দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
পরাণ যেন জল-মানুষ। নৌকোয় ঘুরে ঘুরে নদীর জলে জলেই কাটে ওর সারা দিন। সকালে নৌকো নিয়ে নদীর বুকে বেড়িয়ে পড়ে। সারাদিন মাছ ধরে। বিকেলে বাজারে মাছ বিক্রি করে যে টাকা পায় তাতে চাল ডাল কিনে ঘরে ফেরে। বন্ধু বান্ধব ওর বিশেষ নেই। আসলে সকলের মতো কথা বলতে ওর ভালো লাগে না। ওর যতো কথা নদীর সাথে, কখনো বা নিজের সাথে। বিড় বিড় করে মাঝে মাঝে। আশপাশের লোকজন ওর নাম দিয়েছে 'নদী ক্ষ্যাপা' !
পরাণ একাই থাকে ওর কুঁড়ে ঘরে। ঘরে ফেরার টান তাই নেই। মাঝে মাঝে গাছে জল দিতে আসে ওর ছোট্ট বাগানে।বাগানটা মায়ের তৈরি।মা মারা যাবার সময় গাছগুলোকে যত্ন করতে বলেছিল।পরাণ বাগানে বেগুন, লঙ্কা , পেঁপে, ঢেঁড়স, উচ্ছে,লাউ,কুমড়ো, পুঁই লাগিয়েছে।ওর তরকারির জোগান ঐ বাগান থেকেই হয়ে যায়। গাছে সবসময় কিছু না কিছু সব্জি থাকেই।ঐ দিয়েই মাছের তরকারি বানায়। পাশের বাড়ির কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা বলে এটা হলো ' কিচেন গার্ডেন'। বাগানের সব্জি সরাসরি রান্নাঘরে ।তাই এমন নাম ! আশপাশের লোকজনও ওর বাগানের সব্জি নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে রান্না না করে ও দোকান থেকে খাবার কিনে নিয়ে আসে। সেদিন আর বাড়ি ফেরে না।নৌকোতেই শুয়ে থাকে খোলা আকাশের নীচে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পরাণ যেন কখন মেঘ হয়ে যায়। উড়ে বেড়ায় এদিক ওদিক। কত কথা তখন তারাদের সাথে। মাকে খুঁজে ফেরে তারাদের ভিড়ে। সারা রাত নদী যেন ওকে দোল দিয়ে ঘুম পারায় মায়ের মতো।
সেদিনও ছিল চাঁদনী রাত। এইরকম রাতে ওর বুকে ঢেউ ওঠে।ও ঘরে থাকতে পারে না। যথারীতি নৌকোর পাটাতনে শুয়ে তাকিয়ে আছে নদীর বুকে। দূরে আলোগুলো যেন রাতের কালো শরীরে জোনাকির সাজ। একদৃষ্টে দেখে চলেছে আবেশী মন নিয়ে। হঠাৎ দেখলো নদীর ধারে গাছে আটকে আছে শাড়ির মতো কিছু। ও নৌকো নিয়ে কাছে গেল। চাঁদের আলোয় দেখলো লাল সাদা ডুরে শাড়িতে মোড়া একটা নারী দেহ। চমকে উঠলো ও। দেহটাকে নৌকৌয় তুলল ।হাত পা এখনো গরম আছে। মনে হয় দেহে প্রাণ আছে এখনও ! বুকে জোরে জোরে চাপ দিতে লাগল। হঠাৎ দেহটার মুখ দিয়ে ছিটকে জলের ধারা পরাণের মুখে চোখে সারা শরীরে। কিছুক্ষণ পর দেহটা নড়ে উঠলো।পরাণের মন আনন্দে বলে উঠলো :"ওরে প্রাণ আছে, ওরে প্রাণ আছে "!পরাণ ভালো করে দেখলো তিরিশ বত্রিশ বয়স হবে মেয়েটার।ডাগর ডাগর দুটো চোখ। স্বাস্থ্যবতী। চোখে মুখে যন্ত্রণার ছাপ।পরাণ বুঝলো জীবন ওর থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। মুখে চোখে জল দিয়ে অনেকটাই সুস্থ মেয়েটা। রাতের খাবার ভাগ করে খেল ওরা দুজনে। পরাণের ব্যবহারে ভরসা পাচ্ছে ও। ওর চোখের সেই ভয় উধাও। পরাণের জিজ্ঞাসায় আস্তে আস্তে মেয়েটি মেলে ধরলো ওর অতীত ।
ওর নাম লাবণ্য। অল্প বয়সেই ঢলঢল যৌবন ওর শরীরে।বাবা পাশের গ্রামের ওর বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিল ধুমধাম করে। কিছুদিনের মধ্যেই লাবণ্য বুঝতে পারলো ,ওর বর মাতাল ।জুয়ায় ওর সোনা সব গেল। প্রতিবাদ করলে মার জুটতো কপালে। কথায় বুঝতে পারতো, বাইরে প্রচুর ধার দেনা ওর। একরাতে বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাড়িতে মদের আসর বসালো। হঠাৎ লাবণ্যকে একা রেখে ওর বর বাইরে চলে গেল।মাতাল লোকগুলোর চোখে ওর শরীর ভোগের লালসা। বুঝতে পারলো লাবণ্য, ধার মেটাতে বউয়ের শরীর বেচেছে ওদের কাছে। লোকগুলো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই লাবণ্য ঘরে রাখা বড়ো কাটারি নিয়ে এক কোপ বসালো একজনের হাতে। ছিটকে পড়লো লোকটা। অন্যরা হতচকিত সকলে। ঐ ফাঁকে লাবণ্য বাইরে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করলো। জানোয়ারের দল শিকারের লোভে পিছনে তাড়া করলো ওকে। অসহায় লাবণ্য কোন উপায় না পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীর বুকে। জোয়ারের জল নিমেষে ভাসিয়ে নিয়ে চললো।তারপর আর কিছু মনে নেই ওর। পরাণ সব শুনে স্তব্ধ।এমন মানুষও থাকে ! লাবণ্যের প্রতি মায়ায় মন ভরে উঠলো ওর।
পরদিন পরাণের ঘরে লাবণ্যকে দেখে কৌতূহলী মুখের জিজ্ঞাসায় পরাণ সব জানালো।সকলেই লাবণ্যের দুঃখে সমব্যথী।সকলের মত, এভাবে এক ঘরে এক পূর্ণ যৌবনা মহিলাকে নিয়ে থাকলে কলঙ্ক রটবে। তার চেয়ে পরাণ ওকে বিয়েই করুক। নদী পরাণের হাতে লাবণ্যকে তুলে দিয়ে বোধহয় এটাই বলতে চেয়েছে। স্বামী স্ত্রী মিলে সংসার পাতুক। লাবণ্য নতুন জীবন পাক আবার। লাবণ্য ওর সমস্ত ঘৃণিত অতীত মুছে ফেলে ওর প্রাণদাতার কাছে সমর্পনে রাজী। ওদের বিয়ে হয়ে গেল সকলের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসায়। লাবণ্য নতুন করে বাঁচতে পরাণকে আঁকড়ে ধরলো লতার মতো।পরাণ ভেসে গেল লাবণ্য সুখে। স্বর্গ নেমে এসে যেন ওদের কুঁড়ে ঘরে দাঁড়িয়ে তখন।
সময় চলে যেতে লাগলো নদীর স্রোতের মতো।বছর অতিক্রান্ত পরাণ ও লাবণ্যের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে। চাঁদনী রাতের গল্প পরাণের মুখে শুনে লাবণ্যের শখ হলো সারা রাত নদীর বুকে থাকবে পরাণের পাশে শুয়ে। সেদিন চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে। লাবণ্যেরও প্রবল ইচ্ছায় পরাণ ওকে নিয়ে নৌকোয় পাটাতনে শুয়ে থাকে চাঁদ গায়ে মেখে। আকাশের নীচে শুয়ে মুগ্ধ লাবণ্য। এতো ভালোলাগাও আছে পৃথিবীতে !পরাণের বুকে মাথা রেখে পরম আশ্লেষে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। হঠাৎ জোর ধাক্কার আওয়াজ।পরাণও ঘুম ভেঙ্গে দেখলো সব। হঠাৎ বড়ো বড়ো ঢেউ নদীর বুকে।ওর নৌকোয় আছড়ে পড়ছে ঢেউ।মোচার খোলার মতো দুলছে নৌকোটা।পরাণ বুঝলো,হড়কা বাণ !সাক্ষাৎ মৃত্যু। জোরে দাঁড় বাইতে লাগলো । ঘাটে নৌকো ভেড়াতে হবে। নাহলে ভেসে যাবে ওরা দুজনেই। কিন্তু সর্ব শক্তি দিয়েও নৌকো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না পরাণ ।বুঝলো বিপদ আসন্ন। লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরলো ও।
হঠাৎ এক ধাক্কায় নৌকো গেল উল্টে। ছিটকে পড়লো ওরা দুজন নদীর জলে। শক্ত করে পরাণ ধরে রইল লাবণ্যের হাত। বিধি বাম। জলের তোড়ে ভেসে গেল লাবণ্য। পরাণ সাঁতরে লাবণ্যের কাছে যাবার চেষ্টায়। অসহায় পরাণ দেখলো নদী লাবণ্যকে নিয়ে চললো ওর থেকে দূরে , আরো দূরে। হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো ও। চোখে আগুন নিয়ে নদীর বুক তোলপাড় করে পাগলের মতো খুঁজে চললো পরাণ ওর লাবণ্যকে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
----------------------------------
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
রয়্যাল কমপ্লেক্স, ব্লক ডি,
হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।