বই রিভিউ ।। কাব্যগ্রন্থ: 'বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন' - কবি: কিশোর বিশ্বাস ।। পাঠ-প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
কাব্যগ্রন্থ: 'বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন'
কবি: কিশোর বিশ্বাস
পাঠ-প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
পড়ে ফেললাম কবি কিশোর বিশ্বাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন"। কিন্তু পাঠ-প্রতিক্রিয়া কেমনভাবে শুরু করবো তা নিয়ে সবিশেষ ভাবিত হতে হচ্ছে, কেন না এখনও ঘোর কাটেনি। বস্তুতপক্ষে আমি বিশ্বাস করি কোনও কবির 'কবিতা' ঠিক-ঠিক ভাবে পড়তে হলে কবিকে এবং কবির জীবনকে বাধ্যতামূলক ভাবে জানতে হবে এমনটি নয়। কেন না কবিতাই কবির জাতকে চিনিয়ে দিতে যথেষ্ট। সৃজনের মধ্যে দিয়েই কবি রেখে যান সময়ের দাগ। কবির মনোভূমিতে প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ে যে সব ঢেউ, তারই কিছু কলতান কালির অক্ষরে প্রাণ পায়, আর মুগ্ধ পাঠক তখন অজান্তেই বলে ওঠেন- বাঃ! আর তখনই পরিপূর্ণতা পায় কবিতা।
কবি তিনিই হন যিনি যাপিত জীবনের জীবনযন্ত্রণার প্রাত্যাহিকতার মধ্যেও খুঁজে পান হাসনুহানার গন্ধ, অনাদরে ফুটে থাকা নাম না জানা ফুলের সৌন্দর্য, শিশুর সরলতা, অচেনা বিয়োগব্যথা, অদ্ভুত বিষণ্ণতা, চাঁদের হাসি-কান্না, বিষাদের ছায়া কিংবা অপ্রাকৃত কোনও স্মৃতিমেদুরতা। কবি তিনিই হন যাঁর দু'টো চোখ অন্যজনের দেখার থেকে ভিন্নতর কিছু দেখতে পেয়ে সৃজনশীল হয়ে উঠতে প্রয়াস পায়। মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়া শেষ করে সবাই তো ভাঁড়টিকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। কবিও হয়তো দেন, কিন্তু ভাঁড়টির ভেঙে যাওয়ার শব্দ তাঁর মনের নৈঃশব্দকে খান খান করে, কবি বুঝি শুনতে পান ভাঁড়টির অন্তরাত্মার হাহাকার। মাটি থেকে তৈরী হয়েও মাটিতে মিশে যাওয়ার এই যে অন্তর্বেদন তা কবির মনোভূমিকে আচ্ছন্ন করে, জন্ম দেয় ভিন্নতর কোনও চেতনার। কবি কিশোর বিশ্বাস সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য যিনি তাঁর চলার পথের দীর্ঘ সময় ধরে দেখেছেন জীবনের রোজনামচা, অনুভব করেছেন সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার রকমফের, চিনতে পেরেছেন ভালোবাসার কাঁচ কিংবা হীরাকে, অনুভব করেছেন বেঁচে থাকবার অসামান্য আনন্দ, শুনেছেন মৃত্যুর নিঃশব্দ হাতছানির শব্দ কিংবা ভাবনার এলোমেলো বিন্যাস। কুড়িয়ে নিয়েছেন চলার পথের ধারে পাওয়া অকিঞ্চিৎকর সব নুড়ি আর তাঁর নিজস্ব ভাবনারসে জারিত হয়ে সেই নুড়ি হয়ে উঠেছে এক-একটি হীরে-চুনি-পান্না। জীবনের মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের পাতায় পাতায় মুখ না রেখেও তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতার অবয়ব। তা থেকে ১৭৭ টি কবিতা চয়ন করে (রচনাকাল ১৯৭৩ থেকে ২০১০) রচিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থের (বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন) স্থাপত্য।
সবার মতোই কবি কিশোর বিশ্বাসও জানেন রাত্রির অন্ধকার পেরিয়ে ভোর আসলেই শুরু হয়ে যায় জীবনযুদ্ধ, তখন প্রাত্যাহিকতার টুকিটাকি পেরিয়ে কিছু বিদ্রোহী চিন্তা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায় আর রচনা করে ভিন্নতর কোনও সংলাপ, তবু সব সংলাপ বুঝি উচ্চারণ পর্যন্ত পৌঁছায় না, হারিয়ে যায় কালের গর্ভে, আর কিছু সনিষ্ঠ উচ্চারণ অনুরণিত হতে থাকে জীবন নাটকের মঞ্চ জুড়ে। সুড়সুড়ি নয়, প্রবল ধাক্কার অভিঘাতে সে ভেঙে ফেলতে চায় অচলায়তনের রুদ্ধ দরজা। আর এভাবেই লাল রোদ্দুর পেরিয়ে, বিষাদের ছায়ার পাশ কাটিয়ে, যুগের হাওয়াকে আমল না দিয়ে, বিষণ্ণতার প্রাচীর অতিক্রম করে, নীল নিঃসঙ্গ চেতনার অতল থেকে উজ্জ্বল উদ্ধার ঘটে কবিতার। কবি জানেন ন্যাংটো রাজাও কবে যেন দুম করে টেঁসে যাবে, তখন শেষ ইচ্ছের জ্বালাকে পুড়িয়ে খাক করে আবার জন্ম নেবে ঘাস-শিশুরা, অচলায়তনের মস্ত তালাটা খুলে, বিবর্ণ দেয়ালে আবার তারা লিখবে আঠারো/কুড়ি/একুশের নতুন শপথ; তখন জীবনচাকা ঘুরে গিয়ে রক্তাক্ত আকাশের পটভূমিকায় নতুন সূর্য উঠে ঘোষণা করবে যুদ্ধশেষের বিজ্ঞপ্তি, পত পত করে উড়বে যৌবনের জয়পতাকা।
বস্তুতপক্ষে একজন কবি শুধু কবি হন না, তিনি সেইসঙ্গে একজন দার্শনিক, আবার নিজের অজান্তেই তিনি একজন সমাজ সংস্কারক, জনচেতনা উদ্রেককারী একজন নীরব ঘোষক যিনি ব্যথাতুর মানুষের ক্ষতে ভালোবাসার প্রলেপ লাগাতে বদ্ধপরিকর। কবি কিশোর বিশ্বাস সম্পর্কে এই সব কথাগুলিই সবিশেষ প্রযোজ্য। তবে কি সব কবিই যেমন তাঁর ঘৃণার ভাষাকে সবিশেষ প্রকাশ করতে পারেন না, কিংবা প্রতিবাদী হয়েও প্রতিবাদের যথোপযুক্ত ভাষা খুঁজে পান না, কিংবা নিজের অভিযোগ বা বুকের মধ্যে জমে থাকা রাগের উদ্গীরণ ঘটাতে পারেন না, কবি কিশোর বিশ্বাস কিন্তু সে গোত্রের মধ্যে নন। তাঁর কলম যেমন খুঁজে পায় প্রতিবাদের বলিষ্ঠ ভাষা, ঘৃণার সঠিক অভিব্যক্তি, তেমনই তিনি তাঁর স্বকীয় অনুভববেদ্যতায় লিখে ফেলেন জীবনের ভাঙাগড়া, প্রেমের রকমফের, স্বপ্নের স্ফটিক কিংবা কল্পনার দ্যুতিময় সিংহদুয়ার।
কবি কিশোর বিশ্বাস এবং তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন' সম্পর্কে এর চেয়ে বেশী কিছ বলবার ধৃষ্টতা আমার নেই। তাই এবারে তাঁরই কিছু কবিতার ঝলকে তাঁকে আর একটু চিনে নেওয়া যেতে পারে, যাকে বলে 'গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা':—
১)
এ বাঁচা কি বাঁচা
যে বাঁচার স্বাদ নেই ভালোবাসা নেই
প্রতিটি রীত অশ্লীল হয়ে ওঠে
যে শরীরে পাপের বাসা বাঁধে
নেমে আসে অশালীন ঘুম
তারপর একদিন শরীরে বুকে
অসাড় নিঃঝুম!
(অশালীন- ১৯৭৩)
২)
আমি চিৎকার করে বলি –
এ স্বাধীনতা আমি মানি না
নিপাত যাক স্বাধীনতা
ছিঁড়ে ফেলো ওই ধ্বজা
ধ্বংস হোক এই স্বাধীনতা
ধ্বংস হোক আমার আত্মা!
(স্বাধীনতা- ২০০৮)
৩) আশি বছরের বৃদ্ধা মা
চরকায় সুতো কাটে
ঝুলে যাওয়া চামড়ার ওপর
সূর্যের সাতরঙের আলো খেলে বেড়ায়
তবুও মা আমার চরকায় সুতো কাটে
...
একদিন নীলশিরা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল
রঙে সাদা সুতো লাল হতে লাগল
তবুও মা আমার চরকায় সুতো কাটে!
(মা- ১৯৭৫)
এই রকমই অসংখ্য কবিতা জুড়ে কবির বলিষ্ঠ কলম তার স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছে। কবির বহু কবিতা ফিরে পড়বার মতো সুন্দর এবং বাঙ্ময়। যেমন- ভিখারী সম্রাট, কতদিন, নীল ওড়না, বিগত যৌবনা, ডেলি প্যাসেঞ্জারী, ভাষাহীন নীরবতা, মনে রেখো, ভালোবাসা দেব কিন্তু যৌবন দেব না, নীল নিঃসঙ্গ চেতনা, সামিল, কবিতা আর লেখা হল না, কৃষ্ণা রঙিন স্বপ্ন দেখে, বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন (২০০৯), ভিখারীটি, অবুঝ মন, হারিয়ে যাচ্ছে সুন্দর জীবন … ইত্যাদি।
কবির কবিতাগুলির সবচেয়ে বড়ো সম্পদ এর সরলতা। সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষায় লেখা কবিতাগুলিতে কোথাও এতোটুকু দুর্বোধ্যতা নেই, কথার মার-প্যাঁচ নেই, নেই অযাচিত উপদেশ দেওয়ার অপচেষ্টা। বোধকরি এর নির্ভেজাল সরলতা-ই পাঠককে পরবর্তী কবিতাটি পড়তে উদ্বুদ্ধ করবে। আর এখানেই কবি কিশোর বিশ্বাসের কলমের ক্যারিশমা।
ঝকঝকে প্রায় নির্ভুল ছাপা, চমৎকার প্রচ্ছদ (প্রচ্ছদশিল্পী: কিশোর বিশ্বাস), উৎকৃষ্ট কাগজ, মজবুত বাঁধাই বইটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আশা করা যেতেই পারে কবির কাব্যগ্রন্থ পাঠক ও বিদগ্ধমহলে সমাদৃত হবে।
কাব্যগ্রন্থ: বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন।
কবি: কিশোর বিশ্বাস
প্রকাশক: কথারূপ
মুখ্য পরিবেশক: দে'জ পাবলিশিং
মূল্য - ১২০ টাকা
পাঠ-প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
কৃষ্ণনগর, নদীয়া।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ।