উৎসবের সকাল। আকাশে বাতাসে একটা আশাময় শোভা ছড়িয়ে আছে।শ্বাসের সাথে সেই স্নিগ্ধতার আস্বাদন ঘটে যাচ্ছে মনে মনে।ছেলেটা অন্যদিনের মতো এদিনও এসেছে,কার্তিক পুজোর সকালে।
তার কোন নাম নেই।আমি অবশ্য কখনো তার নাম জানতে পারিনি।আচ্ছা,গল্পের খাতিরে তার একটা নাম দেওয়া গেল।তার নাম কার্তিক।দেউলতলার কলোনিতে তাকে দেখেছি।চালের পাঁপড় বিক্রি করতে আসতো।কার্তিকের মুখে ছিল একটা নিথর নীরবতা।অনেকটা তপস্বীর মৌন মুখের মেদুরতার মতো।চোখে ছিল একরাশ উজ্জ্বল চঞ্চলতা।
এদিন টিউশন পড়িয়ে ফিরছি,শোনা গেল পাঁপড়ওলা কার্তিক এক অসম্ভব কাণ্ড করেছে।কলোনির এক আবাসিক সত্যবাবুর ছেলেটাকে সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি ভিড় দেখে ব্রেক কষলাম সাইকেলের। উল্টোদিক থেকে আসা ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলাম-
-'কী হয়েছে কাকু? কী ব্যাপার?'
-'আর বোলো না।ও বাড়ির বাচ্ছাটা সবে হাঁটতে শিখেছে। আর তোদেরও বলি বাপু,দুধের বাচ্ছা, একটু নজরে রাখবিনি। সেতো দরজা খোলা দেখলে বেড়োবেই'।
-'বাচ্ছাটা বোধহয় রাস্তায় চলে এসেছিল?'
-'শুধু রাস্তায়?,রাস্তা টপকে হোথায় বেনে পুকুরে ডুবে মরছিল আরকি! ভাগ্যিস ছেলেটা দেখল নয়তো আজ কি ঘটনাটাই না ঘটত।'
সকলে কার্তিককে ধন্যবাদ দিল। সবার মুখে এক কথা ঘুরছে।ভাগ্যিস এই ছেলেটা দেখেছিল। সময়মতো ছুটে গিয়ে ডুবে যাবার আগেই ধরে ফেলেছিল।
কলোনিতে পুজোর মণ্ডপ হয়েছে। সত্যবাবু নিজে উদ্যোগ করে প্রতি বছর এই কলোনিতে কার্তিক ঠাকুর আনেন। বেশ ধুমধাম করেই করান পুজো। আজ একি হতে যাচ্ছিল। তার নিজের ঘরের কার্তিককেই তিনি হারিয়ে ফেলতে বসছিলেন।তিনি একবার বাড়িতে গেলেন তারপর ফিরে এসে একটা কড়কড়ে এক হাজার টাকার নোট কার্তিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন
-'এটা রাখ।কাজে লাগবে'।
উৎসবপ্রিয় বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন,বারো মাসে তেরো বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে প্রকৃতিঋতুরও পালাবদল ঘটে চলে।ঘড়ির কাঁটার মতো এক ঋতু আসে আর এক ঋতু যায়।এভাবেই দুটো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল।পাঁপড়ওলা ছেলেটা আর আসেনা।তার কথা একপ্রকার ভুলেই গেছি।আমারও টিউশনির একটু পসার হয়েছে। কিছুটা নিজের রোজগার আর কিছুটা বাবার টাকায় একটা বাইক কিনেছি।কার্তিক পুজোর বিকেল বেলা। আকাশটা নিম্নচাপের কারনে গুমোট করে আছে।বেড়োব কি বেড়োব না ভাবতে ভাবতে বাইকটা নিয়ে বেড়িয়েই পড়লাম। দেউলতলায় আসতেই দেখি হইহই ব্যাপার।বাইক থামিয়ে জটলার মধ্যে ঢুকলাম।দেখি,একটা ছেলেকে সবাই শাসাচ্ছে। দু-একটা চড়চাপড়ও দিচ্ছে।
আরে এতো সেই ছেলেটা, পাঁপড় বিক্রি করতে আসতো।দেখতে অনেক পালটে গেছে।কিন্তু একে মারছে কেন?
আমি কৌতূহলী হয়ে সামনের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম-
-'কী হয়েছে কাকু?কী ব্যাপার? ছেলেটাকে মারছে কেন?'
-মারবে নাতো কি পুজো করবে?মণ্ডপের ভেতর কুণ্ডুবাবুর মানিব্যাগ চুরি করতে গিয়ে একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়েছে'।
সেকি দৃশ্য! সবাই তাকে শাসাচ্ছে -
-'বল,কেন করেছিস বল? আর করবি, বল?'
ছেলেটা অনুনয়ের সুরে বলছে-
-'সত্যি বলছি।কী করে করলুম বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস করুন। কী করে করলুম বুঝতে পারিনি'।
আমি আর সময় ব্যয় না করে নিজের গন্তব্যে এগিয়ে চললুম। হেমন্তের আকাশ এখনো মুখভার করে আছে।তার কখন কেমন স্বভাব।বোঝা দায়।
-------------
আঙ্গারু,ধনিয়াখালি,হুগলি
৯৫৬৪৮৭৩৪১৮