বাঙালি সারস্বত ও চেতনার অগ্রদূত
গোলাম মুর্শিদ
পাভেল আমান
প্রতিটি বাঙালির স্মৃতিতে এখনো অমলিন দেশ পত্রিকায় মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী নিয়ে লেখা ধারাবাহিকভাবে গোলাম মুর্শিদের রচনা আসার ছলনে ভুলি। প্রতি সপ্তাহে একরাশ উদ্দীপনা আশা নিয়ে আগ্রহে বসে থাকতাম তবে তার সেই মননশীল লেখা পড়বো। তখন থেকেই গোলাম মুর্শিদ প্রত্যেক বাঙ্গালীদের মননে এক বিশেষ জায়গা স্থান করেছিল। কাঁটাতারের বেড়া উপরে দুই পারের বাঙালি সত্তা যেন বাংলা ভাষার আহবানে এক হয়ে গিয়েছিল।গোলাম মুরশিদ বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক, গ্ৰন্থকার, আভিধানিক, সারস্বত ও সংবাদ উপস্থাপক প্রয়াত হয়েছেন ২২ শে আগস্ট। এই মুহূর্তে যে কজন বাংলা ভাষা সংস্কৃতির উত্তরসূরি ধারক ও ভাওক হিসাবে নিজেদের সরস্বত ভুবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার মধ্যে গোলাম মুর্শিদ একজন। গোলাম মুরশিদ ১৯৪০ সালের ৮ এপ্রিল বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ধামুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় দুই দশক তিনি অধ্যাপনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন লন্ডনের বিবিসি বাংলা বিভাগে। এ ছাড়া ১৯৯১ সাল থেকে লন্ডনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর জীবন ও জগৎ প্রসারিত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ।গোলাম মুরশিদ বাংলাসাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজ বিষয়ে ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন। প্রাবন্ধিক হিসেবেও তিনি ছিলেন অগ্রগন্য। 'আশার ছলনে ভুলি', 'কালান্তরে বাংলা গদ্য', 'রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া : নারীপ্রগতির একশো বছর', 'সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক', 'রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা', 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদ সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুরশিদ সাহেব পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন। 'যখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি' গ্ৰন্থে সে সব কথা তিনি লিখেছেন। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার স্বল্পকালীন আলাপ পরিচয় হয়েছিল। তাঁর অসামান্য অবদান , ১৯৯৫ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন বৃত্তের উন্মোচন, 'আশার ছলনে ভুলি' আদ্যন্ত পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। মাইকেল সম্পর্কে এমন গভীর, তথ্য ও দলিল দস্তাবেজ ভিত্তিক জীবনীগ্ৰন্থ দুর্লভ। নজরুলের জীবন নিয়ে লেখা তাঁর 'বিদ্রোহী রণক্লান্ত', আমার বিবেচনায় আর একখানি নির্মোহ, নিরাবেগ মূল্যায়ন, যদিও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সমালোচকরা তাঁকে এ বইটি লেখার অপরাধে অক্লান্ত আক্রমণ করেছেন। তাঁর আর একখানি সম্পাদিত কাজের উল্লেখ না করলেই নয় : 'বাংলা একাডেমী বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান'। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নিরাবেগ, নিরপেক্ষ এবং তথ্যনির্ভর আলোচনা করেছেন একাধিক লেখায় এবং গ্ৰন্থে। দুই বাংলাকে তিনি নিকট করেছিলেন তাঁর অসামান্য সব রচনার প্রসাদগুণে । বিদেশে তাঁর দেহাবসানে বাঙালির সারস্বত ভুবনে অন্ধকার নেমে এলো। আপামোর বাঙালি মননে গোলাম মুর্শিদ রয়ে যাবেন তার চিন্তাভাবনা মুক্তমনা চেতনা বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে।
===========================
রচনা- পাভেল আমান-হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ