অন্য মন (অন্তিম পর্ব)
সুপ্তা আঢ্য
অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরে বইয়ের তাকে, দেরাজে তন্নতন্ন করে খুঁজছিল জিনিসটা। পাওয়ার সম্ভাবনা আর চোখ ভরা আশা - - - - দুটোই যখন ব্যর্থ হওয়ার দোরগোড়ায়, ঠিক তখনই শুনল "কী খুঁজছ এভাবে? বইগুলোর কী অবস্থা করে রেখেছ!"
"ও----তুমি!"
"হ্যাঁ - - - - - কিন্তু এরকম পাগলের মত কী খুঁজছ, সেটা বলবে তো!"
একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল"তোমার মনে আছে, ইউনিভার্সিটিতে 'রাজা' নাটকের কিছুটা অংশ আমরা শ্রুতিনাটক হিসেবে পাঠ করেছিলাম। সেই স্ক্রিপ্টটাই খুঁজছি। "
" এতদিনের পরে হঠাৎ তাকে মনে পড়ল----কী প্রয়োজন ওটার? "
নন্দিনীর কাছে সবটা শোনার পর একটা ফাইল থেকে একটু হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজটা নন্দিনীর হাতে দিয়ে পরিহাসের ছলেই বলল" তো - - - - - রাজার চরিত্র পাঠ কে করবে - - - কিছু ভেবেছ? "
অভির গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যা শুনে নন্দিনী সব ভুলে নতুন আশায় আব্দারের সুরে বলল "তুমি হবে রাজা - - - - সেই ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর মতো! চলনা গো - - - - অনেকদিন পর আবার সেই দিনগুলোতে ঘুরে আসি। "
ওর কথায় হাসতে হাসতে অভি বলল" দূর - - - - আমার সময় কোথায়? তাছাড়া স্টুডেন্ট লাইফের একঘেয়েমির হাত থেকে বাঁচতে ওগুলো করতাম। এসব বোকা বোকা ব্যাপার এখন আর ভালো লাগে না। বরং মিঃ মুখার্জিকে বলো - - - - ও এসব ভালোবাসে। আমি কী বলে দেব? "
" থাক্! ওটা আমিই পারব। আর থ্যাংকস, এটা দেবার জন্য।"কথাগুলো বলে সারাদিনের ক্লান্তিতে ক্লান্ত শরীরটাকে প্রায় টেনে টেনে নিয়ে গেল নন্দিনী। নিজের ঘরে গিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে পড়ল ও" এটা কি সেই অভি - - - -! যে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকে প্রেম - অভিমান - বিরহ - - - - সবজায়গাতেই প্রিয় কবিকে সাথী করে নিয়ে যেত! অভির আদরে - শাসনে - সোহাগে - - - - সবখানেতেই ছিল কবির পদছায়া।" কাছের মানুষের পুরো সত্ত্বাটাই যে কোনদিন বদলে যেতে পারে - - - - - সেটা ওর কল্পনাতেও আসেনি। তবুও প্রিয় মানুষের বদলে যাওয়ার যন্ত্রণাটাও নিত্য বদলের মতোই মেনে নিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় দেখল অভি আর তিতাস হোমওয়ার্কের খাতায় ব্যস্ত।মাকে দেখেই তিতাস বলল" আজ আমি বাবাই-এর কাছে সব বই পড়ে নিচ্ছি। তুমি আমাকে বেড টাইম স্টোরি শোনাবে তো?" মুচকি হেসে মেয়েকে আদরে ভরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো ও।
রান্নাঘরে চিরাচরিত কড়াই - খুন্তির প্রেমালাপে বাবা - মেয়ের আলাপ কান পর্যন্ত পৌঁছয় না ওর। অভ্যাসবশে সব কাজ করলেও মনটা বড়ো আনমনা নন্দিনীর। রাতে খাবার টেবিলে ওর নীরবতার আওয়াজ অভিকে কোথাও যেন ছুঁয়ে গেল। আজকাল নন্দিনী ঝগড়া তো দূরের কথা, প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলে না। মনের দরজায় বিস্ময় কড়া নাড়লেও অভি ভাবে "রোজকার অশান্তির থেকে এটা অনেক ভালো।"
সকাল থেকেই নন্দিনী ভীষণ ব্যস্ততার সাথে সবকিছু রেডি করে দিয়ে একটু তাড়াতাড়িই অফিসের জন্য বেরোনোর প্রস্তুতি নিতেই অভি বলল "আমিও বেরোবো - - - চলো তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।"
একটু চুপ থেকে "আমি চলে যাব - - - তোমার দেরী হয়ে যাবে"বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে যায় ।
অফিসে পৌঁছে অনুষ্ঠানসূচিটায় চোখ বোলাতে বোলাতে গতরাতের সিদ্ধান্তটার কথা মনে হতেই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে নন্দিনী। আজকাল অনামা বন্ধুকে নিজের অজান্তেই নিঃসঙ্গতার সঙ্গী করে নিয়েছে ও। নিজের সিদ্ধান্তের কথাটা জানাতেই উত্তর এল "তুমি এখনও বড্ড ছেলেমানুষ! 'রাজা' কে একবার অন্যের দৃষ্টিতে দেখলে ক্ষতি কী? দেখো - - - এতে তোমার ফেলে আসা দিন নতুন রূপে ধরা দেবে তোমার সামনে।"
"কিন্তু - - - - সেই নতুনের আঙ্গিকে আমার পুরোনো 'আমি' যদি তৃপ্ত না হয়?"
"নিজের অনুভবে, মনশ্চক্ষুতে হৃদয়ের অধীশ্বরকে অবলোকন করো - - - - বহিরঙ্গের রাজা কখন যে অন্তরঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে - - - - - তোমার তৃপ্ত হৃদয় তা বুঝতেই পারবে না। মহারানী সুদর্শনা তার সত্যিকারের রাজাতে বিলীন হয়ে যাক - - - শুভকামনায় শুভমুহুর্তের অপেক্ষায় রইলাম, বন্ধু।"
মনের সব দ্বিধা কাটিয়ে সকলের সাথে আলোচনার পর নন্দিনী বলে" রিহার্সালটা তাহলে নাহয় কাল থেকেই শুরু করি। "
" কাল থেকে কেন নন্দিনীদি - - - - সবাই যখন রাজী আছি, আজ থেকেই শুরু হয়ে যাক্ না।" রিয়ার কথায় সবাই একবাক্যে রাজী হতেই লাঞ্চ আওয়ারের পরেই রিহার্সালটা শুরু করে দেয় ওরা। রিয়া-রণিতের 'কচ-দেবযানী' আর নন্দিনী-সৌমাল্যর 'রাজা' শ্রুতিনাটক শেষ হতেই বিকেল গড়িয়ে গেল। রিহার্সাল শেষে বন্যা বলল" রিয়াকে দেবযানী হিসেবে বেশ মানিয়েছে - - - বল্ "
" সে তো হবেই - - - দেবযানীর মতো ওরাও যে সুখেদুখে সারাজীবন একভেলায় ভাসবে ঠিক করেছে।" ওর কথায় দুজনেই হাসতে হাসতে নিজেদের কেবিনের পথে পা বাড়ায়। অফিস থেকে বেরোনোর আগে ফোনটা কেঁপে উঠতেই অক্ষরগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল স্ক্রিনে "মহারানীর মেজাজ ঠিক আছে তো? "
" আপনি কি করে বুঝলেন রানীর মনের খবর? "
" এটুকু না বুঝলে তো বন্ধুত্বের দাবী করাই যাবে না।কী জানো সখী, রবিঠাকুর মানুষটাই যে এরকম-----দুঃখের ভাগীদার হতে হতে কখন যে সুখের কিনারায় পৌঁছে দেয়, তা তুমি জানতেই পারবে না। এই জানাটাই যে আমার জানা গো মহারানী।"
" বুকের ভেতর জমে থাকা সত্যি কথাগুলো কী অনায়াসে বলে দেন! বড়ো অদ্ভূত আপনি - - - আপনাকে বুঝতে গেলে দেখি না বোঝার পাল্লাটাই ভারী হয়ে গেছে। তাই সেই দায়টাও আপনাকেই দিলাম। "
অফিস প্রোগ্রামের দায়িত্বটা পাওয়ার পর থেকেই নন্দিনীর নির্জীব মনটা সজীবতার ছোঁয়ায় নববর্ষার জলে পূর্ণতা পাওয়া উচ্ছল তটিনী হয়ে উঠেছে। বাড়ি ফিরে নিত্যকার রুটিন মাফিক তিতাসের হোমওয়ার্কের বদলে ছাদে গিয়ে শ্রাবণ মেঘের অস্তরাগের রঙে রাঙা সন্ধ্যের আকাশে কৃষ্ণপক্ষের অস্তমিত চাঁদ-মেঘের লুকোচুরি খেলায় তৈরী ছায়াময় জোছনায় স্নাত হয়ে স্নিগ্ধ হতে শেখাল তিতাসকে।
"আজ আমায় হোমওয়ার্ক করাবে না মামণি?"
"কেন, আমার তিতাসের বুঝি ভালো লাগছে না এখানে?"
ছোট্ট দুটোহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে তিতাস বলল "চাঁদের আলোটা ঠিক তোমার মতোই মিষ্টি - - - মামণি ।এখন থেকে রোজ আমরা আকাশের সাথে চাঁদমামা আর মেঘবুড়োর লুকোচুরি খেলা দেখব। খুব মজা হবে - - - - না মামণি?" মুচকি হেসে বুকের মধ্যে মেয়েকে জড়িয়ে নীচে এসে এক নতুন খেলায় মেতে উঠল দুজনে। খেলতে খেলতে কখন যে হোমওয়ার্কটা শেষ হয়ে গেছে - - - - - বুঝতেই পারেনি তিতাস।
সেদিনের পর থেকে অভি আর নন্দিনীর বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ। আসলে সেদিনের নন্দিনীর নিক্ষেপ করা বাক্যবাণ দগ্ধ করছিল ওকে। এখন একটা শীতল স্নায়ুযুদ্ধের সৈনিক দুজনে - - - - যে যুদ্ধে জয়ের গৌরব বা পরাজয়ের গ্লানির ভার দুজনকেই বহন করতে হবে - - - অভিমানে এই চরম সত্যিটা মাথাতেই আসেনি ওদের। তবে আজকাল বাড়ির মধ্যেকার এই অদ্ভূত নীরবতাটাও সহ্য হচ্ছে না অভির - - - মাঝে মাঝেই নন্দিনীর চিৎকার, কথার প্রতিধ্বনি কানে বাজতে থাকে ওর। নিজেই বুঝতে পারে না "কোন নন্দিনীকে আমি চাই? কথায় কথায় যে মেয়েটা রিঅ্যাক্ট করত নাকি এখনকার এই নির্লিপ্ত, শীতল মেয়েটা----যার চোখে শুধুই একরাশ উদাসীনতা?"
বাড়ীর মধ্যেকার গুমোট, দমবন্ধ করা পরিবেশ নন্দিনীকে আহত করলেও তিতাস, অফিসের রিহার্সাল আর বন্ধুর সাথে আলাপন - - - ওর আঘাতের যন্ত্রণাকে অনেকখানি কমিয়ে দেয়। মনের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে 'রাজা' মঞ্চস্থ করছে নন্দিনী আর সৌমাল্য। রিহার্সালের প্রতিটি মুহূর্তে সৌমাল্যর কণ্ঠের অভিব্যক্তিতে রাজা নতুন রূপে ধরা দিচ্ছে ওর কাছে। মাঝে মাঝেই একটা সন্দেহের ছোট্ট কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠছে ওর মনে "সৌমাল্যর চেনা রূপই অচেনা বন্ধুর অজানা রূপ নয় তো?"
এখন অফিসে বেশিরভাগ সময়টা কচ-দেবযানী আর রাজা - রানীই নিয়ে নিয়েছে। লাঞ্চ আওয়ারে একটু ফাঁকা হতেই দেখল অভি অনেকবার ফোন করেছিল ওকে। আশার সাগরে ভেসে ফোন করতেই শুনল "আসলে - - তোমার স্যারের সাথে একটু প্রয়োজন ছিল। সেটা মিটে গেছে, বাই।"মনের এই আশা-নিরাশার ভাঙাগড়ায় এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে নন্দিনী। তাই মনখারাপের অদম্য আকর্ষণের হাতছানিকে এড়িয়ে খোলা হাওয়ায় ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে থাকা বার্তায় মন ডোবালো ও"অন্যের আঙ্গিকে রাজার ভালোবাসায় সেদিনের সেই যুবতী নন্দিনীকে কী খুঁজে পাওয়া গেছে? তাকে অন্তরের অন্তঃপুরের অন্ধকারের উৎসস্হল থেকে আলোর ঝর্নাধারায় স্নিগ্ধ করো - - - - না হলে তোমার জীবনের সোনায় মোড়া দিনগুলো পাণ্ডুলিপি হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।"
ওনার কথায় নন্দিনীর সন্দেহটা আরও দৃঢ় হয়ে উঠলো। বলেই ফেলল" আপনি কি সৌমাল্য? "
" হঠাৎ আমাকে সৌমাল্য বলে সন্দেহ হল কেন তোমার? "
" না----আসলে - - - - রিহার্সালে সৌমাল্যর অভিব্যক্তি আর আপনার অনুভূতি অনেকটা মিলে যায়। "
কয়েকটা হাসির ইমোজির সাথে উত্তর এল "আরে না না, এই একটা ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো - - - - সৌমাল্য - - সৌমাল্যই।"
"আবরণের পর্দা কী উন্মোচিত হবে কখনও? আমি তো কাব্যের নায়িকা নই, তাই লৌহকপাটের আড়ালে থাকা রাজার বহিরঙ্গের রূপ দেখতে বড়ো সাধ জাগে - - - -"
"বেশ তবে তাই হবে। মহারানীর আদেশ অমান্য হবে না। "
দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই এক সকালে অঝোর শ্রাবণধারার পুষ্পবৃষ্টি বহু প্রতীক্ষিত সেই দিনটাকে বরণ করে নিল। আজ নন্দিনী ভীষণ ব্যস্ততার সাথে কাজগুলো সারছিল। অনেকদিন পর অভি রান্নাঘরে এসে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল "তুমি তৈরী হয়ে নাও। আমি এখানে আছি। "
একটু অবাক হলেও হঠাৎ একটা ভালোলাগা জড়িয়ে ধরল নন্দিনীকে। মুখে সেটা প্রকাশ না করে শান্ত ভাবে নিজের ঘরে চলে যায় ও ।ফোনটা অন্ করতেই বৃষ্টিস্নাত কামিনী ফুলের গন্ধ বার্তা নিয়ে এল "আজকের এই বিশেষ দিনে কবিগুরুর আশীর্বাদে তোমার জীবনের ভালবাসা নতুন রূপে ফিরে আসুক। আগাম শুভেচ্ছা আর শুভকামনা।"
উত্তর দেওয়ার আগেই আবারো একটা মেসেজ "আজ রানী সুদর্শনার রাজার ভালোবাসায় লীন হয়ে যাওয়ার দিন। সুদর্শনার সেই রূপ শুধুমাত্র অন্তরঙ্গেই নয় - - - - ফুটিয়ে তোলো তোমার বহিরঙ্গেও। "
" ভারী অদ্ভূত আপনি - - - - - আপন করা কথাগুলো বলে নিজের ইচ্ছের বীজ বুনে আমার মনে চারারোপণ করেন। তবে সুদর্শনা কিন্তু এখনও জানে না ওর হৃদয়েশ্বরের কথা। তাই আপন হৃদয়ের ভালবাসার রঙেই সাজাবো নিজেকে। "
বহুদিন পরে আজ অতি যত্নে নিজেকে সুন্দর করে সাজালো নন্দিনী। আজ বোধহয় অভি বসার ঘরে ওর অপেক্ষাতেই ছিল। সুসজ্জিতা নন্দিনীকে দেখে মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল ও।শ্রাবণের এই ঘন বর্ষায় ঘন নীল মণিপুরী সিল্কের শাড়ি জড়িয়ে রেখেছে নন্দিনীকে। গলায়, কানে সাদা মুক্তোর সেট, হাতে সরু নীল অক্সিডাইজের কগাছা চুড়ি, কপালে নীল টিপের সাথে মিলিয়ে চোখে ঘননীল কাজল আর লম্বা খোলা চুলের ভাঁজে সাদা গোলাপে আজ যেন ও সত্যিই কোন কাব্যের নায়িকা। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্যকোথাও হারিয়ে গিয়েছিল অভি। সম্বিত ফিরতেই বলল "আজ আর বাসে যাওয়ার দরকার নেই। বরং একটা ক্যাব বুক করে নাও। আর হ্যাঁ, সাবধানে যেও।"
কয়েকমুহুর্তের জন্য নন্দিনীও হারিয়ে গিয়েছিল অভির চোখের তারায়। অভির কথায় চমক ভাঙলেও একটা আবেশ জড়িয়ে রাখল ওকে যা তখনই ভাষা জোগালো না ওর মুখে । সম্মতির হাসি হেসে বাইরে বোরোতেই দেখল একটা ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অভির ফোন এল" ও তোমার জন্যই ওয়েট করছে। কিছু না ভেবে চলে যাও।"
আজকের দিনটা নন্দিনীর বোধহয় শুধুই অবাক হওয়ার দিন। সকালটা এত ভালো কাটলো যে নন্দিনীর ভয় হতে লাগলো "শেষ অব্দি সবটা ঠিকঠাক থাকবে তো?" অফিসে আসতেই সকলের প্রশংসার সামনাসামনি হল ও। "আরে নন্দিনীদি, আজ তোমার সাথে রবীন্দ্রকাব্যের নায়িকার কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাওয়া যাবে না। অসাধারণ দেখাচ্ছে তোমাকে।"
রণিতের কথায় বাকীরা কিছু বলার আগেই নন্দিনী বলল "বাকী কথাগুলো অনুষ্ঠান শেষের জন্য তোলা থাকুক না হয়। এখন বরং অনুষ্ঠান শুরুর ব্যবস্থা করি। "নন্দিনীর কথায় সকলে হাসতে হাসতে কনফারেন্স রুমের দিকে পা বাড়ালো।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে করতে বারবার অভির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল নন্দিনীর। অভিকে ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে এই প্রথম ও একা। নন্দিনীর পরিচালনায় অনুষ্ঠানটা নিজের মতো করে ভালোই এগোচ্ছিল। অনুষ্ঠানের মধ্যাহ্নে শ্রুতিনাটকের সময় এগিয়ে আসতেই নিজেকে ভীষণ নার্ভাস লাগছিল ওর। নার্ভাসনেস কাটাতে ইনবক্স চেক করতে দেখল আজ ওর বন্ধুটি হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে অভিকে ফোন করতেই শুনল "কেমন হল তোমার অনুষ্ঠান?"
"একটু পরেই শুরু হবে। তোমরা থাকলে বেশ হতো।"
"কী করা যাবে। মন ঠাণ্ডা রেখে পাঠ কোরো। বেস্ট অফ লাক, বাই।"
ফোনটা রেখে মনে হল - - - "আরও কী কিছু বলার ছিল ওকে?" নন্দিনীর মন আজ লাগামছাড়া----ব্যাকুলতায় ভরে উঠেছে ওর মন। নির্ধারিত সময়ে শ্রুতিনাটক শুরু করল ও আর সৌমাল্য। পাঠাভিনয় করতে গিয়ে এক অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল ওর। আজ সকালে দেখা অভির ওই চোখ আর বন্ধুর পাঠানো বার্তা মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল আজ। একেবারে শেষ অঙ্কে এসে সুদর্শনার কণ্ঠে নিজেরই অন্তঃধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল নন্দিনী। রাজার প্রেমে নিজেকে বিলীন করার মুহূর্তে সৌমাল্যর কণ্ঠে রাজার বলা প্রত্যেকটা কথা এক অদ্ভূত অনুরণনের সৃষ্টি করছিল ওর মনে। স্টেজ থেকে নামার পরেও এক অন্যরকমের ভাববিহ্বলতা জড়িয়ে রেখেছিল নন্দিনীকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর ফোনটা হাতে নিতেই দেখল সাদা স্ক্রিনে কালো অক্ষর মালা সাজিয়ে বসে আছে ওরই অপেক্ষায় "কোনো প্রশ্ন না করে তোমার কেবিনে চলে যাও। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর ওখানেই আছে।"
"কিন্তু - - - - -!"
"আজ আর মনের মাঝে 'কিন্তু' কে জায়গা নাই বা দিলে।"
এবার আর কথা না শুনে থাকতে পারল না নন্দিনী। পায়ে পায়ে নিজের কেবিনে এসে দেখল - - - - ওর অগোছালো ঘরটা বর্ষার রঙের সাথে ভালোবাসার রঙ মিশিয়ে নতুন সাজে সেজে উঠেছে। সারা ঘরজুড়ে স্বর্ণচাঁপার সুবাস আর বিবর্ণ ফুলদানীটায় শোভা পাচ্ছে হলুদ বসন্তের রঙে রঙীন অমলতাস। আনন্দে, বিস্ময়ে চোখে জল এসে গেল নন্দিনীর "কোথায় আপনি? সহচরদের পাঠিয়ে আজও অন্ধকারেই থেকে যাবেন!"
"নাগো সখী - - - - আজ যে আমার আলোয় ফেরার দিন। তাই সব অন্ধকারও আলোয় মিলিয়ে গেছে। দুচোখ বন্ধ করে অনুভব করো নিজের অন্তরে ।"
চোখ বন্ধ করে অপার উত্তেজনায় মুহূর্ত গুনতে লাগলো নন্দিনী----- এক একটা মুহূর্ত ওর কাছে এখন লক্ষ যুগের সমান।
" চোখ খোলো মহারানী। "
" বড়ো ভয় হচ্ছে যে চোখ খুলতে। "
" কেন? "
" যদি আপনাকে দেখতে না পাই! আপনাকে দেখার সাধ যে বহুদিনের । "
প্রাণখোলা হাসিতে নন্দিনীকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে বন্ধু বলল "ভয় নেই ম্যাডাম। তোমার সাধ আজ আর অপূর্ণ থাকবে না। এবার চোখ খোলো সখী।"
আশাতীত আনন্দে, উত্তেজনায় লাজুক চোখ দুটো খুলতেই যাকে দেখল - - - - কোনদিনও কল্পনাতেও সে আসেনি ওর।
" তুমি - - - - -! "
" হ্যাঁ, ম্যাডাম - - - - আমিই।"
"আমি কিচ্ছু বুঝতেই পারছি না। তুমি - - - - উনি - - - - মানে - - -? "
" সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। আগে একটু শান্ত হয়ে বসতো।" নন্দিনীকে সযত্নে চেয়ারে বসিয়ে অভি বলতে লাগল "আসলে এই বদলে যাওয়া নন্দিনীকে আমি মানতে পারছিলাম না। সর্বক্ষণ আমার ভালোবাসা, আমার পুরোনো নন্দিনীকে হন্যে হয়ে খুঁজতাম - - - - আর ব্যর্থ হতাম বারবার।তাই আমার হারিয়ে ফেলা অমূল্য ভালোবাসা সেদিনের সেই অভিমানী, ছেলেমানুষ নন্দিনীকে ফিরে পেতে এটা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। "
কথাগুলো শুনতে শুনতে অজান্তেই চোখের জলে নন্দিনীর সমগ্র সত্ত্বা ভেসে যাচ্ছিল অভির প্রেমে ।ওর কাছে এসে আলতো হাতে নন্দিনীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে চাপাস্বরে বলল" রাজার প্রেমে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছ তো? "
ভালোবাসার যুদ্ধে পরাজিত নন্দিনীর মুখটা এক অপূর্ব আলোর দীপ্তিতে ভরে উঠল। কোন কথা না বলে পতিপ্রেমে সোহাগিনী নবোঢ়া বধূর মতোই নির্ভার হয়ে পরম নিশ্চিন্তে স্বামীর বুকে আশ্রয় নিল অভির হৃদয়েশ্বরী নন্দিনী।অভিও ভালোবাসার কঠোর - কোমল বাহুডোরে বাঁধল ওর প্রেয়সীকে ।
আর তখনই বন্ধ দরজা একটুকু ফাঁক করে নন্দিনীর বস্ আর অভির প্রিয় বন্ধু মিঃ মুখার্জি আনন্দে চোখ মটকে অভিকে স্যালুট জানিয়ে ভালোবাসার দুই কবুতরকে কুঞ্জবিহারের সুযোগ করে দিতে আস্তে আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিল ।
-------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
------------------------------------------------
লেখিকা- সুপ্তা আঢ্য