লালঘর ও একটি মৃতদেহ
সমাজ বসু
একে একে কুড়ি পঁচিশজন লাল ঘরটাকে ঘিরে ফেলল। চব্বিশ ঘণ্টা হাট করে খোলা জানলার ভেতর, বন্ধ ঘর জুড়ে ছড়িয়ে সুখ, দুঃখ,আনন্দ আর অভিমান। যদিও এইসব অভিব্যাক্তিগুলো এখন আর বড় একটা লাল ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে না। আজকাল আঙুলের নামমাত্র ছোঁয়ায় অনুভূতিগুলো মুহুর্তেই পৌঁছে যায় আর একজনের কাছে। দুনিয়া হাতের মুঠোয়। তবুও কিছু মানুষ লালঘরের মায়া ছাড়তে পারে না।
মোহন বাবুর বেশ মনে আছে, তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান হওয়ার সুখবরটা এই লালঘরের জানলা গলিয়েই ছেড়ে গিয়েছিলেন। দিন চারেক পর দেশের বাড়িতে সেই সুসংবাদ, আনন্দের স্রোত বইয়েছিল। এইরকম আরো অনেক স্মৃতির মায়ায়,আজো তিনি লালঘরের বাঁধনে জড়িয়ে আছেন। একসময় এই লালঘরই ছিল মানুষে মানুষে যোগাযোগের একমাত্র সেতু। আজ সেতু আছে, কিন্তু মানুষের বড় একটা চলাচল নেই।
আজ একি কাণ্ড! সকাল থেকে লালঘর ঘিরে এত কালো পাখির ভীড়। তাদের এই ওড়াউড়ি, চিৎকার, উৎকণ্ঠা কিসের? মানুষের প্রতি যেন যাবতীয় ক্রোধ, বিদ্বেষ উগরে দিতে চাইছে। এই সময় লালঘরের দিকে এক পা এগনোও দুঃসাধ্য। সন্মিলিত আক্রমণে সবাই উদ্ধত। অথচ বন্ধুকে নিমন্ত্রণের চিঠি পাঠাতেই হবে। খুব দুশ্চিন্তায় পড়লেন মোহন বাবু। অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন,কালো পাখিদের সংঘবদ্ধতার কথা। কারো হয়ত বিপদ, তাই মানুষের মত সরে না গিয়ে সবাই পাশে চলে এসেছে। উচ্ছিষ্ট খুঁটে খাওয়া অতি নগণ্য পাখিদের এই অনুভূতি,আবেগ আর ঔদার্যে তিনি মুগ্ধ। হতবাক। তাদের সন্মিলিত আক্রমণের ভয়ে, মোহন বাবু আর লালঘরের দিকে এগোলেন না।
পরদিন মোহন বাবু জানতে পেরেছেন ঘটনার বৃত্তান্ত। বেলা তিনটেয় নিয়মমাফিক লালঘরের দরজার তালা ভাঙা হয়েছে। তালা ভাঙতেই অজস্র ঠিকানায় মোড়া চাদরের ভাঁজে পাওয়া গেছে একটি বায়সের মৃতদেহ। হয়ত কোন অশান্ত বেপরোয়া ছেলে তার অপরিণত বুদ্ধিতে লালঘরের খোলা জানলা দিয়ে,সবার অলক্ষ্যে ছেড়ে গেছে সেই মৃতদেহ। কিন্তু সাতসকালে প্রিয়জনের নিথর শরীর আগলে, দূরে গাছের ডালে বসে থাকা আত্মীয়ের চোখে ধরা পড়েছে সেই অমানবিক ক্রিয়াকর্ম। শুধু সেই মৃতদেহ ফিরে পাবার আকুল আকুতিই ছিল তাদের। ঝাঁকে ঝাঁকে পরিজন উড়ে এসেছে। তাদের রক্ষাকবচ নেই। সংক্রমণের ভয় নেই। আজ এইসময়ে মানুষ মানুষের মৃতদেহ এড়িয়ে গেলেও,তারা পারে না। তাদের কালো বর্ণে এতটুকু কালিমা নেই। সহানুভূতির ডানায় ভর করে তারা উড়ে বেড়ায়। প্রিয়জনের মৃতদেহ ঘিরে পাখিদের এই জাগরণেও মানুষের ঘুম ভাঙে না। শরীর ঘিরে এত নিরাপত্তা স্বত্তেও, এই ক্রান্তিকালে অমানবিকতার চোরাস্রোত ক্রমশ মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়। কি অবলীলায় মানুষ আজ ধৃতরাষ্ট্র সেজে বসে আছে।
বন্ধুর নিমন্ত্রণপত্র ডাকবাক্সে ফেলতে গিয়ে, উঁচু পাঁচিল থেকে উড়ে আসা কাকের আওয়াজ শুনেও মোহন বাবু চোখ তুলে তাকাতে পারলেন না।
==================
সমাজ বসু।।
৫৬এ, মিলন পার্ক।।
ডাক-- গড়িয়া।। কলকাতা--৭০০০৮৪
ফোন-- ৬২৯১৩৭৭৩৮২