সৌমেন দেবনাথ
সত্য ভালোবাসাগুলো কেনো জানি এক তরফা হয়। একপাশ থেকে একজন ভালোবেসে যায়। অন্যজন টের পেলেও গ্রাহ্য করে না। রক্তিম চোখের কোণ বেয়ে নোনা জল ঝরে তুলির৷ তা দেখে তেঁতে উঠে তমাল। বললো, আমি তোমায় কোন সাগরে ফেলেছি যে তোমার চোখে এত পানি আসে! আমি তোমায় কোন আগুনে ফেলেছি যে এত জ্বলে জ্বলে অঙ্গার হচ্ছো!
এভাবে আরো কিছু কটাক্ষ কথা বলে তমাল বাজারে চলে গেলো। তিন্নী কল করলে তুলি তার বর্তমান অবস্থা বললো। শুনে তিন্নি বললো, বিপরীত মেরুর মানুষের সাথে মিলন হয় না। ভুল মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে স্বাধীন থাকা শান্তিকর।
তুলি বললো, আমার সময় কাটে না। বেঁচে থাকাটা আমার জন্য বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিন্নি বললো, প্রেমে পড়লে হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে হয় আর প্রেমে ব্যর্থ হলে এক মুহূর্তও বাঁচতে ইচ্ছে করে না। ধৈর্য আর সহ্য এই দুইটা একটু করে দেখ্।
এভাবে ওদের দুই বান্ধবীর মধ্যে কথা হতে থাকে। পৃথিবীতে কেউ কেউ এত ভাগ্যবান যে ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিয়েও ভালোবাসা পায় আর কেউ কেউ এতটা হতভাগা যে অনেক ভালোবাসা দিয়েও কেবল কষ্ট পায়।
তাহেরা বানু বৌমার নিষ্প্রভতা লক্ষ্য করেন। একদিন বললেন, গোমড়ামুখো বৌ ঘরে এনেছি। এমন মুখপোড়া বৌ ঘরে থাকলে আয় বরকত কী থাকে?
তালেব সাহেব বললেন, সৌভাগ্যশশীর দেখা কৃষ্ণকালো কপালে কখনো জোটে না।
ঘরের দরজা দিয়ে চোখের জলের বাঁধ ছেড়ে দেয় তুলি। প্রেম করে বিয়ে করেছে। বাবা মায়ের সায় ছিলো না। সময়ের সাথে মানুষের মন এত পরিবর্তন হয় তুলি জানতো না। ঘরে তমাল নিজের মত ব্যস্ত। তুলি বললো, আমি অনেক স্বপ্ন দেখতাম, ভেঙেও যেত। কষ্ট পেতাম না। কিন্তু তুমি যে স্বপ্ন দেখিয়েছো তা ভেঙে গেলে আমি বাঁচবো না। আশা আকাঙ্ক্ষায় ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিও না।
তমাল ফুটন্ত খইয়ের মত লাফিয়ে উঠে বললো, সুউচ্চ স্বপ্ন না দেখা ভালো। সুউচ্চ স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। কানের কাছে এত ঘ্যানর ঘ্যানর ভালো লাগে না। নিজে বাঁচি না নিজের জ্বালায়, ঘরে জ্বালা, বাইরে জ্বালা, এত জ্বালা ভালো লাগে না।
তুলি ভাবলো, ওর মনে হয় অসময় যাচ্ছে। কাছে সরে এসে বললো, তোমার কি হয়েছে বলো। আমরা তো শফথ করেছিলাম, সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়ে বসবাস করবো।
তমাল কেঁকিয়ে বললো, ব্যবসায়ে ধরা খেয়েছি। আমার টাকা দরকার।
তুলির মুখটা শুকিয়ে গেলো। বাবা মা বিবাহ মেনে নেয়নি। বিবাহের পর একদিনও বাবা মায়ের মুখও দেখতে পারেনি। কোন মুখে সে বাবা মার কাছে যাবে টাকা আনতে, কিভাবে যাবে?
অনেক সাহস করে মাকে কল দিলো তুলি। মা তৃষ্ণা বানু মেয়ের কল পেয়ে বেজায় খুশি। তুলি তমালের সম্বন্ধে বললো, মা শুনলেন। তমাল তাঁর মেয়েকে যে যত্নে রাখবে ভেবেছিলেন সে যত্নে রাখেনি। মা তবুও মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ছেলে মানুষ এমনি। মেয়েদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তোর বাবা তো ডাকাত ছিলো। আমাকে উঠিয়ে এনে বিয়ে করেছিলো। সব জানিস। তাই বলে কী আমি তোর বাবার সংসার করিনি? মাটি কামড়ে থাক। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
তুলি মাকে টাকার কথা বলতে পারলো না। ঘরে চুপ করে বসে থাকলো। তাহেরা বানু এসে বললেন, কাজ কী কিছু জানো? না, কাজ করতে কষ্ট হয়? ঘরের বৌয়ের কাজ কী বলোতো?
তুলি কাজে গেলো। কাজে ওর মন বসে না। মনে শান্তি না থাকলে কাজে কী মন বসে? ঘরে এসে অতীত দিনের ছবিগুলো ও দেখতে লাগলো, বললো, তুমি আছো, তুমি আমার আয়ত্ত্বের মধ্যে নেই।
তমালের বন্ধু তরুণ তমাল তুলির প্রেমে অনেক সাহায্য করতো। আজ দেখতে এসেছে, তুলি বললো, আপনার বন্ধু সময়ের সাথে সাথে চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখন সে আমায় নাস্তানাবুদ করে সুখ পায়। আমাকে কাঁদিয়ে আনন্দের নৈবেদ্য খায়। আমার অন্তরের চিৎকার ধ্বনি ও শুনতে পায় না। আমার আর্তস্বরে ওর হৃদয় বিদীর্ণ হয় না। ওর পাষণ্ডতার কারণে ও পৃথিবীতে কীর্তিমান হবে।
তরুণ বললো, ভাবী, আমি অধমটাকে বোঝাবো।
তরুণ তমালকে ধরলো, বললো, হৃদয়ের কাছাকাছির মানুষগুলোকে ভুলতে নেই, ভুলে থাকার চেষ্টা করতে নেই। ভুল বুঝতে নেই, কষ্ট দিতে নেই।
তমাল বললো, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সে সংগা তোর কাছ থেকে শিখতে হবে?
তরুণ বললো, তোর হৃদয়টা অনেক বড় ছিলো। আমি জানতাম না তোর হৃদয় একটা লোহা, দু দিনেই মরীচা ধরবে।
তমাল বললো, জ্ঞান দিতে চাস তো বিদ্যাপীঠে যা। জ্ঞানের কথা অজ্ঞানদের বল্। জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে খেতে এখন আমার বিষবমি হয়।
তরুণ বললো, ভাবীর চোখে পানি। এক ফোঁটা চোখের জল হৃদয় ফেঁটে বের হয়। যাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারবি না, তাকে তোর স্বপ্ন দেখানো উচিত হয়নি।
তমাল প্রচণ্ড রেগে তরুণের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে বাড়ি এলো, তুলিকে ধরলো, তোমায় উকিল ধরতে বলেছে কে?
তুলি স্বামীর ক্রোধাগ্নি দেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরে বললো, তরুণ ভাই কল করে বললেন তুমি তাঁকে নাকি কষ্ট দিয়োছো? নতুন নতুন বন্ধু করো, ভালো। কিন্তু পুরাতনকেও রেখো। নতুন হলো সীসা আর পুরাতন হলো সোনা।
তমাল বললো, কোনো কথা বলবে না এ বিষয়ে। এত জ্ঞানগর্ভ কথা বাদ দিয়ে সামনে থেকে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।
তুলি চুপ থাকে আর আশ্চর্য হয়। যে মানুষটা তাকে এত ভালোবাসতো, এত স্বপ্ন দেখাতো, এত আশা জাগাতো সেই মানুষটি এখন কত বদলে গেছে। মানবিক বৃত্তিগুলো সময়ের বিবর্তনে পাশবিক বৃত্তি হয়ে গেছে। নির্বাক চিত্তে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে। যার চেতনা চৈতন্যের গভীরে যে ছিলো তাকে আজ সহ্যই হয় না।
পরদিন তিন্নিকে ফোন দিলো, তিন্নি, বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে নিজের মত-পছন্দকে আমার প্রাধান্য দেয়া ঠিক হয়নি। আমি তাদের মনে আঘাত করেছি।
তিন্নি বললো, বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে পৃথিবীতে কেউ কোনো দিন সুখী হতে পারেনি, সুখী হতে পারে না।
তুলি বললো, তমালের ব্যবসায়ে ক্ষতি হয়েছে। আমায় কিছু টাকা দিবি? আমায় সাহায্য করার কেউ নেইরে।
তিন্নি বললো, সম্পর্কের মধ্যে টাকা চলে এলে সেটা আর সম্পর্ক থাকে না। আর টাকা দিয়ে সম্পর্ক কখনো টিকিয়ে রাখা যায় না। টাকা দিয়ে অট্টালিকা করা যায়, হৃদয় জয় করা যায় না।
তিন্নি কিছু টাকা দিতে সম্মত হলো। এরপর সে তুষিকে ফোন দিলো, বললো, দুর্ভোগে আছি, দুর্দিন যাচ্ছে। আমায় কিছু টাকা দিবি বন্ধু? দুর্যোগ থেকে বাঁচা!
তুষি বললো, তোর লোভী আর জ্ঞানপাপী স্বামীর কথা তিন্নির কাছ থেকে শুনেছি। আসলে বড়দের আশীর্বাদ ধন্য না হয়ে কাজ করলে ফল কখনো অনুকূলে আসে ন। তোর স্বামী স্বার্থাণ্বেষী, সভ্য শয়তান।
তুষিও কিছু টাকা দিতে রাজী হলো। দুই বান্ধবীর কাছ থেকে টাকা এনে তমালকে দিলো। তমাল টাকা দেখে থমকে গেলো। তুলির চোখের দিকে বেশক্ষণ চেয়ে থাকলো। তারপর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বললো, সাংঘাতিক সৌন্দর্য দিয়ে নজর ভরে, পকেট ভরে না। ভালোবাসায় মন ভোলে, ভাগ্য বদলাতে চায় টাকা।
তুলি বললো, অদৃষ্ট টাকাতে বদলায় না, অদৃষ্ট বদলাতে আশীর্বাদ লাগে, ভালোবাসা লাগে। আর অধিক সম্পদের লোভে যারা হন্যে হয়ে ছোটে তারা মানসিক রোগী হয়। অল্পতে তৃপ্ত অল্পজনই থাকতে জানে।
তমাল তুলির এসব কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। তা দেখে তুলি বললো, অন্তঃপুরেই তোমার কেবল আধিপত্য। আর বাইরের জগতে লেজ গুটানো কুকুর। মানুষ নামের কলঙ্ক। মুখোশ আটা শয়তান। আমার দু কূল ডুবিয়ে আমায় নিয়ে ছিনিমিনি খেলো। প্রতিটি পাপী প্রাণ পৃথিবীতে পাপের পরিপূর্ণ দণ্ড পাবে।
তমাল ওদিন তুলিকে না মেরে পারেনি। কিন্তু তুলি কাঁদেনি। ও কাঁদতে ভুলে গেছে। ও জেনে গেছে চোখের জলের মূল্য অনেকে দিতে জানে না। ওদিন রাতে তমাল বাড়ি আসেনি। তুলি তমালের শার্ট প্যান্ট লুঙ্গি বুকে জড়িয়ে রাত জেগে কাটিয়ে দিলো। এতে যে ও তমালের শরীরের গন্ধ পায়, তমালের অস্তিত্ব অনুভব করে।
তারেক তমাল তুলির সব কথা জানে। তরুণও তারেককে সব বলেছে। একসাথে বড় হয়েছে। একের দুর্দিনে অন্যজন তাই ছুটে আসে। সব ঋতুর কোকিল যারা তারা বসন্তের কোকিল হয় না। প্রকৃত বন্ধুজন দুর্দিনেও দু হাত বাড়িয়ে দেয়। তমালকে বললো, হাজার হাজার টাকা, সোনার গহনা, জামা কাপড় বিলাস সামগ্রী দিয়েও বর্তমান সমাজে স্বামী সমাজ একটু ভালোবাসা পায় না। সময় সুযোগ পেলেই পরপুরুষকে সময় দেয়। আর তুলি ভাবীর মত নির্ভেজাল, নিষ্পাপ, নির্লোভী ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দিস? ও ভালোবাসা ছাড়া তোর কাছে আর কিছু কী চেয়েছে?
তমাল বললো, আমি যে ওকে কষ্ট দিই তোকে বলে কে? আমার কাজ নেই? বিয়ে কর বুঝবি জীবন কী! সারাদিন ওর আঁচল ধরে বসে থাকবো? ও চায় ওর সাথে সারাদিন খুঁনসুটি করি, বসে বসে প্রেমালাপ করি, ওকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। ও বাস্তবতা মানতে চায় না। ওকে সময় দেয়ার সময়টুকু আমার নেই। দশটা টাকা যারা ইনকাম করে প্রেমালাপ তারা ভুলে যায়। ও ওর সব বন্ধুদের, আমার সব বন্ধুদের মাঝে আমার সম্বন্ধে দুর্নাম ছড়াচ্ছে। ওকি সত্যিই আমায় ভালোবাসে, না আমার কাছ থেকে ও চলে যেতে চায়? আমি তো প্যান্ট শার্ট পরে ওর সাথে দেখা করতে যেতাম, এখন বাসায় লুঙ্গি পরে থাকি, আমাকে কী ওর আর ভালো লাগে?
তমালের কথায় তারেক আশ্চর্য হয়। তমাল বাড়ি চলে এলো। তুলি ঘরে বসে আছে। তমাল বললো, তুমি সংসার করার তাগিদে বিবাহ করেছো? না, বিনোদনের জন্য বিবাহ করেছো? সংসারের কোন কাজটা তুমি করো?
তুলিও কম বলে না, বললো, আমার সংসারের কাজ আমি করবো, আমার সংসারকে স্বর্গ করে তুলবো সে স্বপ্ন আমার ছিলো। আমার কথা হলো রাজরানী করবে বলে যাকে কথা দিয়েছিলে সে আজ তোমার কাছে দাসী অপেক্ষা অছ্যুৎ কেনো? ভালোবাসার উল্টো পিঠে ঘৃণা থাকে। প্রবল ঘৃণা। তুমি ঘৃণা প্রাপ্তিরও যোগ্য না।
পাড়া প্রতিবেশীরাও ওদের আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করেন। তুরাবের মা বললেন, খালি আঁচলে গিরা আটে? লক্ষ লক্ষ টাকা যৌতুক দিয়ে তাই শ্বশুর শাশুড়ীর মন পাওয়া যায় না।
তৌহিদের মা বললেন, শিক্ষিতা বৌমা, চাকরিজীবী তো না। পায়ের উপর পা তুলে সাজগোজ করে। বাড়ির কুটো কেটে দুটো করে না। তাহেরা ভাবীর কপালে এই জঞ্জাল ছিলো? হুরপরী দিয়ে কী হবে অকর্মের হলে! কাজের হলে কালো চলে; সুন্দরী যদি কুলক্ষণে হয় সেই সুন্দরী দিয়ে কী হয়?
এমন গুঞ্জণ সারা গ্রামে রটে গেলো। তুলি কান ঢেকে থাকে, চোখ বুঝে থাকে। তিন্নিকে কল দিলো, তিন্নি বললো, নারীর কোনো নিজের ঘর নেই। অন্যরা যদি আপন করে নেয় তবেই সে মাথা গোজার ঠাঁই পায়। যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকলে আমার কাছে চলে আয়। আমার সাথে কাজ করবি। তোর অন্নের অভাব হবে না। তমালের আশায় ঘর ছেড়েছিলি, ঘর পাসনি। আমার কথায় ঘর ছাড়, তোর ঘর হবে, টাকা হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণা হবি। স্বয়ংসম্পূর্ণা হলে অন্যের আশায় চেয়ে থাকতে হবে না। অর্থহীন জীবন অর্থহীন।
তুলি তিন্নির কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। কিন্তু ওর মন সায় দিলো না। বেশ রাতে তমাল এলো। তুলি বললো, রাত বিরাত বাইরে থাকো কেনো? বিপদ আপদ বলে আসে না। খবরদার রাতে বাইরে থাকবে না।
তমাল বললো, আমি কারো খবরদারী পরোয়া করি না। আমার ভালো মন্দে নাক না গলালে খুশি হবো। অনর্থক গাল বাড়ায়ে দিলে চড় খাবে। অনধিকার চর্চা আমি পছন্দ করি না। সহ্য করি না।
তুলি আশ্চর্য হয়। কোনো কথা বাড়ালো না ও।
ঘুম থেকে উঠে তমাল দেখলো তুলি নেই। তমালের ভয় ধরে গেলো, গেলো কোথায় ও! মাকে বিষয়টি বললো, তাহেরা বানু শুনে বললেন, হতভাগা যাবে আর কই? যাওয়ার কোনো জায়গা আছে কী ওর?
তালেব সাহেব বললেন, পাপ বিদায় নিয়েছে। পথের পতঙ্গ পথে ফিরে গেছে। পথের উচ্ছিষ্ট কুঁড়িয়ে খাওয়া পতঙ্গ সংসারে মন বসাতে পারে না।
তমাল চিন্তিত হলো। ভাবলো, ওর স্বপ্নগুলোকে ছিনতাই করে ওকে বাঁচার আশা শেষ করে দিয়েছি। যার যাওয়ার কোনো গন্তব্য নেই সে গেলো কোথায়? আমার তুলি পথে পথে পাগলের মত ঘুরবে?
তমাল পরিচিত সবার কাছে কল দিলো। কোথাও সে যায়নি। তাশদিদের মা বললেন, দেখ্ আবার কার হাত ধরে পালালো? এমন রূপবানের কী রহিমের অভাব হয়?
তমাল বললো, কাকী, টিপ্পনি কাটা আপনার কাজ না। আপনি আমার শ্রদ্ধেয়জন।
তপুর মা বললেন, বিষ খেলো, না নদীতে ঝাঁপ দিলো দেখ্।
তমাল তুলির খোঁজে বের হয়ে গেলো। তালহা যাচ্ছিলো। তার কাছে জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো, বৌ ঘর থেকে পালায়! কেমন পুরুষরে তুই?
তমাল তালহার কথায় কর্ণপাত না করে তিন্নিকে কল দিলো। তিন্নি বললো, কাউকে জীবন দিতে না পারলে স্বপ্ন দেখাতে নেই। মনের মাঝে প্রতারণার বীজ থাকলে সে পশু বৈ কিছু নয়। এমন একটা মানুষ যে কেবল ভালোবাসার ভিখারী ছিলো তাকে যেমন ইচ্ছা তেমন করে কষ্ট দিয়েছেন। একটা নারী কখন তার স্বর্গ সংসার ছাড়ে? মানবিক বৃত্তি মনের মাঝে না থাকলে সে ব্যক্তি মানুষ না, অমানুষ। অমানুষ সবার ঘৃণার পাত্র। মনের মধ্যে ব্যাধির বাস, স্বপ্নচাষ তারা জানে না।
তমাল তুষিকে কল দিলো, তুষি বললো, মরচে ধরা মনটাকে ঘষামাজা করেন। ভালোবাসা ঠুনকো নয়। ভালোবাসা নেহাতই তাসের ঘর নয়। আত্মার বন্ধন কেবল কল্পনা বিলাস নয়। এবার তো আপনি পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি পাচ্ছেন! তাপিত তৃষ্ণার্ত হৃদয় তৃপ্ত হলো! পথের কাটা সরে গেছে, আবার বিবাহ করেন। স্বপ্ন ভাঙায় যাদের কাজ তাদের আবার হৃদয়! স্বপ্নবতী মানুষটার স্বপ্ন ভেঙে চুরে শেষ করে দেছেন। রূপবতী অনেক পাবেন, তুলির মত হৃদয়বতী আর পাবেন না। জুহুরীর চোখ না থাকলে সোনাকে সবাই তামা জ্ঞান করে ফেলে দেয়। আর শেষে অাফসোসই সম্বল হয়।
তমাল আশাহত হলো। তরুণ আর তারেককে জানালো না। তুহিনকে বললো। বাসস্টান্ডে ওদের বাসা। যেতে দেখেছে কিনা তাই জিজ্ঞাসা করলো। তুহিন মশকরা করলো। বললো, রিক্সাওয়ালাদের বৌ ঘর ছাড়ে না, তোর বৌ ঘর ছাড়ে কেন? সাজগোজ পোশাক আশাকে কী বাজখাই তৃষ্ণা মেটে?
তমাল তুহিনের কল কেটে দিলো। বাবা মায়ের কাছে গেলো না তো! শ্বশুর-শাশুড়ী এমনিতেই রেগে আছেন। আর এই মুহূর্তে গেলে ওর তো ঠ্যাং ভেঙে দেবেন। একটি বার তুলি কল রিসিভ করছে না। অনেক গুলো মেসেজ লিখলো। কোনো উত্তর এলো না।
এভাবে বেশ কদিন চলে গেলো। তরুণ আর তারেকও জেনে গেলো। ওরা দুজন তুলিদের বাড়ি গেলো। তুলির বাবা তাসকিন সাহেব তরুণ আর তারেককে ভেতরে যেতে দিলেন না। বললেন, তোমরা সবাই মিলে আমার মেয়ের জীবনটাকে শেষ করে দিলে। আবার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করেছো। তোমাদের পুলিশে দেবে।
তরুণ বললো, প্রথম ভুলটা ভুল ছিলো। কিন্তু পরের ভুলগুলো ভুল নয়। আপনি বিবাহটা মেনে নিলে ঘটনা এত দূর গড়াতো না। পারিবারিক মতভেদ ওদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে।
তাসকিন সাহেব রেগে গেলেন। তরুণ আর তারেক সেখানে আর থাকতে পারলো না। তমালকে কল দিলো, তোর বৌ তোর শ্বশুরবাড়ি।
তমাল এতক্ষণে স্বস্তিশ্বাস ফেললো। আর ভাবলো, দু দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। রাগ চলে গেলে চলে আসবে।
তমাল নির্ভার হয়ে বাজারে গেলো। কিন্তু সব সময় তুলিকে অনুভব করে। দু দশ মিনিট পরপর কল দিতো। এখন আর প্রিয় নম্বরটি থেকে কল আসে না। ওর জন্য অপেক্ষা করতো, এখন কেউ অপেক্ষা করে না। ঘরটাও কেমন শূন্য শূন্য লাগে। অস্থিরতা কাজ করে। ঘর বাড়ি, উঠোন বারান্দা সবখানে তার অস্তিত্ব অনুভব করে। কল করলে কল রিসিভ হয় না। কাছে থাকতে কদর করেনি, দূরে গেলে এত দরদ ওর প্রতি কোথা থেকে এলো?
তমাল তুলিকে আনতে যাবে। তালেব সাহেব বাঁধা দিলেন, দরকার নেই যাবার। আপদ গেছে। ও মেয়ের সংসার করার কোনো জ্ঞানই নেই। স্বামী, সংসার,আমরা তার কাছে তুচ্ছ।
তমাল কিছু বললো না। তাহেরা বানু এসে বললেন, যে থাকতে চায় না তাকে আনার দরকার নেই। এ ক মাসে তো বৌমার রূপ চিনেছি। যে তার পথ চিনে নিতে জানে তাকে আর ফিরিয়ে লাভ নেই।
তমাল নিজে নিজে মূর্ছা যায়। এ পরিবারে তিনটা মানুষের আনুকল্য তুলি পায়নি। নিজেই নিজেকে অপরাধী করতে থাকে। তাহেরা বানু কর্কশ আওয়াজে বললেন, দোকানে যা, ব্যবসায়ে মনোনিবেশ দে।
তমাল বাইরের উদ্দেশ্যে বের হলো। কিন্তু যে ব্যবসায় তার কাছে মূখ্য ছিলো, তা তার কাছে গৌণ বোধ হচ্ছে। আর যাকে গৌণ জ্ঞানে ফেলে রেখেছিলো তাকেই বারবার মনে পড়ছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো শ্বশুরালয়ে যাবে।
তমালকে দেখা মাত্রই তুলি মায়ের বুকে মুখ লুকালো। তাসকিন সাহেব তমালকে দেখা মাত্রই দু গালে দু থাপ্পড় মেরে দূর হয়ে যেতে বললেন। তমালের নজর শ্বশুরের দিকে না যেয়ে তুলির দিকেই পড়ে আছে। তুলি ফুপিয়ে কেঁদে বললো, লোকটিকে চলে যেতে বলো মা, খুব হিংস্র ও, ওকে দেখলেই আমার ভয় পাচ্ছি৷ দৃশ্যত ওকে চেনা যায় না, ও মুখোশ আটা।
তমাল অপরাধের সুরে বললো, আমি তোমাকে নিতে আসিনি, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। তোমার প্রতি দাবি নেই আবার, তোমার প্রতি অধিকার হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমি নিজেকে নির্দোষ দাবি করিনি, আমি তোমার চোখে না সবার চোখেই অপরাধী। তুমি ছাড়া প্রিয় কেউ নেই তবুও তোমাকেই অসহায়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার ব্যস্ততা, তোমার প্রতি আমার উদাসীনতা, আমার পরিবারের অবহেলা তোমার সংসার ছাড়ার কারণ হবে কেনো? তোমার ব্যর্থতা তোমার সহ্য ছিলো না, তোমার ব্যর্থতা তোমার ধৈর্য ছিলো না, তোমার ব্যর্থতা তোমার মহাশ্বৈর্য দিয়ে সবাইকে আগলে নাও নি।
তুলি মুখ তুলে চেয়ে বললো, প্রহার সহ্য করা যায় অগণ্যতা সহ্য করা যায় না, অপেক্ষা সহ্য করা যায় অবমূল্যায়ন সহ্য করা যায় না, অভিমান সহ্য করা যায় অবহেলা সহ্য করা যায় না, ব্যস্ততায় সৃষ্ট শূন্যতা সহ্য করা যায় উদাসীনতা সহ্য করা যায় না। তোমাকে ভরসার অন্য নাম ভেবেছিলাম কিন্তু হয়েছো দুরাশার অন্য নাম।
তাসকিন সাহেব গর্জে উঠে বললেন, যাবি হারামি?
এ কথা বলেই তিনি পুলিশে খবর দিলেন। তৃষ্ণা তমালকে অনুরোধ করে বললেন, বাবা, তুমি চলে যাও। পুলিশ এলে ধরে নিয়ে যাবে।
তমাল তবুও গেলো না। জলচোখে বললো, মা, তুলিকে বিয়ে করার পর আমি জলন্ত লাভার মাঝে পড়ি। দিনরাত পরিশ্রম করি। আমাকে সাহায্য করার একটা মানুষও ছিলো না। আমাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবে এমনও কেউ পাশে ছিলো না। আমি ব্যবসায়ে ধরা খেয়েছি। তুলি আমার জন্য ধার-দেনা করেছে। আমি ভাবতেই পারিনি সেই তুলি আমার পাশ থেকে সরে যাবে।
পুলিশ এসে তমালকে ধরলেন। বড় অফিসার দাঁত সিটকিয়ে বললেন, নারী নির্যাতন? চল্।
পুলিশ তমালকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। তমাল কোনো এক আশায় পিছে চেয়ে আছে, আর ভেবেছে হয়ত তার ভালোবাসার মানুষটা সব ভুলে বাঁধা দেবে। কিন্তু তুলি তা করলো না। শুধু শাশুড়ি মা তমালের চরম পরিণতি দেখে দু ফুঁটা চোখের জল ফেলেছেন।
------------------------------------
সৌমেন দেবনাথ
যশোর, বাংলাদেশ।