ছোটগল্প।। বাঁশফুল ।। সুবীর ঘোষ
বাঁশফুল
সুবীর ঘোষ
তখনও চাষের মুনিষটা উঠোনে বসে । তার সামনেই কর্তা গিন্নিতে লেগে গেল একপ্রস্থ । কর্তা কী যেন বলতে চাইলেন । তাঁকে থামিয়ে দিয়ে দ্বিগুণ জোরে গিন্নি বলে উঠলেন---তখনই বলেছিলাম । বাঁশ চাইতে এসেছে । দিয়ে দাও । সারা জীবন তো জ্যান্ত লোককে বাঁশ দিয়ে গেলে । মরা লোকের জন্য একখানা দিলে কী ক্ষতি ছিল ! এখন ঠ্যালা সামলাও ।
প্রসঙ্গটা শুধু ঐ তিনজনই জানে । অর্জুনডাঙা গ্রামের সম্পন্ন চাষী বাদল চৌধুরী তাঁর স্ত্রী এবং কৃষিমজুর কুড়ারাম । মধু গোয়ালাদের মেজবউ সদর হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা গেল আজ বোধহয় এক মাসও হয়নি । দুদিন ধরে খুব বৃষ্টি ছিল । নিম্নচাপ । গোয়ালাদের ছোট ছেলেটা বাঁশ চাইতে এসেছিল । বাদল দেননি । বাদল তো ভোলেননি ক' বছর আগে মধু গোয়ালা তাঁর সদ্য কেনা জার্সি গাইটাকে পাইকারদের দেখিয়ে দিয়েছিল । তারপরই গোরুটা চুরি যায় । বাদলের মান্দের বলেছিল সে মধুকে পাইকারের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে । অতএব বাদলের আর কিছু বুঝতে বাকি ছিল না । তিনি অবশ্য মধুকে ঘুরিয়ে বলতে ছাড়েননি । কিন্তু মধুর সাফ জবাব---আমরা গয়লার জাত । দুধ বেচি । গোরু চুরি করি না । তবু বাদলের সন্দেহ যায়নি । সেই রাগের বশেই বাঁশ নিতে আসা ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেওয়া ।
ওরকম মুখঝামটা বউয়ের কাছ থেকে অহরহ শোনেন বাদল । পুরুষমানুষের ওসব গায়ে মাখলে চলে না । কিন্তু এবারের ব্যাপারটা আলাদা । তিনি তাই গলায় অত জোর পান না । বউয়ের যুক্তিটাও তো ফেলনা নয় । গোয়ালাদের বউটা মরল । বাদল বাঁশে হাত দিতে দেননি । আর তাঁর বাঁশবনেই কী না ফুল ফুটল ! বউ যা বলছে তা হতেও তো পারে যে এ ঐ গোয়ালাবউয়ের প্রেতাত্মার কারসাজি । নইলে ফুল তো হবে ফুলগাছে । টগর চাঁপা বেলিগাছে । বাঁশগাছ কী ফুলের গাছ না কী !
মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে বাদলের । কোনোদিন না প্রেতাত্মা ঘাড় মটকে কেল্লা ফতে করে দেয় ! তা যদি না-ও দেয় অমঙ্গল হতে কতক্ষণ ! অসুখবিসুখ মহামারী মৃত্যু সংসারে অভাব অনটন । কুড়ারামকে মাঠে পাঠিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাদল । প্রথমেই গিয়ে হাজির হলেন বটুকেশ্বর ভটচার্যির বাড়ি । এ তল্লাটের ডাকসাইটে পুরোহিত । তিনখানা গ্রামের অদ্বিতীয় পুরুৎমশাই । তিনি যজ্ঞ করলে অমঙ্গল কাটে , অপদেবতা দূর হয় । কত লোককে যে তিনি দেবীদর্শন করিয়েছেন তার ঠিক নেই । এ কথা অবশ্য বাদলের শোনা । তবে কঠিন নিয়ম আছে । অনেকেই সে নিয়ম মানতে পারে না । আচারবিচারে ত্রুটি থাকলে দেবতারা বড় অসন্তুষ্ট হন । ভটচার্যিমশাই সব শুনে বললেন –'দাঁড়াও দাঁড়াও , বাঁশফুলের অপদেবতার পুজোটা আমায় একটু দেখতে দাও । এ পুজো সচরাচর হয় না । শেষবার এ গ্রামে বাঁশফুল ফুটেছিল আমার বিয়ের বছরে । তা পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল । বাঁশফুল চরম অমঙ্গলের জিনিস । গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যায় । না খেতে পেয়ে মানুষ কানা কুঁজো হয়ে যায়' । এই বলে ভটচার্যিমশাই একটা ছেঁড়াখোঁড়া পুঁথি কোত্থেকে বের করে আনলেন । বললেন --- 'এই দেখ , সব বিধেন এখানেই আছে । তোমরা মোড়লমশাইকে গিয়ে ধর । সবাই এককাট্টা হয়ে যজ্ঞ কর । এ যজ্ঞে খরচা তো অনেক । তবে অপদেবতা যে দূর হবে সেটা গ্যারান্টি' ।
সংগঠনের কাজে লেগে যান বাদল । রাস্তায় পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকের সঙ্গে দেখা । সবার মুখে এক কথা । বাঁশের ঝাড়ে ফুল । এ কী কম কথা ! অমঙ্গল ঢোকার এই তো সূত্রপাত । কেয়াকানালির মাঠের রাস্তা ধরে যাচ্ছিল আরো তিন কৃষিমজুর—নিমাই শিবু ও রামপদ । পাশাপাশি ছাগলের পাল নিয়ে হারু নাড়ু দুই ভাই । এত বড় দল দেখে তারা ফিরে এল । তাদের কাছ থেকেই খবর পাওয়া গেল—বাঁশঝাড় ইঁদুরে ভরে গেছে । কুটুর কুটুর করে ফুল খাচ্ছে । বাদল যেন খুশি হলেন একটুঃ খা খা খেয়ে শেষ কর ঐ অমঙ্গলের বাচ্চাকে ।
ঘুরে ঘুরে বাঁশঝাড় দেখা হল । ধানের শিষের মতো ফুল । আসল ধানের শিষ প্রাণ বাঁচায় । আর এ শিষ প্রাণ নেয় । সবার মুখে দুশ্চিন্তা । তবে বাদল কথা বলে এসেছেন ভটচার্যিমশাইয়ের সঙ্গে । শেষ ভরসা তিনিই ।
হারাধন পোস্টমাস্টারের ভাবনা অন্যরকমঃ—কিন্তু ইঁদুর কেন ? ইঁদুর তো চাল গম খায় । সামান্য ফুলের মধ্যে কী পায় বল তো ? খুব মিষ্টি না কী ফুলটা ? কোথা থেকে গান শিখিয়ে ফিরছিল কিরণ দাস । বলল ---ইঁদুর কার বাহন – না গণেশের । গণেশের মাথাটা কার – না হাতির । তা হাতি যেমন মাঝেমধ্যে রেগে যায় তেমনি গণেশও মাঝে মাঝে রাগবে তাতে আশ্চর্য কী ! তখন ইঁদুর পাঠিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করার চেষ্টা করে । সারা জীবন কত আর সবাইকে সিদ্ধি দেবে বল তো । আর কিছু হয়তো বলত কিরণ দাস । নাড়ু চেঁচিয়ে উঠল--- এঞ্জিবাবু আসছে , এঞ্জিবাবু । এঞ্জি মানে এন জি ও । পরিবারপরিকল্পনা ও শিশুস্বাস্থ্য – বিষয়ক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে এ সময় এ অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছেন কৃষ্ণেন্দু সাহা নামে এক যুবক । সবার সব দুশ্চিন্তা শুনে গ্রামের সেই এঞ্জিবাবু বললেন ---আরে দুর্ , অপদেবতা ! ভূমিকম্প কী ডেলি ডেলি হয় না সূর্যগ্রহণ রোজ হয় ? তেমনি বাঁশফুলও বহু বছর বাদ বাদ ফোটে । ফুল খেতে ইঁদুর আসে এটা ঠিক । ইঁদুরের বংশও কিছু বৃদ্ধি হয় । তবে মহামারী মড়কের কথা একদম বাজে । সব ফসল খেয়ে নিয়ে দুর্ভিক্ষ বাধাবে এমন অবস্থা এখন দেশের নয় । তবে কী জানেন , গ্রামে প্যাঁচা নেই , চিল শকুন নেই । ইঁদুরের রমরমা তো এমনিতেই হবে ।
( ২)
এঞ্জিবাবু যা-ই বলুন , বাদল চৌধুরীর মাথা থেকে ভয়টা যায় না । হাজার হোক্ , বাড়ির সতী লক্ষ্মীর মাথায় যখন এসেছে চিন্তাটা । গয়লা বউ মরল ---তার ঝাড়ের বাঁশ সৎকারে লাগল না --- কুদৃষ্টিটা তার বাঁশঝাড়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক । দেখা যাক্ , ভটচার্যিমশাই কবে যজ্ঞ করেন । সবাই তো রাজি । খরচটা কোনো ব্যাপার । গতবার সবাই ভালো ফলন পেয়েছে ।
আদিবাসী পাড়ার ক'ঘর আদিবাসীকে নিয়ে এন জি ও কৃষ্ণেন্দু থকে গেছেন । কিছুতেই পালস্ পোলিওতে রাজি নয় । বলে—হঃ আমরা অত বুকা লই । নুনারা পুলিও খাইলে কুনদিন আর মরদ হবেক না ।
তখন কত রাত হবে ? সাড়ে সাতটা আটটা বোধ হয় । কৃষ্ণেন্দু ভাবলেন পালস্ পোলিওর দিন এগিয়ে আসছে । আজ একবার ওদের পাড়ায় গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সবাইকে বুঝিয়ে এলে হয় । দিনে তো ওদের দেখা পাওয়া যায় না । কেউ চাষের কাজে ব্যস্ত থাকে তো কেউ কাঠবেড়ালি গোসাপ মারতে যায় ।
কৃষ্ণেন্দু আদিবাসী পাড়ায় পৌঁছুতেই কে একজন যেন বলে উঠল --- আবার কী বটে রে এঞ্জিবাবু ? গলায় কয়েক পাত্র ঢালা হয়েছে বোঝা যায় । কৃষ্ণেন্দু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে । গোল হয়ে বসেছে সবাই । সামনে আগুন জ্বলছে । কারো কারো কাছে মাদল । বোঝাই যাচ্ছে নেশা জমলে নাচ শুরু হবে । মেয়েরাও হয়তো গাছকোমর শাড়ি বেঁধে নাচতে থাকবে । একজন ছেলে একটা টিনের বাটি এগিয়ে দিল--- লে এঞ্জিবাবু , খা ।
--- কী রে এটা ?
---হাঁড়িয়া বটে , ভালো জিনিস ।
কৃষ্ণেন্দু পাত্রটা ধরেন না । তাঁর চোখ তখন আগুনের শিখার দিকে । পাশে শালপাতা ভর্তি ঝলসানো ইঁদুর ।
এমন সময় বুধন নামে ছোকরাটা বাঁশি বাজাতে শুরু করল । আলোআঁধারি রাতের সেই নিঝঝুম বিহ্বল পরিবেশে রাঢ়পল্লি ছাড়িয়ে অরণ্যময়তার সমস্ত স্তরের ঊর্ধ্বে সে বাঁশির রেশ যেন ক্ষয়াটে চাঁদের দিকে ছুটে গেল । একটা ভীষণ ঘন ঘোর নামল কৃষ্ণেন্দুর দুই চোখে । বহুদিন আগে পড়া হ্যামেলিনের সেই বাঁশিওয়ালার সঙ্গে মিলে মিশে রাসায়নিক হয়ে উঠল যেন । কৃষ্ণেন্দু জানেন বাদল চৌধুরী দুশ্চিন্তায় ঘুমোতে পারছেন না । আর ঘুমোতে পারছেন না বটুক ভট্টাচার্য বড়সড় যজ্ঞ করার লালসায় ।
প্রকৃতি নিজেই সবার অলক্ষ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার কাজ করে চলেছে । রাত যত বাড়ছে কৃষ্ণেন্দুর মধ্যে তত চেপে বসছে বিস্ময়ের অসাড় ইন্দ্রজাল । নিজের অজান্তেই টিনের বাটিটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন কৃষ্ণেন্দু ।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
*******************************