তারক হালুই আর তার স্ত্রী নয়নতারা,ছেলেকে নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে আসার পর থেকেই ছেলেটা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। কিছু বললেই ঝাঁঝিয়ে উত্তর দেয়। কি হয়েছে কে জানে? কিছু ত বলছেও না। কারণ জানতে চাইলে ওই এক হুঙ্কার,তোমরা চুপ করো, আমাকে একা থাকতে দাও। আমার কোন ব্যাপারে তোমাদের নাক গলাতে হবে না। নিজেদের চরকায় তেল দাও। সন্তানের কথা মা বাবা ভাববে নাতো কে ভাববে? অথচ বাংলা নতুন বছরে সাতদিনের ছুটিও বেশ হৈ হৈ করে কাটিয়ে গেছে ছেলেটা। কিন্তু এবার কি হয়েছে কে জানে?
প্রায় দশটা বাজতে চললো,বাবু এখনও বিছানায়। মানুষটা সেই কোন্ ভোরে চাষের কাজে বেরিয়েছে। যাবার সময় বলে গেছে, কোন অশান্তি কোর না। এই তো আর ক'দিন পরেই ছেলেটা শহরে ফিরবে। কিন্তু মায়ের মন কি আর মানে? দিনের পর দিন ছেলে যদি এইভাবে মনমরা হয়ে পড়ে থাকে,সেকি ভাল লাগে?
--- বিজু, এবার উঠে পড় বাবা। একটু চা খেয়ে বই নিয়ে বোস। এবারে তো একদিনও বইয়ের পাতা খুলতে দেখলাম না। নয়নতারা ছেলের পড়ার টেবিলখানা গোছাতে গোছাতে বললেন।
মায়ের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল বিজু।
--- আমার লেখাপড়ার কথা তোমার না ভাবলেও চলবে। আমায় বিরক্ত কোর না।
--- তুই এইভাবে কেন বলছিস? তোর কি হয়েছে বল তো? কলকাতার হোস্টেলে কি কারো সাথে কোন গন্ডগোল হয়েছে? আমায় বল।
--- তুমি জেনে কি করবে শুনি। আমার কিছু হয়নি। এখন তুমি যাও। ছেলের মেজাজের পারদ আরো চড়তে পারে ভেবে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন নয়নতারা।
--- বিজন হালুই তুমি ফার্স্ট টার্মে কোন সাবজেক্টেই পাশ করতে পারোনি। পুজোর ছুটির এক মাস পরে সেকেন্ড টার্ম। তোমাকে অনেক খাটতে হবে।
--- স্যার, বলছিলাম পেপারগুলো বাংলায় লেখা যায় না? ইংরেজি লেকচার আমি একেবারেই ফলো করতে পারি না।
--- না, বাংলায় উত্তর লেখা চলবে না। তাছাড়া তুমি তো ইংরেজিতে ফর্ম ফিলাপ করেছিলে। যদিও পদবীর বানানটা ভুল লিখেছিলে।
প্রিন্সিপ্যালের রুম থেকে বেরনো মাত্রই বিজন হালুইকে ক্লাসের সবার তির্যক কথায় বিদ্ধ হতে হয়েছে। গ্রামের ছেলে,তাই প্রতি পদে হেনস্থা ছাড়া কিছুই জোটেনি।
বাবার দু বিঘার জমি বেচার টাকায় জোর করে শহরে পড়তে যাওয়া ভুল ছিল। গ্রামের পড়াশোনাটাই ঠিকমত হয়নি। ইংরেজির ই শেখা হয়নি তার। মাটি তো মায়ের আর এক রূপ। এই মাটিই তাকে জীবন দেবে।
--- কিরে,এত সকালে উঠে পড়লি? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন নয়নতারা।
--- আমাকে এই গ্রামেই থাকতে হবে। এখানে অনেক কাজ,যা বাবা এই বয়সে একা করে উঠতে পারে না। অঘ্রাণ মাস পড়ল,আলুচাষের মরশুম। আরো মাসখানেক আগে আসতে পারলে, দু দফা জমিচাষে বাবার কিছুটা সাহায্য হত।
--- কিন্তু তুই কলেজের লেখাপড়া ছেড়ে চাষবাস করবি? তোর কি হল,বলতো?
---- না,চারপুরুষের পেশাকে অসম্মান করে শিক্ষিত হতে চেয়ে আমি ভুল করেছি মা। তাছাড়া গ্রামের মাস্টারমশাইদের আমি ফাঁকি দিয়েছি। কিছুই শেখা হয়নি। এই বিদ্যায় শহর আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু আমার জন্মভূমি, গাঁয়ের মাটি বুকে টেনে নেবে। যে চাষের জমি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে,বাবা হাসি মুখে সেই জমি বেচেছে। আমিই তাকে বাধ্য করেছি। আর সেই টাকায় কিছু পালক কিনে আমার ময়ূর সাজার শখ হয়েছিল। ভুলে গিয়েছিলাম আমি দাঁড়কাক। আমাকে চিনতে পেরে শহরের মানুষ ঠুকরে ঠুকরে বলে দিয়েছে,আমি কে?আমি এখন থেকে রোজ বাবার সঙ্গে মাঠে যাবো। আলুর বীজ ছড়ানোর কাজ সবে শুরু হয়েছে। এরপর চাষ। অমানুষিক পরিশ্রম। বাবাকে সেইসময় আমি বিশ্রাম দেব।
তারক হালুই হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
--- তোর বাবা এখনও আগের মতই খাটতে পারে। তবে বছর তিনেক পরে আবার চন্দ্রমুখী লাগাচ্ছি বুঝলি বিজু। সে তো আবার ফুলবাবু,আদরযত্ন একটু বেশিই চায়। সাত দিন অন্তর তার দেখভাল করা চাই। নইলে তার গোঁসা হয়। বাবার কথায় বিজু হো হো করে হাসতে থাকে।
--- ঠিক আছে,ওই সাতদিন অন্তর আমি একা যাব। তুমি দেখে নিও মা, এইবার বাবা আর ছেলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিঘে প্রতি ষাট থেকে সত্তর বস্তা আলুর ফসল ফলাবই। সব্বাইকে তাক লাগিয়ে দেব।
--- নে, এবার চল দেখি। বেলা কিন্তু গড়াচ্ছে। ছেলের একটা হাত পরম মমতা আর ভরসায় ধরে ফেলেন তারক হালুই।
দুটো মানুষ পায়ে পা মিলিয়ে জমির দিকে এগিয়ে চলেছে। নয়নতারা চোখ মেলে দেখেন,সূর্যের আলো যেন নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অঘ্রাণের নরম উষ্ণতা জড়িয়ে পথের দুধারে গাছগুলো তারই মত চেয়ে আছে দুই আত্মজনের দিকে।
সমাজ বসু।।
৫৬এ, মিলন পার্ক।। ডাক --গড়িয়া
কলকাতা-৭০০০৮৪
ফোন--৬২৯১৩৭৭৩৮২.