রাধা চূড়ার বাঁশি বাজে ....
জয়শ্রী ব্যানার্জী চক্রবর্তী
তুই ! চমকে গেলো ঋভান।বুকের ভিতর এক ঝলক রক্ত যেন চলকে উঠলো । রাধাচূড়ার মুখোমুখি আজ ১৫ বছর পর । ওদিকে চোখে মুখে অপার বিস্ময় রাধাচূড়ার । হাওয়াই এলো মেলো চুল সরাতে সরাতে চোখ রাখলো ঋভানের দিকে । কেমন আছিস ঋভু? ভালো । সানগ্লাসটা খুলে ফেললো ঋভান। মেদহীন, সুঠাম ,ছিপছিপে ,ফর্সা সুপুরুষ চেহারা । চোখ সরালো রাধাচূড়া। তুই একই আছিস ।
স্মিত হাসলো ঋভান । স্থির দৃষ্টিতে তাকালো রাধাচূড়ার দিকে । সেই আদুরে মুখ । লম্বা এক ঢাল চুল এখন কাঁধ অব্দি । ফর্সা মুখে রোদের সোনালী ছায়া । হলুদ কুর্তি আর লং নীল স্কার্ট পরেছে ম্যাচ করে নীলচে সাজ সেজেছে । আগের চেয়ে মোটা হয়েছে কিন্তু খুব কিউট লাগছে তাতে । নীল রং তোর এখনও প্রিয় । ঋভান আবারও হাসলো স্মিত । হুঁ তাই সব কিছু মিলিয়ে দিলো ।রাধাচূড়া ও মৃদু হাসলো ।
তুই হঠাৎ এই সিমলিপালের জঙ্গলে ? বর নিয়ে বেড়াতে বুঝি ? বেড়াতে তবে বর নিয়ে না ! মাসতুতো দিদি আর তার বন্ধুদের সাথে ! ওহ! তো ওরা কই ? মুখ তুলে তাকালো ঋভান ,ঘুরছে আশে পাশেই । একটু দাঁড়া আমি দিদিকে একটা ফোন করে বলে দিই । গাছের ছায়া ঘেরা একটা দিক দেখে দুজনে এলো । বসার বেঞ্চ রয়েছে । ক্যামেরাটা নামিয়ে রাখলো ঋভান । ফোন করে কাছে এলো রাধাচূড়া । জল খেলো ব্যাগ থেকে বোতল বার করে । ঋভানের দিকে তাকিয়ে বললো খাবি ? ইশারায় না করলো ঋভান। একটু তফাৎ রেখে বসলো। তুই এখানে ? ছবি তোলার নেশা বুঝি যায়নি ? দেখি কী কী ছবি তুলেছিস ? ক্যামেরা ওপেন করে দিলো ঋভান । দেখতে দেখতে বললো ছবি তোলার হাত তোর বরাবর ভালো ।মনে আছে কৃষ্ণসায়র পার্কে সেই আমার একটা তুলে দিয়েছিলি ? হুঁ । রাধাচূড়া আর জিজ্ঞেস করলো না সেটা আছে কিনা ! আর বল। কি খবর ? বেড়াতে এসেছিস বউ নিয়ে ? ক্যামেরার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করলো রাধাচূড়া । আমি এখানেই থাকি, আমার জব এখানেই । জানিস তো কেমন প্রকৃতি পাগল আমি তাই বন দপ্তরেই জব নিলাম । রেঞ্জার অফিসার । ছুটির দিন গুলোয় বেরিয়ে পড়ি ক্যামেরা হাতে ! আর বউ । একটু আলতো ভাবে প্রশ্ন করলো রাধাচূড়া । একটু থামলো ছবি দেখা থেকে । নাহ ! তোর মত আর মেয়ে পেলাম কই ! বলে একটু আড় চোখে তাকালো ঋভান রাধা চূড়ার দিকে ।সংসার আর হলো না । আমি তো উড়নচণ্ডী ,পাগলা এলোমেলো ,অগোছালো এই প্রকৃতিতে বেশ আছি । রান্নার লোক আছে ।রান্না দিয়ে সকালে চলে যায় । ও! আর জেঠু , বড়মা ? রাধাচূড়া আস্তে জিজ্ঞেস করলো ,বছর তিন হলো মা বাবা দুজনেই পর পর দু বছর এর মধ্যে ....! কথা শেষ করলো না ঋভান ! ওহহ ইসস !খুব খারাপ লাগছে শুনে , আমি সত্যি জানিনা নারে এই খবর ।দেখা হয় না আর কারোর সাথে যে কারো কাছ থেকে খোঁজ নেবো ! কি হয়েছিল ওনাদের ? রাধাচূড়া ক্যামেরা রেখে কষ্টের কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো । বাবার তো heart attack' আর মায়ের ক্যান্সার । ঋভান একটু উদাস সুরে বলল । একটু চুপ চাপ দুজনে । পূজোর পরে বাতাসে কেমন একটা বিষণ্ণতা মাখানো । উদাসী সুর বুকের ভিতর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তোলে । ঝিম ধরা একটা আওয়াজ বনের ঝোপে ঝোপে । গাছের ফাঁকে ফাঁকে সোনালী রোদের উঁকি ঝুঁকি । সেই আলো ভেদ করে দুজনের মনের দৃশ্যপটে অনেক ছবি ঘোরা ফেরা করছিল । সায়ন্তনের কি খবর ? ঋভান জিজ্ঞাসা করলো । ভাই ভালো আছে । এখন কোলকাতায় থাকে । এসেছে বাড়ী । বউ ও জব করে । এক ছেলে । তোর সাথে যোগাযোগ নেই? রাধাচূড়া তাকালো ঋভানের দিকে । নাহ ! সেই থেকে আর যোগাযোগ নেই ।মাঝে একবার শুনেছিলাম আবীরের কাছ থেকে ।তখন বোধায় আহমেদাবাদে থাকতো । রাধাচূড়া বললো ও । তুই পুজোয় যাসনি বর্ধমান ? মা নেই ইচ্ছা করলো না রে । দাদা বৌদি আছে আসানসোলে । আমি গেলে গ্রামের বাড়ীতে যায় । লোক আছে বাড়িটা দেখাশোনা করে ।দাদা ছুটিতে যায় । কাকারা তো সবাই আছে ।কিন্তু মা বাবা চলে যাবার পর বড়ো ফাঁকা লাগে । যদিও কাকীমা খুব স্নেহ করেন তবু বাড়ীতে গেলে মার গন্ধ বাবার কথা গুলো আর পায়না । ঋভানের মনে পড়ছিল সেই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ছাদের পাশে একলা চিলেকোঠা ! পুরনো বই- এর গন্ধ । দূরে তালগাছের পাশ দিয়ে বলাকার ঝাঁক ।নীল আকাশে ঘুড়িটা অনেক দূরে । ছাদ থেকে দেখা যায় দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ ।নীচে থেকে ডাক আসে ঋভু.....এই ঋভু .... ! রাধাচূড়া ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো হঠাৎ । এই কি হলো তোর ? চমক ভাঙলো ঋভানের । আমার তোর জন্য খুব খারাপ লাগছে রে । তুই বিয়ে কর plz ।একলা কেন থাকবি এমন করে ! মাসিমা নেই কে তোর অসুখ হলে দেখবে? কার কাছে আবদার করবি খাবার ? কে তোর সব গুছিয়ে দেবে? Plz plz plz ঋভু কথা শোন । আরে বিয়ে করলেই যে সবাই সুখে থাকে , আর সব একাকিত্ব দূর হয়ে যায় একথা তোকে কে বললো । রাধা plz কাঁদিস না । তুই সেই ইমোশনাল থেকে গেলি ! ঋভানের ইচ্ছা করছিল সে ওর চোখের জল মুছিয়ে দেয় কিন্তু সে কন্ট্রোল করলো নিজেকে । এই মেয়েটি তো আর তার না ! ঋভান বললো তোরা কোথায় উঠেছিস ? লোকাল বন বাংলো তে ।তিনদিনের জন্য এসেছি । রাধাচূড়া উত্তর দেয় রুমালে চোখ মুছে । তোর হাসব্যান্ড এলো না যে ? ছেলে মেয়ে? ঋভান তাকায় ওর দিকে , রাধাচূড়া উত্তর দেয় , আমার মেয়ে একটা । ১২ বছর এর সেভেনে পড়ে। বাড়ীতে ভাই এসেছে । কাকার মেয়ে এসেছে । জেঠুর ছেলের ছেলে আছে ওদের বাচ্চাদের সাথে ভালো আছে । আমি আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলাম এই বেড়ানো শুধু বন্ধুদের সাথে হবে । বর ,বাচ্ছা কেউ না । বাড়ীতে সবাই আছে ,মা বাবা আছে , রূপুর অসুবিধা হবে না আর ও ভালো থাকে ওদের কাছে । বায়না করেনি ও ।আর বর কিছু বলেনি ? ঋভান জানতে চাইলো । বলেছিল ফার্স্ট এ ।বেশি ডানা মেলেছি । এটা সেটা। হাসে রাধাচূড়া । পরে আর কিছু না । ও নিজেও যায় তো বন্ধু দের সাথে ।আমি আমার টাকা তে এসেছি । তিনদিনের জন্য ।তবে আমার কেউ বন্ধু না সব মাসতুতো দিদির বন্ধু । এই দিদির সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব । ওর অনেক বন্ধু আমার জানা তাই uncomfortable feel হয়না ।কাল বিকালে পৌঁছেছি । মঙ্গলবার সকালে বের হবো । ওহ ! Good । তোরা যাস এর ওর বন্ধুর সাথে আর বাচ্চাকে নিস না? ঋভান দূরে কি দেখতে দেখতে বলে । এমা তা না! একসাথে গেলে রুপু থাকে তো। এটা আমার বিয়ের পর ফার্স্ট বর মেয়ে ছাড়া আসা । ইচ্ছে হলো একটু নিজের মত ঘুরবো ! কেউ তারা দেবে না । কেউ কিছু বলবে না । নিজের মতো একটু এনজয় করবো । রাধাচূড়া অন্যমনস্ক ভাবে বলে । ঋভান ওর দিকে তাকায়। পাতা ঝরছে টুপটাপ । হেমন্ত শুরু হয়ে গেছে । বিষণ্ণ বাতাস । হিমেল এলোমেলো হাওয়া। দূরে একটা হলদে পাখি ডাকছে তার সঙ্গীকে ! টিটুই টুই! এবার দুর্গাপূজো আশ্বিন এর শেষে ছিল । নরম আলো এদিক ওদিক লুকোচুরি খেলছে । ব্রেক ফাস্ট করেছিস তো ? জিজ্ঞেস করলো ঋভান। হ্যাঁ রে ! তুই ? কাজল কালো চোখে তাকায় রাধাচূড়া । সেদিকে তাকিয়ে আবারও বুক ধুকপুক করে ঋভানের । চোখে ভেসে ওঠে সেই কোন একুশের কথা ! সেই ঘামে ভেজা , রোদে লাল হয়ে ওঠা মুখ , সেই দেদার ফুচকা খাবার কথা , সেই বৃষ্টি তে ভিজে প্ল্যাটফর্ম চত্ত্বর ।সেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পালানোর কথা ,সিনেমা যাবার কথা । সেই স্কুল বেলার কথা , সেই সরস্বতী পূজোর কথা ,সেই ওর প্রথম শাড়ী পড়ার কথা । সেই কুলের আচার , আইসক্রিম , বারোভাজা ,খাবার কথা । সেই টিউশন যাবার কথা । সেই ঝগড়ার কথা । মুখে বললো আর বল এর ওর খবর ? চিরন্তন দার কথা? কেমন আছে? কি করছে ? দাদা গ্রামেই আছে ।জেঠু জেম্মা কে কে নিয়ে । যেমন আগে থাকতো দেখেছিস তো তুই । ওপাশে জেঠু এপাশে আমরা মাঝে ঠাকুর দালান । কাকা দুর্গাপুর থেকে বাড়ী এলে আমাদের কাছে ওঠে । পিসি এলে জেঠুর কাছে । দাদা অঙ্কের টিচার । ছেলে বর্ধমানে পড়ে ।বাস আসে বাড়ীর সামনে । রাধাচূড়া একটু থামে । ঋভান বলে ওকে , আর তুই কি করছিস ? জব ? স্কুল টিচার না অন্য কিছু ? তোর তো রিসার্চ করার ইচ্ছা ছিল ? না কোনো কলেজে করছিস ? রাধাচূড়া হাসে , রিসার্চ ই বটে! হুম জব একটা করছি বাট চাকরি না, ব্যবসা । রাধাচূড়া ভট্টাচার্য ব্যবসা করছে ? তোর না geography তে ফার্স্ট ক্লাস এর থেকে সামান্যই নাম্বার কম ছিল । বিয়ে করে মাস্টার ডিগ্রী কমপ্লিট করিস নি ? তোর তো স্কুল কলেজে জব পাবার কথা । মাধ্যমিক ,উচ্চমাধ্যমিক এ যার স্টার থাকে । রাধাচূড়া হাসে একটু মলিন যেন !করেছি কমপ্লিট বাট ৫৫% থেকে রিভিউ করেও ৪ নাম্বার কম হয়ে গেলো পারলাম নারে রিসার্চ করতে । না কলজে এর পরীক্ষায় বসতে পারলাম ।একটা কোচিং নেই ,দিনরাত বাড়ীতে অশান্তির বাতাবরণ । মন পুরোপুরি ভেঙে গেছিলো পারিনি মন দিতে চাকরির পড়াশোনায় ।আর মেয়েটাকেও দেখতে হতো । মন উঠে গেলো স্টাডি থেকে ।সেটা আমার দোষ স্বীকার করি ! জেদ করে কোনদিকে মন না দিয়ে যদি পড়ায় মন দিতাম তাহলে হয়তো আজ কোনো জব পেতাম । ইউনিভার্সিটি তে রোজ যাওয়াতে আপত্তি তাই কোনো রকমে গেছি আবার কোচিং ! হাসলো রাধাচূড়া । তো কিসের ব্যবসা ? ঋভান জিজ্ঞেস করে । আমি নিজের গয়নার কিছু বেচে কিছু বাবার কাছে টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি , ছিট এনে আমি ডিজাইন করি। ড্রেস এর সেলাই এর জন্য দুটো মেয়ে আছে । আমি পেন্ট করি ড্রেস এ । একটা অ্যাসিস্টেন্ট রাখছি । পেন্ট এর ।নানা ধরনের ছবি করি ড্রেস এ । বাহ তোর আঁকার গুণ তাহলে কাজে লাগছে । তোর আঁকা সত্যি খুব সুন্দর । কিন্তু কাজের মধ্যে মেয়ের পড়াশোনা দেখিস তো ? দুটো teacher দিয়েছি । Arts এর একটা ,science er একটা ।পড়ায় তারা ভালই ।মেয়েও পড়াতে serious । তার সাথে ব্যাটমিন্টন শেখে । আঁকা আমি শেখায় ।আমি বেশি সময় পাইনা রে ।তবে খোঁজ রাখি রোজ ।কোনটা হলো না বা হলো না । দুদিন অফ দিই দোকান ।মেয়েকে টাইম দিই । বাড়ীতে রান্না ? রোজ করি না আর ! আমার রান্না পছন্দ নয় ওদের । আমি মেয়ের আর আমার টা করে নি ।হালকা কিছু করি । বর কিছু বলে না? নাহ ! আর দ্যাখে ইনকাম হচ্ছে তো যাহোক ! তোর বর কি করে? ঋভান জিজ্ঞেস করে,Medical representative . রিজিওনাল ম্যানেজার ।শনিবার করে ফেরে । রাধাচূড়া জল খায়। ঋভান বলে ওহ ! কোথায় আছিস ? বর্ধমানেই , বড়ো নীল পুরে । চল একটু হাঁটি দুজনে, দেখায় চল বন । এ আমার চেনা! তোকে স্বাগত জানাবে । ঋভান হাসলো ! হাসি ফিরিয়ে দিল রাধাচূড়া ও!
ওড়িশায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মন কেমন করা সুন্দর সুন্দর জায়গা । ঋভান ওকে দেখাচ্ছিল ,এই জঙ্গলটির বৈশিষ্ট্য হল যে এটি তরঙ্গায়িত ছোটোনাগপুর মালভূমির ওপর অবস্থিত। জঙ্গলকে বেষ্টন করে আছে খৈরিবুরু ও মেঘাসানি নামক পাহাড় চূড়া। মেঘাসানি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। যারা জঙ্গল্ট্রেক ও ক্যাম্প করতে চায় বা পাখি দেখতে চায় তাদের পছন্দের জায়গা সিমলিপাল। এখন এই জঙ্গলটি সবচেয়ে বড়ো বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ।
অপূর্ব মনমাতানো রূপ এই জঙ্গলের। কোথাও ঢেউ খেলানো পাহাড়,কোথাও ফাঁকা জমি ,কোথাও ঘাসের জঙ্গল ,আবার কোথাও সবুজ মাঠের রোমাঞ্চ ।কত রকমের গাছ আর কত রকমের প্রাণী ,হাতি ,লেপার্ড , কাঠবেড়ালি, হরিণ, ভালুক ,ময়ূর , পাইথন , নানা ধরনের পাখি । দেখতে দেখতে বহুদিন পর রাধাচূড়া ভীষণ ভালো লাগছিল । এমন করে মিঠেল রোদ মেখে বহুদিন কারো সাথে হাঁটেনি সে । তার মনে পড়ছিল বইমেলাতে এমনি করে মিঠে রোদ মেখে সে আর ঋভু বই কিনতো। কালো শাল এর ওম মেখে বাদাম খেতে খেতে তারা বই পড়তো । কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে । একটি বার তারা শুধু কলেজের কিছু ছেলে মেয়ে মিলে শান্তিনিকেতন গেছিলো দোলে । খুব ম্যানেজ করে মিথ্যা বলেছিল যে ,শুধু মেয়ে বন্ধুরা যাবে । সেই বাসন্তী রঙের শাড়ি , হৈ হৈ, আবীর রাঙা মুখ , সেই প্রথম আবীর দেওয়া দুজন দুজনকে ! সেই একরাশ পলাশ এনে তার হাতে দিয়ে , ঋভু কিছু ফুল তার চুলে গুঁজে দিয়ে বলেছিল তোকে একদম রবীন্দ্রনাথের নায়িকা লাগছে কিন্তু তুই আমার গল্পের নায়িকা । জঙ্গল পাগল ছেলেটার প্রিয় লেখক বুদ্ধদেব গুহ ।
তার অবশ্য অনেকেই ভালো লাগে লেখক হিসাবে ।
পুরোনো দিনে হারিয়ে গেছিলো রাধা চূড়া । রাধা ... চমক ভাঙলো ওর । অনেক দিন পর কেউ যেন গভীর গলায় ডাকলো । লাঞ্চ করবি তো ? হুম দিদিকে ডাকি । গাড়িতে খাবার আছে রাখা । একসাথে খাবো । তুই কি এনেছিস ? না হলে আমি আর তুই ভাগ করে খাবো । শুকনো আরো কিছু কিনে নিই দোকান গুলোই । রাধাচূড়া বলে , ঋভান উত্তর দেয় ,আমিও এনেছি ,তুই ওদের ডাক ।
দলে ওরা ৭ জন । ওকে দেখে সবাই হৈ হৈ করে উঠলো কিগো পাত্তা নেই । ও আলাপ করিয়ে দিলো আমার এক আত্মীয় ঋভান বর্মন । এখানকার রেঞ্জ অফিসার । আর এ আমার মাসতুতো দিদি অনামিকা সমাদ্দার । অনুদি বায়োলজির টিচার । এরা দিদির সব কলিগ । অনামিকা বললো ঠিক আছে তোরা কথা বল । আমি ওদের সাথে বসছি । খেতে বসে অনামিকাকে দলের তনিমাদি বললেন তোমার বোনের আত্মীয় কি handsome গো ।ইসস! আমার মেয়ের এমন একটা বর হয় বেশ! সবাই হাসলো । লুচি তরকারি মিষ্টি ছিল ,আরো কিছু শুকনো খাবার ছিল সাথে । জঙ্গলে ঘুরতে হলে শুকনো খাবার রাখতে হয় ।ভিতরে খাবার হোটেল নেই সাথে আনতে হয় । খাবার আগে মাকে ফোন করলো রাধাচূড়া । রুপুকে দিতে বললো । কথা শেষ করে হাসলো ঋভানের দিকে । ভাই বোন দের পেয়ে খুব খেলায় মত্ত রুপু । হাসলো ঋভানও ।মেয়ের ভালো নাম কি? রূপকথা। ও আর তোর বর ? দেবজিত লাহিড়ী । ঋভান চাউমিন এনেছিল , ভাগাভাগি করে ওরা নিলো ।অনামিকা মিষ্টি দিয়ে গেলো ঋভান কে , খাবার পর সবাই ঋভান এর কাছ থেকে জঙ্গলের বিষয়ে জেনে নিচ্ছিল । রাধাচূড়া বাথরুম গেলে ঋভান অনামিকা কে একা পেয়ে বললো, দিদি যদি কালকের দিনটা একটু রাধার সাথে কাটাতে চাই অসুবিধা আছে কি? আমি চাইনা কোনো ক্ষতি হোক এই জন্য ! কাল রবিবার আমার ছুটি । অনামিকা বললো আরে আমার অনুমতি নিতে হবে না । তোমার সাথে আমার আগে দেখা হয়েছিল একবার কার্জন গেটে রাধার সাথে । আরেকবার সায়নের সাথে গেছিলে কিন্তু আমি ছিলাম না । মা ছিলো । হ্যাঁ দিদি তখন সায়নের সাথে কেমিস্ট্রি পড়তে যেতাম আপনাদের পাড়ায় । রাধা যেটা বুঝবে করুক । আমি just একটা কথা বলবো একটা দিন যদি একটু খুশিতে থাকে ও তাতে দোষ কোথায় ! আমি জানিনা ও তোমায় কিছু বলেছে কিনা, তাড়াহুড়ো করে ওর বিয়ে দিয়ে মাসীরা ঠিক করেনি । ও সব বলে না কুণ্ঠা লাগে হয়তো ওর ,কিছু কিছু শেয়ার করে বিয়ের পার থেকেই ওর সাথে বিনা কারণে খারাপ ব্যবহার করতো । দেনা পাওনা এই ওই । অকারণে জ্বালায় ওর শাশুড়ি , জা , দেবজিত কিছু বলে না! সেও এক ব্যবহার করে । যার তার সামনে যখন তখন কুৎসিৎ কথা বলে ।আমি হলে বোধায় চড়িয়ে দিতাম । রাধা তাই সহ্য করে । মেয়েটার মুখ চেয়ে , আবার কিছুটা বাবা মার প্রতি অভিমানে ।আবার মাঝে মাঝে এমন ভালো ব্যবহারও করে দেবজিত , তখন দেখে মনে হয় যেনো সব ঠিক হয়ে গেছে ওদের । তুমি ও চেনো ওকে কেমন মেয়ে ও । এত ভদ্র ,মার্জিত , মিশুকে গুণী মেয়ে তার সাথে সুন্দরী ওর husband কতো লাকি কিন্তু ওকে কদর করলো না! ওকে ওর স্বামী , শাশুড়ী মেরেছেও আমি জানি । যদিও ও এটা আমায় বলেনি । মাসী আর মা ফোনে কথা বলছিল আমি শুনেছিলাম । যাক আমার কোনো আপত্তি নেই আর কেনোই বা করবো এটা ওর ব্যাপার । ও অ্যাডাল্ট । আমরা কাল ময়ূরভঞ্জের প্যালেস আর আশ পাশ দেখবো । বুড়ী বালাম ,পলপলা নদী ..! ঋভান সাজেস্ট করলো , আশে পাশে কিছু সাঁওতালি গ্রাম আছে ! প্যালেস দেখতে সবাই যায় but একদম জঙ্গল হয়ে গেছে ।ভিতরে ঢোকা যায়না প্রায়। অনামিকা জানালো কাল বারিপদা দিয়ে এসেছে । ঋভান বলে নেক্সট টাইম বাংরিপোশী তে আসবেন । খুব সুন্দর জায়গা ।অনামিকা জানায় শুনেছে সে । চেষ্টা করবে পরের বার ওখানে যাবার !বলে আমায় তুমি বলতে পারো দিদিই ভেবো ।
খাবার খেয়ে গাড়ি করে কিছু কিমি রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছে গেল সবাই জোরান্ডা জলপ্রপাত । চঞ্চলা এই জলপ্রপাতের শব্দ দূর থেকেই শোনা যায়। পাহাড়ের একটা স্থান থেকে সাদা ফেনার মতো একটা লম্বা জলধারা প্রবাহিত হয়ে কোনও গভীর গিরিখাতে মিলিত হয়েছে । পাখির কোলাহলের সঙ্গে চঞ্চলা জলপ্রপাতের শব্দ মিলেমিশে যেন এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে ।
জলপ্রপাত দর্শন করে আবার লাল মাটির রাস্তা, ধুলোর ঝড় পেরিয়ে এগিয়ে চললো । এবার যাত্রাপথে দেখা গেলো খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর। নদীটি ছোট বড়ো পাথরের রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলেছে মোহনার দিকে। এই গভীর অরণ্যে এই নদী দর্শন সবার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল । নদীর পাড়ে বসে বেশ কিছুটা সময় কাটলো । পাহাড়ি নদীর ঠান্ডা জলে পা ভিজিয়ে মনের মধ্যে এক শান্তির বীজ খোঁজে রাধাচূড়া আর ঋভান ।
ঋভান জানায় এই নদীটি বরেহিপানি জলপ্রপাত থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে ।সারাবছর প্রবাহমান বরেহিপানি জলপ্রপাত থেকেই এই বুধবালাঙ্গা নদীর উৎপত্তি। এই জলপ্রপাতটি দুইটি অংশে বিভক্ত যার একটি অংশের উচ্চতা প্রায় ২৫৯ মিটার ।
এই ঘন জঙ্গলে এতো বড়ো জলপ্রপাত দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেছিলাম । কাছাকাছি একটি ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে দূরের খাড়াই পাহাড় থেকে বহমান জলপ্রপাতকে বয়ে যেতে দেখলো। ঋভান বলে , শিমুল গাছের আধিক্য থেকে এর নাম শিমলিপাল । এখানে চাহলা তে নুন খেতে আসে বন্য প্রাণী রা।
সন্ধ্যায় ফিরে এলো সবাই বন বাংলো তে ।সবাই ক্লান্ত । দুটো ঘর পেয়েছে ওরা ডাবল বেড । একটায় চারজন আর একটায় রাধাচূড়া ,অনামিকা , ও বড়দিমনি মিতাদি । উনি অনামিকা কে খুব স্নেহ করেন । এই ঘরেই থাকতে চাইলেন । একটা বেড এ উনি আরেকটা বেড এ অনামিকা ও রাধাচূড়া ।ফ্রেশ হয়ে রাধাচূড়ার একটু শুলো চোখ বন্ধ করতেই জলছবির মত ভেসে উঠলো নানা স্মৃতির টুকরো ।
ভাই সায়ন্তনের বন্ধু ছিল ঋভান । ক্লাস মেট। বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে গেলে সেই সময় । রাধাচূড়ার থেকে এক ক্লাস নীচে পড়তো ওরা ।পাশের গ্রামে বাড়ী । একদম প্রাইমারী থেকে পড়েছে কলেজ অব্দি । একসাথে খেলা ধূলা ,টিফিন ভাগ করে খাওয়া , দুষ্টুমি , খুনসুটি মজা এমন করেই কেটেছিল স্কুলের দিন গুলো ।হাই স্কুলে এক জায়গায় টিউশন । ছোট থেকে পরিচিত একে অপরের স্বভাবে । একে অপরের ফ্যামিলিতে পরিচিত । নিজেদের বাবারাও একে অপরকে চিনতো জানতো ।ক্লাস ৯ থেকে একটা কেমন যেনো টান তৈরি হয় । ওকে কোনোদিন ভাই মনে হয়নি । বন্ধুই মনে হতো । ক্লাস নাইন আর ইলেভেন এর সরস্বতী পূজার দিন গুলো অন্যরকম ছিল ওদের কাছে । সেই শীতের শেষে মনে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছিল । সেই প্রথম প্রেমের শিরশিরানি । ভাই কে লুকিয়ে দেখা করেছিল ওরা নির্জন এক ঘাটে । চারদিকে নিঝুম বনভূমি । ঝরা পাতা । মাঝে মাঝে জলের তরঙ্গ । হাত ধরে ছিল শুধু একে অপরের ওরা সেদিন । বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ মনে হাজারো নিষেধ । নিজেদের নানা গল্প করেছিল টাও বেশিক্ষন না ৩০ মিনিট । ধরা পড়ার ভয় ছিল মনে ।বন্ধুদের কেউ দেখে ফেললে ! গল্প করে ওঠার সময় ওর শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিয়েছিল ঋভু। ভাই কোনোদিন এই ব্যাপারে সন্দেহ করেনি । সেদিনের সেই অনুভূতি আজও মনের কোণে । ওর একটা ছবি তুলেছিল সেদিন । এর পর স্কুল পাশ করে কলেজে । সায়ন্তন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শিবপুরে চলে গেলো । ঋভান ফিজিক্স নিয়ে রাজ কলেজ ।সেও জিওগ্রাফি নিয়ে ওই কলেজেই ভর্তি হলো । এক সাথে কলেজ যাওয়া , ফেরা ,মাঝে মাঝে ক্লাস বাঙ্ক করে সিনেমা যাওয়া , ওর ভীষণ পাখি আর প্রকৃতির ফটো তোলার নেশা ছিল ।মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তো এখান ওখান । একবার দামোদরের ধারে ওরা দুজনে গেছিলো । শীতের দুপুর ।নৌকা বাঁধা ঘাটে । কিছু দূরে দুটো নৌকা যাচ্ছে নদীতে । মিঠে রোদে বালুকণা তে দোল খাচ্ছে । ওর ক্যামেরা তাক করা । উফফ কি বিরক্তিকর ।ক্যামেরা ধরে বসে থাকা । রাখ তো !একটু গল্প কর । ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছিল রাধা । ওর বাঁ হাত নিজের হাতে নিয়ে বুকের কাছে রাখে রাধা । এক হাত দিয়ে ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলো ঋভু। ওকে কবিতা পড়ে শোনাচ্ছিল রাধা । কিছু বদমাশ ছেলে ওদের দেখে খুব আজে বাজে মন্তব্য করেছিল , সাথে সাথে পড়া থামিয়ে উঠে বসে রাধাচূড়া । নির্জনে এখানে কেউ চলে আসবে ওর ধারণা হয়নি । ঋভুর সাথে ওদের খুব বচসা হয় সেদিন । ঋভুর সাথে তার কোনোদিন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি ।এমন কি একটা চুমুও না । আজ যখন ও পাশে পাশে ঘুরছিল রাধা, তফাৎ রেখে থাকলেও ওর সান্নিধ্য অনুভব করছিল ।ভালো লাগছিল। কৃষ্ণসায়র পার্কে ওরা মাঝে মাঝে যেত ।তার কলেজের পরীক্ষা শেষে একদিন এমনি ওখানে দেখা করতে গেছিলো তারা, হাত ধরে আসছিল তারা । সত্যি হাত ধরে আছে খেয়াল ছিল না । গ্রামের এক পরিচিত জনের সাথে দেখা হয়ে যায় । খবর ছড়াতে বেশি দেরি হয়নি । গ্রামের লোক সেটাকে আরও মুখরোচক করে বানায় । আর তার পর থেকে বাড়ীর শাসন । ভাই এর বন্ধু ,বয়সে ছোট । ছি ছি! দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যায় ।ওদের বাড়ী থেকেও সেই ! তার পর সে বর্ধমান ইউনিভার্সিটি তে এম এ তে ভর্তি হয় । ঋভান কলেজ শেষ করে উত্তর বঙ্গ ইউনিভার্সিটি চলে যায় । খুব মিস করতো কিন্তু দুই বাড়ী থেকেই তাদের মেলামেশায় নিষেধ নেমে এসেছিলো ।এগুলো তখন বন্ধুর কাছে খবর পেয়েছিল । এম এ পার্ট এর পরেই তার বিয়ে হয়ে যায় । বিয়ের পর অনেক কষ্টে সে রেগুলার ক্লাস করতে পায় । তার পর পাস করে কষ্ট করে । পড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ! রোজ অশান্তি করতো শাশুড়ি । জা তাকে কারণে অকারণে ছোট করতো ! আর তার হাসব্যান্ড এর ছিল বাড়ী আর দাদা বৌদি অন্ত প্রাণ ।যত অন্যায় করুক না কেনো ,কোনোদিন বৌদির দোষ দেখতো না ।রাধা চূড়ার চোখ দিয়ে জল আসে পুরোনো কষ্ট গুলোর কথা মনে করে ; ভাই কি জেনেছিল জানেনা তবে এই ব্যাপারে ভাই কোনোদিন রাধা কে জিজ্ঞেস করেনি । হয়তো কুন্ঠা বোধ করেছিল । দুজনের যোগাযোগ আর থেকে না বা থাকলেও সেই ব্যাপারে সায়ন্তন কোনোদিন একটা কথাও বলেনি ।সেও জিজ্ঞেস করেনি । তখন সদ্য একুশ ।আজ পনেরো বছর পর দেখা ঋভান এর সাথে । ঘুমিয়ে গেলি রাধা ?অনামিকা ডাকে। না অনুদি একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল । রাধাচূড়া উঠে বসে ।কেমন লাগলো তোর ওর সাথ পেয়ে ? মুচকি হাসলো অনামিকা । অবাক আমি হটাৎ দেখে । হ্যাঁ ওই আর কি টুকটাক কথা । বিয়ে করেনি এখনও । বলছে করবে না । এখানে কাছেই ওর বাংলো। ওর মা বাবা জানো দুজনেই আর নেই !রাধাচূড়া চুলটা ক্লিপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে বলে । হলুদ সুতির নাইটি পড়েছে ।একটা হালকা চাদর গায়ে । ওহহ একটা ছেলে ? অনামিকা জিজ্ঞেস করে, না দাদা বৌদি আছে আসানসোলে । কি জব করে ঠিক জানিনা জিজ্ঞেস করিনি । ওর তো ভালো রেজাল্ট ছিল ।দুটোতে স্টার পেয়েও ওর ইচ্ছা ছিল না মেডিক্যাল কি ইঞ্জিনিয়ার এক্সাম দেবার । ওর খুব স্বপ্ন ছিল শুরু থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এ সার্ভিস করার ।সেটা হয়েছে । কথার মাঝেই অনামিকা দের স্কুল এর বড়দি । অল্প ঠান্ডাতেও তিনি চাদর মাফলার নিয়ে জড়িয়েছেন ।হাতে গরম পাকোড়া নিয়ে ঢুকলেন আর ঝালমুড়ি সাথে তিন ঠোঙা । অনামিকা রাধাচূড়া খাও । নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রাধুনী দের পটিয়ে ভাজিয়ে নিয়ে এলাম ।খাও খাও ।ওরা তো ও ঘরে বকবক করছে সব ।দুজনেই হেসে ফেলে । দিদি আপনি পারেনও । রাধাচূড়া র বেশ লেগেছে মানুষ টিকে । উনিও বিয়ে করেন নি অনুদির মত । স্কুলে গম্ভীর কিন্তু দলে বেশ হাসিখুশি ।মজার মজার এমন কাণ্ড করেন রাধাচূড়া তো হেসেই খুন । খেয়ে উঠে দুটো ফোন করলো মাকে একটা আর একটা দেবজিত কে । অনামিকা দেখলো দেবজিত এর সাথে কথা বলতে বলতে ওর বিরক্ত হয়ে উঠছে মুখ , নিশ্চয় ওদিক থেকে কিছু এমন বলছে! দেবজিতের স্বভাব হলো ওকে সব সময় খোঁচা দিয়ে কথা বলা । বেশি রাত করলো না ডিনার করতে ।সবাই টায়ার্ড । রাতে বড়দির নাক ডাকার শব্দ । ওদিকে অনুদি ও ঘুমের দেশে ।ঘুম আসছে না রাধাচূড়ার চোখে ।পুরোনো স্মৃতিতে মন ভারাক্রান্ত । ঘুম আসছে না বিছানায় ঋভান এর চোখেও । বাইরে নিঝুম বনের শব্দ । পুরোনো দিন গুলো চোখের সামনে ভাসছে তারও । দুদিকে দুজনের চোখের জল নিঃশব্দে গড়িয়ে এসে বালিশ ভিজিয়ে দিল । সে কথা কেউ জানলে না ।শুধু ঈশ্বর ছাড়া !
পরদিন সকালে সবাই রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করে বের হলো । ঋভান বুঝিয়ে দিল ড্রাইভার কে ।এখানে সবাই খাতির করে ঋভান কে সেটা সবাই বুঝলো । অনামিকা কে বললো লাঞ্চ এর পর মিট করবে ওরা ।একসাথে সাঁওতালি গ্রাম দেখতে যাবে ।রাস্তায় পথ চলতি ভালো হোটেল বলে দিল লাঞ্চ এর জন্য । ওরা বেরিয়ে গেলে ঋভান আর রাধাচূড়া ও বেরিয়ে পড়লো । গাড়ী চালিয়ে নিজের বাংলোর সামনে দাঁড়ালো ঋভান। রান্নার মাসী রান্না করে দিয়ে গেছে । ভাত , পোস্তর বড়া, বেগুন ভাজা ,আলুভাজা , আর সাথে থাকবে দেশী মুরগীর ঝোল ।দুর্দান্ত করে এখানে একটা হোটেলে, সেখানেই অর্ডার দিয়েছে । ওরা দিয়ে যাবে । কচুরি আর ঘুঙনি আর রসগোল্লা নিয়ে এসেছে ঋভান । সাথে রাবড়ি । লাঞ্চ করে খাবে । হাতে মুখে জল দিয়ে বসলো রাধাচূড়া । O my God ! কি দারুন জায়গা ! বাংলো টা ছোট কিন্তু খুব সুন্দর । গেটের পাশে এক দিকে কৃষ্ণচূড়া আর এক দিকে রাধাচূড়া গাছ ।দুটো বড়ো ঘর ।বারান্দা , রান্নাঘর , দুটো বাথরুম তবে একটা বেড রুমের সাথে লাগোয়া ।অন্য টা বারান্দায় । নীচে গ্যারেজ । ব্যালকনি খুব সুন্দর করে সাজানো ।বেতের চেয়ার ।টেবিলে ফুল ,বই পেপার । ব্যালকনিতে টবে গাছ লাগানো । চারদিকে পরিচ্ছন্ন রুচির প্রকাশ । কিছু শান্তিনিকেতনী কাজ ও চোখে পড়লো । তাকালে চারদিকে আদিম সবুজাভ গাছ। নীলাভ আকাশ ।দূরে নদী বয়ে যায় এঁকে বেঁকে । নুড়ি পাথর সাজানো থরে থরে । রাধাচূড়ার মনে হলো এ স্বর্গ । সারাজীবন ওদিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় । এদিক ওদিক বসতি ও কিছু দোকান পাট চোখে পড়েছিল।
রাধাচূড়া স্নান সেরে আসেনি । ওদের তাড়া ছিল ওদের ছেড়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছিল । সে এখানে স্নান করবে । ড্রেস নিয়ে এসেছে । স্নান করতে গেলো সে ওর বেড রুমের ।ওখানে ড্রেস চেঞ্জ এর সুবিধা হবে । বেড রুম এ ঢুকলো সে । চারদিকে যেনো ঋভানের ঘ্রাণ । তার তোয়ালে তার শার্ট তার রুমালের ঘ্রাণ নিলো সে । ঘরে ঢুকে টেবিলে ঋভুর একটা বাঁধানো ছবি । ছবিতে হাত বুলিয়ে আদর করলো সে । আলতো চুমু রাখলো । ফ্রেম টা দেখে মনে হলো ডবল । ফোল্ড করে একটা করা । কি মনে হতে ঘোরাতে দেখলো তার ছবি ।সেই কৃষ্ণসায়র পার্কে তোলা । নীল চুড়িদার পড়া । এলোমেলো চুল ,ছোটো কালো টিপ , ঘামে ভেজা মুখ ! রাধার চোখে জল এলো । মুছে নিয়ে আবার যেমন ছিল রেখে দিলো। দেওয়ালে একটা ছবি বাঁধিয়ে রাখা । একটা পাহাড়ি সিনারি । বৃষ্টি পড়ছে ।একটা মেয়ে ও ছেলে ছাতা মাথায় । এই ছবি ওর আঁকা । ওর ১৯ বছরের জন্মদিনে গিফট করা । শাওয়ার এর ঝর্না ধারায় এসে নিজেকে ভেজালো কিছু ক্ষন । কুসুম কুসুম গরম জলে চোখের উষ্ণ জল মিশে গেলো । স্নান সেরে এসে কালো নীল মেশানো একটা শাড়ী পড়লো । কালো ব্লাউজ । কালো টিপ আর কাজল চোখে তৈরী হয়ে বেরোলো যখন তার সেই শান্ত স্নিগ্ধ সুন্দর রূপ দেখে ঋভান মুগ্ধ হলো । রাধাচূড়া বারান্দার তাকে রাখা রাধা কৃষ্ণ , দুর্গার পুরো পরিবার ,শিব , কালী , জগন্নাথের মূর্তি আর রামসীতাসহ হনুমান এর পটে , ফুল দিতে লাগলো ।ধূপ ধরালো। কৌটোয় রাখা নকুলদানা নিয়ে আর গঙ্গাজল নিয়ে খেতে দিল ঠাকুর কে ।প্রণাম করলো । প্রণাম করলো দেওয়ালে ঝোলানো রামকৃষ্ণ ,বুদ্ধদেব , সুভাষ চন্দ্র , স্বামী বিবেকান্দের ছবি আর ভারতবর্ষের ম্যাপ কেও ।কি সুন্দর দৃশ্য । খুব ইচ্ছে করছিল তার রাধার ভেজা চুলের ঘ্রাণ নিয়ে । আদর করতে। কখনও একটা চুমুও খায়নি তারা । কিন্তু ....! দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে ! সে কখনো তাকে কষ্ট দেয়নি আর এই মেয়ের গায়ে কিনা কেউ আঘাত করে ।তার মনে কষ্ট দেয় ! ঋভানের চোয়াল শক্ত হলো ।কিরে তুই কখন ফ্রেশ হবি ? রাধাচূড়া ডিস সাজাতে লাগলো । খেয়ে নিই আরেকটু পর । মুখ টা ঘুরিয়ে নিল ঋভান।
খাবার পর একটা সিগারেট ধরালো ঋভান । রাধা চূড়া ওর বেড রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে বুদ্ধ দেব গুহর ' বাংরিপোশীর দু রাত্তির ' পড়তে লাগলো । কিরে তুই কি এখন বই পড়বি নাকি? ঋভান ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করে । একটু পড়ি । বাড়ীতে আর টাইম হবে না । রাধাচূড়া বলে । ঋভান হাসলো । ফেস বুক করিস না ?নারে সময় পায়না । হোয়াটসঅ্যাপে আছি তো দেখেছিস ।কাল নাম্বার নিলি । ভাই এর সাথে তোর কন্টাক্ট নেই ? রাধাচূড়া জিজ্ঞেস করে , ফেস বুকে দেখেছি কিন্তু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিই নি । ওকে দিলে তোর কথা জানতে মন হতো কিন্তু বলতে পারতাম না ।কষ্ট হতো ।কিভাবে ও রিয়াক্ট করবে! তবে আমি জানি সায়ন আমায় এখনও ভালোবাসে । ও কোনোদিন কিছু বলেনি তোকে ? ঋভান জিজ্ঞেস করে । ও! না ভাই কোনোদিন কিছু বলেনি এই ব্যাপারে ।বই টা রেখে জানালার দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করে রাধাচূড়া , তুই আমায় এখনো ভালবাসিস ঋভু? তোর কি মনে হয় রাধা ? নিজেকে প্রশ্ন কর !
রাধাচূড়া দু হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠে । আমরা কি দোষ করেছিলাম ঋভু? কেনো কেউ বুঝলো না আমাদের ? আমরা তো ভালোবেসেছিলাম শুধু ।
ঋভান কাছে এলো ।ওর মাথায় হাত রাখলো । ওকে জড়িয়ে ধরে আকুল কেঁদে উঠলো রাধাচূড়া । ক্রন্দনরতা নারীর কাছে স্বয়ং ভগবান ও অসহায় মানুষ তো কোন ছাড়! পুরুষের আদরই বোধায় তার ওষুধ । এ সময় দরকার পুরুষের ভরসার বুক ।ঋভান তাই করলো ।ওকে বুকে টেনে নিল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো দুজন দুজনকে । বহুদিনের পুঞ্জিত অভিমান ,কষ্ট যেনো গলতে লাগলো । অধর স্পর্শ করলো ঋভান রাধাচূড়ার। শুষে নিতে লাগলো যেনো কষ্ট গুলো । রাধাচূড়া ও পরম নিশ্চিন্তে এক সমুদ্র ভালোবাসা যেনো চুমুক দিয়ে পান করতে লাগলো । চোখ বন্ধ দুজনের ।কত ক্ষন এমন কাটলো ওরা জানে না । হটাৎ সম্বিত ফিরে এলো রাধাচূড়ার ! একি করছে সে ! সে ছিটকে গেলো ! ঋভানের তখন অসহায় অবস্থা ।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার । রাধা প্লিজ ফিরিয়ে দিস না আজ তুই ! আমি মরে যাবো সোনা । কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকায়নি । তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি রাধা ।এখনও চাই । প্লিজ আমায় শান্ত কর । অনুনয় করে ঋভান । রাধাচূড়া দুহাতে মুখ ঢাকে, আমায় মাফ কর ঋভু । প্লিজ ! কিছু হলে আজ, আমি তোর নিশান কে হত্যা করতে পারবো না । আমায় মাফ কর । আমি তার দায় নেব রাধা । তুই ফেরাস না । এই আদিম আহ্বান অগ্রাহ্য কি ভাবে করবো বল এখন ?
তুই বাথরুম যা নিজের মত শান্ত কর । আমাকেও করতে দে নিজেকে শান্ত ।জোড় করিস না । প্লিজ । ঋভান দরজায় জোড় শব্দ তুলে বাথরুমে ঢুকলো।চমকে গেলো রাধা । পুরুষ কে ফেরানোর রাগ । ঋভান ঢুকে শাওয়ার চালিয়ে দিল । আস্তে আস্তে জল এর ধারা তার সারা শরীর বেয়ে নামতে লাগলো । সে কাঁদতে লাগলো । ঝর্নার তলায় একা পুরুষ সে । কারোর সামনে পুরুষ রা কাঁদতে পারে না । যত বিষ যত কষ্ট জমিয়ে রেখে পুরুষ হয়ে ওঠে তারা। আস্তে আস্তে শান্ত হলো সে । আবার যেনো সে বাস্তবে ফিরে এলো । কিছু ক্ষন আগে এই বাথরুমে স্নান করে গেছে রাধা । চারদিকে তার ঘ্রাণ লেগে যেনো । আয়নায় আটকানো টিপ । চুলের গার্ডার এ লেগে আছে চুল ।সেটা নিয়ে ঘ্রাণ নিলো সে । আহ! এই তো রাধার ঘ্রাণ । ঘরে এসে দেখলো রাধা নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেছে । বিছানার চাদর কোঁচকানো । পাশে তার একটা কানের দুল পড়ে । তার পর পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে বেরিয়ে এলো । দুল টা পাঞ্জাবির পকেটে রাখলো । তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো । দেখলো রাধা বেতের চেয়ারে বসে দূরে তাকিয়ে আছে । সে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো রাধাচূড়ার। সরি । ইটস ওকে ।পাল্টা হাত রাখলো রাধা ওর হাতে । কলিং বেলের আওয়াজ এলো । দেখলো ঋভান ,হোটেলের ছেলেটা চিকেন নিয়ে এসেছে ।
একটু নিঃশব্দে খেয়ে দেয়ে বের হলো ওরা । গাড়ীতে বিশেষ কথা হলো না । রাধাচূড়ার খুব মন কেমন করছিল এখান থেকে যেতে ! ওই নদীর কাছে যাওয়া হলোনা, যে নদী ব্যালকনি থেকে দেখা যাচ্ছিল, মনে মনে বললো হে বনভূমি হে নদী আমার ঋভু কে দেখো ,হয়তো আর আসা হবে না কোনোদিন ! স্থানীয় একটা সাঁওতালি গ্রামে যাবার কথা ওদের । ফোনাফোনি করে নির্দিষ্ট গ্রামে পৌঁছালো ওরা । ওখানে এসে পৌঁছালো অনামিকাদের দল ও । গরীব আদিবাসী গ্রাম । কিন্তু যেনো তাজা প্রাণ সবার । এরা যেমন জীবনে লড়তে জানে তেমনি অল্প কিছু নিয়ে সন্তুষ্ট ও হতে জানে ।ওরা ঘুরে ঘুরে আদিবাসী দের কাছ থেকে জিনিস কিনতে লাগলো । এক জায়গায় সাঁওতালি নাচ চলছিল । ওরা হৈ হৈ করে ওতে অংশ নিল । রাধাচূড়া কেও টেনে নিয়ে গেলো । কেউ একজন খেয়াল করে বললো , রাধাচূড়া তোমার আরেকটা কানের দুল কই ? ঋভান কিছু বললো না । রাধাচূড়া কানে হাত দিয়ে বললো কি জানি কোথাও পড়ে গেছে হয়তো ! তালে তাল মিলিয়ে নাচতে লাগলো সবাই । রাধাচূড়ার মুখে খুশীর ঝলক দেখে ঋভানের ভালো লাগছিল । সে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে লাগলো ।এমন পরিবেশ সবার মনেই আনন্দ দিচ্ছিলো । বড়দি মোটেও তাল মেলাতে পারছিলেন না।উনি নিজের মতো ভঙ্গি করছিলেন নাচের কাণ্ড দেখে ঋভান ও হাসছিল । সে ওদের সবাইকে চা বিস্কুট আর চপ মুড়ি খাওয়ালো । ওখানে ওগুলোই ছিল । সবার ছবি তুললো । সৌন্দর্যের সাথে যদি সুন্দর ব্যবহার হয় , সবাই আকৃষ্ট হয় । ওরাও হলো । ৮ টা নাগাদ ওরা হোটেলে ফিরলো । রাধা ওদের সাথে গাড়ী তে চলে এলো । ঋভান গাড়ী নিয়ে চলে গেলো । ফ্রেশ হয়ে ডিনার সেরে যে যার ব্যাগ গুছিয়ে নিলো ।কাল ওদের যাওয়া চাঁদিপুর । সেখানে একটা রাত থেকে পরদিন সকালে ফেরা । সকাল ৯ টায় ট্রেন । ট্রেনে বালাসোর থেকে কলকাতা সাড়ে তিনঘণ্টার পথ । রাধা অনামিকার সাথে মাসীর বাড়ীতে উঠবে । পরদিন মা বাবার কাছে ওখানে । অনামিকারা মেমারিতে থাকে । রাতে জিজ্ঞেস করলো অনামিকা কে রাধাচূড়া , অনুদি আমি যে আজ ছিলাম না দিনে, কেউ কিছু বলেনি ?কাল কি ওকে বারণ করবো ? ওর অনেক ছুটি পাওনা । নেয় না ।কাল ছুটি নিয়ে তাহলে যাবে বলছিল চাঁদিপুর । অনামিকা বলে ,তো যাক না । ভালো গাইড তো হবে !এখনকার অফিসার ।সবাই তো চেনে দেখলাম । ভালো পজিশন । কেকি ভাবলো টা ভেবে তুই নিজের আনন্দ কেনো নষ্ট করবি ! বাড়ী ফিরে সেই তো তোর কষ্টের জীবন । ওর সাথে একটু কথা বলে বেরিয়ে যদি মন ভালো থাকে তো ক্ষতি কি! আর ওকে যা দেখলাম ভীষন ভদ্র মার্জিত ছেলে । ওর তো সবাই প্রশংসা করছিল। গাড়ী ঠিক করে দিচ্ছে । চেনা ড্রাইভার । সে নিজেও যাবে এর চেয়ে ভালো আর কি !থাকতেই পারে কারো আত্মীয়,বন্ধু কোথাও! আমার সামনে তো কেউ কিছু বলেনি । আড়ালে বললে জানিনা । যাক ওসব বাদ দে । আমার তো ওকে ভীষণ ভালো লেগেছে রে । তোর মুখে যা শুনলাম ওর বাংলোর বর্ণনা ।দারুন মনে হচ্ছে ।লোভ লাগছে যেতে ।কিন্তু সময় নেই আর কাবাবে হাড্ডি হতে চাইনা । রাধাচূড়া হাসলো ওর কথায় ।
পরদিন সবাই ৭ টার মধ্যে রেডি হয়ে নিলো চাঁদিপুর যাবার জন্য। গাড়ী ঠিক করে দিয়েছে ঋভান । এখান থেকে সাড়ে তিনঘন্টা পথ । ওর গাড়িতে বসলো রাধা চূড়া , অনামিকা আর বড়দি । অন্য ছোট গাড়ীতে বাকি চারজন । চেনা গাড়ী ভাড়া অনেক কম করিয়ে দিল ওদের । ওরা খুশী হোলো ।গান চালিয়ে দিল ঋভান । যেতে যেতে গানের লড়াই ।টুকটাক খাওয়া , বেশ মজা লাগছিল ওদের । পথে আসতে আসতে বেশ কিছু কৃষ্ণচূড়া আর রাধা চূড়া গাছ চোখে পড়লো ওদের । ঋভান ও যেনো প্রাণ পেলো নিজের মুলুকের লোক জন পেয়ে । অনাত্মীয় কজন দুদিনে যেনো আত্মীয় হয়ে উঠেছে । । মাঝে দোকানে টিফিন করলো সবাই পরোটা ,আলুর দম , অমৃতি। সকলে পরিমিত খাচ্ছে কদিন ,সাথে অ্যাসিডিটির ওষুধ ও !যার ফলে শরীর সবার সুস্থ। গাড়ীতে যেতে দুবার বমি হোলো রাধাচূড়ার। যেভাবে যত্ন নিলো ওর ঋভান ,অনামিকা তা দেখে মুগ্ধ ।ওর খুব কষ্ট লাগছিলো এমন ভালোবাসার করুণ পরিণতি দেখে । রাধাচূড়া ঘুমিয়ে গেলো ।কিছু পর তার শরীর সুস্থ হয়ে গেলো । এখানে হোটেলে দুটো ঘর বুক করেছে ঋভান ।একটা নিজের । আরেকটা ওদের ডিমান্ড মতো পেয়ে গেছে বিশাল হল ঘরের মতো ঘর । একসাথে ৮ জন থাকতে পারবে । ওদের এমন ইচ্ছা ছিল ।ঘরে দুটো অ্যাটাচ বাথরুম । পৌঁছতে ১০:৩০ এর ওপর হয়ে গেলো ।
ওড়িশার এক নির্জন সৈকত চাঁদিপুর। অন্যান্য সৈকত গুলির থেকে চাঁদিপুরের বৈশিষ্ট্য একটু আলাদা। এখানে দিনে দু'বার সমুদ্র সরে যায় বহুদূরে, আবার ফিরে আসে পাড়ের কাছে। কেয়া, কাজু, ঝাউয়ে ছাওয়া মনোরম বেলাভূমি। চাঁদিপুর থেকে ৩কিমি দূরে বলরামগড়ি। বুড়িবালাম নদী এখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এখানেই চাঁদিপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। চাঁদিপুর থেকে ঘুরে আসা যায় শৈবতীর্থ পঞ্চলিঙ্গেশ্বর । কিন্তু ওদের সময় নেই এতো । আরেকটা দিন থাকলে হতো ।গেলে আর চাঁদিপুরের কিছু দেখা হবে না ।
বিচ অঞ্চলে ওদের স্বাগত জানাল একসারি পামগাছ। তটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল, যেন চোখের সামনেই সমুদ্র পিছু হটতে শুরু করল, নিমেষে পিছিয়ে গেল কয়েক কিলোমিটার। বহু মানুষ দৌড়ে গেল সমুদ্রের দিকে, গর্ত থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো শিশু কাঁকড়ার দল। আর অলস জেলেরা শুকনো বালিতেই জাল ফেলল , যাতে জল ফিরে এলে আপনা আপনি মাছ এসে ফেঁসে যায় জলে নামার কয়েক ঘণ্টার কষ্ট না করেই। ঝাউ গাছের সারির বেলাভূমি দেখে বসলো ওরা।
সমুদ্রের দিকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যাওয়র পর জেলেদের ডাকে হুঁশ ফিরল। যে কোনও মুহূর্তে সমুদ্র ফিরে আসতে পারে, তখন এতদুরে থাকা একেবারেই নিরাপদ হবে না। ওরা চলে এলো । কেউ কেউ স্নান করছে ।জল ঘোলাটে । ওরাও একটু জল ছেটালো । ঋভান গুনগুন করলো রাধাচূড়া কে দেখে রবি ঠাকুরের লাইন .. 'সাগর জলে সিনান করি শিথিল এলোচুলে ..!'
শীতের অলস বেলা । সন্ধ্যে নেমে যাবে তাড়াতাড়ি । ওরা ঘুরতে লাগলো নিজেদের মত ।কেউ জিনিস কিনতে লাগলো । ওদের দেখে একটু কানাকানি করছিল অন্য চারজন কলিগ । আচ্ছা প্রেমিক নাকি! যাহ আত্মীয় হতে পারে না । থাকতেই পারে! বর্মন কি বামুন হয়? না বোধায় কায়স্থ । তো কিসের আত্মীয় ?কেনো ইন্টারকাস্ট হতে পারেনা ? উনি রেঞ্জার অফিসার ছুটি নিয়ে নিজের আত্মীয় কে দেখাতেই পারেন গাইড করে । প্ল্যান করে তো আসেনি এখানে থাকেন । বউ বাচ্চা তো দেখলাম না ।একটি বার কিন্তু ওদের কোনো অশোভন আচরণে দেখা যায়নি । ভদ্র মার্জিত দুজনে । আত্মীয় কি প্রেমিক জানিনা তবে প্রেমিক হলে বলবো দুজনকে দারুন লাগছে একসাথে ।আর আত্মীয় ভাইবোন হলে কিছু বলার নেই । এমনিতে দুজনেই ভালো ।এমন সব কথার মাঝে বড়দি এলেন ।বললেন দ্যাখো বেড়াতে এসেছ সেটা এনজয় করো। কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে না জেনে মন্তব্য না করায় ভালো ।আর যদি কিছু থাকে সেটা তার পার্সোনাল ব্যাপার । দুজনে যথেষ্ট ভালো । হেল্প করছেন উনি । সবাই চুপ করে গেল । নির্জন ঝাউগাছের সারি দেখে রাধাচূড়া আর ঋভান বসলো । দূরে সূর্য অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে ।মন খারাপের কমলা আলো মিশে আছে আকাশে । চারদিকে ইতস্তত লোক জন । বাঙলা কথা কানে আসছে । যেখানেই যাবে বাঙালী পাবে ।ওদের দল কে কাছে পিঠে দেখা যাচ্ছে না ।
এটা তোর জন্য রাধা । কিরে ? দ্যাখ মোড়ক খুলে দেখল বুদ্ধদেব গুহর 'বাংরিপোশীর দুরাত্তির বইটি '। ওয়াও দারুন । রাধাচূড়া খুশি হয় । । পড়িস আর আমায় মনে করিস । নেক্সট বার সুযোগ পেলে আসিস ।ওখানে যাবো ।আর আমার বাংলোর পাশের নদীতে নিয়ে যাবো । কাল টাইম পাইনি ।ওখানে গিয়ে বসতে হয় ।নদীর সাথে কথা বলতে হয় । গেলি আর দেখেই ফিরে এলি তাহলে নদী ভালোবাসবে না । রাধা চূড়া তেরছা তাকায় , তাই? হুম !আর এটা রুপু কে দিস । ঋভান দেয় ওর হাতে ।রাধাচূড়া দ্যাখে , ভারী সুন্দর বাঁশের কাজ করা ব্যাগ । সুন্দর সুন্দর রঙ এর মালা । সেদিন আদিবাসী গ্রাম থেকে কিনলাম । সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে বললো ঋভান , রাধা আমাদের দিন কি সত্যি চলে গেছে? আর কি এক হতে পারিনা । তুই চাইলেই হবে । রাধাচূড়া বলে ,হয়তো বা ..হয়তো বা না ! আমি কাল তোকে কেনো ফিরিয়ে দিয়েছি ঋভু জানিস ? জানি তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস ।আমিও বিশ্বাস কর । ভীষণ যন্ত্রণা আমারও হয়েছিল । কিন্তু কি জানিস যদি সত্যি এর ফলে কিছু হতো , আমি কি করে পারতাম বল সেটা নষ্ট করতে ?তোর চিন্হ কে আমি মেরে ফেলতে পারতাম না । ঋভান বলে ,কিন্তু আমি তো স্বীকৃতি দিতাম ।পিছিয়ে আসতাম না রাধা । যদি সত্যি এমন হতো ! রূপুকেও নিয়ে আসতাম । রাধাচূড়া আস্তে আস্তে বলে ,যদি রূপুকে হারাাতে হয় ! যদি ও তোকে না মানে বাবা বলে, বড়ো হচ্ছে তো !
যদি ওর কাস্টডি ওর বাড়ির লোক পায়! আমি কি করে থাকবো ওকে ছেড়ে ! ওদের কাছে মানুষ হতে পারবে না রূপু । কষ্টে মরে যাবে বেচারি ! ওদের অত্যাচার কেউ দেখবে না সবাই আমায় দোষ দেবে । রূপু কে কেড়ে নেবে আমায় শাস্তি দিতে ! মেয়েকে যে পাবনা তখন ! তোরা দুজনেই আমার বাঁচার রসদ ।একটু চুপ করে রয়লো দুজনে । দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুজনে । ঋভানের হাতে হাত রাখে রাধাচূড়া বলে , তোর জায়গা কেউ নিতে পারবে না । আজীবন তুই আমার মনে সেফ থাকবি কিন্তু আমি তোর ভালো চাই তুই বিয়ে কর ঋভু! একা থাকিস না । তোকে একা দেখে কষ্ট হচ্ছে রে । কলেজ লাইফ হলে হয়তো তোর পাশে অন্য কাউকে দেখে কাঁদতাম ।কিন্তু এখন বুঝেছি বাস্তব কি! ছোট ছোট ঢেউ ওদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল । উদাস ভাবে সমুদ্রের দিকে ঋভান তাকিয়ে বলল , সৈকত মুখোপাধ্যায় এর একটা কবিতা শোন ।
----------------------------
কবিতা তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন তার পংক্তিতে নিজেকে খুঁজে পায় মানুষ। এই কবিতাটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। এমন ভাবে ছুঁয়ে যায় কিছু অক্ষর!
----------------------------
একজন কেউ তো থাকবে যাকে তুমি দুঃখ দিতে দুবার ভাববে না
তোমার প্রতীক্ষায় থেকে, প্রতীক্ষায় থেকে থেকে থেকে
বেলাশেষে ম্লানমুখে ফিরে যাব মফসসলি স্টেশনের দিকে
একজন কেউ তো থাকবে যার ফোন ইচ্ছে হলে ধরবে তুমি, নাহলে ধরবে না।
একজন কেউ তো থাকবে যাকে তুমি বলবে শোনো, আমি
কারুর সম্পত্তি নই, কারুর সম্পত্তি নই, শোনো
ভালোবাসো? বাসতে পারো। কিন্তু কিছু দাবী যেন কোরো না কখনো
বলতে বলতে তুমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়বে আর...
তখন একজন তো থাকবে যে তোমার হাতের পাতার
ওপরে নিজের হাত রেখে বলবে শান্ত হও, শান্ত হও সোনা
তোমার যেটুকু দিতে ইচ্ছে হবে সেটুকুই দিও, আমি কিছুই চাইবো না।
এখন চলো তো উঠি, চোখ দেখে বুঝতে পারছি ক্লান্ত আছো খুব।
আসলে একজন থাকবে, সহস্র গোখরোর মধ্যে একটিই ডুণ্ডুভ
যে তোমার সবকিছু জানবে কিন্তু ভান করবে কিছুই জানে না
লুকোনো ক্ষতের দাগ, নষ্ট ভ্রূণ, চোখের পাতার নিচে গাঢ় কালি, ভয়
তোমার সমস্ত রণ, তোমার সমস্ত শোক, তোমার সমস্ত পরাজয়।
যার মুখ চেয়ে তুমি ফেলে দেবে মুঠোভর্তি ঠান্ডা অ্যালজোলাম
বলো, কিছু ক্ষতি আছে? আমিই না হয় সেই নতশির ভুজঙ্গ হলাম।
স্তব্ধ হয়ে গেলো রাধা চূড়া । নিঃশব্দে জল ঝরতে লাগলো ওর দু চোখ বেয়ে । জোড় করে তাকে অপবাদ দিয়ে একবার তারও ভ্রূণ নষ্ট করেছিল দেবজিত । সেও স্লিপিং পিল খেতে গেছিলো ।
সে হাত রাখলো দাবী করতে পারবি না নিজের মতো ? কঠিন কিন্তু ভেবে দেখিস ।ওর হাত টা নিজের হাতে নিলো ঋভান। বললো , আশা করি আমার উত্তর পেয়েছিস । তোর জন্য আমার ঘরের দরজা সব সময় খোলা ।যদি তোর মনে হয় ফিরিস আমার কাছে, আর যদি নাও মনে হয়, না পারিস, তবু তোর পাশে আমি সারাজীবন বন্ধু হয়ে ,নীরব ভালোবাসা হয়ে থাকবো । তোর কষ্ট গুলো শেয়ার করিস । আমি অর্ধেক নিয়ে নেবো । আনন্দ গুলো ও করিস ।তোকে দ্বিগুণ করে দেবো । শুধু তোর চোখ যেন না ভেজে । কোনোদিন রূপুুু বুুুঝলে আসিস । রাধাচূড়া বলে মৃদু স্বরে , সব আমাার সয় ,শুধু ভালোবাসলেই বৃষ্টি হয় । সূর্য টা মিলিয়ে গেলো সমুদ্রের দিগন্ত রেখায় । লাল সমুদ্র সফেন ছোটো ছোটো ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছিল ওদের ছুঁতে ।
ট্রেনে ওদের তুলে দিয়ে বাংলোতে ফিরছিল ঋভান। কালকের মতোই আরেকটা গাড়ী ভাড়া করেছিল । চাঁদিপুর থেকে বালাসোরে স্টেশন এক ঘণ্টার পথ । যাবার আগে রাধাচূড়া ওর হাতে একটা ভারী সুন্দর কাজ করা বাঁশি আর একটা ময়ূরের পালক দিয়েছে ।বলেছে কৃষ্ণের ওখানে রাখিস আর না হয় তোর কাছে রাখবি ।যখন দেখবি রাধাচূড়া তে ফুল ফোটার সময় বাজাস । দেখিস কেমন রাধাচূড়ার ফুল গুলো ফুটবে ! খুশিতে দুলবে ।আমি ঠিক বুঝবো । দেখিস তুই । তুই না শিখেছিলি বাঁশি । সত্যি সে ভুলতে বসে ছিল সে কোনোদিন বাঁশি শিখেছিল । আজ বাজাবে । সে তো রোজ ই শোনে রাধাচূড়া থেকে কেমন যেন একটা সুর ভেসে আসে । আর সেই সুরে আকুল হয়ে সে তার রাধা কে খোঁজে । দিনের পর দিন যায় । মাসের পর মাস যায় রাধা আসে না আর । রাধা কে একদিন কৃষ্ণ ছেড়ে গেছিলো আজ রাধা বুঝি সেই শোধ নিচ্ছে । আজ তার রাধা আবার হারিয়ে গেলো ! কিন্তু সে অপেক্ষা করবে । ঋভান গান চালিয়ে দেয় গাড়ীতে । 'তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তরা ....কি জানি কি আবেশে দিশাহারা ...! ঋভান পকেট থেকে দুল টা একবার দেখে আবার ঢুকিয়ে রাখলো পকেটে ।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
---------------------------------
Jayashri Banerjee Chakraborty
Purbo Bardhoman