Click the image to explore all Offers

মুক্তগদ্য: আশাপূর্ণা দেবীর বকুল কথা প্রসঙ্গে ।। দীপক পাল

 

ছবিঋণ  - ইন্টারনেট 

 

 আশাপূর্ণা দেবীর বকুল কথা প্রসঙ্গে 

 দীপক পাল 

 

আশাপূর্ণা দেবীর অমর সৃষ্টি তার লেখা 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' , 'সুবর্ণলতা' 'বকুল কথা' এই তিনটে উপন্যাস নিয়ে তার ট্রিলজি যা কালের বিবর্তনের একটা অসাধারণ দলিল এই বিবর্তনের ভাল দিক খারাপ দিকগুলোকে তিনি সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন আমি আগে ট্রিলজির প্রথম দু খন্ড নিয়ে কিছু কথা লিখেছিলাম তাতে সেকাল সেকাল - একালের সন্ধিক্ষণের দিকটা বলা হয়েছে যদিও পারুল বকুলের স্কুলে ভর্তি যাতায়াতকে নতুন যুগের সূত্রপাত ধরা যেতে পারে কিন্তু প্রবোধ চন্দ্র তার ছেলেরা অপূর্ব, কানু মানু সেকালের প্রতিনিধি হয়ে প্রায় জোর করে পারুলের বিবাহ দেন প্রতিবাদ করেনি পারুল


 বকুল এখন লেখিকা তবে ছদ্মনামে সাহিত্য মহল পাঠক মহলে সে অনামিকা দেবী তার লেখার কদর এখন দিকবিদিক তার পিতা প্রবোধচন্দ্র বাতের ব্যাথায় কাবু হয়ে নিচের বাইরের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেছেন পিয়নকে বলেছেন সব চিঠিপত্র তার হাতে দিতে তিনি সবার চিঠি পড়ে তারপর ওপরে পাঠান খাম হলে জল দিয়ে খাম খুলে পড়ে আঠা লাগিয়ে, শুকিয়ে  তারপর ওপরে পাঠিয়ে দেন একদিন অনামিকা দেবীর নামে একটা চিঠি এসেছিল এই বাড়ির ঠিকানায়, কিন্তু প্রবোধচন্দ্রের নামে কেয়ার নেই যা কখনো হয় নি বকুলের চোখে পড়তেই খামটা সে তুলে নেয় প্রবোধ চন্দ্র হাঁ হাঁ করে উঠতেই বকুল বলে 'এটা আমার চিঠি'

' অনামিকা দেবীর চিঠি তোমার কি করে হয়? এটা নিশ্চয় ভুল ঠিকানায় এসেছে' বকুল বলে ,- ' ঠিক আছে আপনি চিঠিটা খুলে পড়ে আমাকে পাঠিয়ে দেবেন'

নিজের পরিবার পাড়া প্রতিবেশীর বিদ্রুপ সত্ত্বেও  প্রবোধচন্দ্র বকুলের বিয়ে দেননি তার মৃত্যুর আগে ওপরের পূব দিকের পোরশনটা তিনি বকুলের নামে লিখে দেন বকুল ওখানে বসেই তার সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছে অনামিকা দেবী নামে ছোড়দার মেয়ে শম্পা হঠাৎ হঠাৎ তার কাছে চলে আসে আর তার প্রেমিকের গল্প করে সে বাবা মার তোয়াক্কা করে না সে শুধু পিসির ভক্ত একটার পর একটা প্রেমিক পাল্টায় কারো সাথে কিছুদিন ঘোরে, আবার কারো সাথে সিনেমা যায় তার এক প্রেমিক শম্পার অনুমতি নিয়ে তার বাবার কাছে গিয়ে শম্পাকে  বিয়ের প্রস্তাব দিতেই তিনি রেগে গিয়ে বলেন, 'তোমার সাহস তো কম নয়, বেরিয়ে যাও '


আড়াল থেকে শম্পা সব দেখার পর তার কি হাসি এবার তার এক কারখানার অ্যাসিসট্যন্ট ফোরম্যানের সাথে আলাপ হলো তাকে দেখতে অনেকটা নিগ্রোদের মতো গালে মুখে হাতে জামা প্যান্টে সব কালি ঝুলি মাখা গাঁট্টা গোট্টা শরীর এক চোট ঝগড়ার মাধ্যমে আলাপ সে কথা সে পিসিকে বলে আর বলে, 'জানো মুখটা অনেকটা জাম্বুবানের মতো তাই ওকে আমি জাম্বো বলে ডাকি আমাকে কি বলে জানো, বলে, ভদ্রলোকের মেয়ে তুমি  তোমার সাথে আমার মানায় না একদম, কেন আমার পেছন পেছন ঘুর ঘুর কর? কেটে পড় তো, চলে যাও

- 'তুই তাহলে কেন ওর পেছন পেছন থাকিস?' বকুল অবাক হয়

- 'না গো পিসি, জাম্বো দেখতে খারাপ হলেও মনটা খুব ভাল, বেশ একটা পুরুষালী চেহারা ওর'


বকুল ভাবে এখনকার মেয়েরা কত সাহসী হয়ে উঠেছে শম্পা কতটা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে এইতো সেদিন পাশের বাড়ীর নির্মলকে একটা বই দিতে যাচ্ছিল বকুল প্রবোধ বলে,

- ' বই নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? নির্মলের বাড়ী? বইটা আমাকে দাও আমি তাকে দিয়ে আসব| সোমথ্থ ছেলের কাছে একা একা যাবার কি আছে?'


তখন প্রেমের সুযোগই ছিল বই আদান-প্রদানের মাধ্যমে অথচ সেই সুযোগটা হাতছাড়া হয় বাবা দাদাদের শাসনের জন্য অথচ পাশাপাশি দুই ফ্যামিলির খুবই যাতায়াত ছিল নির্মলটা আরো ভীতু সে তার জ্যেঠিমাকে যমের মতো ভয় পায় তিনি কখনো চান না তারা মেলামেশা করুক আর শম্পা সেখানে খালি প্রেমিক পাল্টে চলেছে জামা পাল্টানোর মতো ওদিকে অপূর্বদাদার মেয়ে সত্যভামাও আর একজন অতি আধুনিকা তার মা অলকার বাপের বাড়ীর প্রায় সবাই সরকারী অফিসের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত  তাদের দম্পতিরা পার্টি-টার্টিতে অভ্যস্ত তাই অলকা তার মেয়েকে সেই ভাবে ট্রেনিং দিয়েছে অপূর্বর আপত্তি সত্ত্বেও সত্যভামাও মুখে পেন্ট টেন্ট লাগিয়ে তার বয়-ফ্রেন্ডদের নিয়ে পুরী, রাঁচি নেতারহাট ঘুরে বেড়াচ্ছে অক্লেশে

 

একদিন অনামিকা দেবী জলপাইগুড়ির এক সাহিত্য সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু কিছু দর্শকের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য ভাঙচুর করার জন্য ভন্ডুল হয়  সে সভা উদ্যোক্তারা পড়লেন লজ্জায় তারা ঠিক করলেন যারা দুরে থাকেন তাদের থাকার ব্যবস্থা করা জরুরি অনামিকা দেবীর থাকার জায়গা হলো অনিল বাবুর বাড়ী তিনি খুব অমায়িক তার বাড়ীতে অনিল বাবুর এক ভাগ্নে বউ আছে নাম নমিতা তার স্বামী থাকেন হৃষিকেশ তিনি সাধু নমিতা সারাদিন খুব হাসিখুশি ছিল যখন অনামিকা দেবীর বিছানা করে মশারী গুঁজে বেরিয়ে যাবে সেই সময় নমিতাকে খুব বিষন্ন দেখে কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলে ' কিছু নাকিন্তু  বেশ কিছুদিন পরে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় নমিতা হঠাৎ এসে হাজির অনামিকা দেবীর কাছে, জলপাইগুড়ি থেকে ওখানকার সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে তার প্রিয় লেখিকার কাছে পরামর্শ নিতে এখন সে কি করবে অনামিকা দেবী তাকে জলপাইগুড়িতে ফিরে যাবার পরামর্শ দিল সে তার আত্মীয়ের বাড়ি ফিরে গেল এদিকে শম্পা বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে গেল তার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে তার বাবা বলেছিল ' কুলিটার সংস্পর্শ না ছাড়লে এবাড়ীতে তার জায়গা হবে না।' শম্পা মুখের ওপর বললো, 'বেশ তবে চলে যাচ্ছি' তারপর রাতে যে সে কোথায় গেল সেটা সে কাউকে এমন কি তার প্রিয় পিসিকেও বলে গেলনা শম্পার বাবা -মার ধারণা বকুলের আস্কারায় শম্পা এরকম উদ্ধত হয়েছে তাদের ধারণা ছিল বকুল সব জানে কিন্তু তারা হতাশ হলো অন্যদিকে এক অন্য রূপে ফিরে এল নমিতা মুখে উগ্র মেক-আপ, কানে কর্ণাভরনের ঝাড়, গলার কন্ঠাভরণের দ্যুতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে মাথার খোপা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের গোপুরম বলে, 'আমি আমার সেই জলপাইগুড়ির দীনহীন চরিত্র মুছে ফেলেছি এখন আমি সিনেমায় নেমেছি আমার নাম এখন রূপছন্দা কাল থেকে আমার শুটিং শুরু নায়িকা রোলে আমি সবাইকে দেখিয়ে ছাড়বো আমি মোটেই ফ্যালনা নই আমার বই রিলিজ হলে আপনার কাছে এসে প্রণাম করে নিমন্ত্রণ কার্ড দিয়ে যাব' একথা বলে দৌড়ে গিয়ে গাড়ীতে উঠল  কিন্তু একদিন খবরের কাগজে বেরোল, বাংলার নায়িকা রূপছন্দার মৃতদেহ বোম্বের এক হোটেলে পাওয়া গেছে গোয়েন্দা রিপোর্ট সম্ভবত এটি একটি আত্মহত্যার ঘটনা

 

এদিকে কোন এক সোর্সে বকুল জানতে পারলো শম্পা তার অসুস্থ জাম্বোকে নিয়ে চন্দননগরে পারুলের বাড়ী আছে অনেকদিন ধরে ওকে না জানানোয় পারুলের প্রতি তার অভিমান হলো এও শুনলো যে যেদিন শম্পা বাড়ী থেকে বেরিয়ে  যায়, সেদিন সে সোজা জাম্বোর মেসে গিয়ে দেখে জাম্বোর একশো চার ডিগ্রীর ওপর জ্বর শম্পা বাইরে গিয়ে ওর জন্য ওষুধ খাবার নিয়ে এসে সারারাত ওর সেবা করে, সকালে জ্বর নেমে একশো দুই ডিগ্রী হলে জাম্বোকে জোর করে উঠিয়ে ট্রেনে করে সোজা চন্দননগর স্টেশন তারপর রিক্সা করে পারুলের বাড়ী পারুল নিচে নেমে জাম্বোর জন্য শম্পার কথায় নিচের ঘরে খাটে বিছানা করে শুইয়ে দিল আর শম্পাকে নিয়ে ওপরে গেল কিন্তু জাম্বো একটু সুস্থ হতেই কলকাতায় কাজে ফিরে গেল, সঙ্গে নিল বকুলের  পিসিকে লেখা একটা চিঠি শম্পা বলে দিয়েছে যেমন করে হোক বাড়ীতে না গিয়ে চিঠিটা পিসির হাতে দিতে হবে কলকাতায় ফিরে জাম্বো দেখে কারখানায় লক্ আউট কিন্তু এক সম্মেলনে অনামিকা দেবীকে চিঠিটা ঠিক পৌঁছে দেয় চিঠি পড়ে সে সব জানতে পারে একদিন সে পারুলের কাছে যায় সেখানে পারুলের কাছে শুনলো 'সে আজই সকালে চলে গেছে কলকাতায় একটা ছেলে এসে খবর দিল কারখানার গেটে ওরই বন্ধু ঝগড়ার মধ্যে ওর দিকে বোমা ছুঁড়েছে তাতে করে জাম্বোর দুটো পা ই নাকি উড়ে যায় সেটা শুনে ওপরে না উঠে সিঁড়ির নিচ থেকেই হাউ মাউ করে বলে, 'পিসিগো, আমি কলকাতায় চললাম জাম্বোর হাসপাতালে' বলেই ছুটে রিক্সায় উঠে ছেলেটার সাথে চলে গেল কোন কথা বলার সুযোগ পাইনি কলকাতায় কোন হাসপাতালে জাম্বো আছে তাও জানিনা, কি বলবো বল'


ডাকবাক্সে অনেক চিঠি জমেছে তার মধ্যে পারুলের একটা চিঠি বার করে সে বারান্দাতেই বসলো একটু মন দিয়ে পড়ার জন্য চিঠিটাকে ঠিক সেই সময় হৈ হৈ করে একটা ট্রাক এসে দাঁড়াল বাড়ীর সামনে ট্রাকের ওপর সকলে উল্লাসে রঙিন রুমাল ওড়াচ্ছে তাদের বেশবাশ অসংবৃত সংক্ষিপ্ত চুল এলোমেলো ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে কেমন কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি চিৎকার করতে লাগলো ওপর থেকে নেমে এলো সত্যভামা ব্রাউজার গলার পিঠের কাট অনেকটা নামানো নাভির অনেক নীচে শাড়িটা পড়েছে বকুলকে বললো পিকনিকে যাচ্ছে ওরা বকুলের কেমন অশ্লীল কুৎসিত মনে হলো

 

জাম্বো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বংশীর সহায়তায় মানিকতলার মাঠ কোঠায় বংশীর বেড়ার বাড়ীতে গিয়ে উঠলো একটা ক্যম্বিসের চেয়ারে বসে শম্পাকে বারে বারে তাড়াতে চেয়েছিল সফল হয়নি এদিকে একদিন বাড়ীতে শম্পার খোঁজ পাওয়াতে ওর বাবা মা ওকে নিয়ে আসার জন্য তৈরী হতেই বকুল বললো,

-' দেখো দাদা তোমরা নিজেদের ইগো নিয়ে  থেকো না, শম্পা যা চাইবে তাই করবে'


ছোড়দা ও ছোট বৌদি খুব যত্ন আনন্দের সাথে মেয়ে জামাইকে উলুধ্বনি শাঁখ বাজিয়ে ঘরে তুললো জামাইকে খুব আদর করে ডিস ভরে মিষ্টি খেতে দিল এত আনন্দের মাঝে হঠাৎ একটা তীব্র গোঙানি আর কান্না শোনা গেল শম্পাদের ঘরের দরজার পাশের ভীড়টা হঠাৎ সত্যভামাদের ঘরের দিকে ছুটলো সেখানে বকুল গিয়ে দেখলো সত্যভামা খাটে শুয়ে আছে, তার দেহ নীল অপূর্বদাদা আর অলকা বৌদি পরস্পরকে দোষারোপ করে চলছে নারী স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে অনেকে মাত্রাতিরিক্ত স্বেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে

 

এখানে লেখাটা শেষ করা যেত কিন্তু পারুলের কথাটা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায় পারুলের ছোট ছেলে শোভন খুব উঁচু পোস্টে কাজ করে তার সর্বত্র একটা বিশেষ মর্যাদা আছে সেটা অফিসে হোক বা পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে হোক রেখাও এই ব্যপারে খুব গর্বিত তাদের একটি ছেলে একটি মেয়ে ভাই বোনে খুব ভাব হঠাৎ কি হলো ওদের মধ্যে রেখা মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে বাপের বাড়ী চলে গেল শোভন ছেলেকে চন্দননগরে মায়ের কাছে রেখে গেল পারুল কিন্তু বলেছে, ' তোরা কিরে? ছেলে মেয়ের মুখ চেয়ে একটু এডজাস্ট করে থাকতে পারলি না বলতো ওরা দুই ভাই বোনের মধ্যে কত ভালবাসা ছিল সেটা তোরা নষ্ট করলি তবে ওকেও ওর মার কাছে কেন পাঠিয়ে দিলি না?' ছেলেটা সব সময় গোঁজ হয়ে থাকতো  একদিন বাবাকে লিখলো, 'আমাকে আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি করে দাও'

 

পারুল শোভনকে সব পরিস্থিতি জানিয়ে খামে একটা চিঠি পাঠাল তার মধ্যে নাতির চিঠিটা ঢুকিয়ে দিল তারপর শোভন এসে ছেলেকে আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি করে দেয় কৌতুক করে পারুল বকুলকে বলেছিল আমাদের মা, সুবর্ণলতার সময় যদি এই সুযোগটা থাকতো তবে মা যদি তখন বাবার সম্পর্ক ত্যাগ করতো তাহলে তখন আমরা কোথায় থাকতাম খুব কঠিন প্রশ্ন



                                 _____________________________



Address :-
----------------'
Dipak Kumar Paul

 DTC Southern Heights,
Block-8,  Flat-1B, 
Diamond Harbour Road,
Kolkata- 700104.

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.