রমজান আলি
হায়ার সেকেন্ডারিতে ভালো রেজাল্ট করায়, হানিফকে তার আব্বা বাংলা অনার্সে রাজ কলেজে ভর্তি করে দিল। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে সায়েন্স নিয়েই পড়ুক। ছেলের সে কি গোয়াঁরতুমি বাংলা নিয়ে পড়বে। ম্যাথে একশোর মধ্যে অষ্ট-আশি পেয়েও রাজ কলেজে ম্যাথে অনার্স পেলো না বলেই দ্বিতীয় চয়েসে বাংলা পেয়ে ভর্তি হয়ে যায়। যাতায়াতের অসুবিধায় হানিফ কলেজ হোস্টেলে থাকতে শুরু করে।
দু-একটি কবিতা কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশ পাওয়ায় হানিফ বাংলার জনপ্রিয় শিক্ষক কালীবাবুর নেক নজরে পড়ে। হানিফের ক্লাশ পার্ফমেন্সও খারাপ নয়। তার ক্লাশেই পড়ে রুকসোনা। অসাধারণ না হলেও সে সুন্দরী। গ্রাম্য মেয়ে ধুলো ঝেড়ে দিলে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।ক্লাশে হানিফের সঙ্গে রুকসোনার তেমন কোনো কথা হয় না। রুকসোনা পিছনের বেঞ্চে বসে, নীরবে হানিফের তৎপরতা দেখে। রুকসোনার চোখের গভীর দৃষ্টি, হানিফ যে লক্ষ করে নি তা নয়।
প্রথম বর্ষে অনার্সের ক্লাশ বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে গেল। টেস্টের পরই একদিন রুকসোনা হোস্টেলে এসে হানিফকে খোঁজ করে। কাঁদতে কাঁদতে হানিফকে জানায় যে বাড়ির লোক একজন রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোর করে তার বিয়ে দিচ্ছে।তাই সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। হানিফ কিছু একটা না করলে, সে বিষ খাবে, তবু এ বিয়ে করবে না। লোকজন খাটিয়ে একজন জন হেডমিস্ত্রী যত পয়সাই করুক না কেন, সে কখনোই রুকসোনার মনের খোরাক জোগাতে পারবে না।
হানিফ বুঝে উঠতে পারে না, সে কি করবে ? না করবে ? একবার ভাবে মেয়েদের হোস্টেলে তার থাকার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু অর্থ জোগাবে কে ? রুকসোনার বাড়িতে জানালে পাত্র হয়তো অর্থের জোগান দেবে কিন্তু বিয়েটা থামাতে পারবে না। তাই ঠিক করে রুকসোনাকে সে নিজেই বিয়ে করবে। তবে এব্যাপারে রুকসোনারও মতামতের প্রয়োজন। কোন দ্বিধা না করে হানিফ রুকসোনাকে প্রস্তাব দিয়েই ফেলে। তবে হানিফের বাড়ির লোক মানবে কিনা সে ভয়ও আছে।
হানিফ তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে জানায় যে হানিফের বাবা মেনে না নিলে তারা একটা টালির ঘর ভাড়া নিয়ে বস্তীতে থাকবে, আর টিউসানি পড়িয়েই চালিয়ে নেবে।
রুকসোনাকে কথা দিয়ে তাকে নিয়ে হানিফ আজই নিজের গ্রামে ফিরে যাবে। সঙ্গে আর এক বন্ধু সমীরণ ও সমীরনের বান্ধবী মালতী নেয় । এতে একটা সুবিধা আছে, মনে বল পাওয়া যায়। তাছাড়া হানিফ জানে তার আব্বা চাষীবাসী মানুষ হলেও বাইরের লোকজনের সামনে বাড়ির কাউকে অপদস্ত করেন না।
নদী পেরিয়ে গ্রাম যেতে সন্ধ্যা নেমে এলো। গ্রাম যত এগিয়ে আসে হানিফের মনে ভয় গ্রাস করে। মাঝে মাঝে ভাবে উটকো ঝামেলা ঘাড়ে না নিলেই ভালো করতো। তাছাড়া ব্যাপারটা নিয়ে গ্রামে ঢি ঢি পড়ে যাবে। বিশেষ করে আব্বার মাথা গরম হয়ে গেলে থামানো মুশকিল।
গ্রাম ঢোকার আগে একটা চটি । এখানে ধানের আড়ত। একটা পান-বিড়ির দোকান, একটা মোবাইল রিচার্জের দোকান। সাইকেল সারানোর একটা দোকান আছে। সেখানে এখন মোটরসাইকেলও সারানো হয়। দোকানে যে ছেলেটা মোটরসাইকেল সারায় সে হানিফের বন্ধু। আর আছে একটা চায়ের দোকান। রাত্রি ন'টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
হানিফের পিছু পিছু তিনজন চায়ের দোকানে ঢুকলো। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি। দোকানের বাইরের রাস্তার উপর তালাই বিছিয়ে টোযেনটি নাইন তাস খেলা চলছে। তাসুড়েদের ঘিরে পরামর্শদানকারী আরও সব মাথা। কারও কাছে খবর পেয়ে ভিড়ের মধ্যিখান থেকে তাস হাতে হানিফের চাসতো চাচা ভারিক্কি গলায় চিৎকার করে বললো ' কি হানিফ কখন ফিরলি? ' রুকসোনার ভিতরটা কেঁপে ওঠে। সে যেন গরুর খোঁয়াড়ে ঢুকেছে। হানিফ উত্তর দেয়
-- ' এখুনি চাচা। এই সব বন্ধুরা বেড়াতে এসেছে। ' বন্ধুরা বলতেই কৌতূহলী জনতার সার্চ লাইট পড়ে রুকসোনার উপর। এ গাঁয়ে এখনো মেয়ে বন্ধু স্বাভাবিক নয়। আবার সব তাসে মেতে উঠে। চাচার গলা শোনা যায় -- ' টেক্কা বিবি পড়লো কিনা মনে রাখতে পারিস না তো, খেলতে আসিস কেন ? ডাক শরু হয় -- বিশ, একুশ, বাইশ, তেইশ, চব্বিশ --- ডবল, রিডবল....
ওদেরকে চা খাইয়ে হানিফ বিকাশ আর রুকসোনাকে সাইকেলের দোকানে বসিয়ে রেখে মালতীকে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
দরজায় ঢুকেই প্রথম ঘরটায় আব্বা থাকেন। নামাজের পাটিতে বসে কেবলা মুখি হয়ে তসবী গুণছেন। ভয় নেই। উঠোন পেরিয়ে সোজা দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের দাওয়ায় উঠলো। মা ঘর থেকে বেরিয়ে মালতীর দিকে তাকিয়ে থ। রাত বিরেতে কার মেয়ে আনলো। মায়ের মনোভাব বুঝতে পেরে হানিফ বললে -- 'বিয়ে করলুম মা।'
-- ' বিয়ে করলি মানে ?
-- ' ওই করলুম।'
মালতী কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাঁদতে কাঁদতে হানিফের মায়ের চিৎকার -- ' ওগো হানিফের বাপ, দ্যাখো গো, তোমার ছেলে একটা পেত্নী ধরে এনেছে। ওগো আমার কি হলো গো। বাবার বলনু, পড়তে পাঠিও না, ছেলের বিয়ে দাও। আমার ক্থা শুনলে না। ওগো আমার কি হলো গো।' মালতী সত্যি দেখতে ভালো নয়। কিন্তু তা নিয়ে এমন পরিস্থিতি হবে হানিফ স্বপ্নেও ভাবে নি। তাকে আর দাওয়ায় উঠতে হয়নি সে এগনেতেই দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে নামাজের পাটি ছেড়ে তার আব্বা দক্ষিণদুয়ারি ঘরে হাজির। তার মেজাজটা আজ ভালো নেই। একই তো ধানের দাম নেই, তার উপর মিলে ধান দিয়ে টাকা পান নি। সঙ্গে ছেলের এই কান্ড। ধৈর্য রাখতে পারলেন না। চোখ দুটো পাকিয়ে ডান হাতের তর্জনী তুলে বললেন -- ' বের হারামজাদা আমার ঘর থেকে। শ্লা, আমি ওর হোস্টেল খরচ দিতে পারছি না, আর উনি করলেন বিয়ে। ---' না, আমি '
-- 'চুপ কর হারামজাদা। তাও করলি করলি, একটা ভালো দেখে। এমন কালো, হাড় মাস কিচ্ছু নেই। ' গ্রামের দজ্জাল মহিলা বলে পরিচিত আসিয়া চাচি তার খাঁইখাঁই গলায় বলে উঠে -- 'কেন কালো কি মানুষ লয়? ভোলার কালো বউটা এখনো গাঁয়ের সেরা। '
মালতী শুধু ভ্যাল ভ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
মা এবার গর্জে উঠে -- ' কেমন বেহায়া মেয়ে দ্যাখো, চুপ করে শুনছে। বেরো পোড়ামুখি। '
হানিফ একটা পথ খুঁজে পায়। বলে -- ' মা, ও তো শুনতে পায় না। '
পাড়া-প্রতিবেশি সবাই জড়ো হয়ে গেছে। আর মান সম্মানের কিছু বাকি নেই।
মা আবার নাকি সুরে কাঁদতে কাদতেঁ বলে -- ' ওরে ব্যটারে, তুই আনলি তো একটা ভালো দেখে কেন আনলি না। তোর কি আক্কেল একটা কানে কালা আনলি। '
-- ভালো আনলেও নিতে না।'
হানিফের আব্বা হাতের তসবি নাচিয়ে বলে -- 'আলবত্ নিতাম। তসবি হাতে বলছি নিতাম। '
ততক্ষণে হানিফের চাচা তাস খেলার শেষে বিকাশ আর রুকসোনাকে বসে থাকতে দেখে সঙ্গে করে ওদেরকে নিয়ে ঘরে ঢোকো। হাঁক দ্যায় ---' হানিফ কোথা ? হানিফ? কি ছেলের আক্কেল জ্ঞান দ্যাখো রাত বিরেতে এদেরকে রাজুর সাইকেলর দোকানে বসিয়ে রেখে বাবু.... '
সবাই সমীরণ আর রুকসোনার দিকে তাকায়। নতুন লাইন আসা ইলেকট্রিকের আলোতে রুকসোনাকে বেহেস্তের হূর মনে হয়। রুকসোনার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হানিফের আব্বা মতলেব শেখ। হানিফ তার আব্বুর চোখ মুখের ভাষা পড়তে পারে।
হানিফ হালে পানি পায়। গলার জোর বাড়িয়ে আব্বাকে বলে --- ' আব্বু একে নয়, ওকেই তো এনেছি। ' একটা গুঞ্জন ওঠে। আসিয়া চাচি বলে --' দ্যাখ্ এবার ঘরে তুলতে পারিস কিনা ? '