একটি নষ্ট ছেলের গল্প
ডঃ রমলা মুখার্জী
হেমন্তের পড়ন্ত বেলা। অন্যান্য বছরে এ সময়ে শীত পড়ে যায়। কিন্তু এ বছর যেন শীতের দেখা নেই। তার ওপর ট্রেনটাও আসতে খুব দেরী করছে। সেঁজুতি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে কোন সিট খালি নেই। এগিয়ে যায় টি স্টলের দিকে। রাজুর স্টলে এক কাপ চা খেয়ে প্লাটফর্মে পায়চারি করতে আরম্ভ করে সে। যা ভীড়, চলাফেরা করাও খুব অসুবিধে। শরীরটা আজ তার বড় ক্লান্ত। প্রায় একমাস ছুটির পর আজ কলেজ খুলল-কিন্ত সব ক্লাসের পর আবার মদনবাবুর প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসও হল।অন্য বন্ধুদের কাছেই বাড়ি। ব্যান্ডেল লোকালে তারা সব চলে গেল। বর্ধমান লোকালে একা একা সেঁজুতি বাড়ি ফেরে। বন্ধুদের সঙ্গে ব্যান্ডেলে চলে আসে সে, তারপর প্রতীক্ষা করে কখন তার ট্রেন আসবে। দূর হলেও উপায় নেই সেঁজুতির, সরকারি কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পড়ার সুযোগ যখন পেয়েছে তখন পিছিয়ে আসাটাই বোকামি। পড়াশোনায় বরাবরই সেঁজুতি বেশ ভাল। অনেক বড় হবার স্বপ্ন তার কালো গভীর চোখে খেলা করে। সেঁজুতির দিদির বিয়েতে ইতিমধ্যেই সেঁজুতির বাবার কিছু ধার দেনা হয়ে গেছে। সেঁজুতিকে ভাল ভাবে পাশ করে একটা চাকরি পেতেই হবে। হঠাৎ তার স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, চেঁচিয়ে ওঠে সে, পড়ে যায় প্লাটফর্মের ওপর। যে ছেলেটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে সেঁজুতি পড়ে যায় তাকায় তার দিকে। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু ছেলেটি ব্যস্তভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করছে, একবার "দুঃখিত" বলারও কোন প্রয়োজন বোধ করছে না। সেঁজুতি ধুলো ঝেড়ে উঠতে উঠতে বলে "আরে সুধীর না"? ছেলেটিও থমকে গিয়ে পিছন ফিরল, সেঁজুতিকে দেখে বলে "সুজি না? এখানে একা একা কি করছিস?" শেষের কথাটায় যেন ধমকের সুর। সেঁজুতি হেসে বলে "চিনতে পেরেছিস তাহলে? তোর সেই পাকামো করা স্বভাবটা আর গেল না। এখন তো আমি কলেজে পড়ি, সেই ছোট্ট সুজি আছি নাকি?"
সুধীরও একমুখ হাসি নিয়ে বলে, "বাবা! তোকে আবার চিনতে পারবো না। ছোটবেলায় তোকে সুজি বলে ডাকলে তুই রেগে গিয়ে বলতিস- মেরে হালুয়া করে দেব।" দুজনেই খুব হেসে উঠল। তারপর সুধীর গলা নামিয়ে বলল, "তুই কলেজে পড়ছিস শুনে খুশি হলাম। আমার তো আর পড়া হল না"। "কেন রে পড়লি না কেন?" সেঁজুতির জিজ্ঞাসা। "তুইতো জানিস ছোটবেলা থেকেই পড়াতে আমার এলার্জি", সুধীর উত্তর দেয়।
'তা এখন কি করছিস?'
'ঐ একটা ব্যবসা মত আর কি।'
'কিসের ব্যবসা রে?'
সুধীর একটু চমকে আমতা আমতা করে, "এই অর্ডার সাপ্লাই এর কাজ আর কি।'
কথাবার্তার ফাঁকে সেঁজুতি লক্ষ্য করছিল সুধীরকে, কেমন যেন রুক্ষ সুক্ষ্ম চুল, পরনের জামাকাপড়ও ময়লা। হঠাৎ মস্তান-গোছের দুটো ছেলে এসে সুধীরকে যেন জোর করে নিয়ে গেল। যাবার সময় সুধীর সেঁজুতিকে বার বার সাবধান করে দিল যাতে সে এই প্ল্যাটফর্মে সন্ধ্যেবেলায় একা একা না ঘোরে, ওয়েটিং রুমে বসে থাকে, প্ল্যাটফর্মটা নাকি ভাল নয়। সেঁজুতি আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকে সুধীরের কথা। এ কি ছেলেবেলার সুধীর! কত ভাল চাকরি করতেন ওর বাবা। সুধীরের মা সুধীরকে সুন্দর জামা পরিয়ে সবসময় পরিছন্ন করে রাখতেন। সেঁজুতির চিন্তা সূত্র ছিন্ন হল রাজুর ডাকে। রাজুর স্টলেই চা খায় সেঁজুতি। রাজু জিজ্ঞাসা করে, দিদিভাই, আপনি যে ছেলেটির সঙ্গে কথা বললেন তাকে চেনেন? সেঁজুতি দ্বিধা ভরে উত্তর দেয়, হ্যাঁ, মানে ছেলেবেলায় চিনতাম। ওর বাবা ব্যাঙ্কের বড় অফিসার ছিলেন। বদলির চাকরি। বছর তিনেক আমাদের বৈঁচীতে থাকার পর কোথায় যেন সুধীররা বদলি হয়ে চলে গেল। আজ অনেকদিন বাদে দেখলাম। রাজু বলে, ছেলেটির বিষয়ে আপনি তাহলে কিছুই জানেন না। ছেলেটা ভাল নয় দিদিভাই।
"একথা কেন বলছ রাজু? সুধীর তো ব্যবসা করে," সেঁজুতি বলে।
"ব্যবসা-ট্যাবসা ওসব বাজে কথা, ছেলেটি একটা পাক্কা পকেটমার," রাজু জানায়। সেঁজুতি আঁৎকে উঠে বলে, "কি বলছ তুমি রাজু! সুধীর পকেটমার। আমি তো ভাবতেই পারছি না!"
রাজু আরও বলে, "খুব সাবধান দিদিভাই, ওদের একটা দল আছে।"
সেঁজুতিও লক্ষ্য করেছিল সুধীরের বন্ধুগুলোও কেমন যেন। কি মনে পরতে সঙ্গে সঙ্গে সেঁজুতি ওর ব্যাগটা দেখল। ব্যাগের চেন খোলা, মানিব্যাগটা উধাও। সেঁজুতি প্রায় কেঁদে রাজুকে বলে, "মানিব্যাগে আমার বই কেনার জন্য টিউশনির টাকা কটা রেখেছিলাম, কিন্তু মানিব্যাগটাই পাচ্ছি না।" রাজু বলল, "আর পেয়েছেন, ওই ব্যাটা পকেটমারটা ঝেড়ে দিয়েছে।" ততক্ষণে ট্রেন ঢুকে গেছে। সেঁজুতি ট্রেনে উঠে পড়ল। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে সুধীর এসে হাজির। সুধীরকে দেখে ভয়ে ঘৃণায় সেঁজুতির বাকরোধ হয়ে গেল। "পকেটমার" বলে চেঁচাতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। সুধীর সেঁজুতির কাছে এসে বলে, "সুজি, তোর একটা জিনিস বোধহয় পড়ে গিয়েছিল, নে, রেখে দে" সেঁজুতির মানিব্যাগটা সেঁজুতির হাতে গুঁজে দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে সুধীর নেমে পড়ল।
ট্রেন চলতে লাগল। সেঁজুতির মনের পর্দায় ভেসে উঠল অতীতের কত স্মৃতি। সরল, মাথামোটা গোছের ছেলে ছিল সুধীর। সেজন্য তাদের বন্ধুত্বের কোন ফাঁক ছিল না। সুধীরের দিদি প্রীতি ছিল অত্যন্ত মেধাবী। সুধীরের বাবা মা সবসময় সুধীরের বুদ্ধি কম হওয়ার জন্য দুঃখ করতেন, ওকে পড়াশোনার জন্য বড় চাপ দিতেন। সুধীরের বাবা অঙ্ক না পারার জন্য সুধীরকে প্রচন্ড মারতেন। সবসময় তারা তাদের বুদ্ধিমতী মেয়ের সঙ্গে সুধীরের তুলনা দিয়ে সুধীরকে শাসন করতেন। সেঁজুতির মনে পড়ল কাউকে না বলে সুধীর একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। সেঁজুতি সুধীরকে জিজ্ঞাসা করেছিল, "বাড়ি থেকে পালিয়েছিলিস কেন সুধীর?" সুধীর খুব দুঃখের সঙ্গে বলেছিল, "ওসব শক্ত শক্ত অঙ্ক আমার মাথায় ঢোকেনা। বাবা আমায় খুব মারে। মা সব সময় বকে, আমার বাড়িতে থাকতে একদম ভাল লাগে না। আমাকে নিয়েই তো যত অশান্তি। আমার না খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে।"
নিজের অজান্তে সেঁজুতির গাল বেয়ে নেমে আসে দু চোখের জল। সে ভাবে, "মাথামোটা সুধীরকে উচ্চশিক্ষিত করার প্রাণপণ চেষ্টা না করে যদি কোন হাতের কাজ শিখিয়ে বা অন্যকোন ভাবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতেন ওর বাবা তা হলে হয়তো সুধীর এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না। মানিব্যাগটা যেভাবে তুই আমায় ফেরত দিলি সুধীর, ঠিক সেই ভাবে তুই কি আর আমাদের কাছে, তোর বাবা-মার কাছে ফিরে আসতে পারিসনা? সুধীর, তুই ফিরে আয়, তোকে শক্ত পড়া পড়তে হবে না, শক্ত অঙ্ক শিখতে হবে না, কত কিছু করার আছে এই পৃথিবীতে। কাজের অভাব নেই, সুধীর ঐ কাজ তুই ছেড়ে দে, সুধীর তুই ফিরে আয়।"
-------------
ডঃ রমলা মুখার্জী
বৈঁচি, বিবেকানন্দ পল্লী
হুগলী, ৭১২১৩৪
হোয়াটসঅ্যাপ- ৯৪৭৪৪৬২৫৯০
মোবাইল- ৭০০৩৫৫০৫৯৫