ছোটগল্প ।। বেইমান ।। শ্যামল হুদাতী
0
মে ০১, ২০২৫
বেইমান
শ্যামল হুদাতী
হারাধন রায় ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় কোন আগ্রহ ছিল না। স্কুলে যাবার নাম করে বেড়িয়ে এদিক-ওদিক গুলি খেলে বেড়াত। পড়াশোনায় মন ছিল না ঠিকই কিন্তু সে খুব চালাক ছিল। বাবার একই ছেলে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার খুব স্নেহে মানুষ হয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পরেই বাবার ব্যবসা চালকল বিক্রি করে দিল। হারাধন পাটের ব্যবসা শুরু করল। জমি জমা অনেক ছিল। তার জমি বাড়ি বিষয় সম্পত্তি দেখে সাবিত্রীর বাবা হারাধনের সাথে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিলেন।
পাটের ব্যবসায় অনেক বড় লোকসান করে ফেললো হারাধন। তার অনেক জমিজমা বিক্রি করতে হলো। ব্যবসা পত্রে মন না দিয়ে ঘরে বসে বসে খেতে লাগলো - সে আর কতদিন চলবে? আস্তে আস্তে সব ফুরিয়ে আসতে লাগলো। হারাধন কি করবে নিজেই বুঝতে পারছে না?
একদিন চানটান করে খেতে বসে বললো - 'সাবিত্রী তাড়াতাড়ি খেতে দাও। ভীষণ খিদে পেয়েছে । সাবিত্রী দুম করে পাতে দুটো ঘুঁটে ফেলে দিল।
- 'একি ভাতের বদলে ঘুঁটে কেন?'
- 'যে স্বামী আয়-উপায় করে না, তার পাতে ভাতের বদলে ঘুঁটেই পড়ে।'
হারাধন এত বড় অপমান সইতে পারল না। তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।
হারাধন মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছিল, সে আর বাড়ি ফিরবে না, আত্মহত্যা করবে।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বারান্দায় সাবিত্রী শাড়ি শুকাচ্ছিল। হারাধন সেই শাড়িটা তার ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নিল। মনে মনে ভাবল এই শাড়িটা কাজে আসবে। বনের ভেতর ঢুকে সে ঠিক করল, সে আত্মহত্যা করবে। একটা শক্তপোক্ত গাছও বেছে নিল। বউয়ের শাড়িটা গলায় ভালো করে ফাঁস দিয়ে গাছের ডালে বাধার উপক্রম করছিল তখন গাছ থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বললো - ' ও ভাই এই গাছে গলায় দড়ি দেওয়া চলবে না।'
- 'কেন? এই গাছ কি তোমার?
- 'না এই গাছ আমার নয়। তবে ভূত হয়ে এই গাছেতে অনেকদিন বাস করছি। তুমি এই গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ভূত হয়ে এ গাছে বাস করবে - সেটা হচ্ছে না । আমাদের একই জায়গা কম তারপর তুমি আসলে আরো জায়গা কমে যাবে না? আর ভাই, তুমি এই বয়সে গলায় দড়ি দিতে যাবে কোন দুঃখে?
- 'গলায় কি আর সাধে দড়ি দিতে যাচ্ছি ভূতদা?'
- 'এত অল্প বয়সে তুমি কেনই বা গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছ? তুমি আমার ভাইয়ের মতো। যাও ভাই ফিরে যাও।'
হারাধন কেঁদে কেঁদে বলল - 'অনেক দুঃখ ভূতদা, জমি জমা যা ছিল সব দেনা দায়ে চলে গেছে। টাকা পয়সা একটাও নেই বউয়ের কাছে ভাত চেয়েছিলাম সে আমাকে ভাতের বদলে ঘুঁটে দিয়েছে। সেই দুঃখেই আমি আত্মহত্যা করতে এসেছি।'
- 'তোমার দুঃখের কথা শুনে আমার চোখে জল চলে এসেছে। শোনো তুমি আত্মহত্যা করতে যেও না। আমাকে দাদা বলে যখন তুমি ডেকেছো, আমার কর্তব্য তোমাকে সাহায্য করা।'
- 'তোমার সাহায্য পেলে নিশ্চয়ই আমি ঘুরে দাঁড়াবো।'
- 'তোমায় আমি এক্ষুনি দশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিচ্ছি। এই নিয়ে তুমি ব্যবসা শুরু কর।'
- 'বল কি এক্কেবারে দশ হাজার সোনার মুদ্রা আমি তো ভাবতেই পারি না।'
- 'এই টাকা নিয়ে তুমি তোমার ব্যবসা শুরু কর। লাভ হলে লাভের অংশ দিয়ে যাবে, আর লোকসান হলে তুমি আবার আমার কাছ থেকে কিছু নিয়ে যাবে। কিন্তু ভাই, বেইমানি করতে যেও না। বেইমানি করলে ঘাড় মটকে দেব, মনে থাকে যেন!'
- 'ঠিক আছে ভূতদা। তোমার এই দান আমি জীবনে ভুলতে পারবো না।'
হঠাৎ গাছ থেকে সোনার মুদ্রার ব্যাগ পড়লো।
ভূত বলল, 'যে বউ তোর সঙ্গে অমন খারাপ ব্যবহার করেছে, তার সঙ্গেও তুই ঝির মতো ব্যবহার করবি।'
হারাধন বউয়ের শাড়ি, ব্যাগ সব ফেলে বাজার থেকে কিছু দামি শাড়ি ধুতি,চাল, ডাল, আরো দরকারি কিছু জিনিস কিনে বাড়ির দিকে এগালো।
বউ তো দেখে অবাক। বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় খালি হাতে গেল, ফিরলো অনেক জিনিসপত্র নিয়ে!
হারাধনের কথাবার্তা চালচলন অনেক পাল্টে গেল। গ্রামের বাজারে বড় কাপড়ের দোকান খুলে বসলো। লাভ ও হতে লাগলো। বউকে আর সেরকম পাত্তা দেয় না। কথায় কথায় ধমক দেয় বেশি রেগে গেলে চর ও থাপ্পর মারে।
বউ আর কি করে? মুখ বুুজে থাকে।
বেশ কিছুদিন পর হারাধন ১০০ গ্রাম ছোট মাছ কিনে একটা প্লাস্টিক প্যাকেট করে গাছতলা হাজির হয়ে ডাকল - ও ভূতদা - ও ভূতদা!
- কে রে? ও ভাই নাকি আমার জন্য মাছ এনেছিস?
- হ্যাঁ ভূতদা।
- মাছের প্লাস্টিকটা দেখে বলল - এ কিরে? সামান্য কটা ছোট মাছ?
- হারাধন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল - 'প্রথম ব্যবসা তো লাভ তেমন হচ্ছে না। আরো বেশি পুঁজি থাকলে আরো বেশি লাভ হতো।'
- 'তাই বুঝি ঠিক আছে আমি তোকে আরো বিশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিচ্ছি। ভালো করে মন দিয়ে ব্যবসা কর। ভালো করে মন লাগিয়ে ব্যবসা করলে নিশ্চয়ই বেশি লাভ হবে। কিন্তু আমার কথা ভুলিস না যেন! ভুললে ঘাড় মটকে দেব!'
দু থলে স্বর্ণ মুদ্রা পেয়ে হারাধন নাচতে নাচতে বাড়িতে ফিরলো। আরো একটা বড় দোকান নিলো। লাভও হল প্রচুর। বিরাট বাড়ি তৈরি করল। এখন দাস দাসী অনেক। সুন্দরী এক মেয়েকে সে বিয়ে করল।
ভূত দাদার কথা ভুলেই গেল! বোকা ভূতটা আশায় বসে রইল কবে হারাধন মাছ নিয়ে আসবে। মাছের অপেক্ষায় রোজ বসে থাকে, কিন্তু হারাধন আর আসে না!
ভূত ভাবলো একবার হারাধনের খোঁজ নেওয়া দরকার। ভূতদের একটা সুবিধা হল, তারা অদৃশ্য থেকেও যেখানে সেখানে হাজির হতে পারে।
একদিন তখন ভোর রাত, ভূতটা জানালা দিয়ে ডাকল, ' এই ভাই এই ভাই...'
আচমকাই হারাধনের ঘুমটা ভেঙে গিয়ে, সে চেঁচিয়ে উঠলো - কে? কে ?
- 'আরে আমি তোর ভূতদা। আমি তোর বাড়ি অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছি। তুই কি আমার কথা ভুলে গেলি?
- 'না ভুলিনি ভূতদা। কাল আপনার মাছ নিয়ে যাবো।
- 'অনেকদিন বড় মাছ খাইনি। কালকে দুটো বড় বড় মাছ নিয়ে আসিস। বাড়িটা তো বেশ ভালোই বানিয়েছিস।'
- 'এই আমার বাড়ি নয় ভূতদা।'
-'তবে কার?'
- 'নতুন বউ বড়লোক তো! তাদের বাড়ি।'
- 'আবার বিয়ে করেছিস বুঝি!'
- 'আগের সেই দজ্জাল বউটা কইরে?'
- 'ওটাকে ঝি করে রেখেছি।'
পরদিন অবশ্য বাজার থেকে বেশ বড় সাইজে তিনটি কাতলা মাছ কিনে নিয়ে গাছ তলায় হাজির। ডাকল, - ভূতদা, ভূত দা!
- 'মাছ এনেছিস।'
- হ্যাঁ
- মাছ দেখে বোকা ভূতটা খুশি হয়ে বলল, - 'খুব ভালো মাছ এনেছিস! খেয়ে শান্তি পাব, অনেকদিন এত বড় মাছ খাইনি!'
- 'আরও কুড়ি হাজার স্বর্ণ মুদ্রা পেলে আপনাকে রোজই এরকম মাছ খাওয়াতে পারি।'
-'বলিস কি রে? ঠিক আছে আমার কাছে আর বিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রাই আছে। তোকে সব দিয়ে দিচ্ছি। কথার কথা কিন্তু রোজ এমন মাছ খাওয়ানো চাই। কথার খেলাপ করা চলবে না! কথার খেলাপ করলে ঘাড় মটকে দেবো!
আরো কুড়ি হাজার স্বর্ণমুদ্রা । হারাধন নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল!
প্রথম তিন চার দিন রোজ মাছ নিয়ে গেল ভূতদার জন্য। হারাধন ভাবল যখন ওর কাছে কোন স্বর্ণমুদ্রা নেই, তখন ওটাকে শুধু রোজ রোজ খাইয়ে কি লাভ? তবে ভূতটা বাড়িটা চেনে। মাছ না পেলে দৌড়ে চলে আসবে বাড়িতে।
হারাধন গ্রামের দোকান ও বাড়ি বিক্রি করে শহরে চলে আসল। শহরে একটা বাড়ি কিনলো। বড়বাজারে কাপড়ের পাইকারি ব্যবসা শুরু করল। কাপড়ের ব্যবসায় হারাধনের অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেক। সে নতুন উদ্যমে আরো নতুন নতুন রিটেল শোরুম খুলল শহরের ওপরে।
ভূতটা নতুন বাড়িতে গিয়ে তাকে পেল না। জানলার বাইরে দিয়ে ডাকলো, ভাই কোথায় রে? ভাই কোথায় রে? কেউ সারা দিল না। মনের দুঃখে আবার সে তার গাছে ফিরে গেল।
বোকা ভূতটা রোজ অপেক্ষা করে থাকে- কখন তার ভাই মাছ নিয়ে আসবে। গাছের নিচে পাতার আওয়াজ হলে - ভূতটা বলতো, ' ভাই এসেছিস নাকি?' ভাই এসেছিস?.... ভাইয়ের অপেক্ষায় বসে থাকতো দিনের পর দিন.... বেইমান ভাই আর আসতো না........।
-----------------------------
শ্যামল হুদাতী
৩৫৭/১/১৩/১, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড
কলকাতা - ৭০০০৬৮