গল্প ।। স্বপ্নে শিখরচূড়ার বিভীষিকা ।। অঞ্জনা মজুমদার
0
জুন ০১, ২০২৫
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
স্বপ্নে শিখরচূড়ার বিভীষিকা
অঞ্জনা মজুমদার
আজ নিয়ে তিনদিন একই স্বপ্ন দেখল মিলন। সাদা ঝকঝকে বরফের ভেতর একটা লাল রক্তের রেখা। লম্বা সেই দাগ বরফের ওপর দিয়ে খাদের দিকে গেছে। সেই রেখার পাশে একপাটি বুটজুতো পড়ে রয়েছে। সেই জুতোখানা ভারি চেনা মিলনের।
-- মিলু, ওঠ ওঠ, বিনু ডাকতে এসেছে। আজ তোদের বেড়াতে যাবার কথা আছে না?
মিলন চোখ মুছে উঠে বসল। স্বপ্নই দেখছিল সে। আজ নর্থ বেঙ্গল যাবার কথা চার বন্ধু মিলে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ। বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাবার অনুমতি দিয়েছেন মা।
যথাসময়ে মিলন, বিতান, লালন আর শাক্য দার্জিলিং মেলে উঠল। ওদের মধ্যে বিতান এক বছরের সিনিয়র। যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। ট্রেন ছাড়ল ঠিক সময়ে। বাড়ি থেকে আনা খাবারে ডিনার সেরে চারজন শুয়ে পড়ল। দুজন লোয়ার আর দুজন আপার বার্থ। শুয়ে পড়লেও মিলনের ঘুম আসতে দেরি হল। তাই সকালে বড্ড ঘুমিয়ে পড়েছিল। বন্ধুদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো। নিউ জলপাইগুড়ি এসে গেছে।
ঠিক করে রাখা গাড়ি করে ওরা পৌঁছে গেল হোমস্টেতে। এখানেই ওরা তিনরাত্রি থাকবে। এখান থেকেই ওরা তিনদিন পাহাড়ে ট্রেক করতে চায়। এজন্য দুজন শেরপা লাল আর বিট্টু ওদের সঙ্গে যাবে। শাক্যর মামা ফরেস্ট রেঞ্জার। উনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আজ রাতে ভালো করে ঘুমিয়ে রেস্ট নিতে হবে।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে চারজনে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ি পথে ওপরে উঠতে লাগলো। দুপুর পর্যন্ত হেঁটে একটু ওপরে একটা সমতল জায়গায় হোমস্টে থেকে আনা খাবার দিয়ে সবাই লাঞ্চ সেরে নিল।
সামনেই একটা পাহাড়ের চূড়া। মাথার ওপরে বরফ জমে আছে। ওই বরফের চূড়ায় ওরা উঠতে পারবে না। সেই ট্রেনিং ওদের নেই। শুধু পাহাড়ে চড়ার উত্তেজনা ওরা ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছে।
হঠাৎই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ওরা দৌড়ে একটা আশ্রয় খুঁজে নিল। পাহাড়ে একটা গুহা। মাঝারি আকারের।
ছয়জন ঢুকেও একটু জায়গা আছে। ভেতরে কিছু যন্ত্রপাতি রয়েছে। বিতান জিনিসগুলো হাতে নাড়াচাড়া করে বলল, এগুলো তো ট্রান্সমিটার। এখান থেকে কি কেউ কোথাও যোগাযোগ করে?
লাল বলল, কিন্তু এখানে তো কেউ আসেনা দাদাবাবু। কেনই বা আসবে? এ জঙ্গলে তো কোনও বন প্রাণীও নেই।
বিতান বলল, এই পাহাড়ের ওপারে কি আছে ?
বিল্টু বলল, ওপারে তো বর্ডার। পাহাড়ের ওপারে দুই পাহাড়ের দুই মাথায় সেনা ক্যাম্প আছে।
বৃষ্টি থেমে গেল। গুহার বাইরে পায়ের শব্দ। বিল্টু মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে থাকতে বলে গুহার ভেতরে কোনের দিকে সবাইকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
দুজন ছাই ছাই পোষাক পরা দুজন লোক গুহার ভেতরে এসে বসল। একজন বলছে আজ নয়া কুছ খবর নেই। চল্ আউর কুছ খবর জোগাড় করি। নহি তো বস হামাদের ছেড়ে দিবে না। চারজন লোককে বর্ডার পার করে এপাশে আনতে হবে।
অন্যজন বলল, ঠিক বাত। চল্ আবারও ক্যাম্পে নজর রাখি। দুজনে আবার বেরিয়ে গেল।
লালু চুপিচুপি বলল, দাদাবাবু আভি জলদি ঘর চলিয়ে। সবাই পা টিপে টিপে নামতে লাগলো। মিলন বলল, আমরা এখন কি করব?
বিল্টু বলল, দাদাবাবু পুলিশ অফিসার আর মেজর দাস কে জানাতে হবে। লালন বলল, মেজর দাস বাঙালি? চলো সবাই আমরা এখনি যাই।
গ্রামে পৌঁছে ওরা আগেই সেনা ক্যাম্পে এলো। লালু বিল্টুকে মেজর ভালমতই চেনেন। বললেন, কি হয়েছে পাহাড়ি বাচ্চা ? এরা কারা?
লালু বিল্টু সব কিছু বলল। বিতান বলল, আমার মনে হচ্ছে ওখানে ট্রান্সমিটার রাখা আছে।
মেজর বললেন, ঠিক আছে। আজ সন্ধ্যায় অপারেশন ট্রান্সমিটার।
চার বন্ধু বলল, আমরাও যাব।
বিকেলে সবাই যখন রেস্ট নিচ্ছে, মিলন পায়ে পায়ে হোমস্টের বাগানে ঘুরতে ঘুরতে মনের ভুলে বনের মধ্যে চলে এল। তারপর কখন যে আপন খেয়ালে গুহার দিকে চলে এসেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ মাথায় একটা আঘাত। চোখে অন্ধকার নেমে এল। মিলন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। লোকটা হাত ধরে টেনে তাকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে দিয়ে পিছন ফিরে চলে গেল। অচেতন মিলন গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে একটা গাছে আটকে গেল।
এদিকে মেজর আর বন্ধুরা বেরোনোর সময় মিলনকে কোথাও খুঁজে পেল না। তবু মিশন সবার আগে। সবাই চুপিচুপি এগিয়ে চললো। খানিকটা এগিয়ে গুহার কাছাকাছি পৌঁছে লালন বলল, দেখ বিতান, এটা মিলনের চশমা না? তাই তো! এখানে কি করে এলো? তবে কি মিলন এখানে এসেছে?
ওরা এগিয়ে চলল। গুহার ভেতরে ট্রান্সমিটারের আওয়াজ মেজরের যন্ত্রে সিগন্যাল দিচ্ছে। গুহার সামনেটা ঘিরে ফেলেছে সেনাবাহিনী। মেজর আর পুলিশ অফিসার আচমকা ভেতরে ঢুকে দুজনকে বেঁধে ফেললেন। তখনও ট্রান্সমিটারে গলার স্বর ভেসে আসছে হ্যালো, হ্যালো, এনি প্রবলেম? মেজর বললেন, নো প্রবলেম।
দেন সেন্ড দ্য রুট ম্যাপ। ও কে বলে মেজর যন্ত্র অফ করলেন। উদ্ধার হল, মোবাইল, ল্যাপটপ আর নানান রকমের গ্রেনেড,ডিটোনেটর।
লালন বলল, মিলনকে কি করেছে ওরা?
মেজর একজনের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বললেন, বল্ ওই দাদাবাবু কাঁহা ? নহি তো গুলি চলেগা।
সে হাত বাড়িয়ে খাদের দিকে দেখাল।
তিন বন্ধু আর বিল্টু লাল সেদিকে ছুটল। ভাগ্য সহায়, একটু নীচে গাছের গায়ে মিলন পড়ে আছে। লাল,বিল্টু নীচে নামল সেনাবাহিনীর সাহায্যে ধরে ধরে মিলনকে তুলে নিয়ে এল। পাহাড়ের গায়ে ঝুরো ঝুরো বরফ পড়েছিল। তার গায়ে মিলনের মাথা থেকে বেরোনো রক্তের রেখা। ওর একটা জুতো পাশে পড়ে আছে।
চোখেমুখে জল দিতে জ্ঞান ফিরতে মিলন দেখল তার স্বপ্নে দেখা দৃশ্য যেন জীবন্ত হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে।
সবাই মিলে ধরাধরি করে মিলনকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এল। মেজর বললেন, এরা এই গুহা থেকে আমাদের দেশের খবর পাচার করত। টাকার লোভে এরা কাজ করত। দেখা যাক এরা কি কি খবর পাচার করেছে। আমাদের হেড অফিসে সব রিপোর্ট পাঠাতে হবে।
লাল বলল, এরা আমাদের গাঁয়ের নয়। আমরাও গরীব মানুষ। তাও টাকার লোভে দেশের ক্ষতি কখনও করবো না।
মিলনকে মেজর বললেন, তুমি একা একা ওদিকে গেলে কেন?
মিলন দুর্বল স্বরে উত্তর দিল, জানিনা কি করে গেলাম। মাথায় বাড়ি খাবার পর কিছু মনে নেই। তবে বরফের ওপর ওই রক্তের দাগ আমি অনেকবার স্বপ্নে দেখেছি।
মেজর বললেন, থ্যাঙ্ক গড যে তুমি গাছে আটকে গিয়েছিলে। না হলে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
বিতান বলল, এবার কি আমরা আবার একদিন ট্রেক করতে পারি?
মেজর বললেন, আজ রেস্ট নিয়ে কাল ঘুরে আসুন। আমাদের লোকজন ওই পাহাড়ে নজর রাখবে। কি মিলনবাবু পারবে তো?
মিলন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
পরদিন সকালে আবার চারবন্ধু পাহাড়ে। গুহা পেরিয়ে বাঁক ঘুরতেই সোনালি রোদে ঝকঝকে উজ্জ্বল কাঞ্চনজঙ্ঘা ওদের স্বাগত জানাল।
বিতান বলল, এটা দেখতেই তো বারবার ছুটে আসা যায়।
মিলনের মন থেকে স্বপ্নের কথা মিলিয়ে গেল। সবাই মুগ্ধ হয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে লাগল। চারজন আর কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি সবার মোবাইলে তোলা হযে গেল। সঙ্গে লাল আর বিল্টুও।
এবার নীচে চলেন দাদাবাবুরা। উন্নত শির কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি বুকে নিয়ে চারজন নীচে নেমে এল।
পরদিন ফিরে আসার সময়ে লাল, বিল্টু আর গ্রামের লোকেদের চোখে জল। আবার আসবেন সবাই বলছে। চারজন একসাথে বলল, নিশ্চয়ই আবার আসবো। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে বারবার ফিরে ফিরে আসব।
মিলন আর কোনওদিন সেই স্বপ্নটা দেখেনি।
===========================
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১
ফোন নং 9475873503