দোতলার প্রাচীর ঘেরা উঠোনে তিন বালিকার হাস্যকলরোল ও ছুটোছুটিতে খানিকক্ষণের বিরতি। এদের মধ্যে আঁখি সবচেয়ে ছোট। সবে তিন পেরিয়েছে। সে এই বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। বাকি দুজন নীলা ও শীলা.. ওরা দুই বোন, ভাড়া থাকে নিচতলায় বাবা মায়ের সাথে দুটি ঘর নিয়ে। নীলা আঁখির থেকে মাস ছয়েকের বড় হবে আর নীলার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় শীলা। ওদের বড় দিদি ইলা আর আঁখির দিদি পাখি প্রায় সমবয়সী। ওরা দুজনে অন্যদিকে খেলা করছে। আঁখির পরিবার বলতে ওর দুই দিদি দুই দাদা নতুন বৌদি আর মা।
আঁখি, হ্যাঁ ওই নামেই ওর বাবা ওকে ডাকতো। বাবার চোখের মনি তাই আঁখি। যদিও ওর আর একটা নাম আছে তবু, আজ তাকে আঁখি বলেই ডাকবো। মা বলে, আঁখির মাথায় খুব বুদ্ধি! সব শেখাগুলো সে খুব অল্প বয়সেই শিখে ফেলেছে। দোষের মধ্যে ভীষণ মেজাজি, রেগে গেলে ছোট হোক বা বড়, রাগের চোটে দেবে মাথায় একটা ঢিস মেরে.. তারপর.. শিং গজানোর ভয়ে আর একটা ঢিস। সবাই.. ওরে বাবা, ওরে মা, করতে করতে হার স্বীকার করে। মা বলে, হবে নাই বা কেন? ছোট থেকে যা দেশলাই কাঠির মশলা খেয়েছে.. চকমকি ঠুকলে আগুনতো ছিটকাবেই ! সেকি! দেশলাই কাঠি.. মানে? ঠিক বুঝলাম না।
-- সেই ছোট্টবেলাতেই.. যখন সে হামা দিতেও শেখেনি, পেট পেরে চলতে শিখেছিল শুধু। ওর বাবা হয়তো মাটিতে কোথাও সিগারেট খেয়ে দেশলাই রেখেছে.. আর মেয়ে যদি দেখতে পায় তাহলে একটু একটু করে এগিয়ে দেশলাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারলেই হল, কী করে আঙ্গুল দিয়ে দেশলাই বাক্স উল্টে নিজের দিকে আনার কৌশল যে রপ্ত করেছিল? তারপর একটা একটা কাঠি বের করে মুখে দিয়ে চুষে মশলা গুলো খেয়ে ফেলতো। আট-দশ মাস হতে না হতেই বেঞ্চ বা টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকেও দেশলাই বাক্স পেড়ে সাবাড় করতো চুপিসারে।
ছোট্ট আঁখি, ছোট্ট তার জগৎ। গুটি কয় হাতে গোনা পরিচিত মুখ। মাঝে মাঝে অচেনা মুখ বাড়িতে আসে.. কিছুক্ষন থেকে চলে যায়। ছোট্ট বলে তাকে আদর করে, ওর সাথে কথা বলে.. এইটুকুই। তার সমস্ত জগৎ ঘিরে বাড়ির সাত সদস্য। দিদিরা ওর যত্ন করে.. কোলে নেয়, লজেন্স দেয়। খেলতে খেলতে ক্লান্ত হলে মায়ের কোলে আশ্রয় নেয়। মা রান্না করে, স্নান করিয়ে সাজিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়ায়। নতুন বৌদিও মাঝে মাঝে তাকে কোলে নেয়.. সাজিয়ে দেয়। আর আছে বড়দা। তাকে সবাই ভয় পায়। আঁখির কাছে বড়দা বাড়ির বড়, কারণ সেই শুধু বাইরে যায়.. বাকিরা বাড়িতেই থাকে। বড়দা বাজার করে, প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে এনে দেয়, দোষ করলে বকাবকিও করে। ছোটদা আর দিদিরা দুপুরে স্কুলে যায় তখন সে মায়ের কাছে ছড়া শেখে, স্লেট পেন্সিলে অ আ.. একে চন্দ্র দুইয়ে পক্ষ.. লিখতে শেখে।
আর রোজ বিকেলে নীলা শীলা ওপরে এলে তাদের সাথে দৌড়াদৌড়ি খেলে। সেদিনও খেলছিল। বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে.. ওরা খেলা থামিয়ে রেলিংএর ধারে দাঁড়িয়ে রাস্তার লোক দেখতে লাগলো। চার দেওয়ালের বন্দিশালায় যখন ওরা হাঁপিয়ে ওঠে তখন এভাবে রাস্তার লোক দেখে.. এটাও একধরণের খেলা। পরিচিত কাউকে দেখতে পেলে ডাক পারে.. এই যেমন এখন নীলা শীলা ডাকছে -- বাবা! বাবা!
ওদের বাবা অফিস থেকে ফিরছে, রাস্তায় দেখতে পেয়ে রেলিংয়ে ঝুঁকে বাবা বাবা করে চিৎকার জুড়েছে। তার বাবাও ওপরে তাকিয়ে মিষ্টি করে ধমক দিল -- সরে দাঁড়া, পড়ে যাবি তো।
-- বাবা চকলেট খাবো, বাবা আইসক্রিম খাবো।
আবদারগুলো বাবার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিতে লাগলো তারা।
আঁখি এসব দেখছে, তারপর কী জানি চেনা ছবির সাথে মিল খুঁজে না পেয়েই মৃদু প্রতিবাদ করে উঠলো -- ' বাবা বলে ডাকছিস কেন?'
শীলা ও নীলা হেসে উঠলো। নীলা বললো,
-- বাবাকে বাবা বলে ডাকবো নাতো কী বলে ডাকবো?
-- বাবা আবার কী? আমরা তো বড়দা বলে ডাকি।
-- তোদের বড়দা আছে, তাই বড়দা বলে ডাকিস। আমাদের বাবা, তাই বাবা বলে ডাকছি।
আঁখি কিছুতেই মানবে না। ওর চেনা জগতে 'বাবা' বলে কেউ নেই। বাড়ির যে বড়.. যে বাইরে যায়, যাকে সবাই ভয় পায় .. সে বড়দা। জেদের বশে নীলাকে একটা ঢিস দিয়ে দিল। নীলা কাঁদতে কাঁদতে নিচে তার মায়ের কাছে নালিশ জানাতে চলে গেল। শীলা একটু বড়, সে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা বোঝাতে চেষ্টা করলো -- শোন, তোরা সবাই ভাই-বোন, আর তোদের সবার বড় দাদা বলেই বড়দা বলিস যেমন বাকিদের ছোটদা, দিদি, বৌদি বলে ডাকিস তেমনি। তোর তো বাবা নেই..
বলেই শীলা একছুটে নিচে চলে গেল।
আঁখির জগৎ হঠাৎ শূন্য মনে হল। এতদিন যে পূর্ণতার গরবে গরবিনী ছিল সে, তার জীবনে এরকম একটি অভাব!
ওদের বাবা আছে, তার নেই কেন? বাবা শব্দেটা কী আগে কখন শুনেছে? কাউকে ডেকেছে কখনো? ছোট্ট স্মৃতির পাতা হাতড়ে কোনো চেহারা কী সামনে এলো? মাঝে মাঝে গানের সুর কানে বাজে, যে গান শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়তো। কিন্তু কার গলা মনে পড়ে না। একটা স্পর্শ.. যে স্পর্শ ভীষণ আপন ছিল.. সেই স্পর্শ-অনুভূতির অভাববোধ হয়। সবই আছে তবু যেন কী নেই মনে হয়। তাহলে সেই অনুভূতির মানুষটাই কী বাবা? সবার বাবা আছে, তাহলে তারও আছে। কিন্তু, কোথায় আছে? প্রশ্নটা মাথায় উদয় হতেই মাকে মনে পড়লো। মা-ই পারবে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে.. মা.. মা..
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তার শুভ্রবসনা মা সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে চৌকাঠ পেরোতেই আঁচলে টান..
-- মা, আমার বাবা কই?
অকস্মাৎ হাত কেঁপে উঠলো, কেঁপে উঠলো প্রদীপের শিখা আর কেঁপে উঠলেও যা দেখা গেলনা তা মায়ের হৃদয়। নিবু নিবু প্রদীপখানা হাতের আড়াল দিয়ে সামলে তটস্থ পায়ে এগোলো.. পেছনে আঁখির প্রশ্ন ধাওয়া করছে।
-- বল না মা, নীলা শীলার বাবা আছে, তাহলে আমার বাবা কই?
কী উত্তর দেবে মা? বাস্তব কত কঠিন.. ওইটুকু দুধের শিশুকে কী করে বোঝাবে যে তার বাবা নেই। দুবছর আগে হঠাৎই সে তাদের শুধু নয় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে.. যেখান থেকে কেউই আর ফিরে আসে না, আঁখি তখন মাত্র একবছরের অবোধ শিশু। মায়ের মন সব টের পায়। ছোট্ট আঁখি ঘুমের ঘোরে হঠাৎ জেগে উঠে বাবাকে খুঁজতো.. দোলনায় দোল দিতে দিতে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে আদরের মেয়েটাকে রোজ ঘুম পাড়িয়ে দিত ওর বাবা। প্রায়ই বাবার ঘরে ঢুকে দেশলাই বাক্স না পেয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যেত মেয়েটা। পানবাটায় পান খুঁজতো! বাবা মাঝে মাঝে পানের একটি ছোট্ট টুকরো ওর মুখে দিয়ে দিতো। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে সে। আজ হঠাৎ এ প্রশ্ন মাথায় এলো কী করে? চারটি নাবালক সন্তানকে আঁচলে গিট মেরে রেখেছে তাদের মা। বড়টাকেই বা বাদ দেয় কী করে? কতই বা বড় সে? একুশে পা দিতেই বাবার সব দায়িত্ব তার কাঁধে। দুবছর ধরে সংসার সামলাচ্ছে মায়ের পরামর্শ অনুযায়ী। ঘরে নতুন বৌ, তারও তো সাধ-আহ্লাদ আছে! অথৈ জলে পড়ে থাকা একটা সংসারকে ভরাডুবির হাত থেকে প্রানপণে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে.. আর কাউকে হারাতে দিতে পারবে না মা। তাই তো শোক ভুলে চোখের জল মুছে ফেলেছে যাতে ছেলেমেয়েরা নিজেদের অসহায় না মনে করে?
মা প্রদীপ হাতে এ ঘর ওঘর ঘুরে সন্ধ্যা দেখিয়ে তুলসীবেদীতে প্রদীপ রেখে প্রার্থনা করছে -- হে ঈশ্বর শক্তি দাও!
এতক্ষন উলুধ্বনি দেওয়ার মতো পেছন পেছন একই ধ্বনি আউরে গেল মেয়েটা। মা কোনো উত্তর না দিয়েই সোজা ঠাকুর ঘরে ঢুকলো। পেছন পেছন আঁখি।
-- বলছো না কেন, আমার বাবা কই?
মা আর কতক্ষন নির্বিকার থাকবে। আঁখিকে কোলে তুলে নিয়ে ঠাকুরের আসনের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। আসনের বাঁ দিকে ওপরে দেওয়ালে টাঙানো একটি ছবি, আঁখির বাবার ছবি। সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো,
-- কে বলেছে তোর বাবা নেই? এই তো তোর বাবা।
-- আমার বাবা!
আঁখির দুচোখ বেয়ে খুশি ঝরতে লাগলো। দুহাত বাড়িয়ে দিল ছবির দিকে। ছবিতে হাত বুলিয়ে অনুভব করলো আশ্চর্য এক সুখানুভূতি। অনুভব করলো তার পূর্ণতা।আর মায়ের দুচোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা।
খুশির ভাগ বিলোতে মায়ের কোল থেকে নেমে ছুট্টে বাইরে বেরিয়ে এলো আঁখি।
-- শীলা, নীলা.. তাড়াতাড়ি আয়, আমার বাবাকে দেখে যা।
ওর চিৎকার শুনে শুধু নীলা শীলা নয়.. ছুটে এলো বাড়ির সকলেই.. আর যা দেখলো তাতে সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকালো.. একবার ছবির দিকে একবার আঁখির দিকে।
আঁখির আঁখিপাতে তখন শুধুই খুশির ঝিলিক।
_______________________________________
রীতা রায়
মালদা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
পিন - 732101