ধারাবাহিক গল্প ।। প্রেম ও সংকল্প (পর্ব - ১) ।। দীপক পাল
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
প্রেম ও সংকল্প
(প্রথম পর্ব)
দীপক পাল
গতকাল ডেপুটি ফিনান্স ম্যানেজার সুমন্ত সেনের ফেয়ার ওয়েল হয়ে গেছে। গত চৌত্রিশ বছর টানা কর্মজীবনের শেষে তার এই আধা সরকারি অফিসের কাজে ছেদ পড়ল। ফেয়ার ওয়েলে তার ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবাই তার কর্মজীবনে কাজের সফলতা ও কুশলতা সর্বোপরি তার অত্যন্ত মার্জিত ব্যবহারের প্রশংসায় পঞ্চমুখে পেশ করল বিভিন্ন উদাহরণ সহযোগে। সবার শেষে তাকেও কিছু বলতে বলা হলো। কিন্তু তিনি যে ঘোরের মধ্যে কি বলেছিলেন সেই কথা অনেক ভেবেও মনে করতে পারলেন না নেহাতই দু একটা মামুলি কথা ছাড়া।
সুমন্ত বাড়ীর ছাদে পায়চারী করছেন এ মাথা থেকে ও মাথা। বড়ো ছাদ। টবে কত ফুলগাছ। মৃদু হাওয়ায় বেল ফুল জুঁই ফুলের গন্ধ আর তার সাথে চিনা গন্ধরাজ ফুলের গন্ধে একটা মাতন লাগা আবেশ লাগে। এই আবেশেই যেনো সুমন্তর মনে আনে একটা জিজ্ঞাসা। যা তিনি এতদিন উপলব্ধি করেন নি। সেটা হচ্ছে চলে যাওয়া গত চল্লিশটা বছর। আজও যেন মনে হয় এইতো সেদিন। কিন্তু সেটা যে এত দ্রুত চলে গেলো ভাবতেই অবাক লাগছে তার। মনে পড়ে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক ও বিকম পরীক্ষার দিনগুলোর কথা। আর তখনই মনে তার প্রেমের উন্মেষ ঘটে। তারপর ঘটনা পরম্পরায় পড়ায় মনোযোগ ও পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে প্রেমও যেন আপন খেয়ালে শান্ত নদীটির মত বয়ে গেল। যেন সেই গানটার মত ' পুষ্প বনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে '। কিন্তু তার পা কখনো তার জন্য পিছলে যায় নি বা তিনি পিছলোতে দেন নি। মনে ছিল উচ্চাশা। প্রেমের নিগড়ে বাঁধা পরেও সেটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে একটা একটা ধাপ তিনি ঠিক উঠে গেছেন। সেটাও তিনি পেরেছেন ওই প্রেমের শর্তে। বিয়ের পরে তার দুই ছেলেকেও স্ত্রীর সহায়তায় একটা একটা সিঁড়ি অতিক্রম করতে সাহায্য করেছিলেন। এখন তারা থাকে সস্ত্রীক বিদেশে। একজন স্টেটিস্টিসিয়ন আর একজন এম আর সি পি করছে। দুজনেই থাকে বিলেতে। তারা বাবাকে টাকা পাঠায়। কিন্তু তিনি ওদের টাকা বিশেষ খরচ করেন না। ওদের নামে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন। সময়ের স্রোতের সাথে চলতে চলতে যাত্রা তার থেমে গেলো নিয়মের চক্রে। একটা উঁচু জায়গা দেখে তিনি বসলেন। আকাশের দিকে তাকালেন। তারা ভরা আকাশ। কতদিন যেন দেখেন নি এ রকম আকাশ। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি তার পুরনো দিনের কথা ভাবলেন। দেখতে পেলেন তিনি অর্থাৎ যুবক সুমন্ত টেন ইয়ারস একাউন্টসের প্রশ্ন পত্র সলভ করছেন একমনে। একটা ইয়ারের সবটা শেষ করে পরেরে বছরেরটা শুরু করলেন। আগের বছরেরটা একবারেই মিলে গিয়েছিল। তাই খুশী সে। এবারেরটাও মিলে যাচ্ছে। শেষ প্রশ্নটা বড়ো।ট্রেডিং অ্যান্ড প্রফিট অ্যান্ড লস একাউন্ট অ্যান্ড ব্যালেন্স শিট। একটু আড়মোড়া ভেঙে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই সুপর্ণার চোখাচোখি হলো। ওকে দেখলেই সুমন্তর মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সেও লক্ষ্য করে সুপর্ণার চোখেও যেন আলোছায়া খেলে বেড়ায়। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে তারা কিছুক্ষণ। সুপর্ণা একটু চোখ নামাতেই সেও খাতার পাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করলো। সামনেই যে তার ফাইনাল পরীক্ষা। অন্যমনস্ক কি হওয়া যায়। সুপর্ণাকে তার ভালো লাগে কিন্তু তার সাথে প্রেম করা যায়না। ওদের বাড়ীর মেয়েরা খুব কনজারভেটিভ। স্কুলে যাতায়াত ছাড়া ঘরের বাইরে বের হয় না। তারপর কলেজে পড়তে পড়তে তাদের একে একে বিয়ে হয়ে যায় বা বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট না হলেও অবস্থাপন্ন পরিবার হওয়ার দরুন বিয়ে দেওয়া হয় ভাল ভাল জায়গায়। অতএব তুমি একটি অত্যন্ত ভালো ছেলে পাড়ায় এই সুনামটা থাকায় এবং তুমি কখনো কোন বাজে কাজে জড়াতে পারো না এই বিশ্বাসটা সবার মধ্যে থাকায় তোমার এখানেই ইতি হওয়া উচিত। পাড়ার সবাই তোমাকে ভালোবাসে বিশ্বাস করে এমন কি সুপর্ণার দুই ভাইয়ের সাথে তোমার খুব ভালো বন্ধুত্ব আছে।
টানা দশটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে সুমন্তর একটু খোলা হাওয়ায় বেরোতে ইচ্ছে করে। বেরিয়ে একটু রাস্তার মোড়ে দাঁড়ায়। ফুটপাথে একটু চলা ফেরা করে। দোকানগুলোয় সব পরিচয় থাকায় একটু কথা বার্তা হয়। দু একজন বন্ধু ছাড়া বাকি সব বন্ধুরা ভালো ভালো চাকরিতে ঢুকে গেছে। সে এখনও কোনো চাকরির চেষ্টা করে নি যতদিন না সে বি কম পাশ করবে। বি কম পাশ করার পর সে চাকরির চেষ্টা করবে না হয় পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে দেখলো উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে একটি মেয়ে টু ওয়ে রাস্তা পরিয়ে এপারে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। কাঁধে তার ১টা সুন্দর শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। তাতে নিশ্চয়ই আছে বই খাতাপত্র। সুমন্তর সাথে চোখাচোখি হলো তার। আজ কদিন ধরেই এটা হচ্ছে। সাউথ কলকাতার কোনো কলেজে পরে নিশ্চয়ই। লেডি ব্রাবোর্নে নয় মনে হয়। কারণ ও যে বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়ির ছোট মেয়ে লেডি ব্রাবোর্নে পড়ে। কখন দুজনে একসাথে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ালে কেউ কারো সাথে কথা বলে না। কেউ কাউকে চেনে বলে মনেই হয় না। আজ মনে হয় সে এখনও বেরোয় নি। এদিকে ওই মেয়েটি একবার ডান দিকে কোন বাস আসছে কিনা দেখছে আবার যখন বাম দিকে তাকাচ্ছে তখনই সুমন্তর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে। পেছনের রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখে সুপর্ণা বই খাতা বুকে নিয়ে ইউনিফর্ম পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। ওদের বড়ো ব্যবসা। সকালেই ওর বাবা ও দাদা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। দাদা গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যায়। সুপর্ণা হেঁটে আসছে দৃপ্ত ভঙ্গিতে কখনো তার সোজা দৃষ্টি কখনো মাটির দিকে। ওর মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর হাঁটার মধ্যেই সুমন্তর সাথে বার তিনেক গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখলো। সেও দৃষ্টি বিনিময় করলো সুপর্ণার সাথে। কিন্তু কেন যে সেটা করলো সে জানে না। সুপর্ণা তার পাশ দিয়েই হেঁটে চলে গেলো ডান দিকের ফুটপাথ ধরে।
বাসস্ট্যান্ডের গায়েই মনোজদার লন্ড্রির দোকান। সে মাঝে মাঝে খদ্দের না থাকলে বাইরে বেরিয়ে আসে। এদিক সেদিক তাকিয়ে হাঁক ডাক করে। সুমন্তকে দেখে হাঁক পারলো,
- ' এই সান্টু, এদিকে আয় '। সুমন্ত এগিয়ে গেলো।
একটা ১০ নাম্বার বাস এসে দাঁড়ালো স্ট্যান্ডে। বাসে উঠে পড়ল মেয়েটি শান্তিনিকেতনি ব্যাগ সামলে।
- ' কি বলছো মনোজ দা বলো।'
- ' তুই মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস?'
হোঁচট খেলাম একটু। এইরে মনোজদা কি কিছু টের পেলো। বললাম,
- ' কি আর দেখবো মানুষের চলাফেরা ও গাড়ির যাতায়াত। সামনের সপ্তাহে আমার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে তাই পড়াশোনার ফাঁকে এই সময়ে মস্তিষ্কে পিওর অক্সিজেন নিতে বেরোই।'
- ' হ্যাঁ এই সময়ে তোকে রোজই দেখতে পাই। কিন্তু কতটা অক্সিজেন এই গায়ে গায়ে গাড়ি বাস চলার বড়ো রাস্তায় পাস সেটা রাস্তার ধারে দোকানে বসে খুব টের পাই। তাহলেও তুই আসিস। তোর সাথে কথা বলে খুব আনন্দ পাই। '
- ' হ্যাঁ আসবো নিশ্চয়ই। মাথাটা জ্যাম হয়ে থাকে। একটু বাইরে বেরোলে মাথার জ্যামটা কাটে।'
- ' সন্ধ্যেবেলা বেরোস? তোকে সন্ধ্যায় দেখি না।'
- ' কি করে দেখবে। আমরা তো উল্টোদিকের চা এর দোকানের পাশে আড্ডা মারি। ওখান থেকে
দেখতে পাই তুমি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তিদা আজিতদা শানুদাদের সাথে আড্ডা মার
আর কাস্টমার আসলে দোকানে ঢুকে কাজ সেরে আবার বেরিয়ে এসে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ডাক,
- ' এই জটু, তাড়াতাড়ি চারটে চা দিয়ে যা।' জটুও....
- ' এই নিয়ে যাচ্ছি মনাদা। চারটে বিস্কুট নিয়ে যাই?
- ' তুমি বলো হ্যাঁ নিয়ে আয়।'
দোকানে কাস্টমার আসায় মনোজদা সুমন্তর কাঁধে ছোট্ট একটা চাপর দিয়ে দোকানে ঢুকতে
ঢুকতে বলে, ' যা বাড়ি যা মন দিয়ে পরীক্ষার পড়া কর। আর এদিক ওদিক তাকাবি না একদম। এই
একটা আলটপকা কথা বলায় মনোজদার ওপর ওর খুব রাগ হলো। কোনো কাণ্ড জ্ঞান নেই মানোজদার।
একজন মহিলা কাস্টমারের সামনে এটা কি কথা? এমনিতে মনোজদা খুব ভালো মানুষ। ক্রিকেটে খুব
ভালো বোলার ও খুব ভালো ফিল্ডার। ভালোও বাসেতাকে খুব।কখনো কখনো মনোজদা অজিতদা
শান্তিদাদের সাথে আড্ডা মারে সকালবেলা। অবশ্য ওর নিজের কোনো বন্ধু এসে গেলে তখন ও সেই
বন্ধুর সাথে গল্প করে বা এদিক সেদিক যায়।
যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হলো আবার শেষও হলো একদিন। পরীক্ষাটা সে ভালই দিল। সুপর্ণার সাথে নীরব প্রেম কিছুদিন চললো তারপর নিজেকে সে একদম গুটিয়ে নিল ঐদিক থেকে। একদিন তার সেই শান্তিনিকেতনই ব্যাগের মেয়েটির সাথে হঠাৎ আলাপ হয়ে গেল। ব্যাপারটা ছিল ভারী ইন্টারেস্টিং ও অভাবনীয়। মেয়েটি বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষা করছিল। হাতে তার ধরা ছিল সুন্দর রঙীন ছাতা। সুমন্ত মনোজদার সাথে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। একটা দশ নম্বর বাস স্ট্যান্ডে আসতেই ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠতে গিয়ে তার হাত থেকে ছাতাটা পড়ে যায় রাস্তায়। ছাতাটা সে গোটাতে পেরেছিল শুধু। বাস ছেড়ে দিতেই মেয়েটি রাস্তায় পড়ে থাকা ছাতাটা দেখে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। বাস তখনও গীয়ার চেঞ্জ করেনি। এক মুহূর্ত না ভেবে সুমন্ত লাফ দিয়ে ছাতাটা তুলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে পড়লো। মেয়েটা বাসের পাদানি থেকে উপরে উঠে রড ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সুমন্ত ছাতাটা মেয়েটির হাতে তুলে দিতেই সে বলে
- ' অসংখ্য ধন্যবাদ দেব, এরকম একটা রিস্ক নিয়ে আপনি ছাতাটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিলেন।'
- ' আমার এরকম চলন্ত বাসে ওঠা নামার অভ্যাস আছে। তাই এটা কিছু না। চিন্তারও কারণ নেই।'
পরের স্টপেজ আসতেই সুমন্ত বাস থেকে নেমে পড়লো। ফুটপাথ থেকে জানলা দিয়ে রড ধরে
দাঁড়ানো মেয়েটির উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো সুমন্ত। মেয়েটিও হাত নাড়লো তার উদ্দেশ্যে। আবার সে
ফিরে এলো মনোজদার কাছে। মনোজদা বললো,
- ' তুই তো হিরো হয়ে গেলিরে সন্টু।'
পরের দিন সকালে সুমন্ত ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে সামনের দিকে চোখ পড়তে দেখে
এদিকের বারান্দায় সুপর্ণা দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। আবার একবার চোখাচোখি হলো। সুমন্ত রাস্তার দিকে চোখ ফেরালো। ধীরে ধীরে হেঁটে বড়ো রাস্তার বাম দিকের ফুটপাথে এসে দাঁড়ালো। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো সুপর্ণা বারান্দায় নেই। স্বাভাবিক স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে যে। এবার ডানদিকে চোখ পড়তেই দেখে মিষ্টির দোকানের কান্তি টুলে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এখন দোকানে কোনো খদ্দের নেই। মনোজদা দোকানের ভিতরেই আছে। নিশ্চয়ই খবরের কাগজে খেলার পাতা পড়ছে। শান্তিনিকেতনি ব্যাগ কাঁধে ও মাথায় সেই ছাতাটা খুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ডান দিকে মনে হয় সেই বাসটাও আসছে। বাসস্ট্যান্ডে এসে আজকে ওকে দাঁড়াতে হবে না। কিন্তু আশ্চর্য মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বাসটাকে দেখে সোজা এই ফুটপাথে উঠে একেবারে সুমন্তর সামনে এসে দাঁড়ালো। সুমন্ত অপ্রস্তুত। মেয়েটি বলে,
- ' দেখেছেন অন্যদিন বাসস্ট্যান্ডে এসে কতক্ষণ দাঁড়াতে হয়। আজ একদম ঠিক সময়ে এসেছে।'
-' কেনো বাসটা ধরার চেষ্টা করছেন না। তাড়াতাড়ি গেলে এখনও বাসটা পেয়ে যাবেন।'
- ' বারে আপনার সাথে তো আলাপই হলো না আমার। আমার নাম চান্দ্রেয়ী, চান্দ্রেয়ী চ্যাটার্জী।
মুরলীধর গার্লস কলেজের কলা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আপনি?'
- ' আমার নাম সুমন্ত সেন। সুরেন্দ্র কলেজে অফ কমার্স থেকে বি কম ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম
এইবার।'
- ' আজকে প্রথম ক্লাসটা করবো না। চলুন ঐদিক যাই গল্প করতে করতে। আমি পরের স্টপেজ
থেকে উঠবো।'
- ' বেশ চলুন। আপনি থাকেন কোথায়? মাফ করবেন আমি বোধহয় কৌতূহল প্রকাশ করলাম।'
- ' আমাকে আপনি যেখান থেকে দেখতে পান সেই সেখান থেকে দুপা এগোলেই বাম দিকে যে রাস্তাটা
পরে সেই রাস্তায় ঢুকে ডান দিকের প্রথম বাড়ির পরের বাড়ীটা। একদিন নিয়ে যাব আপনাকে যদি
অবশ্য আপনি রাজী থাকেন।
পরের বাসস্ট্যান্ডে এসে উপস্থিত হলো তারা। একটা ৪৫ নম্বর বাস এসে দাঁড়ালো স্ট্যান্ডে।
চান্দ্রেয়ী সেটা দেখেও দেখলো না। বাসটাতে ভীড় একটু থাকলেও সেটাতে ওঠা যায়। অথচ ওটার
গায়ে গায়েই আর একটা ৪৫ নং বাস এলো ফাঁকা। চান্দ্রেয়ী বাসের দিকে এগিয়ে গেলো। বাসে উঠতে
উঠতে হাত নাড়ালো। বললো,
- ' এবার আসি, আবার কালকে দেখা হবে।'
সুমন্তও হাত নাড়িয়ে প্রত্যুত্তর দিয়ে ফিরে চললো। ফিরে এসে সোজা কান্তির মিষ্টির দোকানে
ঢুঁকে ১২৫ গ্রাম দই চাইলো। সব মিষ্টির দোকানে ফ্রিজে ১০০ গ্রাম দই পাওয়া যায় কিন্তু এর ফ্রিজে থাকে ১২৫ গ্রাম দই। কান্তি প্রায় সুমন্তর বয়সী তাই একটু বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে। সে ফ্রীজ খুলে একটা ১২৫ গ্রামের ভাঁড় ও একটা কাঠের চামচ বার করে সুমন্তর হাতে দিয়ে বলল,
- ' কি চুপি চুপি প্রেম করা হচ্ছে তাই না? আগে সোজা এসে দোকানের বেঞ্চে বসে গল্প করতে। এখন লক্ষ্য করছি সোজা এসে ওই মোড়ে দাঁড়াও।'
- ' তুই চুপ কর, বসে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখিস না?'
- ' কি করবো খোলা চোখে যা দেখি তাই বললাম।'
- ' তুই দেখছি বসতে দিবি না এখানে। এইনে তোর পয়সা। এবার পালাই আমি।'
দুটো দিন কাটলো সুমন্তের গল্পের বই পড়ে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। একদিন মেট্রো হলে একটা ইংরেজি বই দেখে। বন্ধুদের সাথে দুটো দিন বেশ হৈ চৈ করে কেটে গেলো। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই চান্দ্রেয়ীর কথা মাঝে মাঝে মনে পড়েছে।
সোমবার যথারীতি ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো সুমন্ত। দেখলো ধীর পায়ে আসছে চান্দ্রেয়ী। ফুটপাথ উঠে সোজা এসে দাঁড়ালো সুমন্তের সামনে। তারপর দুজন গল্প করতে করতে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলো পরের বাস স্ট্যান্ডের দিকে। কাছাকাছি পৌঁছতেই পিছন ফিরে দেখতে পেলো সেই ডাবল ডেকার বাসটা স্টপেজে ঢুকছে। চান্দেয়ী সুমন্তর হাতটা ধরে বললো,
- ' এই আমি বাসটা ধরার চেষ্টা করি কেমন।'
- ' ঠিক আছে ঠিক আছে, সাবধানে, আবার না ছাতা পড়ে যায় দেখবেন।'
চান্দ্রেয়ী হাসতে হাসতে ছাতাটা বন্ধ করতে করতে দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে পড়লো। সুমন্ত সঙ্গে
সঙ্গে ফিরলো না। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপারে গেলো। তারপর বাম দিকের রাস্তাও পেরোলো। সেখানে বাসস্ট্যান্ডের গায়ে একটা চায়ের দোকান আছে, সেখানে ঢুকলো। এই দোকানে কখনো সখন বন্ধুদের সাথে এসে চা বিস্কুট খায়। আজও চা আর বিস্কিট চাইলো। রাস্তার ধারের একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো। এখানে বসে বাসস্ট্যান্ডের শেডের কিছুটা পোরশন আড়াল হলেও বাকি অনেকটা দেখা যায়। বসে চা বিস্কুট খেতে খেতে কেমন একটা চিন্তা এসে মাথায় ভীড় করে এলো যেটা সে এতদিন মাথাতেই ঢুকতে দেয়নি। সেটা একটা চাকরী। একাউন্টিং সম্পর্কিত। ভবিষ্যতে কাজে দিতে পারে,অপরদিকে পড়া চালিয়ে যাবার জন্য টাকারও দরকার। চাকরি তাকে নিয়মিত অর্থ যোগাবে। পয়সা মিটিয়ে উঠে পড়লো সে। বাসস্ট্যান্ডের পাশে বসা কাগজয়ালার কাছ থেকে একটা স্টেটসম্যান কিনে পেছনের রাস্তা দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরলো। পথে একটা দোকান থেকে এক দিস্তা কাগজ ও একটা ডট পেন কিনল।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে এখনও তো বেশ দেরী, তবে সেকি টাইপ শর্ট হ্যান্ড
ক্লাসে ভর্তি হবে। তবে সে তাই করবে। শুধু শুধু বসে না থেকে একটা কিছু করা উচিত। সকালে রোজ সে একটু পড়াশোনা করে। আর সন্ধ্যেটাও একটু ব্যস্ত থাকা যাবে।আজই অফিস থেকে বাবা ফিরলে কথাটা বাবার কাছে পেশ করতে হবে। যা ভাবা সেই কাজ। কথাটা বাবার কাছে পেশ করাতে বললেন,
- ' তুই কি এম কমটা দিবি না নাকি চান্স পাবিনা?'
- ' সেটাতো একটা ব্যাপার ঠিকই। কিন্তু বসে না থেকে শর্টহ্যান্ড আর টাইপটা শিখে নিলে কি হয়?'
- ' ঠিক আছে টাকা নিয়ে যা। কলেজ স্ট্রিট গিয়ে পিটম্যানের বই আর শর্টহ্যান্ড খাতা কিনে নিয়ে
একেবারে ভর্তি হয়ে আসবি।'
- ' ঠিক আছে।'
পরদিন সকালে চান্দ্রেয়ী সুমন্তকে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
- ' কি ব্যাপার আজকে একেবারে এই স্টপেজে?'
- ' আজকে সামনের বাস স্ট্যান্ডে না গিয়ে পেছনের বাসস্ট্যান্ডে যাই চলো।'
- ' যাচ্ছি চলুন। যাচ্ছি এই কারণে যে আপনি আমাকে তুমি বলেছেন।'
- ' এমা তাইতো! আপনি কিছু মনে করবেনা প্লিজ।'
- ' তাহলে আমি যাব না আপনি যান।'
- ' আচ্ছা আচ্ছা চল। কিন্তু আমাকেও তুমি বলতে হবে তোমাকে।'
- ' না মশাই, অত সহজে তুমি বলতে পারবো না আমি। আমার তুমি বলতে সময় লাগবে।'
- ' আচ্ছা ঠিক আছে।'
চান্দ্রেয়ীকে বাসে তুলে দিয়ে সে রাস্তাটা পেরিয়ে উল্টো দিকের রাস্তায় ঢুকে পড়ে হাঁটতে শুরু করলো। এঁকে বেঁকে রাস্তা দিয়ে গিয়ে সে লোয়ার সার্কুলার রোডের অপর পারে গিয়ে ট্রাম স্ট্যান্ডে গিয়ে একটা কুড়ি নাম্বার ট্রামের জানলার ধারে গিয়ে বসলো। ছোটবেলায় সে যখন সুরেশ সরকার রোডের একটা স্কুলে পড়ত তখনকার কথা তার মনে পড়লো। তাই এসব রাস্তায় তার হাঁটতে খুব ভালো লাগে। ট্রামে জানলার ধারে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে। একসময় ট্রাম কলেজ স্ট্রিটের স্টপেজে এসে থামলো। কলেজ স্ট্রীটে খুব সহজেই তার প্রয়োজনীয় বই আর খাতা পেন্সিল পেয়ে গেলো। এবার সে বাসে উঠলো। বাড়ির স্টপেজে না নেমে সোজা পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়ে গিয়ে নামলো। তারপর রাস্তা টপকে পার্ক স্ট্রিটের একটা শর্টহ্যান্ড ইনস্টিটিউশনে গিয়ে ঢুকলো। সব খবর টবর নিয়ে ভর্তি হলো। শর্টহ্যান্ড ক্লাস শুরু করবে ১লা জুলাই থেকে। জুনের আর মাত্র কটা দিন বাকি। তাই সে জুলাই থেকেই স্টার্ট করবে। ওখান থেকে বেরিয়ে আবার বাসে উঠে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বেলা একটা বেজে গেলো।
চলবে------------------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata-700104.