পূর্ব কথন
গ্রামের সুন্দর ভোরবেলায় রাজেন ঠাকুর পুজোর আয়োজন করেন। সাহায্য করে ঝিনটি। বাবার আদরের ঝিনুক। ওর আজ খুব মন খারাপ, মননের জন্য। এর মধ্যেই এসে উপস্থিত হয় বহুরূপী শম্ভু। এর পরই বাড়ির বেড়ার দরজার পাশে ঝিনটির আর্তনাদ, সামনে মুখোমুখী ফনা উদ্যত বিষধর সাপ।
পর্ব ৮
ঠাকুরমশাই, যাবেন না, আমি দেখছি - শম্ভুর চিল চিৎকারে কান দেন না নিধু ঠাকুর। উদ্যত বিষধরের সামনে প্রাণাধিকা কন্যার অসহায় আর্তি তাঁকে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য করেছে। মেয়েকে বাঁচাতে নিরস্ত্র অবস্থায় তিনি ছোটেন বেড়ার দরজার দিকে। শম্ভু কালবিলম্ব না করে দাওয়ার কোণে পড়ে থাকা ছোট শাবলটি হাতে নিয়ে তীব্র গতিতে নিধু ঠাকুরকে টপকে এসে উপস্থিত হয় ঝিনটি আর সাপের ঠিক মাঝখানে। সাপ শুনতে পায় না, কিন্তু পায়ের চাপে মাটি ও শুকনো পাতার আলোড়ন তার আদিম ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তোলে।
কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে আত্মরক্ষায় মানুষও খুঁজে পায় তার আদিম প্রবৃত্তিকে। শম্ভুর হাতের শাবল সজোরে বিদ্ধ করে সাপটিকে মাটির সাথে। অচেতন ঝিনটি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
এরপরই ঘটে অভাবনীয় ঘটনা। নিধু ঠাকুর দৌড় থামাতে পারেন না। পায়ে ধুতি জড়িয়ে আছড়ে পড়েন সাপটির সামনেই। তীব্র আক্রোশে আর যন্ত্রণায় মৃত্যুর আগে শেষ ছোবল বসায় সাপটি নিধু ঠাকুরের পায়ে। দুবার হেঁচকি তুলেই তীব্র বিষে নিথর হয়ে যান নিধু ঠাকুর। মৃত্যুর কোলে নেতিয়ে পড়ে সাপটিও। বিস্ফারিত চোখে শম্ভু হাহাকার করে কেঁদে ওঠে - ঠাকুরমশাই। সেই চিৎকারে জ্ঞান ফিরে পেয়ে কোনক্রমে দাঁড়িয়ে ওঠে ঝিনটি। চোখের সামনে বাবার মুখে গ্যাজলা ওঠা শায়িত দেহ আর শাবলে গাঁথা সাপটিকে দেখে আবার জ্ঞান হারিয়ে শম্ভুর কোলে লুটিয়ে পড়ে কিশোরী মেয়েটি।
ইতিমধ্যেই গ্রামের বেশ কিছু মানুষ ভিড় করে ফেলেন সেখানে। সে সময়েই নিলেশ কম্পাউন্ডার সাইকেল চড়ে আসছিল।সূর্য ডাক্তারের চেম্বার খুলতে হবে সকাল সকাল। তারই তৎপরতায় নিধু ঠাকুর আর ঝিনটিকে নিয়ে সবাই পৌঁছে গেল ডাক্তারখানায়। সূর্য ডাক্তার খুব বিষণ্ণচিত্তে জানালেন, নিধু ঠাকুর চিরবিদায় নিয়েছেন। ঝিনটি প্রাথমিক চিকিৎসার পরই সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে সে বাবার বুকের উপর।
গ্রামের লোকের তৎপরতায় দাহকাজ শেষ হতে হতে রাত্রি হয়ে যায়। ঝিনটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের বাড়ি নিয়ে যান রাজলক্ষী দেবী। কাঁদতে কাঁদতে ক্রমেই নেতিয়ে পড়ে মা-বাবা হারা অসহায় মেয়েটি। ডাক্তার সূর্য শেখর একটি ওষুধ খাইয়ে দেয় তাকে। বলে মা, ও এখন ঘুমিয়ে পড়বে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দাও।
এদিকে বহুরূপী শম্ভু একাই চুপ করে বসে থাকে নিধু ঠাকুরের দাওয়ায়। দুপুরে চেম্বার বন্ধ করে ফেরার সময় নীলেশ সাইকেল থেকে নেমে পড়ে। শম্ভুর পাশে বসে বলে - সেই থেকে ঠায় বসে আছো বহুরূপী। যা হবার হয়েছে। এখন চল আমাদের বাড়ি, দুটো মুখে দাও যা হোক।
শম্ভু দুদিকে মাথা নাড়ে। তারপর বলে, না ভাই। আমার সামনেই আজ নিধু ঠাকুর চলে গেলেন মিষ্টি মাকে একা ফেলে। জানিনা এই গ্রামে আসব কিনা।
কোন উত্তর দিতে পারে না নীলেশ। সে তাকিয়ে থাকে তার চলে যাবার দিকে।
ক্রমশঃ