নির্জনতা প্রিয় হবো, আমি কি সেই ধরনের কবি? আমি যে জনগণের কবি হতে চাই, জনতা বাদ দিলে আমার চলবে কি করে? "
মাত্র একুশ বছরেই চলে গেছেন, কিন্তু এই দু'হাজার চব্বিশেও তিনি যথেষ্ট মিশে আছেন বাঙালির মননে, আন্দোলনে, প্রতিবাদে। কবি সুকান্ত কমিউনিস্ট রাজনীতি সমর্থন করতেন। শ্রমিক আর মেহনতি মানুষের জীবন যন্ত্রণা তাঁকে কখনও স্বস্তি দেয়নি। এই পৃথিবীর দূষিত সমাজকে পরিশোধনের যে চেষ্টা তিনি তাঁর লেখনির মধ্য দিয়ে করেছেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে এই পংক্তিতে,
'প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি --' আর এই শপথ বাস্তবে ফলপ্রসূ হবে তখনি, যখন আমরাও দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠতে পারব-- ' অস্ত্র ধরেছি এখন সমুখে শত্রু চাই।' যদিও এই সংগ্রাম তাঁকে অমর করবে কি না, তা নিয়ে কবির কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না, আর ছিল না বলেই বিক্ষোভ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
' ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ,
আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।'
শিশু-কিশোরদের ভিতরের শক্তিকে কবি চিনেছিলেন, চিনেছিলেন নিজের ভিতর থেকে, যার প্রতিফলন ছাড়পত্র কাব্যের 'আঠারো বছর বয়স'। আবার একটি খুব সুন্দর পদ্যে তিনি লিখেছেন,
" দেখ ওই মোটা লোকটাকে দেখ
অভাব জানে না লোকটা
যা কিছু পায় সে আঁকড়িয়ে ধরে,
লোভে জ্বলে তার চোখটা।"
কষ্ট, অত্যাচার থেকে পালানোর চেষ্টা করে কখনও বাঁচা যায় না, কবি তাই পরিখা কবিতায় লিখেছেন,
'পালাবে বন্ধু? পিছনে তোমার ধূমন্ত ঝড়
পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে।'
কবি সুকান্ত 'পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশ্যে' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে লিখেছেন,
'আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ,
আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের।
হতাশায় স্তব্ধ বাক্য; ভাষা চাই আমরা নির্বাক,
পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের।
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা
ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা,
আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা
পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা।'
অর্থাৎ শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে সুকান্ত বিশ্বকবিকে চেয়েছিলেন একজন সহযোদ্ধা হিসেবে, যিনি প্রতি পংক্তিতে বলে যাবেন নিপীড়িত মানুষের কথা, যাঁর প্রতিটি অক্ষরে ধরা থাকবে সাধারণ মানুষের সুখদুঃখের ইতিহাস।
দরিদ্রের চোখে যখন পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি, তখন এই পদ্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। সমাজের উঁচু তলার মানুষরা আজো যে ভাবে আপামর জনসাধারণের রক্ত চুষে চলেছে, সেই সময়ে সুকান্ত লিখেছেন, 'বড় লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়', কিংবা 'সব চেয়ে ভালো খেতে গরিবের রক্ত' যা আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ক্ষমতালোভী শাসক বা শাসকের মদতপুষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ আজও একইভাবে জনসাধারণের মাথায় টুপি পরিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে চলেছে। কবি তাই লিখেছেন,
"ব্লাক মার্কেট করে ধনী রাম পোদ্দার
গরিব চাষীকে মেরে হাতখানা পাকালো
বালিগঞ্জেতে বাড়ি খান কয় হাঁকালো!"
সমাজের সর্বস্তরে, দোকানে বাজারে আজ ভেজালের শতকরা হার ক্রমাগত উর্দ্ধমুখী, কোথাও কোথাও তা ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের মত অবস্থায় চলে এসেছে যেমন, তেমনি অযোগ্য মানুষদের দুর্নীতির জন্য সত্যিকারের যোগ্য মানুষদের বসতে হচ্ছে পথে। সুকান্তের লেখাতেও উঠে আসে সেই কথা,
'ভেজাল কথা-, বাংলাতে ইংরেজি ভেজাল চলছে
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে,' … তাঁর ভাবনা, কবিসত্ত্বা যে অক্ষরদেহ ধারণ করেছিল, আজও সেই পংক্তিমালা কিছুমাত্র প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি, বরং আবার সময় এসেছে তাঁকে আঁকড়ে ধরার, তাঁর কবিতার শিখায় জ্বলে উঠে সমস্ত অকল্যাণ আর অসততার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
অনিন্দ্য পাল
চম্পাহাটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।