সময় বদলায়। বদলে যায় কতকিছু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বদলে ফেলি নিজেদেরকে। এটাই কালের নিয়ম। কিন্তু ভালোমন্দের বিচারে তা কখনো ধরা হয়, আবার কখনো গা-ভাসানো স্রোতে ভেসে যায়। যাকে বলে ট্রেন্ড। পথে-ঘাটে, স্কুল-কলেজে, বাজার-অফিসে, সমাজে-মনুষ্যত্বে--সর্বত্রই ধারাবাহিকতা বহন করে সময়।
সেদিন আমার স্কুলের সামান্য একটা ব্যাপার ঘটল। টিফিন পিরিয়ডে মার্বেল নিয়ে দুই ছাত্রের মধ্যে গন্ডগোল বাঁধে। এক ছাত্র অপরজনকে একটা চাপড়ে দিল। যা হয় শিশু বয়সে। হঠাৎ দুই মহিলার চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে আসি। পঞ্চমে কন্ঠ তুলে উভয়েই অন্যের ছেলের দোষারোপে মত্ত। বিগত সময়ের কিছু ছোটোখাটো বদমায়েশির খতিয়ান তুলে এখানে অংশগ্রহণ করায় অবলীলাক্রমে। অগ্নিতে ঘি প্রদানস্বরূপ তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। গতিক গন্ডগোল বুঝে উভয়কেই বোঝাতে শুরু করলাম। কিন্তু এরা কে আর আমি কে, তার তোয়াক্কা না করে দিব্যি চালিয়ে যেতে লাগলেন রণংদেহি মূর্তিধারন করে। অনেক পরিশ্রমে ফল মিলল। কিন্তু কেউ বোঝার চেষ্টায় করলেন না এই বয়সের বাচ্চাদের এমন খুনসুটি বা ঝগড়া-মারপিট হয়েই থাকে, সেটাকে এমন উচ্চমার্গে নিয়ে যাওয়ার কোনো হেতু নেই। কারণ পরক্ষনেই ওরা আবার একসাথে খেলবে। এটাই নিয়ম, এটাই স্বাভাবিকতা। কিন্তু হল বিপরীত।
ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে আছি। মনে পড়ল আমার ছোটোবেলার শৈশবের কথা। তখন বয়স ছয় হবে। পড়াশোনা তো দূর, অক্ষরের নামগন্ধ ছিল না আমার। দুরন্তপনা আর দুষ্টুমির যাঁতিকলে পড়ে মা আমার গ্রামের এক পাঠশালাতে ভর্তি করে দেন। পাশের বাড়িতেই গ্রামের এক মাস্টারমশায পড়াতে আসতেন। পড়াশোনা না-করার বদ ইচ্ছেতে কান্নাকাটির ভেক ধরলাম। প্রথম ক'দিন দিদিভাই জোর করে কোলে তুলে দিয়ে আসত। শুরু হত আমার কান্নার উচ্চাঙ্গ রেওয়াজ। মাস্টারমশায় চটের ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়তে বলতেন, কিন্তু উচ্চাঙ্গের খেয়াল কোনোমতেই থামত না। এভাবে চার-পাঁচদিন বেহিসেবি রেওয়াজ চলল। পরের দিন মাস্টারমশায়ের ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম করল। কয়েকবার নরম সুরেই বসতে ও পড়তে বলেছিলেন বটে, কিন্তু আমার অবস্থার উন্নতি হয়নি। সজোরে হাতটা ধরে বসিয়ে দিয়ে বেধড়ক পিটলেন। লাঠি ভেঙে দুইখান। আমার রেওয়াজের সুর বদলে গেল। হেঁটকি সহযোগে মুখ দিয়ে লালারস গড়াতে লাগল। ভয়ে তরাসে প্রস্রাবনামক তরল পদার্থটির কখন বর্হিগমন ঘটেছে, তা বোঝার ফুরসৎ পাইনি। পাশের বাড়ি হওয়ার সুবাদে মা আমার রেওয়াজের আর্তনাদ শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। ছটফট করছিলেন। কিন্তু কয়েক পা বাড়িয়ে প্রতিবাদের ঝান্ডা তুলে বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিতে পারতেন,- এ কেমন শিক্ষা! মাস্টারমশায়ের ব্যক্তিত্বে আঘাত হেনে তাঁর কত পুরুষ যে উদ্ধার করতেন তিনিই জানেন। কিন্তু কোনোটাই করেননি। হয়ত এটাই শিক্ষা। তায় নীরবে থেকেছেন, আমায় ভুলিয়েছেন আদরযত্নে। কোনো প্রতিবাদের ভাষা ছিল না। চরম সত্যিটা মেনে নিয়েছিলেন এই ভেবে যে, ভালোর জন্য এটা করেছেন। যাইহোক, চার-পাঁচদিন লেগেছিল আমার পিঠের ব্যথা সারতে। তারপর থেকে আমার শিক্ষাজীবন ১৮০ ডিগ্রি কোণে মোড় নেয়। কোনোদিন পড়াশুনা করার জন্য কাউকে একবিন্দু তাগাদা দিতে হয়নি আর।
পরবর্তী সময়ে বুঝেছিলাম, সেদিন কেন আমার মা-বাবা নিশ্চুপ ছিলেন। বোধহয় আমার এই ভালোটা পাওয়ার জন্যই। শিক্ষালাভে যেমন আদর, যত্ন, ভালোবাসা থাকবে, অপরদিকে শাসনের শ্যামলতাও থাকবে। সেদিন যিনি আমায় এত পিটেছিলেন, তিনি আজ আমার শিক্ষাজীবনের এক ধ্রুবতারা। একজন শিক্ষকের কাছে ছাত্রছাত্রী তার সন্তানসম। শিক্ষার প্রতি কতটা অনুরাগ, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কতটা যত্ন, ভালোবাসা, মানবিকতা, সংস্কার-সংস্কৃতি থাকলে তবেই তিনি শিক্ষাদানে ব্রতী হন।
আমাদের সময়ে শাসন শিক্ষার পরিমন্ডলে একটা বেদীসম ছিল। সময় বদলেছে, আমরা বদলেছি, শুধু হারিয়েছি মনুষ্যত্বের ভিত্তি। আর তাই এখন সেই দন্ড বিচারের কাঠগোড়ায়। মানুষগড়ার মন্ত্রটাই বদলে গেছে, বদলে গেছে শিক্ষার পরিবেশ, বন্ধনের গভীরত্ব।
________^^^_________
বিকাশ আদক
গ্রাম- ধর্ম্মপোতা, পোষ্ট - কল্লা
থানা - চন্দ্রকোনা, জেলা - পশ্চিম মেদিনীপুর
পিন - ৭২১২০১
মোবাইলঃ ৯৬৩৫৩৩৪৬৩৯