শেষ বারের মতন
প্রতীক মিত্র
রফিক মোল্লা লুঙ্গিটা একটু গুটিয়ে সাইকেলে ওঠার আগে শেষবারের মতন ভটচার্য বাড়িকে একবার দেখে নিল। এই বাড়ি ওর যাতায়াতের রাস্তায় পড়ে না। ব্যবসার সূত্রে শহরের যতটুকু যাওয়া ওই দত্তদের বাগানের সামনে দিয়ে। অথচ ভটচার্যের বাড়িতে এখনই ও যাওয়াটা বন্ধ করতে চায়নি। নকুল ভট্টাচার্য্য আর রফিক মোল্লার পরিচিতি বহু বছরের।সেই পরিচিতির একটা বেশ মিঠে নাম আছে।বন্ধুত্ব। মোল্লার বেকারীর ব্যবসা নকুল আর তার আশপাশের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে রমরমিয়ে চলার পেছনে যেমন নকুল নিজে একটা বড় কারণ তেমনই নকুলের হোমিওপ্যাথির পসার ওর এলাকা ছেড়ে মোল্লা পাড়া এবং আশপাশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পেছনে বিরাট কারণ রফিক নিজে। তবে বন্ধুত্বের কারণে কেউই একে অন্যের এই মাহাত্ম্য বা হাত বাড়ানোটাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে চায়নি। তবে এখন ওর সব মনে পড়ছে। নদীর চরে সূর্য্যাস্ত দেখা, হোগলার জলা জঙ্গলে গোসাপ ধাওয়া করা, একসাথে পিঙ্কি নামের মেয়েটির প্রেমে পড়া…নকুল ভুগছিলো। বয়সজনিত কারণেই। তার ওপর গিন্নীর আচমকা চলে যাওয়া।মানসিকভাবে কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল নকুল। রফিকের সাথে সপ্তাহে অন্তত একদিন দেখা করতোই। তখন সে যত্ত জমানো অভিমান, আফশোস সব উগড়ে দিতো। বাড়িতেও ছেলেরা আর ছেলেদের বউদের সাথে ওর যে মতের মিল হচ্ছিলো না সেটাও জানিয়েছিল। রফিক নকুলকে নিজের বলে মনে করতো বলেই এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে নকুলের ছেলেদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো।নকুল বেঁচে ছিলো বলে তারা রফিককে কিছু না বললেও হাবেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো তারা ওকে বিশেষ কেন একটুও গুরুত্ব দিতে রাজী নয়।নকুল নকুলের গিন্নী অবদি যদি বা বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে কোনো ছুঁতমার্গিতা ছিল না, ওরা যে এইসব বেশ মেনে চলবে সেটা ওরা সেইবারই বুঝিয়ে দিয়েছিলো রফিককে। রফিক মোটেও চমকায়নি। পরিস্থিতি যে সুবিধের নয় সেটা ওর বুঝতে আর বাকি ছিল না।ওর বাড়িতেই ওর ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতনিদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ছিল দেখার মতন। রফিকের ভাই জাকির রফিককে এখন ভটচার্য বাড়িতে যেতে বারণ করেছিল।রফিক শোনেনি। তার সবচেয়ে ভালো বন্ধুটা চিরতরে চলে গেল। বাড়িটার হাল একবার দেখে আসবে না?তারও তো একটা দায়িত্ব আছে। নকুল আর রফিক কখনো একে অন্যকে আলাদা করে ভাবেই নি।অথচ এখন…গ্রামের প্রতিটা আগাছা, আকাশের মেঘ, পুকুরের জলের নোনা গন্ধে শুধুই অবিশ্বাস। রফিক সাইকেল চালানো শুরু করে দিলো। বোধ হয় ভটচার্যের বাড়িতে ওর আর আসা হবে না।
==============================
কোন্নগর, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ