শক্তিপীঠ ।। সুবিনয় হালদার
জীবনের সঙ্গে লড়াই সেই জন্মলগ্ন থেকে জীবনের ! হয়তো বা আরও দশমাস পূর্ব হতে বা তারও আগে ! যখন পিতৃহারা কুমারী সুলক্ষণা প্রত্যন্ত একটা গ্রামের দারিদ্রে জর্জরিত অভুক্ত বিধবা মায়ের সঙ্গে চলে যায় শহরে-, বাবুর বাড়ির কাজে । অপুষ্টি এবং বয়সের ভারে রোগাক্রান্ত মা কিছুদিনের মধ্যেই ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর সেই কারনে বাবুরা সামান্য দায়সারাভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দেয় ! মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া এক কাঠা বাস্তুভিটে এবং ছোট্ট কুঁড়েঘর হয় অসুস্থ বয়স্কা বিধবার শেষ আশ্রয়স্থল । বৈরাগী-বুড়ি ওই গ্রামেরই বসবাসকারী গরিবদুঃখীর আনন্দময়ী মা । জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সময়ে অসময়ে, বিপদআপদে তাঁরই শরণাপন্ন হতো ! কারন তিনিই গ্রামের অলিখিত ডাক্তার, না মানে ধাইমা ! সরকারী হাসপাতাল থেকে অনুমতি প্রাপ্ত বৈরাগী-বুড়ি কখনো কাউকেই বঞ্চিত করতোনা । নিজের সব কিছুই উজার করে যথাসর্বস্ব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো । সুলক্ষণা মাসের শেষে বেতন পেয়ে যখন গ্রামে মাকে দেখতে এসেছিলো তখন বৈরাগী-বুড়ি তার মাকে সেবাশুশ্রূষা করে অনেকটাই সু্স্থ করে তুলেছিলো । সেই দেখে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত মনে আবার শহরে বাবুর বাড়ির কাজে ফিরে যেতে পেরেছিলো ! এভাবেই চলতে থাকে সময়, গড়াতে থাকে বছর । বর্ষাঋতুর আগমনে হেলো লাঙল চষে মাঠে, জমি তৈরী হয়, বীজ ছড়িয়ে তোলা বানিয়ে রোপণ করে, ফসল ফলায় চাষী । সেই ফসল সযত্নে ঘরে এনে মা-লক্ষ্মী জ্ঞানে পূজা করি আমরা সবাই । সহায় সম্বলহীনা একা একটা মেয়ে গতরে খেটে নিজের এবং বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের লজ্জা ও পেটের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় সততার সঙ্গে । কয়েক বছরেই সুলক্ষণা বাবুর বাড়ি সবার বিশ্বাসী হয়ে ওঠে তার কাজে ব্যবহারে । সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সহজ সরল সদা হাস্যমুখ সুলক্ষণাকে অসততার শূলে চড়িয়ে বিদ্ধ করলো বাবু একরাতে ! লজ্জায় ঘৃণায় ভয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত সুলক্ষণার ঋতুচক্র যায় থেমে ! বাবুকে সে বলে তার শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কথা ! বয়সে তিনগুণ বড় বাবুকেই সে পরমেশ্বর মেনে পদতলে আঁকড়ে ধরে । কিন্তু পরমেশ্বর বাবু তার কুকর্মে কাবু এক অভিশাপগ্রস্ত পরাজিত ঈশ্বর । বিতাড়িত সুলক্ষণা পরমেশ্বরী শক্তিপীঠ মা । জন্ম দেয় সদ্যজাত জিবনকে, জীবনের সঙ্গে লড়ে, লড়ে বাঁচতে । জিবন বড়ো হতে থাকে জীবনচক্রে । ভিখারিনী মা জিবনকে বুকে আঁকড়ে নিয়ে দোরে-দোরে, গ্রামে-গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে থাকে ! যুদ্ধ করে জিবনের জন্য জীবনের সঙ্গে, সবকিছুরই বিনিময়ে ! একটা ঘর একটা দোর একটা মানুষকে অবলম্বনের খেসারত তাকে প্রতিমুহূর্তে দিতে হয় রক্তাক্ত হয়ে । ভাগ্যিস ধাইমা বৈরাগী-বুড়ি জিবনের জন্মলগ্নেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সুলক্ষণাকে অপারেশন করিয়ে গর্ভগৃহটা বন্ধ করিয়েছিল ! অন্ধকারে কিংবা দিনের আলোতেও শয়তানদের দাপাদাপি । উষ্ণ রক্তের পিপাসা যেন মেটেনা আর । সুলক্ষণা আঁধারে অথবা নির্জন আলোতে একা অসহায় ভোগ্যপণ্য আর লোকসমক্ষে কেবলই কুলক্ষণা নোংরা বিকারগ্রস্ত পাগলী ! সত্যিই কি তাই ? প্রগতিশীল উন্নত মানসিক সম্পন্ন মানুষের মাঝে সামান্য জায়গা, নুন্যতম সহানুভূতি সব যেন এক মুহুর্তে উধাও হয়ে হারিয়ে যায় ! মুখ লুকিয়ে অন্ধকারে কালি মাখে নিজের হাতে নিজেরাই ! কাদা ফিঁকিয়ে কাঁটা বিছিয়ে রাস্তাঘাটে সুলক্ষণার দুর্বিষহ জীবন যুদ্ধ দাবানলে ভস্মিত করতে থাকে । এসব কিছুর সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত পরাজিত সুলক্ষণা তার ছোট্ট শিশুকে বুকের অমৃত সুধা পানকরায়, আর মাথার ওপর ঘণ হয়ে বেড়ে ওঠা নিকষকালো কেশরাশি পৃথিবী পৃষ্ঠদেশে দুহাতে উপড়াতে থাকে, ছিঁড়তে থাকে আর হাসে ! অশুদ্ধ সমাজে দুষিত বাতাসে নিশ্বাস নিতে কষ্টে হাঁপিয়ে ওঠে ! জীবনকে নিয়ে জীবন সাগরে সে ডুবে যেতে উদ্যত হয় । বৈরাগী-বুড়ি মা আনন্দময়ী রূপে তার পথ আগলায়, তার হাত ধরে । অন্তরে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলে - আমার পাগলি মেয়ে, আমি তো আছি ! অঝোর নয়নে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে সুলক্ষণা আর ফোঁপাতে ফোঁপাতে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে - মাগো আমি আর পারছিনা ! বৈরাগী-বুড়ি সবার মুখে ঝামা ঘষে নিজের আঁচলের ছায়ায় স্থান দেয় । জীবন বাঁচে এবং জেতে জীবন সংগ্রামে ।
সভ্য সমাজের শুভ্রবস্ত্র পরিহিত দামি অন্নজল গ্রহণ করা বাবুরা কি ভাবছেন ? কখনো আয়নায় নিজের অসভ্য বর্বর মুখমণ্ডলের চরিত্রস্খলনের প্রতিচ্ছবি দেখেছেন ? একবার, না না বারবার দেখবেন ! সুলক্ষণারা অন্ততপক্ষে কুলক্ষণা হতে রেহাই পাক, মাথা উঁচু করে সুস্থতার সঙ্গে বাঁচুক, তার জন্য ---, নিজের উত্তরসূরিদের, নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য --।।
############
(সুুবিনয় হাালদার, রগ্রাম - দৌলত পুর, পোষ্ট - দিঘীরপাড় বাজার
, থানা - ফলতা, জেলা - দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারতবর্ষ । দূরভাষ - ৯৬৩৫৫৭৬৪১২)