অসিত কুমার পাল
বছর তেইশের তরুণ অনিমেষের মা নেই । তার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার মা ক্যান্সারে মারা যান। চাকরিজীবি বাবা ও অবিবাহিত পিসিমার কাছেই সে মানুষ । বছর দুই হল পিসিমা দেহ রেখেছেন । বাবা মাস কয়েক আগে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে অনিমেষের পড়াশুনাও শেষ হয়ে গেছে । এখন সংসারে অনিমেষ ও তার বাবা ছাড়া কেউ নেই ।
কিন্তু অনিমেষ তার শৃঙ্খলা পরায়ন বাবার খিট খিটে স্বভাবের জন্য খুবই বিরক্ত বোধ করে । পড়ার টেবিলে বা বিছানায় বই খাতা ছড়ানো থাকলে বাবা বলেন - সব কিছু গুছিয়ে রাখার অভ্যাস কর, নইলে সময় মত প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে পাবে না । আলো জ্বেলে রেখে ঘর ছেড়ে বের হলে বলেন - আলোর স্যুইচ অফ করে দাও, নইলে বিদ্যুতের অপচয় হবে । বেসিনের কল বন্ধ করতে ভুলে গেলে বলেন - জল অমূল্য, নষ্ট করো না । এইভাবে তিনি প্রায়ই নানা নীতিকথা শেখান ।
বাবার কথায় অনিমেষের মাথা গরম হয়ে যায়, কিন্তু কিছু না বলে বাবার কথা মেনেও নেয় । সে ভেবে রেখেছে খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি জোগাড় করে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে । তারপর বাবার সংস্রবে না থেকে আলাদা ভাবে বসবাস করবে । সে চাকরির জন্য নানা জায়গায় দরখাস্ত পাঠাতে শুরু করে দিল ।
সৌভাগ্যক্রমে অনিমেষ শীঘ্রই একটা চাকরির জন্য সাক্ষাৎকারের ডাক পেল ।
সাক্ষাৎকারের জন্য কেমন পোষাক পরা উচিৎ, কেমনভাবে কথা বলা উচিত ইত্যাদি সম্পর্কে তার বাবা নানা উপদেশ বর্ষন করতে লাগলেন । অনিমেষ অবশ্য তার বাবার উপদেশে তেমন আমল দিল না । কিন্তু নির্ধারিত সময়ের অন্তঃত আধ ঘন্টা আগে সাক্ষাৎকারের স্থানে উপস্থিত হওয়ার উপদেশটি তার মনে ধরল ।
সাক্ষাৎকারের দিন অনিমেষ নির্দিষ্ট সময়ের আধ ঘন্টা আগেই সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে গেল । দেওয়াল ঘেরা কম্পাউন্ডের ভিতরে চারতলা বাড়ি । প্রবেশপথে লোহার একটি বিশাল দরজা । সেটি আধখোলা অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু আশপাশে কোন দ্বাররক্ষককে দেখা গেল না । অনিমেষের মনে দ্বিধা জাগল । একটু ইতস্তত করে অনিমেষ ভিতরে ঢুকে দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিল । সে দেখতে পেল দরজা থেকে সাক্ষাৎকারের বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য প্রশস্ত পথের দুপাশে সারিবদ্ধ বাহারি গাছ আছে । সম্ভবত কোন মালি গাছে জল দিতে দিতে অন্য কোথাও চলে গেছে , কিন্তু জল দেওয়ার পাইপটি বন্ধ করে যায়নি । ফলে পাইপ থেকে ক্রমাগত জল বেরিয়ে রাস্তার উপর জমে যাচ্ছে । দ্বিধাগ্রস্ত অনিমেষ পাইপে জল আসার ভালভটি বন্ধ করে দিল ।
এরপর অনিমেষ বাড়িটির একতলায় পৌঁছে দেখল সেটি একটি ছোট ঘর । কোন লোকজন নেই, কিন্তু অনেকগুলো অলো জ্বলছে । দেয়ালের গায়ে একটি ছোট বোর্ডে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের দোতলার হলঘরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া আছে । এবার অনিমেষ একটি বাদে অন্য আলোর স্যুইচগুলি বন্ধ করে দিল । তারপর সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল । দোতলায় এসে সে দেখতে পেল হলঘরের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি সোফা রাখা আছে। । গোটা সাতেক সাক্ষাৎপ্রার্থী যুবক একটি বিশেষ জায়গায় পাশাপাশি বসে আছে । কিন্তু হলঘরের সমস্ত পাখাগুলি চালু আছে । খানিকক্ষন চিন্তা করে অনিমেষ ওই যুবকগুলির মাথার উপর ঘুরতে থাকা পাখা চালু রেখে অন্যগুলি বন্ধ করে দিল । তারপর অন্য যুবকগুলির পাশে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ।
একটু পরে পাশের একটি ঘরে সাক্ষাৎকারের জন্য এক একটি যুবকের ডাক পড়তে লাগল । অনিমেষ লক্ষ্য করল কারোরই সাক্ষাৎকার দু তিন মিনিটের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না । সাক্ষাৎকারের পরে তারা অন্য একটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে বিশদ বিবরণ জানা গেল না । সবার শেষে অনিমেষের ডাক পড়ল ।
অনেকটা উৎকন্ঠা নিয়ে সাক্ষাৎকারের ঘরে ঢুকে সে দেখল একজন মাত্র ভদ্রলোক একটি বড় টেবিলের ওপারে একটি চেয়ারে বসে আছেন । তিনি অনিমেষকে একটি চেয়ারে বসতে নির্দেশ করে বললেন - তুমি কবে চাকরিতে যোগ দিতে পারবে? হতচকিত অনিমেষ কোন জবাব না দিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল ।
ভদ্রলোক জানালেন - এই চাকরিটির জন্য একজন শৃঙ্খলা পরায়ন যুবকের প্রয়োজন । আমার মনে হয়েছে তুমি এই চাকরির জন্য একমাত্র উপযুক্ত প্রার্থী । আজকের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা কোন প্রার্থীকেই আমি বেশি প্রশ্ন করিনি । অন্য দিকে আমি এই বাড়ির ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় ও কম্পাউন্ডের মধ্যে লাগানো বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার সাহায্যে সকল প্রার্থীর গতিবিধি ও কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছি । আমি দেখেছি একমাত্র তুমিই প্রবেশ দরজার পাল্লা বন্ধ করেছ, রাস্তায় জল দেওয়ার পাইপের ভালভ বন্ধ করেছ, নিচের ঘরের অকারনে জ্বলতে থাকা আলোগুলি বন্ধ করেছ, দোতলার হলঘরে অকারনে চালু রাখা পাখাগুলি বন্ধ করেছ । এ সবই একজন শৃঙ্খলা পরায়ন মানুষের লক্ষণ । তাই আমি তোমাকেই এই চাকরির জন্য নিয়োগপত্র দিতে আগ্রহী ।
অনিমেষ মনে মনে ওর বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করল । কারন তার বাবার কঠোর অনুশাসনের ফলশ্রুতিতেই তার মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত হয়েছে এবং সে কারণেই সে একটা চাকরীর জন্য উপযুক্ত হিসাবে বিবেচিত হয়েছে ।
সে সানন্দে ওই চাকরিতে যোগদানে সম্মতি দিল ।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
( একটি ইংরেজী গল্পের ছায়ায় রচিত। )
--------------------------------------------------------
রচনা - অসিত কুমার পাল
আলমপুর।