পূর্বকথন
আমবাগান থেকে বেরিয়ে ঝিনটি মননকে নিয়ে গ্রামের প্রাচীন কলিমন্দির দেখতে নিয়ে যায়। প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস জানতে চায় মনন। ঝিনটি যা শুনেছে গ্রামের প্রাচীন মানুষদের কাছে, তাই বলতে শুরু করে।
পর্ব ১৮
সে অনেককাল আগের কথা।সে সময়ে এই মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল ছিল গাছপালার ঘন জঙ্গল, ছোট বড় গর্ত, ভাগাড়, বাঘ আর বুনো শেয়ালের অবাধ বিচরণভূমি, বিষাক্ত সর্পের বাসভূমি। মানুষ দিনের বেলায়ও এই অঞ্চল দিয়ে যেতে ভয় পেত। মানুষ বাস করত না এখানে। অনেক দূরে দূরে কতিপয় ঘর নিয়ে এই গ্রামের অস্তিত্ব ছিল। শোনা যায় এক সাধুর পরামর্শেই শুরু হয় এই পুজো। শুরুর কয়েকদিন আগেই ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করেন গ্রামের মানুষ, সঙ্গে থাকেন ওই সাধুবাবা। তখন মন্দির ছিল না, ওই পরিস্কার করে জমিতে অস্থায়ী বেদী তৈরি করেই পুজো হত। প্রচুর বাঁশের ঝাড় ছিল এই অঞ্চলে। সেই বাঁশ, চট, টিন আর তেরপল দিয়ে বেদী ঘিরে হত মন্দির। পুজোর কদিন কেটে গেলেই এই অঞ্চল আবার হয়ে যেত অন্ধকার। সারা রাত হত কালী পূজো, লোকে বলত রক্ষাময়ী মায়ের পুজো। দুপুরে হত দক্ষিণ রায় বা বাগবাবার পুজো। তখন ছাগ বলির হত। মাঝে মাঝে ডাকাত দল নরবলিও দিত।
ঝিনটির গল্প শেষ হতেই মনন বলে - ইন্টারেস্টিং। ওই সন্ন্যাসী এলেন কোথা থেকে?
ঝিনটি আবার শুরু করে গ্রামের লোক একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাকে একটি গাছের গোড়ায় ধুনী জেলে এক সন্ন্যাসী বসে আছে একে একে সবাই সন্ন্যাসীকে প্রণাম করতে আসে সন্ন্যাসী তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখে খুব সন্তুষ্ট হয়ে বলে - বল কি চাও তোমরা সবাই চুপ করে আছে। এই দেখে একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে বাবাকে প্রনাম করে বলে - বাবা আপনি তো আমাদের দয়া করতে এসেছেন তাহলে আমাদের সবাইকে এই আশীর্বাদ করুন আমরা যেন সবাই মিলে সুস্থ শরীরে এখানে বসবাস করতে পারি। সন্ন্যাসী শুনে খুব খুশি হলেন তিনি বললেন বেশ তাই হবে। কিন্তু তোমাদের একটা কাজ করতে হবে। যদি পারো তাহলে তোমাদের মঙ্গল হবে।
নিশ্চয়ই পারবো। বলুন কি করতে হবে।
তিনি বললেন তাহলে মন দিয়ে শোনো। সামনে বটগাছ আছে তার তলায় কালো পাথর টা রেখে বাবা দক্ষিণরায় জ্ঞানে পূজা করবে। বটগাছ থেকে উত্তর দিকে কিছুটা দূরে একটা বেদি তৈরি করে হাতের মাপের একটা রক্ষা কালী মূর্তি তৈরি করে পূজা করবে বছরে একবার বৈশাখ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের মধ্যে শনিবার অথবা মঙ্গলবার।
তখন ঐ বৃদ্ধ লোকটি বাবাকে বলেন - পূজা তো হবে কিন্তু পূজার বাসন তো আমাদের নেই বাবা।সন্ন্যাসী বলেন - কোনো চিন্তা নেই। বটগাছের ঈশানকোণে ঐ যে পুকুরটা দেখা যাচ্ছে, পূজার আগেরদিন একজন পূর্ণ বয়স্ক মহিলা সারা দিন উপবাস থেকে সন্ধ্যাবেলা অর্থাৎ গোধূলি লগনে ওই পুকুরের ঘাট একটি প্রদীপ জ্বেলে ওখানে রেখে ভক্তিভরে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে আসবে - আমরা আগামীকাল তোমার এবং বাবা দক্ষিণ দ্বারে পূজা দেবার মনস্থ করেছি। পূজার বাসন গুলো দিয়ে দিও মা। এই বলে ওখান থেকে চলে আসবে। পরের দিন ভোরে ওখানে গেলেই বাসন পেয়ে যাবে। দুপুরবেলা একটা সাদা ছাগ বলি দিয়ে দক্ষিণ রায়ের পূজা হবে আর রাত্রিবেলা একটা কালো চোখ বলি দিয়ে রক্ষা মায়ের পূজা হবে। পুজো হয়ে গেলেই পরের দিনে বাসন গুলো ভালো করে মেজে, ধুয়ে গুছিয়ে রেখে বলে আসবে - পূজা হয়ে গেছে তোমার ভাষণ তুমি নিয়ে নাও মা। ওই কাজটিও গোধূলি লগনে করতে হবে তাহলেই যেখানে কার জিনিস সেখানেই চলে যাবে এই কাজটি যদি করো তাহলেই তোমাদের সব আশা পূর্ণ হবে। আর যে কোন অসুখই হোক না কেন মায়ের বেদী ধুয়ে সেই জল রুগীকে খাইয়ে দিলে তার রোগ সেরে যাবে। বাবার বাঘ তোমাদের এই ৫০০ বিঘা জমির চতুর্দিকে বেড় দিয়ে পাহারা দেবে যাতে বাইরের কোন জন্তু জানোয়ারের ভিতরে ঢুকে কোনরূপ ক্ষতি করতে না পা এই কথা বলে সন্ন্যাসী বিদায় নিলেন সেই থেকেই গ্রামের মানুষ এই পূজা করে আসছে। আরো শোনা যায় প্রায় ১০০ বছর আগে এক মহিলা সারাদিন উপবাস করে পূজা করেন। কিন্তু নিয়ম মেনে তিনি যখন পরেরদিন পূজার বাসন পুকুরপাড়ে রেখে আসেন তখন লোভ সামলাতে না পেরে একটি কাঁসার জামবাটি নিজের কাছে রেখে বাকি বাসন ঘাটে রেখে আসেন। বাসনপত্র যথাস্থানে চলে
যায়। কিন্তু পরের বছর একই নিয়ম মেনে পূজার বাসন পত্র আর আসে না। । তখন
পুরোহিত বলেন যে ওই মহিলার লোভের শাস্তি। ঠিক আছে আমি বাসনের ব্যবস্থা
করছি। এই বলে নিজে বাসন নিয়ে আসেন এবং পূজার আয়োজন করে। ১৯৪৩ সালে যখন
দুর্ভিক্ষ হয় তখন থেকে পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। আর গ্রামের মানুষ নানা রকম
মানত করে থাকেন সারা বছরেই। যারা সন্তান কামনায় মানত করেন তারা এই গাছের
গোড়ায় দক্ষিণ রায়ের বেদিতে মাটির ছোট ছোট ঘোড়া কুমোরদের কাছ থেকে তৈরি
করে নিয়ে পুজো দেয়। সেই ঘোড়াগুলি আজও মন্দিরের বেদীর চারিদিকে রয়েছে।
ঝিনটির
কথা শেষ হয়। মন বলে ওঠে এইসব গ্রামীণ গল্প শুনতে খুব ভাল লাগে। ঝিন্টি
প্রতিবাদ করে ওঠে - এগুলো মোটেও গল্প নয় এগুলো সব সত্যি। মনন তর্ক করে না।
ক্রমশ