বিজ্ঞপ্তি
লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫
নভেম্বর ২১, ২০২৪
তামস চক্রবর্তী
মেঘ পাহাড়ি গ্রামের পারাং নদীর গা ঘেঁষে ছিল হারাধন বেসরার দোচালা কুঁড়ে ঘর । বরেন তার মা মরা একমাত্র ছেলে ।সে অনেক দিন আগের কথা ,বরেন তখন বছর একুশের তরতাজা যুবক ।হালকা শ্যামবর্ণ মাথায় এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল । পেটানো শরীর ।কোদাল কাঁধে মাঠে যাওয়ার সময় মাথার হলদে গামছার পাগড়ীতে গোঁজা থাকত একটা নীল রঙের আড় বাঁশি ।অপূর্ব বাজাতো ছেলেটা ,অনন্ত বেদনাময়একটা করুণ কান্না যেন ঘুরে বেড়াতো চারপাশে । আশেপাশের পাঁচ গাঁয়ের মানুষ বরেনের বাঁশির সুর ঠিক চিনে নিতে পারতো ।সে বারই তো গাঁয়ের রঞ্জন মাস্টার পারাং এর পাড় ধরে স্কুলে যাওয়ার পথে বরেনকে ডেকে বলেই ফেললেন- ' বরেন, এ বাঁশি তুই ছেড়ে দে, কেন বাজাস তুই এতো করুন সুর ,কিসের এতো দুঃখ তোর? তার চেয়ে স্কুলে ফিরে চল । নীরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল বরেন,কিছু বলতে পারেনি ।একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে।এক সময় রঞ্জন মাস্টারের স্কুলের সেরা ছাত্র ছিল সে।বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে ।এক অজানা শূন্যতায় শরীরটা কেঁপে ওঠে । পারাং এর পাড় ঘেঁষে নুইয়ে পড়া চালতা গাছের ছাওয়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে পড়েন মাষ্টার মশাই ,ঘড়ির কাঁটায় সময় ধরে চলা রঞ্জন রায় । বরেনের সরল নিষ্পাপ, ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখ আর ছল্ ছল্ করে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়ে একটা বুক ভাঙা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । এক নিবিড় স্নেহে বরেনকে কাছে ডেকে মাথায় গায়ে হাত বোলান । স্নেহের পরশে হু হু করে কেঁদে ওঠে বরেন । চোখ ফেটে জল আসতে চায় রঞ্জনের, ছাত্র অন্তঃপ্রাণ মাষ্টার মশাই, ভালোবাসতে জানেন ।কয়েকটা মহুর্ত কেটে যায়, ছাত্রের হাত ধরে অন্তহীন বেদনায় গুমরে ওঠা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে আস্তে আস্তে বলেন,-'বাজা না বাবা বাজা সেই গানটা,যেটা একটু আগেই তুই বাজাচ্ছিলি ওই যে' - খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে '। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বরেনের, বাধ্য ছেলের মতো তার প্রিয় নীল বাঁশিটায় সুর তোলে , নির্জন পারাং এর ঘাট আদ্র হয়ে ওঠে সুরের যাদুতে । চালতা গাছের তলায় ভিজে মাটির উপর বসে মাষ্টার মশায়ের অনুরোধে বরেন বাজিয়ে চলে একের পর এক সুর-রাগ,সুরের নেশায় যেন পাগল হয়ে ওঠে দুজনেই, কতটা সময় কেটে গেছে খেয়াল হয় নি ,শুধু সুরের মূর্ছনায় নির্জন পারাং এর নিথর জল কেঁপে কেঁপে ওঠে ।হঠাৎই বাঁশি থেমে যায় বরেন চমকে ওঠে, কঠিন অঙ্কের সহজ সমাধান করা কড়া শিক্ষক রঞ্জন রায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে । বরেনের নিষ্পাপ চোখেও অশ্রুপ্লাবন ।মাষ্টার মশাই ধুতির খুঁটে চোখ মুছে বরেনের বাঁশি টা চেয়ে নেয়, ডুকরে আসা দীর্ঘশ্বাস চেপে নীল রঙা বাঁশিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন । কি যেন খোঁজেন ।আলতো করে হাত বুলিয়ে বাঁশি টা মুখের কাছে তুলে ধরে নিজেই একবার বাজানোর চেষ্টা করেন। ফুঁ দেন ,কিন্তু সুর ওঠে না।বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেন ।ব্যর্থ হন। নিষ্পলক চোখে বরেনের দিকে তাকান।তারপর হঠাৎই তীব্র আক্রোশে বাঁশিটা ছুঁড়ে দেন নদীর জলে।ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে বরেন। ক্ষনিকের মধ্যেই সম্বিত ফেরে, দ্রুত নদীতে লাফিয়ে পড়ে সে । ক্ষীণ স্রোতা পারাং, এক বুক জল ,খুব বেশি বেগ পেতে হলো না ,একটু খানি সাঁতরে বাঁশি টা তুলে আনে বরেন । ভিজে সপ্ সপে শরীর, মুখে এক মুখ হাসি , যেন যুদ্ধ জয়ের বিজয়ী সৈনিক ।মাষ্টার মশাই পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে, তিতিরের মতো ঘন কালো চোখে বিশ্বের প্রশান্তি ।কি যেন বলতে গিয়েও গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না, শুধু ঠোঁট দুটো বার কয়েক কেঁপে উঠল । গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্কুল পালানো ছেলের মতো বাড়ীর পথ ধরে ফিরতে থাকেন অঙ্কের মাষ্টার মশাই । সেদিন গোধুলির আবছা আলোয় বাড়ী ফেরে বরেন।তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে, রঞ্জন মাস্টারকে আর কেউ কখনো স্কুলে যেতে দেখেনি । বরেনও আর কোনোদিন সুর তোলেনি । শত অনুরোধেও শুধু ম্লান হাসে বরেন । মাথা নাড়ায় । নির্বাক বরেনের হৃদয়ে সুর ওঠে,কান্না আসে । এখনো মাঠে যাওয়ার সময় মাথার হলদে গামছায় গোঁজা থাকে তার সেই প্রিয় নীল বাঁশিটা।,যা আর কোনোদিন সুর তোলেনি এক বুক দীর্ঘশ্বাসের মতো।মাঝে মাঝে বাঁশিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে বরেন,দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে । তারই মতো বাঁশিটাও যেন বোবা হয়ে গেছে ।।############@@@@@@@@##########
তামস চক্রবর্তী । গ্রাম- পাথরাজুড়ি । ডাক- বেঁউচ্যা ।
জেলা- পশ্চিম মেদিনীপুর ।সূচক-721129,