গল্প ।। ইলিশ ভাপা ।। এস. আজাদ
ইলিশ ভাপা
এস. আজাদ
— হ্যালো, কবিতা।
— হ্যাঁ, বল।
— আজকে আমি রান্না করছি। তুই খেতে আসবি?
— কি রান্না করছিস?
— সেটা তো বলবো না।
— তুই খাবি কিনা বল।
— খাব। আমাদের মেসে আজ কেউ নেই আমাকে রান্না করতে হতো। ভালোই হলো।
— স্নান করে তাড়াতাড়ি চলে আয়।
কবিতা ও দীপা এক সঙ্গে গার্লস কলেজে পড়ে। ফার্স্ট ইয়ার। দুজনে দুটো আলাদা আলাদা মেসে থাকে। দুজনের বিষয় আলাদা। একজনের বাংলা অনার্স আরেকজনের ইংরেজি। দুজনের ঠিকানা ও আলাদা। একজনের বাড়ি মেদিনীপুর আর একজনের পুরুলিয়া। তবুও কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পেয়েছে একে অপরের সঙ্গে। অনলাইনে ভর্তির পর যেদিন ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন এর জন্য এসেছিল সেদিন লাইনে আগে পরে দাঁড়িয়ে ছিল দুজনে। সেখান থেকেই পরিচয় ক্রমে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা। এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে কেউ কাউকে কিছু না দিয়ে খায় না। একজনের মেসে যদি মাছ রান্না হয় তো আরেকজনের নিমন্ত্রণ। আর মাংস হলে তো কথাই নেই। মেসের অন্যান্য বন্ধুরা এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেও তাদের কিছু যায় আসে না।
ছুটির দিন সকালবেলা ঘুম থেকে দেরি করে উঠে জামা কাপড় কেচে বারান্দায় মেলে দিয়ে স্নান করে কবিতা চলে আসে দীপার মেসে। দীপা তখনও রান্না ঘরে। দীপারা মোট ছয় জন থাকে। একজন ছাড়া বাকি সবাই বাড়ি চলে গেছে। দীপা ইউটিউব দেখে নতুন রান্না শিখেছে তারই পরীক্ষামূলক হাতে খড়ি। দীপার বাড়ির আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল। কবিতা পিছিয়ে পড়া দরিদ্র পরিবারের একমাত্র এগিয়ে যাওয়া সন্তান তার দাদা মাধ্যমিক ফেল করে বসেছিল দুই বছর। এখন গ্রামের ছেলেদের সাথে ভুবনেশ্বর এ পাইপ লাইনের কাজ করে। বাবা গ্রামে গরু ছাগল পালে আর চাষের সময় লোকের জমিতে জন খাটে। সেও এখানে এসে কলেজের সামনে চায়ের দোকানের কাকুকে বলে একটা টিউশন পেয়েছে। ক্লাস ওয়ানের ছাত্র মাসে দেড় হাজার টাকা দেয়। ছাত্রের মা, সুমনা বৌদি খুব ভালো মানুষ। সপ্তাহে চার দিন সন্ধা বেলা পড়াতে যায়। যে দিন পড়াতে যায় সে দিন রাত্রে মেসে খাওয়ার খরচ বেঁচে যায়। বাকি তিন দিন আর একটা টিউশনির খোঁজে আছে পেয়ে গেলে খুব ভালো হয়।
দীপার রান্না শেষ হলে ঘণ্টা খানেক চলে উদ্দেশ্যহীন বক বক তারপর খেতে বসে অবাক হয়ে যায় কবিতা অসম্ভব দরদ আর ভালোবাসা দিয়ে রেঁধেছে দীপা। এরকম স্বাদ সুমনা বৌদির তরকারীতে পাওয়া যায় বটে কিন্তু এ তো তার থেকেও আলাদা। তাদের গ্রামে এমন রান্না কেউ কোনোদিন খেয়েছে কিনা জানে না কবিতা। বামুন কায়েতদের ঘরে হয় কিনা জানেনা কিন্তু তাদের মতো বাউরী বাগদীদের ঘরে হয়নি কখনো এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। চরম তৃপ্তিতে খেতে খেতেই দীপাকে জিজ্ঞেস করে, — এটাকে কি বলে রে?
— ভাপা? বলেই নিজের মনে হেসে ফেলে, কবিতার বাড়ির অবস্থা সে জানে তার মুখেই শুনেছে। কিন্তু ভাপা চেনে না এটা ভাবতে পারে না। তাও তো ইলিশ নয় ছোটো রুই লেজা মুড়ো ছাড়া ছ'পিস চারশ গ্রাম ষাট টাকায় কিনেছে তিনজনের জন্য। সামান্য একটু পোস্ত আর সরষে বাঁটার সাথে চারটে কাজু বাদাম দিয়ে ছিল।
ভাপা শুনে কবিতা আরো চমকে যায়। ভাবে হোক ছোটো তবুও তো ইলিশ ভাপা। সে দীপাকে বলে, — দারুন হয়েছে। আমাকে শিখিয়ে দিবি?
— দেব। বলে একটু মিইয়ে যায়। ভাবে তার সব চেষ্টা জলে গেল, জীবনে যে প্রথম ভাপা খাচ্ছে তার কাছে রিভিউ আশা করা বাতুলতা ছাড়া কিছু নয়।
থালা এবং নিজের আঙুল চুষে চুষে সাদা করে ফেলে তার পর ওঠে কবিতা। কলতলায় হাত ধুয়ে দীপকে থালা বাটি ধুতে সাহায্য করে। তারপর দীপার ঘরে একটা ফাঁকা বেডে শুয়ে হাবিজাবি নানা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু হীন গালগল্প চলে। সাড়েপাঁচটা বাজতে পড়াতে চলে যায়। যেতে যেতে মাকে ফোন করে বলে, — যেন মা আমি আজ কি খেয়েছি?
— কি ?
— ইলিশ ভাপা।
— সে আবার কি ?
— ইলিশ একটা মাছ বটে শুনেছি। তা ওই ভাপা না চাপা কি বললি ও তো বাবার জম্মে শুনি নাই।
— দীপার কাছে শিখে নি। তারপর এক দিন তোমাদের খাওয়াবো।
মেয়ের কথা শুনে মায়ের গলা ভিজে আসে, ভাবে জীবন যৌবন শেষ হয়ে গেলো পেট ভরে ভাত ই জুটলোনা সব দিন, তাদের আবার ইলিশের স্বপ্ন। তবে মেয়ে কে কিছু বলে না। একথা সে কথায় বৌদির বাড়ির একেবারে দরজায় এসে ফোনটা তড়িঘড়ি করে কেটে ঢুকে পরে পড়াতে।
সপ্তাহ খানেক পরে সুমনা বৌদি একদিন বলল, — কবিতা, আগামী সোমবার পড়াতে আসতে হবে না।
— কেন বৌদি? কোথাও যাবেন নাকি?
— না। সোমবার সৌদীপের জন্মদিন। তুমি ঠিক ছ'টার সময় চলে আসবে। এখানেই রাত্রে খাবে।
— ঠিক আছে।
সোমবার সৌদীপের জন্য একটা চকলেট নিয়ে ঠিক ছ'টার সময় হাজির হয় বড়োরা বিশেষ কেউ নেই। বৌদির বাবা-মা শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর ভাসুরের মেয়ে। বাইরের বলতে সে আর সৌদীপের পাঁচ-সাত জন বন্ধু। সৌদীপ সবার সাথে তার মিসের পরিচয় করিয়ে দিলো। বাচ্চারা ক্লান্তি হীন ভাবে কয়েক ঘন্টা নাচা-গানা হৈ হুল্লোড় করলো তার মাঝে কেক কাটা হলো। বাচ্চারা তার গালে মুখে খানিক মাখিয়ে দিয়ে গেলো। জীবনে প্রথম শহুরে জন্মদিন পালনের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত তাকতে পেরে নতুন ধরনের অভিজ্ঞাতা হলো তার। তাদের পাড়ার বেশির ভাগ মানুষ তো নিজের জন্মদিন ই জানে না। তার আবার পালন! রাত্রি ন'টার পর বাচ্চাদের বাবা-মারা সেজে গুজে উপস্থিত হলো। ছাদে টেবিল চেয়ার পেতে খাবার সময় দেখা গেলো পয়ঁত্রিশ-চল্লিশ জন হবে। খেতে বসে আর এক চমক।
সৌদীপের বাবার দোকানের তিন জন কর্মচারী পরিপাটি করে পরিবেশন করছে একটার পর আর একটা। তাদের গ্রামে তো বাবুরা কেউ তাদের মানুষ বলে মনেই করে না। তাই কোনো ভোজ কাজে তাদের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। নিজেদের দরিদ্র জ্ঞাতি গুষ্টির কাজে তেমন ভালো-মন্দ আর জোটে কোই।
শহরের রাস্তা ঘাটের হাওয়ায় ছয়-সাত মাস কাটিয়ে প্রথম দিক কার পদগুলো চিনলেও গোল বাঁধলো সবুজ সবুজ পাতার মতো দেখতে আবার অনেকটা চৌকো কেকের মতো একটা জিনিস পাতে দিয়ে গেলে, সে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে অন্যরা কি করছে বোঝার জন্য। অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করে বুঝলো সাদা সুতো দিয়ে জড়ানো কলাপাতার ভিতরে কিছু একটা আছে। কলাপাতার বাঁধন খুলতে বেরিয়ে এলো ইয়া বড়ো! একটা মাছ সঙ্গে মাখা মাখা মসলায় জড়াজড়ি, দেখতে অনেকটা সেদিন দীপার মেসে খাওয়া ভাপার মতো হলেও এর স্বাদ একেবারে অন্য রকম। সেটা ছিল নরম আর থ্যাসাথেসে। এটার স্বাদ এতই অপূর্ব যে, সে স্বাদ জীবনে ভোলা যাবে না। তার আর একটা নিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু যদি কেউ কিছু ভাবে তাই আর চায়নি। মাংস দিতে এসেছিল, সে নেয়নি এত সুন্দর একটি মাছ খাওয়ার পর মাংস খেলে মাছের স্বাদ টাই মাটি হয়ে যাবে যে। আর মাছটা এত বড় ছিল একটা তেই তার পেট ভরে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে মেসে ফেরার সময় সে সাহস করে সুমনা বৌদিকে জিজ্ঞাসা করে, — আচ্ছা বৌদি ওই পাতার ভেতর জড়ানো যে মাছটা ছিল ওটাকে কি বলে গো। আমাদের গ্রামে তো এসব পাওয়া যায় না।
— ওটা তোমার খুব ভালো লেগেছে বুঝি? ওটাকে ইলিশ পাতুরি বলে। কোথাও কোথাও আবার ইলিশ ভাপা ও বলে। তা রান্না গুলো কেমন হয়েছিল?
তৃপ্তিতে মুখ উপচে পড়া উচ্ছ্বসিত হাসিতে কবিতা বলে, — দারুন! এরকম রান্না এর আগে কখনো খাইনি।
সাইকেল চালিয়ে বড় বাজারের ভিতর দিয়ে ফিরতে ফিরতে কবিতা ভাবতে থাকে দীপার মেসে খাওয়া ভাপার সাথে এই পাতুরি এর সাধের আকাশ-পাতাল ফারাক। অনেকটা তাদের জীবনের সাথে সুমনা বৌদিদের জীবনের মত। তাদের পাড়ার শৈশবের সাথে সৌদীপদের শৈশবের মতো।
__________
এস. আজাদ (সেখ মহঃ সানি আজাদ)
মোবাইল : ৯৪৭৫৯৭৬৫৭৬
শিবপুর দীঘিরপাড়, পোস্ট - রাজবাটী,
জেলা - পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ৭১৩১০৪