গল্প।। নিখোঁজ ছায়া ।। ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ
নিখোঁজ ছায়া
ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ
তিন বছর পর দেশে ফিরল হিমেল। লন্ডনের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় নেমেই প্রথম যাকে ফোন করেছিল সে আদিল। কিন্তু নম্বরটি নিষ্ক্রিয়। বারবার চেষ্টা করেও কোনো সাড়া নেই। হিমেল ভেবেছিল হয়তো সিম বদলে গেছে। পরেরদিন বিকেলেই সে গুলশানে আদিলদের পুরনো বাসায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বাড়ির ফটক বন্ধ। পরিচিত দারোয়ান নেই। নতুন এক রুক্ষ কণ্ঠ জানায়, "এই বাসা তো দুই বছর ধরে খালি। পরিবারটা কোথায় গেছে, কেউ জানে না।" হিমেল স্তব্ধ হয়ে যায়। আদিল ছিল তার ছায়ার মতো। প্রতিদিন কথা হতো। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল, দূর থেকেও একে-অন্যের খোঁজ রাখবে। তাহলে এখন? রাতে পুরনো ফেসবুক ইনবক্স, ইমেইল, সব ঘেঁটে হিমেল পায় এক অদ্ভুত এনক্রিপ্টেড ফাইল। সেন্ডার নাম GhostShadow। পাসওয়ার্ড চাইছে। বহু চেষ্টা শেষে একটা পুরনো কোড দিয়ে খুলতে সক্ষম হয় সে। ভিতরে শুধু এক লাইনঃ
"If I disappear, you'll know where to find me—where the shadow never returned."
হিমেল বুঝে ফেলে, এটা সেই পুরনো মিলের কথা। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে তারা দুজন সেখানে গিয়েছিল এক শহুরে অভিযানে। সে রাতে তারা দৌড়াতে দৌড়াতে বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু আদিল বলেছিল, "আমার ছায়া যেন ভিতরে রয়ে গেছে।"
রাত ৩টা।
হিমেল সেই ভাঙা মিলের সামনে দাঁড়িয়ে। বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ। কাঁচ ভাঙা, দেয়ালে গ্রাফিতি, ছাদের কিছু অংশ ধসে পড়েছে। হঠাৎ কিচিরমিচির শব্দ... ছায়ার মতো কিছু নড়ছে। হিমেল পেছনে ঘোরে, আর ঠিক তখনই শুনতে পায় সেই কণ্ঠ,
"তুই... তুই তো আসবি বলিসনি!"
অন্ধকারের মধ্যে উঠে দাঁড়ায় একজন। মুখ সাদা হয়ে আছে, চোখ লালচে। ধুলো আর ক্লান্তিতে তার চেহারা চিনতে কষ্ট হয়,কিন্তু সে আদিল।
"আদিল! তুই কোথায় ছিলি এতদিন?"
"চুপ! তোকে এখানে আসতে মানা করেছিলাম। তারা ট্র্যাক করছে আমাদের।"
"কারা?"
"এক চক্র... যারা কিশোরদের হ্যাকার বানিয়ে ব্যবহার করে। আমি ছিলাম তাদের টার্গেট। আমি একদিন তাদের অপারেশন ধরে ফেলি। তথ্য সংগ্রহ করি। ফাঁস করার আগেই বুঝে ফেলে তারা।"
"আর তোর পরিবার?"
"তাদের সরিয়ে নিতে হয়েছে। সালমান ভাই... যে একসময় আমাদের অভিভাবক ছিলেন, সে আসলে তাদের একজন ছিল।" হিমেল তখনই সিদ্ধান্ত নেয়—আদিলকে বাঁচাতে হবে, তথ্য ফাঁস করতেই হবে।
আচমকা মিলের ছাদে আলো পড়ে। ড্রোনের শব্দ, আর মুখোশধারী কয়েকজন লোক রশি বেয়ে নামছে। একজনের হাতে লোকেশন ট্র্যাকিং ডিভাইস।
"তারা জানে আমরা এখানে," ফিসফিস করে আদিল।
হিমেল আদিলকে গ্যারেজের দিকে ঠেলে দেয়, আর নিজে বিপরীত দিকে গিয়ে কাঁচের বোতল ছুঁড়ে মারে। শব্দ শুনে মুখোশধারীরা বিভ্রান্ত হয়।
আদিল গ্যারেজে পায় একটি ফ্ল্যাশ ড্রাইভ, যাতে আছে চক্রটির হেডকোয়ার্টার, সদস্যদের নাম, ফান্ডিং সোর্স—সব তথ্য। তখনই দরজার পাশে কণ্ঠ ভেসে আসে—
"তোমরা ভাবছ পালিয়ে যেতে পারবে?"
এক মুখোশধারী এগিয়ে আসে, হিমেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাতাসে চাপে পড়ে মুখোশ খুলে যায়।
সালমান ভাই!
"আমি ছিলাম আদিলের ছায়া হয়ে। সব সময়। ও ভাবত আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে?"
হিমেল ধাক্কা দিয়ে তার হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দেয়। আর ঠিক তখনই দূরে পুলিশের সাইরেন বেজে ওঠে।
"তুই কি ফোন করেছিলি?"
আদিল মাথা নাড়ে, "তুই আসার আগে থেকেই ট্র্যাক সিস্টেম অন করেছিলাম। ব্যাকআপ দরকার ছিল।"
পুলিশের বিশেষ ইউনিট ঢুকে পড়ে। সালমানসহ পুরো চক্র গ্রেপ্তার হয়।
ভোর ৫টা।
হিমেল আর আদিল হাঁটছে মিল থেকে বেরিয়ে। মাথার ওপর ভাঙা ছাদ, পেছনে পুলিশের গাড়ির আলো।
"তুই না থাকলে কি যে হতো?"—আদিল কাঁপা গলায় বলে।"ছায়া হারালেও বন্ধুত্ব হারাতে নেই।" হিমেল হেসে বলল। আদিল থেমে বলে,
"আসলে তোকে আমি শুধু বন্ধু ভাবিনি। তোকে আমি ছায়া ভেবেছি—যে নিঃশব্দে সঙ্গে থেকেছে, রক্ষা করেছে, ঝুঁকি নিয়েছে।" হিমেল আকাশের দিকে তাকায়। সকাল হয়েছে। ছায়া নেই।
কিন্তু তারা জানে, "ছায়া হারালেও সাহস থাকতে হয়, ফিরে আসার।"
ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ
অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।