তিলোবতী
বদরুদ্দোজা শেখু
এই যে ইমরুল, তার বড়ো ফুফু সাবিয়াতুন বিবির বিয়ে হয়েছিল ভীমপুরে,ইমরুলদের বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। এক জমিদারের হালসাহানার সাথে।
তার নাম ছিল আহাসান মন্ডল। বেশ দবদবা ছিলো তার , আর বন্দুকও ছিল। কিন্তু সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। সে আরেকটা বিয়ে ক 'রে বসলো। গাঁয়েরই মেয়ে, সম্পর্কের লটাপটিতে তার সেই প্রেমিকা গর্ভবতী হ'য়ে পড়ে, কাজেই তাকে বিয়ে করতে সে বাধ্য হয়। একদিন জমিদারের জমিদারিও চ'লে যায় আর হালসাহানার চাকরিও চ'লে যায়। তার দবদবারও শেষ। তখন সে দ্বিতীয় ঘর সংসার আর পরকীয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কাজেই তার সম্পত্তি বেচে খাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সে শেষ কালে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথেই তার ছেলেপুলেদের নিয়ে থাকতো। কারণ তার দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পর তার প্রথম স্ত্রী সাবিয়াতুন তার দিকে ভুলেও তাকায় নি। সে তার বাপের বাড়ি থেকে যা কিছু পেয়েছিল আর ২য় নিকার আগে আহাসান মন্ডল তাকে যা কিছু সামান্য জমিজমা লিখে দিয়েছিল তাই সম্বল ক'রে দিনাতিপাত করতো। তার আট ছেলে আর সর্বশেষ এক মেয়ে। সাবিয়াতুন তেমন সুন্দরী বা আকর্ষনীয় ছিল না।সাদামাটা গড়নের শ্যামলা গ্রাম্য মহিলা।
কিন্তু তার মনটা ছিল খুব উদার আর শান্তিপ্রিয়। তার যে মেয়ে সন্তান হ'লো ,তার উজ্জ্বল ফরসা গায়ের রঙ আর তাকে খুব সুন্দরী দেখাতো। তার মুখশ্রীও বেশ উজ্জ্বল হাসিখুশি, তবে তার অধরৌষ্ঠ একটু মোটা আর ঈষৎ কালচে। আর বাম গালে একটা কালো তিল ছিল। তার নানী তার নাম রেখেছিল তিলোবতী। বড়ো হ'য়ে উঠলেও তার তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। যৌবন আসতে না আসতেই তার রূপ আর শরীরের গড়ন বেশ আকর্ষনীয় হ'য়ে উঠলো। তার কিশোরী বয়স হ'তে না হ'তেই অনেক বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকে। তাদের অবস্থা তখন প্রায় গরীবের পর্যায়ে, তাই ধনীদের ঘর থেকেও যেমন প্রস্তাব আসে , তেমন সাধারণ মধ্যবিত্তদের ঘর থেকেও প্রস্তাব আসে। দুএকটি বাড়ির পরেই উঠতি যুবক আমিরুলের বাড়ি। সে মাঝেমধ্যে তাদের বাড়ি আসে, তিলোবতীর মাকে চাচী ব'লে ডাকে , চাচীর প্রয়োজনে বিপদ- আপদে সাহায্য করে। সেও বিয়ে করার আশায় থাকে। বাড়িতে আসা যাওয়ার সুবাদে তার সাথে একটা ভালবাসার সম্পর্ক নিয়েও তিলোবতী স্বপ্ন দ্যাখে , বরং আমিরুল তাকে স্বপ্ন দেখায়। বিষয়টা আহাসানের কানে উঠতে -না-উঠতেই সে বাড়িতে এসে শাসিয়ে যায় , ওই ছেলের এ বাড়িতে আসা যাওয়া করা চলবে না আর তিলোবতীও তার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারবে না। তড়িঘড়ি সে গ্রামের উঠতি মোড়ল লোকমানের ছেলে মাহিদের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ।
মাহিদ খুব একটা আশাপ্রদ পাত্র ছিল না , কারণ তার নাকি বুদ্ধিশুদ্ধি কম , কিছুটা খ্যাপাটে ধরণের , খায়দায় , বাপের চাষ দেখাশুনা করে , গরু বাছুরের যত্ন করে আর ঘুমায়। এই ধরণের গড়পড়তা এক পাত্র। তার মা ও বড়ো ভাইদের মত ছিল না ওই আধ-পাগলা ছেলের সাথে তিলোবতীর বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তার বাপের সিদ্ধাতই চূড়ান্ত। তাই তিলোবতী গুমরে'গুমরে' থাকলেও প্রতিবাদ করতে পারেনি।
বিয়ের সময় গয়নাপাতি কাপড়চোপড় দিয়েছিল লোকমান মোড়ল ভালোই। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিয়েশাদির বিষয়টা চুকে যায়। গরীব আমিরুল আর কী করতে পারে ? - - সে পরবর্তীকালে ফুরসতে কাজ ক'রে দেওয়ার অছিলায় সাবিয়া চাচীর খোলা বারান্দায় এসে ব'সে থাকে , টুকটাক কোনো ফরমাস করলে তা যথাসাধ্য ক'রে দ্যায়।তারও খেটে খাওয়া জীবন। তবু যেন কী এক অরোধ্য প্রত্যাশায় সে সপ্তাহে এক দু'দিন এসে বসে, খোঁজখবর ক'রে ব'সে থেকে চ'লে যায়। সাবিয়াতুন তাকে এসো না, বলতে পারে না। তিলোবতীর সাত ভাই বিয়েশাদি ক'রে যে যার মতো সংসার করছে। আর তাদের মা ছোট ছেলে তামু-কে নিয়ে আলাদা হাঁড়ি। আমিরুল তামুকে ডেকেডুকে কাজে নিয়ে যায়; কিন্তু তামুর খেটে খাওয়ার অভ্যাস নাই, জন্মগতভাবেই সে দুর্বল।
সবকিছু প্রথম দিকে ঠিকঠাক চলছিল, মাহিদের বাড়িতে তিলোবতীকে সাধারণ চাষী ঘরের সব কাজ করতে হতো ; কিছু খামতি হ'লেই তার শাশুড়ী বা তার বরের থেকে নানান কটু কথা শুনতে হতো। বছরখানেক পর তার একটা পুত্র সন্তান হলো। নাম রাখলো রুবেল। যাক মেয়ে সন্তান তো আর হয়নি, এবার হয়তো তার একটু আদরযত্ন হবে শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস , সেই ছেলে দু'বছর বয়স হ'য়ে গেলেও কথা বলতে পারলো না।
কেবল গোঁ গোঁ শব্দ করতো আর হাত-পা ছুঁড়তো।
এমনকি সে পাগলাটে ব'লে ডাক্তার মত দিলো , এ রোগ কিছুতেই সারবে না। সব সময় তাকে ঘ্যার ঘ্যার ক'রে ধ'রে রাখতে হয় , সব সময় সে গোঁয়ার্তুমি করে, ছুটে বাড়ি থেকে যেদিক সেদিকে চ'লে যায় , পুকুরে ডুবতে যায়। তাদের গ্রামের পাশে একটা ছোট পাহাড়ের মতো টিলা ছিল, সেখানে আনথাবড়ি ওঠার চেষ্টা করে আর গড়িয়ে গড়িয়ে প'ড়ে যায়, হাতপা শরীর ছিঁড়েখুঁড়ে রক্তাক্ত হ'য়ে যায়, তাতে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকে না। এই রকম পাগলের নানা উপসর্গ।
শুরু হলো তার মায়ের গঞ্জনা শোনার পালা ।তার ছেলেকে নিয়ে সে সবসময় ব্যতিব্যস্ত। তার মায়ের বাড়িতেও সে থাকতে পারে না। ছেলে যেদিক সেদিকে চ'লে যায়। আর তিলোবতীর জীবন দুর্বিসহ ম'রে যাওয়ার সামিল। সে সংসারের কাজ করবে, না তার বাচ্চাকে সব সময় ঘ্যারঘ্যার করবে ! ধ'রে বেঁধে রাখবে ! তার জীবন অতীষ্ঠ হ'য়ে উঠলো । ক্রমে শ্বশুরবাড়িতে তার ছেলেকে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা, মারধোর করা ইত্যাদিও হ'তে লাগলো। তার স্বামী মাহিদ তিলোবতীকেও পাগল ছেলের জন্ম দেওয়ার জন্য অবক্তব্য গালাগালি মারধোর ছাড়াও তালাক দেওয়ার হুমকি দিতে লাগলো। আর অন্য মেয়েকে নিকা করার জন্য ব্যস্ত হ'য়ে পড়লো। মারধোরে তার ছেলের ও তার সুন্দর ফুলের মতো গায়ে কালশিটে প'ড়ে গেল। সে তার ছেলেকে নিয়ে তার মায়ের বারান্দায় এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো, কিছু খেতো না, কোনো আবদার দাবি কিছুই তার ছিল না। সে ক্ষতখাওয়া পাষাণের মতো দিনদিন হ'য়ে যেতে লাগলো। সে না পারতো তার নাবালক ছেলেকে ছাড়তে, না পারতো মরতে।
তার সেজো ভাই রহিমের অবস্থা একটু ভালো।
তার সাথে ইমরুলের দিদির বিয়ে হয়েছিল।তখন ইমরুল ওর দিদির বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতো।
সে দেখতো,কী ব্যথিত বিষণ্ণ মলিন মুখে তিলোবতী দিদি তার সেজো ভাইয়ের চৌকিতে এসে বসতো, তার সাথে কথা বলার আর কোনো প্রসঙ্গই ইমরুল খুঁজে পেতো না। রহিমও তার ভাগ্নের চিকিৎসার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুই করা সম্ভব হয়নি।
বলতে দ্বিধা নাই, ফুফুর বাড়ির সবাই এক সময় কায়মনোবাক্যে চায়তো ওই পাগল ছেলের মৃত্যু হোক।তাহ'লে হয়তো ওর মা আদরের তিলোবতী একটূ রেহাই পায়, প্রাণে বাঁচে। কিন্তু তিলো হয়তো তার ছেলের মৃত্যু কামনা করতে পারেনি ; তার জীবনের সব স্বপ্ন চুরমার হ'য়ে গেলেও , তার সন্তানের মৃত্যুর আগেই সে বেছে নিলো নিজের মৃত্যুবরণ।
একদিন ভোরে খবর এলো হঠাৎ, তিলোবতী শ্বশুরবাড়ির কোঠাঘরের কড়িকাঠে শাড়ি পেঁচিয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে । কখন এসব ঘটেছে কেউ জানে না। পাশে দড়িতে বাঁধা তার পাগল ছেলে। --পুলিশে রিপোর্ট করা হয়। পুলিশ এসে লাশ নামালো।তার ভাইয়েরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলো তার কাটাছেঁড়া আটকানোর। এমনকি ওর শ্বশুরবাড়ির কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাই , এই মর্মে মুচলেকাও দিতে চায়লো।কিন্তু পুলিশ শুনলো না।। তার পোষ্টমর্টেমের জন্য লাশ চালান করলো। ফুফু তো পাথরের মতো নির্বাক ব'সে রইলো বারান্দায়।
এখন তার উদ্ভ্রান্ত পাগল ছেলেকে কে দেখবে ? কেউ তার দায়িত্ব নিতে সাহস করলো না।পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট আর পারিপারশ্বিক তদন্তের উপর ভিত্তি ক'রে পুলিশ মাহিদের ওপর নির্যাতনের বা বধূহত্যার কোনো কেস দিলো না। তিলোবতীর বাপের বাড়ির এ বিষয়ে কোনো আপত্তিও ছিল না।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-য়ের মতো তাদের চোখের সামনে তিলোবতী মারা যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার মাহিদ নিকা করলো পাশের গ্রামের অন্য এক মোড়লের অল্প বয়সী মেয়েকে , দাওয়াৎও দিয়ে গেল। এদেশে মেয়ে পাওয়ার কি অভাব আছে ? কথায় বলে না, মেয়েরা এখন পাতানে তিন ঢেউ । কাজেই কিছু বলার নাই,যার যে রকম রুচিবোধ। এক মাসও অপেক্ষা করলো না। যে অজুহাতে এতো তাড়াতাড়ি নিকা করলো, সেই পাগল ছেলেকে দেখাশুনা করা, সে চরম অবহেলা আর অযত্নে দিন দশেকের মধ্যেই মারা গেলো। যাক, সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কারণ,তার কষ্ট আর দুর্গতি চোখে দেখার মতো ছিল না । তিলোর মা চোখের পানি ফেলেই নীরব হ'য়ে রইলো। আল্লার কাছে মোনাজাত করলো, তারা যেন বেহেস্তে স্থান পায়।
সেই বিড়ম্বিত বেদনা নিয়ে ফুফু অনেকদিন পাথরের মূর্ত্তির মতো জীবনযাপন করলো, নামাজ রোজায় লিপ্ত হ'য়ে রইলো।ইমরুল যতোদিন ওখানে ছিল, মাঝে মাঝে ফুফুর কাছে গিয়ে বসতো। জীবন- জীবিকার টানে সেও একদিন সেই গ্রাম ছেড়ে বৃহত্তর জীবনের পথে পাড়ি দিয়েছে। খোঁজখবর রাখার তেমন সুযোগ ছিল না। তখন আধুনিক ফোনের যুগও ছিল না । ফুফু যে কবে মারা গেলো , তার ছেলেরা কেউ তাকে জানাতে পারেনি। এখন্ও ইমরুল তার সাবিয়াতুন ফুফুর কথা মনে ক'রে অন্তরের অন্তঃস্থলে ব্যথিত বিষণ্ণ বোধ করে ; সে সর্বান্তকরণে কামনা করে , মৃত্যুপথযাত্রী তার ফুফু যেন তার অন্তরের আদুরী তিলোবতীকে ও তার ছেলেকে শিয়রের কাছে মানসচোখে দেখতে পেয়েছে আর হাসিমুখে জীবনের ওপারে চ'লে যেতে পেরেছে।
নির্বিবাদী শান্তশিষ্ট মৌন তিলোবতীর সেই অনন্ত বিষণ্ণ বেদনাময় অপাঙ্ক্তেয় মুখাবয়ব আজো ইমরুলকে কষ্ট দ্যায়।সে বেদনাময় ইতিহাস সবকিছু লেখায় প্রকাশ করা যায় না।হয়তো বিধাতা কাউকে কাউকে বেঁচে বর্তে থাকার ন্যূনতম সহায়তা দিতেও অপরিসীম কার্পণ্য করেন ।
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
( ১২৭২ শব্দ )
© বদরুদ্দোজা শেখু, , বহরমপুর
-----------------------------------------------
লেখকের নাম-- বদরুদ্দোজা শেখু
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
পঃ বঙ্গ , ভারত ।
হো• অ্যাপ নং +91 9609882748
----------------------
কবি-পরিচিতি
-------------------
বদরুদ্দোজা শেখু-র জন্ম ১৯৫৫ সালে ফেব্রুয়ারীতে মুর্শিদাবাদ জেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে ।ক্ষুদ্রচাষী সাইফুদ্দীন সেখ ও গৃহবধূ ফজরেতুন্নেশা বিবির সন্তান। দারিদ্র্যের মধ্যেই গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ।পেশায় অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। নেশায় কবিতা লেখালেখি। শোভা গোস্বামীকে বিবাহ করেছেন।
এযাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন,শব্দ ভেঙে সংলাপ,আরো থোড়া দূর,এবং পরী ও পেয়ালা ।তাঁর কবিতা অদলবদল , সপ্তাহ, দৌড় , কবিতীর্থ ,শব্দনগর, ঋতুযান ,একুশে বর্ণমালা প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত । বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী থেকে একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন।- - -
তিনি কিছু কিছু অণুগল্প ও ছোট গল্পও লিখেন
----------------------------------------
-