মুক্তগদ্য ।। কিশোর কবি সুকান্ত ।। শিশির আজম
0
জুন ০১, ২০২৫
ছাড়পত্র
শি শি র আ জ ম
সুকান্ত জন্মেছিলেন অগ্নিগর্ভ এক সময়ে। যখন মাতৃভূমি পরাধীন। পার্টি, মার্কসবাদ, সাহিত্য - কোন কিছুই তার কাছে আলাদা ছিল না। কবিতা একটি আর্ট ফর্ম। হ্যাঁ, সত্যি। এটা আরও সত্যি হয় যদি তা মানুষকে তাড়িত করে, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, মানুষকে ভালোবাসায় প্ররোচণা দেয়। এই পথটাই বেছে নিয়েছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। এর ছাপ-তাপ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ছাড়পত্রে'র পাতায় পাতায় পাওয়া যায়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। মনে রাখা দরকার, এর পূর্বে ১৯৪০-এ প্রকাশিত হয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'পদাতিক'। আর তারও পূর্বে ১৯৩৭-এ আমরা পেলাম দিনেশ দাসের 'কাস্তে'। নিশ্চয় এসবের উত্তাপ সুকান্তের চেতনায় ছাপ ফেলেছিল।
কবিতা কখনো কখনো শ্লোগান হয়ে উঠতে পারে। হোক। এই শক্তি কবিরই আছে। নজরুলকে কি আমরা অগ্রাহ্য করতে পারবো? সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা শামসুর রাহমানকে? পিকাসোর 'গুয়ের্নিকা' অথবা জয়নুলের 'দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা' কি 'আর্ট' নয়? হ্যা আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন যে ফিদা হুসেনের 'ভারত মাতা' পেইন্টিং না পোস্টার? বিনয় মজুমদারের 'ভুট্টা সিরিজে'র কবিতাকে আপনি নিছক পর্ণ হিসেবেই বিবেচনা করতে পারেন। তা করুন। কিন্তু হুমায়ূন আজাদের 'পাক সার জামিন সাদ বাদ'কে তো উপন্যাসের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারবেন না অথবা সুবিমল মিশ্রকে নিছক যৌনসাহিত্যিক বললেই বা কি এসে যায়! ওর 'হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তী'কে তো বাংলা শ্রেষ্ঠ গল্পের টেবিল থেকে সরানো যাবে না। জয়নুলের 'মনপুরা '৭০' যে শাসকের নির্লিপ্ততাকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়, এটা তো রাজনীতিই। হ্যা, সুকান্তকে পড়তে গেলে ওর সময়টাকে বুঝে ওটা দরকার। না হলে আজকের দিনে আমরা ব্যার্থ হবো ওর কবিতার স্পিরিটটা অনুভব করতে।
সুকান্তকে হয় তো ইংরেজ কবি কিটসের জীবনের সঙ্গে মেলানো যায়। কিটস পঁচিশ বছর বেঁচেছিলেন, সুকান্ত একুশ বছর। দুজনেরই ব্যক্তিজীবন সংক্ষিপ্ত কিন্তু সাহিত্য-জীবনের ব্যাপ্তীকাল মহাসামুদ্রিক। দুজনেরই মৃত্যুর কারণ যক্ষা। হয় তো রাঁবো, লোরকা বা আবুল হাসানও এক্ষেত্রে তুলনীয় (৩৭ বছর বয়সে রাঁবো কবিতা লেখা ছেড়েছিলেন। কেন?)। এরা কেউই সময়কে অস্বীকার করেননি, আবার সময়ের গড্ডালিকা স্রোতে নিজেকে ভাসিয়েও দেননি। সুকান্তের গল্প-কবিতা-গানে এর বিচ্যূরণ আমরা দেখি। আর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ছাড়পত্র'-তেই সুকান্ত নিজেকে জানান দেন নজরুল-নেরুদা-নাজিম-মায়াকোভস্কির সহযাত্রী হিসেবে। একুশ বছরের জীবনে কাব্যগ্রন্থ ছয়টি। সৃটিকর্মের তালিকা করলে ঋত্বিক ঘটক আর তারকোভস্কির সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে। ঋত্বিকের ফিচার ফিল্ম আটটি, তারকোভস্কির সাতটি। কিন্তু এদের এই সংক্ষিপ্ত সৃষ্টিকর্মের প্রভাব কি বিপুল আর ধ্বংসাত্বক!
আসলে আর্টের কচকচি কবি দেরাজেই ঢুকিয়ে রাখেন। সময়টাকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন, জীবনকে আলাদাভাবে দেখতে প্রলুব্ধ হন। সেই 'আলাদা' অবশ্য সবসময় বৃহৎ জনমানসের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ হবে এমনটা মনে করার কারণ নেই। জনরুচি যে সবসময় মানবিক মূল্যবোধের বিচারে যথার্থ সক্ষমতা দেখিয়েছে, এমনটা তো বলা যায় না। 'রুচি' খুবই আপেক্ষিক একটা ব্যাপার। জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশের সম্মতিরছাড়া হিটলার কীবাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করলেন? তালিবানরা যে আফগানিস্তান দখল করতে পারলেন সে কি বৃহত্তর আফগান জনগোষ্ঠীর মতামতকে উপেক্ষা করে? না। এর জন্য দরকার হয় সম্মতি উৎপাদন। আর এই কাজটা যথেষ্ট চাতুরতা আর শৈল্পীকতার সাথে করে গণমাধ্যম। বিস্ববিদ্যালয় আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তো করেই। জনমানসের আকাঙ্ক্ষার সাথে কবির একধরণের বোঝাপড়া চলে, চলতে থাকে অবিরাম। কেন না কবিতাও তো নিজের সত্তা আর স্বাতন্ত্রবোধকে গুরুত্ব দেয়। দেয় বৈকি, শ্রমিকের ঘাম আর রক্তের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে মান্যতা দিয়ে। ফলে শাসকের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বটা আর অগোচরে থাকে না। এস্টাব্লিশমেন্ট তার হাড্ডিগুড্ডি চিবিয়ে খেতে চায়। একারণে লোরকাকে খুন হতে হয়, মলয় রায়চৌধুরী পড়ে যান পুলিশের রোষাণলে, নাজিম হিকমতকে জেল খাটতে হয়। আর তিরিশের কবিদের যে আত্মমগ্নতা সেটা সুকান্ত পছন্দ করেননি। ওদের কবিতার প্রকরণে যে পশ্চিমমুখীতা সেটাও গ্রাহ্য করেননি সুকান্ত। ওকে নজরুলের অনেকটা কাছাকাছি মনে করা চলে। তবে এটা নিশ্চিত যে নজরুলের কবিতার ইসলামিজমের ডগমা আর মিথ সুকান্তকে মোটেও আকৃষ্ট করেনি। আর কবিতায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যাবহার তাকে বিরক্তই করেছে সম্ভবত। উনি সময়টাকে ধরেছেন আর নিজেকে সময়ের সেই আগুনে পুড়িয়ে নিয়েছেন। 'ছাড়পত্র'কে সময়ের দলিলই বলা চলে।
৩৭ টি কবিতা নিয়ে 'ছাড়পত্র' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, সুকান্তর মৃত্যুর পর, ভারতের স্বাধীনতার মাত্র কয়েকমাস আগে। বলা বাহুল্য, তার সবগুলো কাব্যগ্রন্থই একে একে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত। অন্যান্য কবিতার মতো তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতেও সেই সময়ের ঝড়ঝাঁপটার আঁচ রয়েছে। সময়কে সত্যের দিকে ঘুরিয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। কবি হয়ে যান রানার। 'একটি মোরগের কাহিনী' কবিতাটা তেতাল্লিশের মন্বন্তরের রক্তভেজা আখ্যান। তার কবিতার 'চাঁদ' হয়ে ওঠে সময়ের 'ঝলসানো রুটি'। আমরা তো দেখেছি শওকত ওসমানের 'ক্রীতদাসের হাসি' কি ভয়ংকর!
শাসকের ইচ্ছায় দুর্ভিক্ষ আর কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু। তবে সুকান্ত যে 'চারাগাছ' রোপন করেন অমোঘ নিয়মে তা হয়ে ওঠে বিদ্রোহের দূত।
'অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি।'
কম্যুনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হবার কারণে সুকান্তর একাডেমিক পড়াশুনা লাটে ওঠে, প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। কিন্তু তার কবিতায় স্ফূরিত হয় রাজনীতির আগুন, কৃষক-শ্রমিকের ক্ষুধা আর তেজ। পরাধীন দেশের নাগরিক হয়েও কবি বিশ্বনাগরিক। পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকের রক্তই লাল, সমস্ত শ্রমিকের ঘামই নোনতা। লেনিন তারও নেতা, তার চেতনার মশাল।
'লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।'
সময়ের প্রয়োজনে কামরুল হাসানের তুলি হয়ে ওঠে বেয়োনেট, গর্জে ওঠে জহির রায়হানের ক্যামেরা, সুকান্তের কলম হয়ে ওঠে সাধারণ দেশলাই কাঠি যে হুলুস্থুল কান্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। হ্যা, এ-কারণেই শামসুর রাহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' বা নির্মলেন্দু গুণের 'স্ক্রা' বা মলয় রায়চৌধুরীর 'জখম' কবিতা এবং কবিতার চেয়েও বেশি কিছু। আপনি চাইলে জহির রায়হানের 'স্টপ জেনোসাইড'কে সিনেমা বলে মানতে নাও পারেন। তো? 'হাউল' বা 'জাতিসংঘ'কে হয় তো গিন্সবার্গ ট্র্যাডিশনাল আর্টফর্মের ভাবনা থেকে লেখেননি। হয় তো।
আপনি 'ছাড়পত্র'র কবিতাগুলোকে কবিতা বলে মানতে নারাজ? কে বলেছে আপনাকে মানতে? ওরা কি কবিতা হতে চেয়েছে? ওরা হতে চায় সিগারেট, ওরা হতে চায় দেশলাই কাঠি। এজন্যই মৃণাল সেনের হাতে নির্মিত হয় 'কলকাতা '৭১' বা 'আকালের সন্ধানে'। সত্যজিৎ রায় আমাদের নিয়ে যান 'হীরক রাজার দেশে'।
সুকান্তকে মেনে নিতে হয়েছিল ভাস্কর রদাঁর নিয়তি। অগুস্ত রদাঁর 'বালজাক' প্যারিস গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ প্যারিসের বালজাক আর রদাঁর বালজাক এক ছিল না। মানুষ যা দ্যাখে শিল্পী তা-ই দ্যাখেন না। হয় তো অন্যভাবে দেখেন। অথবা আমরা যখন দেখি একটা গ্লাসের অর্ধেকটা খালি তখন কবি দেখেন গ্লাসের অর্ধেকটা ভরা। হ্যা, আমরা দেখি অন্ধকার আর কবি দেখেন আলোর অনুপস্থিতি। ডাচ পেইন্টারদের প্রতিকৃতিগুলো যে অফুরন্ত ছায়ায় ডুবে থাকে এতে ঐ প্রতিকৃতিগুলোর অন্তর্নিহীত আলোময়তাই কিন্তু শিল্পানুরাগীদের আনন্দ দেয়। দ্বন্দ্বটা এখানেই। মানে মানুষের ব্যক্তিজীবন বলে যেটা আমরা মনে করি সেটা তো আধুনিক রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানেরই বানানো খাঁচা।
মানুষ রাজনীতিপ্রবণ জীব। লেখাও রাজনীতি। তাই বলে শিল্পের সঙ্গে রাজনীতির ঠোকাঠুকি মোটেই কি হয় না? ধর্মের সঙ্গে তার ছোঁয়াছুঁয়ি? কবিতা কি? মানুষ বাদে, রাজনীতি বাদে তার অস্তিত্ব কোথায়? এমন কি ফিদা হুসেনের ঘোড়া বা নিকোলাস গ্যিয়েনের চিড়িয়াখানার পশুপাখিও কি রাজনীতির বাইরে? ফলে সুকান্তকে রাজনীতির কবি বলার কোন মানে হয় না। কারণ কবি মাত্রেই রাজনীতিক। বলা হয় ক্লিনটনের সময়ে আমেরিকা তুলনামূলকভাবে কিছুটা পরিচ্ছন্ন ছিল। কেন? হ্যা, গিন্সবার্গ নামে তখন আমেরিকায় এক ঝাড়ুদার ছিল। কবি সে। শামসুর রাহমান আর হুমায়ূন আজাদকে মেরে ফেলতে হয়েছিল। কেন না এরা ছিলেন কবি আর নোংরা পাকে অন্যদের সঙ্গে নামতে এরা রাজি হননি। তো রাজনীতিটা এসেই যায়। আপনি চান বা না চান। মানুষের পক্ষে থাকলে আপনাকে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও চলে। আপনি তখন কম্যুনিস্টই। যেমনটা বলেছেন চার্লি চ্যাপলিন।
সাম্রাজ্যবাদ যখন বলিভিয়ার জঙ্গলে চে গুয়েভারাকে খুন করে তখন তার পকেটে ছিল এর্নেস্তা কার্দেনালের 'কান্তে জেনারেল'। পকেটবুক সাইজের ক্ষুদ্র এই কবিতার বই ছিল চে'র সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা, বেঁচে থাকার রসদ।
আমাদের আছে 'ছাড়পত্র'। আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছেন সুকান্ত। এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
'ছাড়পত্র'ই আজ আমাদের ছাড়পত্র।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
শিশির আজম
Shishir Azam
জন্ম : ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৮
জন্মস্থান, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা :
এলাংগী, কোটচাঁদপুর
ঝিনাইদহ -৭৩৩০
বাংলাদেশ।
বাংলা কবিতায় Tea Poetry Movement এর উশকানিদাতা
কাব্যগ্রন্থসমূহ :
ছাই (২০০৫)
দেয়ালে লেখা কবিতা (২০০৮)
রাস্তার জোনাকি (২০১৩)
ইবলিস (২০১৭)
চুপ (২০১৭)
মারাঠা মুনমুন আগরবাতি (২০১৮)
মাতাহারি (২০২০)
টি পোয়েট্রি (২০২০)
সরকারি কবিতা (২০২১)
হংকঙের মেয়েরা (২০২২)
আগুন (২০২৪)
চা কফি আর জেনারেল কানেকটিভিটি (২০২৪)
সন্ধ্যায় তিমিমাছ (২০২৫)
প্রবন্ধ :
কবির কুয়াশা (২০২৫)
================================
শিশির আজম।