মাশুল
সুব্রত দত্ত
অফিসে আজ ভীষণ কাজের চাপ ছিলো। ব্যস্ততার মধ্যেও বস-কে ধরে কোনক্রমে ট্র্যান্সফার অর্ডারটা আপাততঃ স্থগিত রাখতে পেরে বেশ টেনশনমুক্ত অভিষেক। আজকাল ইউনিয়নের মাধ্যমে এসব কাজ আর হয় না। ইউনিয়নের নেতাদের পাত্তাই দেয় না আমলারা। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে মোবাইল ফোনটা সেন্টার টেবিলে রেখে, টিভি চালিয়ে দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয় অভিষেক। খাবারটা সামনে রেখে স্ত্রী মৌমিতা বলে,
--- "খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাবে।"
--- "হুঁ, খাচ্ছি।"
অভিষেক স্যান্ডউইচ আর কফি খেতে খেতে টিভির দিকে চোখ রাখে। নাঃ, সেই একই খবর আর ভালো লাগে না। খুন, ধর্ষণ, নীতিহীন রাজনৈতিক বাহুবলীদের আস্ফালন, তাদের নির্লজ পরকীয়া প্রেমের উপাখ্যান, সুবিধাবাদীদের দল বদল --- ওঃ, অসহ্য! চ্যানেল পাল্টে ফুটবল ম্যাচ দেখে। মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। কলিগ সুশান্তের সাথে কথা হয়। ট্র্যান্সফার রদের বিষয়টাও জানায় অভিষেক। কথা শেষ হতেই খেলাতেও বিরতির বাঁশি বেজে যায়। আজ নাটকের রিহার্সালও নেই। তাই একটু রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে। ফেসবুকে চোখ বুলিয়ে নেয়। কয়েকটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। সেগুলো দেখতে গিয়ে হঠাৎ একটা নামে আটকে যায় অভিষেকের চোখ। সঞ্চিতা ব্যানার্জী! নিশ্চিত হতে প্রোফাইল খুলে দেখে সে। হ্যাঁ, সঞ্চিতাই তো! সরকার থেকে ব্যানার্জী হয়েছে। কিন্তু এতদিন পরে হঠাৎ আবার বন্ধু হতে চাওয়া কেন? অভিষেক বুঝে উঠতে পারে না, কি করা উচিৎ। একসেপ্ট করা কি ঠিক হবে? নাকি ডিলিট করবে?
গভীর সংশয়ে পড়ে যায় অভিষেক। মৌমিতা জিজ্ঞেস করে,
--- "কি হলো, আর খাবে না? অর্ধেক খাবার তো রয়েই গেলো।"
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে অভিষেক উত্তর দেয়,
--- " না, আর খাবো না।"
--- "সেকি! তুমি তো কখনো খাবার নষ্ট করা না। আজ কি এমন হলো?"
--- "ওঃ, বলছি তো খাবো না। আমার আজ ইচ্ছে করছে না, তাই। এত প্রশ্ন করছো কেন?"
--- "তুমিই বা এই সামান্য কথায় এত রেগে যাচ্ছো কেন? রাগ করার মত তো কিছু বলি নি!"
--- "তুমি এবার একটু থামবে? এই প্যান প্যান করা আমি একদম পছন্দ করি না। আর সেটা তুমি ভালো করেই জানো।"
মৌমিতা আর কথা বাড়ায় না। কাপ-ডিশ নিয়ে চলে যায়। অভিষেক নতুন নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসে। এই নাটকটায় তার চরিত্রটাতে ভালো অভিনয়ের সুযোগ রয়েছে। একটা ব্রেক পাওয়া যাবে মনে হয়।
ডিনারের পর স্ত্রী মৌমিতা বিছানায় গিয়ে বালিশটা সরিয়ে নিয়ে উল্টোদিকে পাশ ফিরে শুয়ে পরে। বিষয়টা অভিষেকের ভালো লাগে না। সে বলে,
----মৌ, সরি! আমি তখন একটু বাজে ভাবে রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। প্লিজ, কিছু মনে করো না।
মৌমিতা কোনো কথা বলে না। অভিষেক মৌমিতার কাছে যায়। হাতটা ধরে বলে,
---এখনো রাগ করে আছো? শোন না।
মৌমিতা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়।
---সরি বললাম তো। এই শোনো, তোমাকে একটা কথা বলবো। শুনে নিশ্চয়ই তুমি চমকে উঠবে।
মৌমিতা না ফিরেই বলে,
---কোন কথা?
---আরে, এতদিন পরে সেই মেয়েটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। এখন অবশ্য কারোর স্ত্রী। তাই তো মেজাজটা বিগড়ে গিয়েছিলো।
অভিষেক একটু আড় চোখে তাকায় মৌমিতার দিকে। দ্রুত উঠে বসে মৌমিতা বলে ওঠে,
---কোন মেয়েটা?
---আরে সেই সঞ্চিতা।
---- কে সঞ্চিতা?
----আরে কল্যাণীর সেই মিলি। তুমি তো জানোই, একসাথে নাটক করতাম ওখানে।
মৌমিতা আবার উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে বলে,
----ওঃ, তোমার সেই নায়িকা মিলি? তো, আমায় বলছো কেন?
----একসেপ্ট করবো?
----সেটা তোমার ব্যাপার, আমায় জিজ্ঞেস করছো কেন? ইচ্ছে হলে করবে!
----না, মানে --
----তোমার যা খুশি তাই করো। আমি কেন বলবো?
----হুঁ, ঠিক আছে, একসেপ্ট করেই ফেলি তাহলে। অনেকের মতো ফেসবুকে ফ্রেন্ড থেকে যাবে। ক্ষতি তো নেই তাতে কিছু।
মৌমিতার বাঁকা চাহনিতে অভিষেক একটু লজ্জা পায়। বলে,
---ওভাবে তাকালে কেন?
---বাব্বাঃ, তোমাদের প্রেমের কথা ওখানকার সবাই জানে। কিছুই শুনতে বাকি নেই। সবার মুখে মুখে তোমাদের জুটির কথা নাকি ঘুরে বেড়াতো।
---বাদ দাও তো ওসব কথা। আমি কখনো ওসব নিয়ে আর ভাবতে চাইও না।
মৌমিতা আর কথা বাড়ায় না। বিষয়টা যে মৌমিতার না-পসন্দ, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না অভিষেকের। সে-ও শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর পাশে মৌমিতা নাক ডাকতে শুরু করে। এটাও অভিষেকের একদম অপছন্দের। মহিলাদের কথা বলা ছাড়া অন্য কোনও আওয়াজ বেরোনো ঠিক মানতে পারে না। তবু কিছু করার নেই। সহ্য করতেই হয়। কিন্তু অভিষেকের চোখে আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না। ঘুরে ফিরে মনে ভেসে উঠছে পুরোন দিনের সব টুকরো স্মৃতিকথা।
* * * * * * *
গ্র্যাজুয়েশনের পর কয়েকটা চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছিল অভিষেক। তার মধ্যে থেকেই লেগে গেলো একটা সরকারি চাকরী! কিন্তু পোস্টিং সেই কল্যাণীতে। কলকাতা থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারিতে শারীরিক ধকল সইতে কষ্ট হবে বলে বাড়ির সকলের কথামত কল্যাণীতেই থাকার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু নাটকের কি হবে? কলকাতার এক নামকরা নাটকের গ্ৰুপের নিয়মিত অভিনেতা সে। তবু যেতে বাধ্য হলো অভিষেক। সরকারি চাকরী বলে কথা! তবে মানুষ যেখানেই যাক না কেন, তার প্যাশনের জায়গা সে ঠিক খুঁজে নেয়। অভিষেকও কল্যানিতে একটা নাট্যদলে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যায়। চাকরি আর নাটক সমান তালে এগিয়ে চলে। নায়কোচিত চেহারার জন্য ভালো চরিত্র পেতে অসুবিধে হয় নি। অল্পদিনের মধ্যে সে কল্যাণীতে এক পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে। অভিষেকের বিপরীতে বেশ কয়েকটি নাটকে দেবারতি অভিনয় করছিল। বন্ধুরা "যীশু - কোয়েল" বলে ক্ষ্যাপাতেও ছাড়ে নি। সেই দেবারতি পারিবারিক কারণে আর অভিনয় করতে পারছে না। তাই নতুন নায়িকার সন্ধানে দলের সকলে।
নতুন নাটক ধরা হবে। গ্ৰুপের সকলে বসে আছে। পরিচালকের সাথে একটি মেয়ের প্রবেশ ঘটলো। প্রথম দিন, একটু অপ্রস্তুত লাগছিলো তাকে। পরিচয়পর্বে জানা গেলো, ওর নাম সঞ্চিতা সরকার। গায়ের রঙটা একটু চাপা। কিন্তু বেশ মিষ্টি দেখতে। সেই সঞ্চিতাই অভিষেকের বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করবে বলে পরিচালক তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। রিহার্সাল চলছে। অভিষেক লক্ষ্য করছে --- কারণে অকারণে তার দিকেই বারবার সঞ্চিতার দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। অভিষেক স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে যায়। দু'চারটে কথা হয়। জানতে পারে ওর ডাকনাম মিলি। একদিন রিহার্সাল শেষে অভিষেকের ওপর মিলিকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে। ধীরে ধীরে সেটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়। দু'জনের সখ্যতা বাড়ে। এভাবেই একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যায় ওরা। আর পর পর বেশ কয়েকটা নাটকও দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়। যদিও অনেকে বলেছে, মিলির নাকি শিবু নামে একজনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। অভিষেক সেকথা জিজ্ঞেস করেছিলো মিলিকে। কিন্তু মিলি বলেছে, শিবুই নাকি তার পেছনে লেগে ছিলো। কোনও সম্পর্ক তৈরি হয় নি। অভিষেকও আর কথা বাড়ায় নি।
স্বপ্নের দৌড়ে ওরা ছুটে বেরিয়েছে এখানে সেখানে। ছুটির দিনে কলকাতায় ঘুরতে যাওয়া, নাটক বা একটু অন্য ধারার ফিল্ম দেখা, নন্দন - একাডেমি চত্বর -- ভিক্টরিয়া -- চিড়িয়াখানা -- মিউজিয়াম -- গঙ্গার ধারে হাঁটা, বৃষ্টিতে ভেজা ...এসবেই কিভাবে যেন কেটে গেলো বছর দুয়েক। অভিষেকের বাড়িতেও মিলিকে এনেছিলো কয়েক দিন। অভিষেক তার মাকেও নিয়ে গিয়েছে মিলিদের বাড়িতে। সেখানে মিলি অভিষেকের গা ঘেঁষে বসেছিলো বলে তার মা বেশ রেগে গিয়েছিলো। একবার কলকাতার পুজো দেখাতে এনেছিল মিলিকে। সেদিনের ঘটনা ভোলার নয়। কয়েকটা বড় পুজো দেখার পর তেইশ পল্লীর প্যান্ডেলে ঢুকতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি! প্রায় হাঁটুজল জমে যায় সেখানে। বৃষ্টিটা একটু ধরতেই ওরা বেরিয়ে পরে। অনভ্যাসে পড়া শাড়ি খুলে একাকার কাণ্ড! অভিষেক কোন রকমে আবডালে নিয়ে গিয়ে মিলিকে সেই শাড়ি পরতে সাহায্য করে। মিলি অভিষেকের প্যান্টের অবস্থা দেখে হাসে। অভিষেক তাকিয়ে দেখে রাস্তার তেল মেশানো কালো জলে তার সাদা প্যান্ট একদম প্রিন্টেড হয়ে গেছে। কিছু করার নেই। ঐ অবস্থাতেই সে মিলিকে কল্যাণীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।
অভিষেক কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে, তার কলকাতার বাড়িতে যাওয়াটা মিলি ঠিক পছন্দ করছে না। যদিও সে ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, বাড়ি থেকে আলাদা হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা তার নেই। সব বিষয়ে মিলির খবরদারিও তার ভালো লাগে না। তবু বেশ কাটছিলো তাদের দিনগুলো।
কিন্তু হঠাৎ-ই তাদের স্বপ্নময় ফাল্গুনী বাতাস অতি তুচ্ছ কারণে দুঃস্বপ্নের কালবৈশাখী ঝড়ে বদলে যায়। এটাই হয়তো নিয়তি। বাড়ির প্রয়োজনে কয়েকদিনের জন্য অভিষেককে কলকাতায় থাকতে হবে। আগের রাতে তাই মিলিকে বলে সেই কথা,
---কাল কলকাতায় যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। বাড়ির কিছু কাজ আছে।
---না গেলে?
---চলবে না। আমাকে যেতেই হবে।
---না, যেতে দেবো না।
---সেকি! যাবো না বললে হবে?
---হ্যাঁ, হবে। তুমি যেতে পারবে না, ব্যাস।
---ওঃ, না গেলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। বাড়ির সবাই জানে আমি যাচ্ছি। আর আমি না গেলে কাজগুলো হবে না। প্লিজ, ওরকম জেদ করো না।
---না, না, না। আমি যেতে দেবো না। তোমায় ছাড়া এতদিন থাকবো কি করে?
---আরে বাবা, মাত্র চার-পাঁচ দিনের ব্যাপার। শোনো, আমাকে যেতে দাও প্লিজ। এরকম জেদ করছো কেন বুঝতে পারছি না। আমাকে যেতেই হবে।
---তাই? আমার কথা না শুনে যাবেই?
---আরে বাবা আমাকে যেতেই হবে। ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করো।
---ঠিক আছে, যাও। আর আমার কথা ভাবতে হবে না। যদি বাড়িতে যেতেই হয়, তাহলে আমার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করতে এসো না।
---কি? কি বললে? এতবড় কথা!
--- হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি।
মিলির চোখ ছলছল করছে। তবু অভিষেক বলে,
---ও, ঠিক আছে। যাচ্ছি। আর কখনো আসবো না।
বেরোতে গিয়েও অভিষেক দাঁড়িয়ে পড়ে। আচমকা এই পরিস্থিতির চাপে মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মিলি বালিশে মুখ গুঁজে রয়েছে। কোনও সাড়া না পেয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় অভিষেক।
আটদিন পর অভিষেক ফিরে আসে কল্যাণীতে। তবু দু'জনের কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করলো না। অভিষেক ভাবে, মিলি আগে আসবে। কারণ, সে-ই আগে ঝগড়া শুরু করেছিলো। মিলিও হয়তো ভেবেছিলো, অভিষেকই আসবে। নাঃ, কেউ কারো কাছে আসে নি। অভিষেক সেই নাট্যদল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়। জেদ করে দু'জনেই জয়ী হলো। কিন্তু হেরে গেলো তাদেরই গড়ে তোলা একটা ভালবাসার সম্পর্ক! অভিষেক নিজেকেই প্রশ্ন করে, সত্যিই কি ছিলো, ভালবাসা? আরো তিনটে বছর কেটে গেলো। আর কারো প্রতি আগ্রহ জন্মায় নি তার। অবশেষে বাড়ির পছন্দেই মৌমিতাকে বিয়ে করে অভিষেক। তারপর কলকাতায় ট্র্যান্সফার চেয়ে পেয়েও যায়। মিলি নামের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকে যায়।
# # # # # #
কাল রাতে উল্টোপাল্টা ভাবনায় ঘুমটা ভালো হয় নি অভিষেকের। কলকাতায় ট্র্যান্সফার নিয়ে স্ত্রী - পুত্র সহ বেশ সুখেই সংসার করছে সে। ইতিমধ্যে অবশ্য অভিষেক মাকে হারিয়েছে। মিলি নামটা মুছেই গিয়েছিলো মন থেকে। হঠাৎ তেনার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে খুঁচিয়ে ঘা করার কি দরকার হলো, তা বুঝে উঠতে পারে না অভিষেক। যাক গে, ওসব ভাবনা ছেড়ে দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। রাতে রিহার্সাল শেষে বাড়িতে ফিরে আসে। মোবাইলে মেসেঞ্জার নোটিফিকেশনে দেখে সঞ্চিতা টেক্সট পাঠিয়েছে।
---একটু কথা বলা যাবে?
অভিষেক কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। একটু ভেবে উত্তর দিলো --
---হ্যাঁ, বলো।
----কেন আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে?
এরকম একটা বিচ্ছিরি প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে, তা কল্পনাও করে নি কোনদিন। সে বললো --
---এতদিন পরে হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? আর এর উত্তর তুমিই বেশি ভালো জানবে।
---আমি কি এতই খারাপ, যে ছেড়ে যেতে হলো?
---ভালো-খারাপের প্রশ্ন আসে নি তো সেদিন!
---তাহলে?
---ইগো। আমাদের দু'জনের ইগোর লড়াইয়ে আমাদের সম্পর্কের মৃত্যু ঘটেছে। আর একটু হলেও তুমিই বেশি দায়ী ছিলে।
---আমার কাছে কিন্তু তুমি একই রয়ে গেছো।
---তাই? সেটা কি করে হয়। তোমার সংসার আছে তো।
---হ্যাঁ আছে। বর আর মেয়ে।
---তাহলে তো তুমি তাদের ঠকাচ্ছো!
---মোটেও না। এই জানো, তোমায় অনেকদিন থেকেই ফেসবুকে খুঁজেছি। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষে বিমলদার ফ্রেন্ডলিস্টে খুঁজে পেলাম। এই, তোমার ফোন নম্বরটা দেবে?
---কেন, সেটা দিয়ে আবার কি করবে?
---কেন, অসুবিধে আছে?
---না, সেরকম কিছু নয়। কিন্তু সে তো ফেসবুকেই রয়েছে। ঠিক আছে, তবু দিচ্ছি ...
---ফোন করলে বিরক্ত হবে না তো?
---অস্বাভাবিক কিছু না বললে বিরক্ত হবো বলে মনে হয় না।
---ঠিক আছে। আজ যে আমি কি আনন্দ পেলাম, সেটা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
---ঠিক আছে। আমার একটু কাজ আছে। আমি এখন বেরোব।
এরপর মাঝে মধ্যেই ফোন আর টেক্সট-এ পুরোন সব কথা উঠে আসে। কলকাতার টালিগঞ্জে মিলির বিয়ে হয়েছে। হঠাৎ একদিন ফোন বেজে ওঠে --
---সময় করে চলে এসো একদিন আমার বাড়িতে। টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন, ইন্দ্রপুরী স্টুডিও পার হয়ে রাণীকুঠি। মোড় থেকে বাঁ-হাতে একটু এগোলেই আমার বাড়ি। তোমার ভবানীপুরের বাড়ি থেকে তো দূরে নয়!
---দেখো, সেটা কি সম্ভব? সম্ভব হতো, যদি আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক থাকতো। তাই নয় কি? এখন আর আগের মতো তুমি বা আমি একা নই। আমার মিসেসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই?
---না, থাক। দরকার নেই।
---কেন? আমার বউ কিন্তু বেশ ভালো।
---হ্যাঁ জানি। এত প্রশংসা করতে হবে না।
---সত্যি কথাই বলছি।
---আচ্ছা রাখছি। রাতে মেসেঞ্জারে টেক্সট করবো।
অভিষেক প্রমাদ গোনে। এ তো আবার তাকে সেই জড়ানোর চেষ্টা!
এভাবেই দিন এগোয়। টেক্সট আর ফোনে কথা হয়। অভিষেক বিষয়টাকে মেনে নিতেও পারে না। মাঝে মাঝে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন মিলি পাগলের মতো কথা বলতে চেষ্টা করে। একদিন সে কল করে বলে,
---তুমি আমার ফোন ধরো না কেন?
---আমাকে কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই সম্ভব হয় না।
---এরকম করো না প্লিজ। আমি তো বেশি কিছু চাই না। শুধু তোমার কন্ঠস্বর শুনে সেইসব দিনের স্মৃতিমন্থন করি।
---আমি সত্যিই ব্যস্ত থাকি।
---এই শোনো না, তোমাকে আমি একটা গিফট দেবো। তোমাকে খুব সুন্দর লাগবে ঐ শার্টটা পড়লে।
---উঁহু, না না মিলি, খবরদার! ওসব পাগলামো একদম করবে না। এটা অসম্ভব!
---কেন অসম্ভব?
---এখন এসব হয় না। চলতে পারে না।
---সে একদিন তোমাকে ঠিক দেবো। এই জানো, তোমার সেই মন ভোলানো হাসিটা এখনো ভুলতে পারি না। এখনো অমন করেই হাসো, তাই না? (ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে)
---আচ্ছা, এখন ওসব ভেবে কি হবে? শুধু শুধু মন খারাপ করো কেন? স্বামী-কন্যা নিয়ে মন দিয়ে সংসার করো।
---হুঁ, তাই তো করছি। কিন্তু তোমাকে যে ভুলতে পারি না! আচ্ছা, আমার মতো তোমার কি আমায় মনে পড়তো?
---সত্যি কথা বললে মন খারাপ করবে না তো?
---না, বলো।
---তোমাকে সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম। তাই তোমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে অবাক হয়েছিলাম।
---তুমি এরকম নিষ্ঠুর!
---ঠিক আছে, এখন রাখছি।
---এতদিন পর তোমার কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। সেই আগের মত। ফোন কাটতে ইচ্ছে করছে না।
---উপায় নেই। ফোন রাখছি।
বেশ কিছুদিন এভাবেই কেটে যায়। মাঝে মাঝে মিলিকে আরো সময় না দিতে পারার জন্য ঝগড়াও শুরু করে দেয়। দু'বার অভিষেক মিলিকে ব্লক করে দিয়েছিলো। দু'বারই ফোন করে মিলি কান্নাকাটি করেছে। বলেছে অভিষেক যেন তাকে আনব্লক করে দেয়। তাহলে অন্ততঃ প্রোফাইল খুলে অভিষেকের ছবিগুলোই দেখবে। আর কিছু নয়। অভিষেকও আনব্লক করেছিলো। কিন্তু মিলি যেন রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘিনী! অভিষেককে আগের মত করে পাওয়ার লোভে সে মত্ত হয়ে ওঠে। এমন অভিযোগও করে, অভিষেক নাকি শুধু বউ নয়, অন্য কাউকে বেশি সময় দেয়। শেষে একদিন এই বলেই কথা শুরু করে
---এই, তুমি প্রায় সারাদিন অনলাইনেথাকো কেন? কার সাথে এত কথা বলো তুমি?
---মানে? শুধু চ্যাট করার জন্যই কি সবাই অনলাইনে থাকে? আর কোন কাজ থাকে না?
এক কথা - দু'কথায় তুমুল ঝগড়া শুরু হয়। অভিষেক বলে --
---শোনো, আমার এরকম কলতলার ঝগড়া করতে রুচিতে বাঁধে। রাখছি।
---না, রাখবে না। তোমার ফেসবুক মেসেঞ্জারে সব সময় সবুজ আলো জ্বলে থাকে। নিশ্চয়ই অন্য কারো সাথে কথা বলো। তার সঙ্গেও সম্পর্ক আছে তোমার।
এবার অভিষেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। বলে --
---এই মিলি, সাবধানে কথা বলো তুমি। কি ভাবো তুমি আমায়? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে আমি পরকীয়া প্রেম করতে যাবো? এই যে তোমার সাথে কথা বলি, এটাকেও তাহলে পরকীয়া বলতে হয়। কারণ, তুমি এখন অন্যের স্ত্রী। তুমিও পরকীয়াই করছো। ছিঃ, তোমার মানসিকতা এত নীচ, সেটা তো বুঝি নি! শোনো, আমার ঘরে মোটামুটি সুন্দরী একটা ঘরোয়া বউ আছে, ছেলে আছে এবং কলেজে পড়ছে, অফিসের কাজ আছে, নাটকের রিহার্সাল আছে, অনেক পরিচিত মানুষের সাথে যোগাযোগ আছে। এসবেই সারাটা দিন কেটে যায়। পরকীয়ার জন্য সময় বা রুচি কোনটাই নেই আমার।
---আমার কথা শোনো -- (মিলি কাঁদতে থাকে)
---না, আর একটা কথাও বলবে না। ওসব ন্যাকামো মার্কা চোখের জলে আর ভুলছি না। ছিঃ! তোমার সঙ্গে কথা বলতেই আমার গা গুলিয়ে আসছে। নতুন করে আবার যোগাযোগ করতে এলে কেন? নাঃ, আর নয়। আবার, হ্যাঁ আবার তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। এবং ফাইনালি তোমায় ব্লক করছি।
---না, শোনো, ব্লক করো না। না চাইলে কথা বলো না। কিন্তু ব্লক করো না। তবুও ফেসবুকে তোমাকে দেখতে পাবো।
---বলছি তো আর নয়। আর কোনদিন তুমি আমার জীবনে কোনভাবে ফিরে আসার চেষ্টা করো না। গুড বাই!
ফোনটা কেটে দেয় অভিষেক। তারপর সঞ্চিতা ব্যানার্জির নামটা ফেসবুক আর কন্টাক্ট লিস্ট থেকে ব্লক এবং ডিলিট করে দেয়। মনে মনে ভাবে, এক সময়ের মনের মানুষ শেষ পর্যন্ত মনকে বিষাক্ত করে জীবনের একটা অধ্যায় সমাপ্ত করে দেয়। কিন্তু বিষয়টা মৌমিতাকে না বলেও শান্তি পাচ্ছে না সে।
ডিনারের পর বিছানায় গিয়ে সব কথা বলে মৌমিতাকে। ঘটনা শুনেই মৌমিতা নির্বাক হয়ে অভিষেকের দিকে চেয়ে থাকে। সে বলে,
---আমার অজান্তে তুমি ওর সাথে এভাবে জড়িয়ে পড়লে?
---জড়াই নি। তবে হ্যাঁ, কথা বলেছি।
---না না, যখন তোমাকে ওই অসভ্য মেয়েটা এত অপমানজনক কথা বললো, তখন আমাকে জানাতে পারতে। আমরা দু'জনে মিলেই ওকে উচিত জবাব দিয়ে দিতাম।
---আসলে দিনে দিনে এত কথায় জড়িয়ে পড়াতে একটা পাপবোধ জাগছিলো মনে। তাই ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে বলতে পারি নি। তবে যা বলার, আমি বলে দিয়েছি।
মৌমিতা এই ঘটনায় ভীষণভাবে মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আর আগের মতো কথা বলে না। যার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকতো, সে যেন হাসতে ভুলে গেছে। গুনগুন করে গানও গায় না। বাড়িটাতে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। অভিষেক যথাসাধ্য চেষ্টা করে যায় মৌমতাকে স্বাভাবিক করতে। নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়ে নেয়। কিন্তু মৌমিতা কিছুতেই তার সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না। অভিষেকের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা তো বলেই না, বরং তার প্রশ্নের উত্তরে শুধু "হুঁ" "হ্যাঁ" বলে দায় সারে। তবে মিলির ফেসবুকের পোস্টগুলো দেখে অনেকটাই ধারণা করে নেয়।
অভিষেক বুঝতে পারে মৌমিতা ডিপ্রেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার কোনো চেষ্টাই কাজে লাগছে না। শেষে অভিষেক একজন ভালো Psychiatrist -এর কাছে মৌমিতাকে নিয়ে যেতে চাইলে মৌমিতা বলে,
---আমি পাগল নাকি? মনের কোনো রোগ হয় নি আমার। আমি সুস্থ।
---তুমি বললেই হবে? তোমার ব্যবহারের এই পরিবর্তন কি স্বাভাবিক? প্লিজ নরমাল হও।
---তুমি আমার সাথে যে তঞ্চকতা করেছো, তাতে আমার মন ভেঙে গেছে। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখনো তোমার অন্ন ধ্বংস করছি। যদিও সেই খাবার গিলতে পারছি না। উগড়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এখানে আমার কোনো অধিকার নেই। তবে, আমার পক্ষে আর এভাবে তোমার কাছে থাকা সম্ভব হবে না। আমি চলে যাবো।
বিস্মিত অভিষেক প্রশ্ন করে,
---চলে যাবে মানে? কোথায় যাবে? বাপের বাড়িতে?
---না, বাপের বাড়িতেও নয়। কোথায় যাবো জানি না।
---প্লিজ মৌ, এমন কথা বলো না। আমি কি তোমায় ভালোবাসি না? এখনো কি তোমাকে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে?
---না, আর কোনো প্রমাণ চাই না। কিচ্ছু চাই না।
---আচ্ছা, আমি কি এমন করেছি মিলির সাথে? শুধু কথা হয়েছে। দেখাও হয় নি ওর সাথে। তাহলে?
---ও তুমি বুঝবে না।
---ও, তুমি তাহলে তোমার সিদ্ধান্তেই আটকে থাকবে?
---হ্যাঁ। কয়েকটা দিন সময় নেবো। প্রতিমের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করে আমি চলে যাবো। তারপর তুমি মিলিকে নিয়ে থেকো।
---এসব কথার মানে?
---হ্যাঁ, ও তোমাকে এখনো এত ভালোবাসে, তাহলে তোমার সঙ্গে থাকতে পারবে না?
---ওঃ কি যাতা কথা বলছো। তোমার কি মাথা ঠিক আছে?
---কেন, বরকে ছেড়ে তোমাকে বিয়ে করতে অসুবিধে কোথায় ওর?
---বিয়ের প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?
---তুমি বললেই ও তোমার কাছে ছুটে আসবে সব ছেড়ে। তুমি ওকে ব্লক করেছো। কিন্তু আমি ওর ফেসবুকের পোস্টগুলো দেখেছি। সবই তোমাকে উদ্দেশ্য করেই পোস্ট করেছে।
---কিছু পোস্ট দেখেছি ঠিকই, তবে তোমার মতো করে ভাবি নি। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো।
---এত কথার কি আছে। তোমাদের এতদিনের সম্পর্কের মাঝে আমি কাঁটা হতে চাই না।
---ধ্যাৎ, থাকো তুমি বিছানায় একা।
অভিষেক সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে। তারপর সিগারেটের পর সিগারেট ধরিয়ে যায় আর এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে যায়। ঘরে আর বাইরে দু'জনেই নির্ঘুম রাত কাটায়। তবে অভিষেক একটা পথ অবশেষে খুঁজে পায়।
সকালে চা খেয়ে অভিষেক অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। মৌমিতাকে সে বলে,
---আমার জন্য খাবার বা টিফিন করতে হবে না। ক্যান্টিনে খেয়ে নেবো।
---যে ক'দিন আছি, আমার কাজটুকু আমি করে যাবো।
অভিষেক আর কথা বাড়ায় না। কাল রাতে সে ভেবে নিয়েছে তার ভবিষ্যৎ পন্থা। কোনক্রমে আধপেটা খেয়ে টিফিন বক্স নিয়ে অফিসে চলে যায়। প্রথমেই বস-এর চেম্বারে সে প্রবেশ করে। বস মি: চ্যাটার্জী তাঁকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
---আপনার চেহারা এরকম হয়েছে কেন? চোখ মুখ শুকনো শুকনো লাগছে!
---না স্যার, তেমন কিছু হয় নি।
---কিছু তো হয়েছেই। যাই হোক, বলুন, কি বলতে এসেছেন।
---স্যার, আমাকে ট্র্যান্সফার করেই দিন।
মি: চ্যাটার্জী চোখ কপালে তুলে বলে,
---সেকি! ট্র্যান্সফার যাতে না করি, সেজন্য সেদিন এত তদ্বির করলেন, আর আজ ...
---হ্যাঁ স্যার। এখন ওটাই আমার দরকার। যত দূরে সম্ভব আমাকে পাঠিয়ে দিন।
---আপনি তো অবাক করলেন মশাই!
---স্যার, এটা আমারই সিদ্ধান্ত। কার্যকর করবেন আপনি।
---হুঁ, ঠিক আছে। এত করে যখন চাইছেন, তখন তো দিতেই হয়। তো আপনার পছন্দ কোনটা। নর্থবেঙ্গল নাকি হলদিয়া?
---আমার কাছে এখন সবই সমান স্যার। যেখানে আপনার ভালো মনে হবে, সেখানেই দেবেন।
---ঠিক আছে, শিলিগুড়িতেই আপনার পোস্টিং দিচ্ছি। মনোরম পরিবেশে মনটা ভালো থাকবে। আপনি যান। আজই ট্র্যান্সফার অর্ডার হাতে পেয়ে যাবেন। খুশি তো?
অভিষেক মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে শুকনো হাসি হেসে বলে,
---থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার। খুব উপকার করলেন আমার। মনে থাকবে।
---আপনার মতো মানুষ কিছু চাইলে তাকে কি ফেরানো যায়? যান, আজ কাজ করতে হবে না। বন্ধুদের সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিন।
---ধন্যবাদ স্যার। অনেক ধন্যবাদ।
অভিষেক ছলছল চোখে বেরিয়ে আসে। অর্ডারটা হাতে নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে অভিষেক বেরিয়ে প্রথমে যায় নাটকের গ্ৰুপে। ট্র্যান্সফারের কথা শুনে সবার মন খারাপ হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছায় যে এই ট্র্যান্সফার, সেটা কাউকে বললো না অভিষেক। পরিচালক অথৈ জলে পড়ে বলে,
---এমন একটা রোলে তোমার substitute অভিনেতা পাই কোথায়?
---ঠিকই পেয়ে যাবেন।
---না না, যত সহজে বলছো, ব্যাপারটা তত সহজ নয়।
---আমি আর কি করবো বলুন। চাকরি রাখতে তাদের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে।
---তা তো বটেই। তবে শিলিগুড়িতে ভালো নাটকের গ্ৰুপ পেয়ে যাবে। যাও, বেস্ট অব লাক।
বাড়িতে ফিরে চুপচাপ চা খেয়ে ফোনে দরকারি কল সেরে নেয় অভিষেক। কথাহীন মুহূর্তরা যন্ত্রনায় কাল যাপন করে। ডিনারের পর বিছানায় গিয়ে অভিষেক মৌমিতাকে বলে,
---আমাকে এড়ানোর জন্য তোমাকে আর কোথাও যেতে হবে না। আমাকে ট্র্যান্সফার করে দিয়েছে। রবিবারের দার্জিলিং মেইলে শিলিগুড়ি যাচ্ছি। সোমবার জয়েন করবো।
---মানে?
---যা বললাম সেটাই মানে। শোনো নি?
---হ্যাঁ শুনেছি। কিন্তু তুমি যাবে কেন?
---আমাকে যেতেই হবে, তাই যাচ্ছি।
---আর ছেলে?
---তোমার কাছে মাতৃস্নেহে থাকবে।
---ওর পড়াশুনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নেবে?
---তুমি তুমি তুমি। সব তোমার দায়িত্ব। শুধু আমার ব্যাপারে তুমি দায়মুক্ত।
---না, আমি এসব দায়িত্ব নিতে পারবো না।
---আমি না থাকলে তো আর কোনো সমস্যা নেই।
---না, তুমি যাবে না।
---কেন? তুমি তো বলেছো আমার সঙ্গে থাকবে না। তাহলে?
---আমার মাথার ঠিক ছিলো না। তাই ওসব বলেছি।
কিন্তু তুমি যে সত্যি সত্যি দূরে চলে যাবে, তা ভাবি নি।
---মৌ, ঢিলটা তুমি ছুঁড়ে দিয়েছো। আর সেটা হাতে ফেরানো যায় না। ভালোই তো হলো। আমার মতো একজন দুশ্চরিত্রের ছায়াও মাড়াতে হবে না তোমায়!
---না, এরকম করো না। আমি একা হয়ে যাবো। থাকবো কি করে?
---শুধু তুমি নও, আমিও তো একা হয়ে যাচ্ছি।
মৌমিতা অনেক চেষ্টা করেও অভিষেককে ধরে রাখতে পারলো না। অভিষেক বারবার অফিসের দোহাই দেয়। মৌমিতার আর কিছু করার নেই।
রবিবার সন্ধ্যা। অভিষেক তৈরি হচ্ছে। ছেলে অমিতকে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। অমিত বলে,
---তুমি কবে আসবে বাবা?
---জানি না বাবা। আমি কিচ্ছু জানি না। তোমরা ভালো থেকো। পড়াশুনা ঠিক মতো করবে। মায়ের কথা কিন্তু মেনে চলবে।
---তাহলে তুমি মায়ের কথা না শুনে চলে যাচ্ছো কেন?
---এটা অফিসের অর্ডার বাবা। আমি যেতে বাধ্য।
---সত্যিটা তুমি এড়িয়ে গেলে!
অমিতকে বুকে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টায় বলে,
---আর একটু বড় হও। সব বুঝতে পারবে। আমি আসি তাহলে? সাড়ে ছ'টা বাজে। রাস্তায় জ্যাম থাকলে ট্রেন ধরতে পারবো না।
---ছুটিতে আমরা তোমার কাছে যাবো।
---হ্যাঁ, তোমাকে কেউ শেয়ালদায় ট্রেনে তুলে দিলে আমি এনজেপি থেকে তোমাকে নিয়ে যাবো। কেমন?
---আর মা?
---আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা। আমি চলি। বাই।
অভিষেক বেরিয়ে যায়। একটু তাড়াহুড়ো করেই ট্রেন ধরে সে। নির্দিষ্ট সিটে বসে। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। জানালার কাঁচের বাইরে তাকিয়ে দেখে, কলকাতা থেকে তার দূরত্ব বেড়ে চলেছে। এই সব কিছুর জন্য দায়ী তার এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত! সেই ভুলের মাশুল তাকে গুনতে হচ্ছে। নতুন করে মিলির বন্ধুত্বের ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত হয় নি তার। মিলি ওরফে সঞ্চিতা ব্যানার্জীর এক বিষাক্ত ছোবল অভিষেকের সংসার জীবনকে বিষময় করে দিয়ে গেলো। কোনদিন তাকে ক্ষমা করতে পারবে না। তবে মৌ-এর বিষয়টাও সে মেনে নিতে পারে না। একটু বুঝতে চেষ্টা করলো না? ফোন বেজে ওঠায় তার ভাবনায় ছেদ পড়ে। মৌ কল করেছে। অভিষেক কলটা রিসিভ না করে ফোনটা রেখে দেয়। আবার রিং টোন বাজে। অভিষেক এবার আর ফোন হাতেই নিলো না। রিং টোন বেজেই চলে ...। সেই শব্দে তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। তবু বুকে পাথর চাপা দিয়ে অভিষেক সেটা মিউট করে রাখে। না, আর কেউ অপরিহার্য নয়। যেমন সেও কারোর প্রয়োজনীয় নয়। আজ থেকেই তার নিঃসঙ্গ পথ চলা শুরু।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
--------------------------
সুব্রত দত্ত
আশ্রম পাড়া
শিলিগুড়ি।