ছোটগল্প।। নির্ঝরের প্রতীক্ষায় ।। গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
নির্ঝরের প্রতীক্ষায়
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
..(এক)......
রোগটা ভালোমতই পাকিয়েছিল কিংশুকের। টানা তিনমাস বিছানায়। যদিও আশৈশব রোগব্যাধির সাথে তার নিবিড় সখ্যতা। আজ এটা তো কাল ওটা --- একটা না একটা লেগেই আছে। তবু এবারেরটা যেন একটু বাড়াবাড়ি রকমের। শরীরটা ভালোই ভেঙেছে। এমনিতেই রোগাপাতলা চেহারা। রোগে ভুগেভুগে আরো যেন হাড্ডিসার। গাল ভেঙে প্রকট হয়েছে হনু। গজালের মত ঠেলে বেরিয়েছে কণ্ঠার হাড়। চোখদুটো ঢুকেছে কয়েক ইঞ্চি গর্তে। গৌরবর্ণ গাত্রের ফাক্যাসে আভায় ফুটে উঠেছে রক্তাল্পতার লক্ষণ। মাথার ঝাকড়মাকড় চুলগুলো দীর্ঘদিন না কাটায় যেন পাখিরবাসা! তবে চুলের ব্যাপারটা তার ক্ষেত্রে একটু অন্যরকম। তেল-সাবান-চিরুনি দিলেও কেশপ্রশাধনের সখ তার হালে কোনোদিনই পানি পায় নি।
আসলে নিজের শরীর, বেশভূষা সম্পর্কে চিরকাল বড্ড উদাসীন কিংশুক। কেউ এ নিয়ে ফুট কাটলে ঠাট্টা করেই জবাব দেয়,"এই কাটখোট্টা শরীরটাকে সাজালে-গোজালে কেমন হাস্যকর লাগবে বলো দেখি!" তা বলে কেউ যদি মনে করে শরীরের শ্রীহীনতা নিয়ে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা আছে --- তবে আবার সেটা মস্ত বড় ভুল। যারা তার ঘনিষ্ঠ, তারামাত্রই জানে যে এমনি ধাঁচের মানুষ কিংশুক। তবে তারা এও বলে --- শুধুই বলেই না --- তাদের বদ্ধমূল ধারণাও বটে, যে কিংশুক বড্ড বেশি অন্তর্মুখীন, আত্মমগ্ন। কবিমাত্রই ভাবুক হয় --- কেউ কেউ কিংশুকের আত্মভাবের এমন একটি সরল বিশ্লেষণও করে থাকে। কিন্তু কিংশুক নিজেকে পুরোদস্তুর কবি ভাবতে একেবারেই নারাজ। তবে সে অস্বীকার করে না যে কবিতার সাথে যেন তার আজন্মের সম্পর্ক। কবিতা তার আত্মার সুহৃদ। বেদিশা চিন্তার আশ্রয়। ব্যথার শান্তি। একটু আধটু কবিতা লিখলেও --- সবটুকু ভালো লাগা যেন কবিতা পাঠেই। পড়তে পড়তে ভেসে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া। একাত্ম হয়ে যাওয়া কবিতার গভীর থেকে গভীরতর অন্তরে। যে কবিতার শব্দচিত্র যদি কখনো তার কাছে তার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবির মত ঠেকে, তবে তো আর কথাই নেই! সেই কবিতা শুধু তাকে আপ্লুতই করেনা --- সম্পূর্ণ অধিকার করে বসে অনায়াসেই। যেহেতু মনের চাওয়ায় সবটুকু জুড়ে শুধুই কবিতা, তাই কবির বাছবিচার নেই। রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ থেকে শুরু করে শক্তি-সুনীল-জয় --- সবাই স্বাগত তার কাছে। আবৃত্তির গলাটিও তার দারুণ। তার চেহারার সাথে একেবারেই মানানসহি নয়। ভরাট। সুমিষ্ঠ। শ্রুতিসুভগ। একবার যে শোনে বারবার তার আবদারে জেরবার হতে হয়। যদিও রোগ থেকে ওঠার পর গলার স্বরটা যেন একটু বেতালা। ফ্যাসফ্যাসে। ভাঙাভাঙা। কিংশুক এনিয়ে কিছুটা চিন্তান্বিতও, তবে তার চিকিৎসকটি তাকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে,"ও কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।" মানুষটার উপর তার অগাধ আস্থা। যতবারই বিছানা নেয়, ততবারই ঠিক তাকে টেনে তুলে আবার খাঁড়া করে দেন। তাছাড়াও মানুষটার সাথে তার ঠিক ডাক্তার-রুগীর সম্পর্ক নয়। ছোটকাকার বন্ধু। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছে। খুব স্নেহ করেন তাকে। কাকার বন্ধু বলে ডাক্তারকাকু বলেই তাকে ডেকে এসেছে এতকাল।
"তুমি বরং কিছুদিন হওয়াবদল করে এস কোথা থেকে.... ওষুধপথ্যিতে রোগ সারে, কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধার করতে ওটাই মোক্ষম দাওয়াই।" ডাক্তারকাকু বলেছিলেন।
শরীরস্বাস্থ্য নিয়ে আর কবে ভেবেছে কিংশুক? নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল, "কোথায় আর যাব?"
--- তুমি যদি যেতে চাও তো আমি একটা ব্যবস্থা করতে পারি।
নিছক কৌতূহলেই প্রশ্ন কিংশুকের,"কোথায়?"
জবাবে যেন একটুকরো ছবি মেলে ধরলো ডাক্তার কাকু, "এই বাংলাতেই। অরণ্য, টিলা, ঝর্ণা, আদিবাসী গ্রাম, নির্জনতা ... যাবে?"
কেমন যেন লোভ হয় কিংশুকের।
"গেলে মন্দ হয় না।"
"ঠিক আছে আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। ওখানে আমার এক বন্ধুর একটা বাংলো আছে। সেও ডাক্তার। তার বাবাও ডাক্তার ছিলেন। এখন কেউ থাকে না। একজন কেয়ারটেকার আছে। সে-ই দেখাশুনা করে।"
দিন দুয়েকের মধ্যে সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। চেনা ঘেরাটোপের বাইরে এই প্রথম পা রাখলো কিংশুক। ডাক্তারকাকু এতটুকু বাড়িয়ে বলেন নি। সবুজ প্রাণপ্রাচুর্যের অপূর্ব লাবণ্যে ভরা শান্ত অরণ্য। গাছেগাছে পাখির কূজনে যেন সদ্য বুলিফোটা শিশুর উচ্চারণের আনন্দ। আকাশ-দর্পণে অরণ্যমনের যেন অবিকল প্রতিচ্ছায়া। উপাসনালয়ের ভাবগাম্ভীর্যে ধ্যানস্থ চারপাশের নীরবতা। কিংশুক অবাক হয়ে ভাবে --- তার নাদেখা অচেনা পৃথিবীটার কতই না রং! এত মুগ্ধতার মাঝেও কোথাও যেন খচখচ করে আক্ষেপ! আরোআরো কতই না রং আছে এই রঙবাহারি পৃথিবীটার! এতকাল অদেখাই রয়ে গেছে তার! হয়ত তার সিংহভাগই এজীবনে আর দেখা হয়েই উঠবে না। মনেমনে হাসে কিংশুক। সবকিছু ধরে রাখার জন্য আর কতটুকুই বা এই জীবন-পাত্রখানি? পরক্ষণেই দিক পরিবর্তন করে ভাবনান্তরে যাওয়া মনের সখেদ প্রশ্ন --- যাকে আপনকরে পেতে চেয়েছিল, তারজন্য এই জীবনায়তনের পরিসরটুকু তো যথেষ্টই ছিল, তাহলে? মনটা ধূসর হয়ে উঠলো বিষাদে। কেন হারিয়ে গেল সুমনা?
আপাতত দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে এসেছে কিংশুক। পাওনা যা ছুটি ছিল সে সব তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। এখন মেডিক্যাল-সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়ে কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছে চাকরিটা। কিন্তু এভাবে আর খুব বেশিদিন চলবে না। এ ক'টা দিনের মধ্যে যেমন করেই হোক তার শরীরের বল-তাকত ফিরিয়ে আনতেই হবে। শরীরটা এখনো যথেষ্টই দুর্বল। হাঁটতে গেলে পা টলে। হাঁফ ধরে। মাথা ঝিমঝিম করে। এখানে শুয়েবসে আর কবিতার বই পড়ে অলস সময় কাটে। এতটুকুও নড়ে বসতে হয় না। তাকে বেশ মনে ধরেছে বুধনের -- এ বাংলোর কেয়ারটেকার। খুব করিতকর্মা লোক। না চাইতেই সব কিছু এনে হাজির করে হাতের কাছে। তার উপরে রান্না করে খাওয়ানো, স্নানের জল তুলে দেওয়া, কাপড় কেচে দেওয়া --- এতটুকুও ত্রুটি নেই তার যত্নে, আন্তরিকতায়। নেই ক্লান্তি। বিরক্তিও। মুখে সদাই হাসি। আর সেই হাসি যেন অরণ্যলালিত জীবনের অনাবিল সারল্যের এক অনুপম দ্যুতি। মানুষটাকে বড় ভালোলাগে কিংশুকের। ভালোলাগে এই বাংলোটাকেও। ঠিক যেন ক্যালেন্ডারে দেখা ছবির মত। ছায়া-সুশীতল শান্ত প্রতিবেশে একচালা বাড়ির আদলে ছোটর উপর ছিমছাম। যেন অরণ্য স্নেহসিক্ত এক টুকরো কোমল শান্তিনীড়। সামনে একফালি বারান্দা। খান দুয়েক বেতের চেয়ার। যেখানে বসলেই মনকে চোখ ঠারে অরণ্য। নিজেকে আর খেয়াল থাকে না। বাংলোর ঠিক পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া --- অষ্টাদশীর তরুণিমায় উচ্ছল। বাংলোর ঢালু চালে থোকাথোকা ফুল ঝরিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে চপল পুলকে আপনমনে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। চুপচাপ বসে অপলক চেয়ে কিংশুক হারিয়ে যায় শাল-পিয়াল-পলাশ-মহুয়া-আকাশমনির ওই নিবিড় শ্যামলিমায়। কখনো উদাস করে পাখির গান। কত সুরেই না তারা ডেকে যায়! দু একটা ধরাও দেয় দৃষ্টিপথে। কী শোভা! কী রঙের বাহার! কী নাম পাখিগুলোর? জানা নেই তার। এই না জানার জন্য একটা কষ্ট বোধ করে তখন সে।
একটা পাকা সড়ক চলে গেছে পুব থেকে পশ্চিমে। মাঝেমধ্যেই ওই সড়ক ধরে ছুটে চলে যায় ইজারাদারদের কাটবোঝাই লরি। কিংবা বনবিভাগের জীপ। গাড়িগুলো একঝলক দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যায় গাছ-গাছালির অন্তরালে। রাত বাড়ার সাথেসাথে কমে আসে গাড়িগুলোর চলাচল। তারপর একসময় সম্পূর্ণ স্তব্ধ। শুনশান পথ তখন নেতিয়ে থাকে বনভূমির নিঝুম কোলে। রাত বাড়লেই অরণ্য রহস্যময়ী। গা ছমছম নীরবতা। নিশাচর শ্বাপদের পায়েপায়ে খসখস, খসখস। রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানি। একটানা ঝিঁঝির গুঞ্জন। নৈঃশব্দের নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে জংলা আঁধার। অনেক রাতে হঠাৎ কোনো জান্তব আর্তনাদ! ঘুম ছুটে যায় কিংশুকের। শিহরণ খেলে যায় গোটা শরীরে। একটা বিভৎস দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এক হিংস্র জানোয়ারের নখদন্তে ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে আরেকটা নিরীহ জীব। একজনের গর্জনে নিষ্ঠুরতার উল্লাস, অন্যজনের আর্তনাদে অসহায়তার আবেদন। একটু পরেই অরণ্য আবার নিশ্চুপ। আর ঘুম আসে না কিংশুকের। কানপেতে সজাগ হয়ে শুনতে চেষ্টা করে সেই শব্দটাকে। সেই....সেই শব্দটাকে। কালরাতেই প্রথম শুনেছিল। যেন সমবেত রমনীকণ্ঠের দূরশ্রুত মৃদু হাস্যধ্বনি। বস্তুত ওই শব্দ ঝরনার পথচলার। আজ সকালে বুধনকে শুধিয়ে জেনেছে --- ক্রোশটাক দূরেই অবস্থান ওই ঝরনাটার।
কিংশুকের মন টেনেছে ওই অলখঝোরা। যেমন টেনেছিল একদিন সুমনা। কৈশোরের বেড়া টপকে যৌবনের দরজায় উঁকিঝুঁকি দেওয়ার বয়স তখন তার। পাশের বাড়িতে ভাড়া এলো সুমনারা। সুমনা আর ওর বাবা-মা। সুমনার বাবা-মা খুব আলাপী আর মিশুকে। নিজে থেকে এসেই কিংশুকদের বাড়ির সবার সাথে আলাপ-পরিচয় করে গেল। অল্পদিনের মধ্যেই দুটো পরিবারের মধ্যে গড়ে উঠলো ঘনিষ্ঠতা। আর সেই সুবাদেই কিংশুকদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু হলো সুমনার। ভারি মিষ্টি মেয়ে! ভাসাভাসা দুটো চোখ। টুসটুসে গাল। তুলতুলে ঠোঁট। নিখুঁত চিবুক। কথায়কথায় চোখেমুখে উপচে পড়তো হাসি। হাসলে সুন্দর টোল পড়তো গালে। প্রথম-প্রথম কিংশুক লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো সুমনাকে। বড্ড লাজুক আর মুখচোরা স্বভাবের ছিল কিনা সে। কিন্তু সুমনা ঠিক তার বিপরীত। শিশুর মত সহজ, সরল, স্বচ্ছন্দ্য। দ্বিধাহীনচিত্তে সে আসতো কিংশুকের কাছে। কলকল করে কথা বলতো। প্রাণখুলে হাসতো। বলা যেতেই পারে, সুমনার স্বভাবগুনেই কিংশুক তার স্বভাবসিদ্ধ আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। দুজন দুজনার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল।
.......(দুই).......
কিংশুকের কাছেই কবিতাকে ভালোবাসতে শিখেছিল সুমনা। যদিও প্রথম প্রথম অধিকাংশ কবিতারই অর্থ বোধগম্য হতো না তার কাছে। নিরুৎসাহ বোধ করতো। হতাশ হয়ে বেহাল গলায় বলতো,"দুর, যার মানেই বোঝা যায় না, তা' পড়ে কী হবে? অর্থবহ একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে তখন কিংশুক বলতো,"জীবনের কোনো একটা মস্ত জটিলতার পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি হলো গিয়ে একটা কবিতা। অ্যাতো সহজে কি মানেটা ধরা দেয়? জীবনটাকে বুঝতে যেমন সময় লাগে, কবিতাকেও তাই।" প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে কবিতার অর্থ বুঝিয়ে দিতে লাগলো কিংশুক। তারপর একটু একটু করে নিজেই বুঝতে শিখে গেল সুমনা। পড়ামাত্রই কবিতার মর্মার্থ যখন প্রাঞ্জল, তখন জন্মালো অনুরাগ। কিংশুকের মতই কবিতাকে সম্পূর্ণ ভালোবেসে ফেললো সুমনা।
কিংশুকের কণ্ঠে কবিতা শুনতে কী ভালোই না বাসতো সুমনা! বিশেষকরে ওই কবিতাটা। অনেকবার শুনেও বারবার শুনতে চাইতো।
"আরেকবার শোনাও না কিংশুকদা
....'যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে/সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,/যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,/যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া...."
কিংশুক তারপর থেকে শুরু করতো
, "... মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,/দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা,/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনই অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।।....."
স্বরক্ষেপণের নিখুঁত প্রক্রিয়ায়, উচ্চারণের সুগভীর ব্যঞ্জনায়, শব্দে-ছন্দে-ভাবে কবিতাটি যেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের গাম্ভীর্যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতো কিংশুকের কণ্ঠে।
সুমনার অপলক মুগ্ধ দৃষ্টি তখন স্থির হয়ে থাকতো কিংশুকের মুখে। এক-একদিন, কেন জানি অমন দুটির চোখের আলোয় মুখ তুলে চোখ পাতলেই কেমন যেন আনমনা হয়ে যেত কিংশুক। মনঃসংযোগ ছিন্ন হতো। সুর কাটতো। তাল ভাঙতো। মাঝপথে কবিতা পাঠে ইতি টেনে চুপ করে যেত।
সুমনা জানতে চাইতো,"কী হলো কিংশুকদা থেমে গেলে যে?"
একটা দীর্ঘশ্বাস মুক্তি দিয়ে কিংশুক বলতো,"আজ আর নয়, আরেক দিন হবে...."
সুমনা অবাক হয়ে বলতো,"কেন কিংশুকদা?
কিংশুকের নির্লিপ্ত উত্তর,"সব 'কেন'-র উত্তর কী ছাই আমিও জানি!"
আর পীড়াপীড়ি করতো না সুমনা।
সত্যি তো কেন এমন হয়? কেন ওই দুটো চোখ সবকিছু গোলমাল করে দেয়? কেন ভাবের ছন্দপতন ঘটে? কেন কবিতার মালাখানি ছিঁড়ে গিয়ে পুঁতির মত এলোমেলো ছড়িয়ে পড়তে চায় শব্দগুলো? কিছুতেই যেন কোনোকিছু বুঝে উঠতে পারতো না কিংশুক। তবে বুঝেছিল ---- বুঝেছিল আরো বেশ কিছুদিন বাদে। যেদিন দুজনার কবিতা পাঠের আসরে একটা বেয়াদপ আরশোলা কোথা থেকে উড়ে এসে হঠাৎকরে সুমনার গায়ে এসে বসেছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়ে সুমনা এমন লম্ফঝম্ফ শুরু করে দিয়েছিল যে কিংশুক আর হেসে বাঁচে না! এখানেই কিন্তু শেষ হয়ে যায় নি ব্যাপারটা। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে অতঃপর আর যা সে করে বসেছিল, তা' যে তার পক্ষে কখনো করা সম্ভব হতে পারে --- তা' কিংশুকের কল্পনাতেও আসে নি কোনোদিন। বাবাগো মাগো বলে চিৎকার করতে করতে একছুটে এসে আচমকা জাপটে ধরেছিল কিংশুককে। একটা তপ্ত তরঙ্গ চকিতে খেলে গিয়েছিল কিংশুকের রক্তপ্রবাহে। থরথর করে কেঁপে উঠেছিল হৃদপিন্ডটা। বিহ্বল উত্তেজনার সেই চরম মুহূর্তে প্রথমবারের মত কিংশুক উপলব্ধি করেছিল --- সুমনাকে সে ভালোবাসে।
সম্বিত ফিরে পেতেই একঝটকায় সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। ভীষন লজ্জা পেয়ে, সঙ্কুচিত হয়ে সুমনার কিংশুকের মুখপানে তাকাবার এতটুকু শক্তি পর্যন্তও যেন আর অবশিষ্ট ছিল না। কোনদিকে না তাকিয়ে একছুটে পালিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। দুদিন আর আসে নি। মনেমনে খুব হেসেছিল কিংশুক। তারপর থেকে এই ঘটনাটাকে মজার খোরাক করে সুমনাকে খুব ক্ষেপাতো কিংশুক,"আরে আরে ওই দেখ, ওই দেখ একটা আরশোলা..."
প্রথম প্রথম বিশ্বাস করে নিয়ে তিড়িংতিড়িং লাফালাফি শুরু করে দিত সুমনা, তারপর যখন বুঝতো সবটাই মজা, বেজায় চটে উঠে বলতো,"খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু কিংশুকদা, এই বলে রাখলাম।"
--- খারাপ আর কী হবে শুনি? তুমি ভয় পেয়ে, চিৎকার করে, দিশেহারা হয়ে ..... তারপর?
লজ্জায় মরে গিয়ে সুমনা চোখ নামিয়ে খুব নিচুগলায় বলতো,"তুমি না একেবারে যা-তা .... অসভ্য.."
হো হো হেসে উঠতো কিংশুক।
ভালোবাসার মাঝে একটু একটু করে বাসা বাঁধে আশা। সে আশা -- সুমনাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার। তবু মনের ভিতরে কোথায় যেন একটা 'কিন্তু' খচখচ করেই চলে। সুমনা কি তাকে ভালোবাসে? তাদের বাড়ির দুচারটে বাড়ির পরেই থাকতো কুনালদা। বেচারি প্রেম করে দারুন চোট খেয়েছিল। দেখা হলেই দুঃখ করে বলতো,"বুঝলি, মেয়েদের ভালোবেসে কখনো নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। ওরা ভালবাসতেও জানে আবার ভালোবাসা নিয়ে খেলতেও জানে।" না না, সুমনা মোটেও সে ধরনের মেয়েই নয় -- সবরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে মনেপ্রাণে এই বিশ্বাসটাকেই নিজের মধ্যে সংহত করতে চাইতো কিংশুক। তবুও যেন কিছুতেই ওই 'কিন্তু'টাকে ঘোচাতে পারতো না। একদিন তাই সঙ্কোচের সব বাঁধা কাটিয়ে উঠে প্রশ্নটা করেই বসলো।
এতটুকুও লজ্জা নয়, বরং প্রশ্নটা শুনে যেন হেসেই বাঁচে না সুমনা।
"এমা তুমি জানো না? তুমি কী গো কিংশুকদা? ঘরময় ফুলের সৌরভ তবু তুমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইছো --- বৃক্ষ তোমার ফুল কি ফুটিয়াছে?" বলেই আবার হেসে উঠেছিল পাহাড়িয়া নদীর উচ্ছ্বাসে। হাসতে হাসতেই বলেছিল,"এখনো বোঝো নি?"
---- হুম, বুঝেছি।
---- কী বুঝলে?
সুমনার দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে কিংশুকের প্রতিপ্রশ্ন,"কী বুঝলাম বলো দেখি?
কিংশুকের দুটো হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে থেমে থেমে উচ্চারণ করেছিল সুমনা, "আমি...তোমাকে...ভালো... বাসি।"
ওই ভালোবাসি শব্দটুকুর মধ্যেই কিংশুক সেদিন খুঁজে পেয়েছিল ভালোবেসে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার নিশ্চিন্ত প্রত্যয়। ভালোবেসে ভালোবাসাকে জয় করার মধ্যেই তো ভালোবাসার সবটুকু স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নসম্ভবের আশ্বাস তাকে যেন এক স্নিগ্ধ-সাফল্যের প্রসন্নতায় একেবারে কানায় কানায় করে দিয়েছিল। একবারের জন্যেও এ সংশয় উঁকি দেয় নি মনে --- সত্যি তো, মুখের কথায় কতটুকু মুখর হয়ে ওঠে হৃদয়ের সংবাদ! ভালোবাসার কতটুকু স্পন্দন অচঞ্চল হয়ে ওঠে ওই 'ভালোবাসি' উচ্চারণে? সেদিন নয়, আজ কিন্তু বারবার অবাক হয় কিংশুক --- কেন সেদিন এ প্রশ্নগুলো একবারের জন্যও তার মনের মধ্যে জাগলো না!
কোথা দিয়ে কেটে গেল দুটো বছর। দুটো বছর! দুটো প্রাণ ততদিনে প্রেমের পানসিতে ভেসে পার হয়ে গেছে স্বপ্নের অনেকটাই পথ। তারপর এল সেই দিনটা! অঘটনের মত আকস্মিকতায়। সুমনার ঝলমলে মুখখানি কেমন যেন বদলে গিয়েছিল সেদিন। ঘনকালো মেঘে ঢাকা শাওনের আকাশের মত। দুষ্টুমির ঝিলিক নয়, দুটি চোখে ছিল আহত বিবর্ণতা! অধরোষ্ঠের মাঝে সদা ফুটে থাকা শ্বেতকরবী হাসির সতেজ পাপড়িগুলো যেন ঝরে গিয়েছিল কোনো এক আকষ্মিক ঝঞ্ঝাবাতে। সুমনার এমন বিষণ্ন প্রতিমাসম রূপ আগে কোনোদিন দেখে নি কিংশুক। সোৎকন্ঠে শুধিয়েছিল, "কী হয়েছে তোমার সুমনা?"
সুমনার দুটো ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছিল। দুগাল বেয়ে অশ্রুধারা।
"আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি কিংশুকদা,...."
হতচকিত বিস্ময়ে চমকে উঠেছিল কিংশুক। তারপর অনেকগুলো প্রশ্ন পরপর ---
"কোথায়? কেন? কবে?"
--- শিলিগুড়ি। বাবার বদলির অর্ডার হয়ে গেছে। আগামী মাসেই চলে যেতে হবে।
একটা প্রকান্ড অবিশ্বাস্যতার বিভ্রান্তিতেই যেন বলে উঠেছিল কিংশুক, "তুমি চলে যাবে সুমনা?"
--- আমি তো যেতে চাই না.... তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না .... কিন্তু ....
--- তাহলে কিসের কিন্তু?
নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে নি সুমনা। ভেঙে খানখান হয়ে যেতে যেতে বলেছিল, "আমি জানি না ... জানি না ....জানি না ....."
আর কিছু জানতে চায় নি কিংশুক। সুমনার ওই অশ্রুকাতর বিপন্নতাই বুঝিয়ে দিয়েছিল ওই না বলা 'কিন্তু' র মর্মকথা। একরাশ যন্ত্রণার তীব্র অনুভূতি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল : জীবনের বাস্তবতার কাছে কতই না অসহায় ভালোবাসার আবেগ। তবু আকুল হয়ে ভাবে, ভালোবাসার মৃত্যু নেই। ভালোবাসা আকাশের মত সীমাহীন। সমুদ্রতরঙ্গের মত চিরন্তন। দূরত্বের ব্যবধান তাই দুটি ভালোবাসাকে কোনোদিন বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। ওই সূর্য আর মাটির পৃথিবীটার মতই। দুজনার মাঝে কতই না আলোকবর্ষের দূরত্ব! তবু ভালোবাসার আলো-উত্তাপে কেমন একে অন্যকে ছুঁয়ে আছে অনায়াসে।
কিংশুক বলেছিল , "আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো সুমনা।"
সুমনা শুধুই কেঁদেছিল। যাবার দিন কান্নাভেজা গলায় বলেছিল, "আমার তো কোনো নিজস্ব মোবাইল ফোন নেই, তাই নিজের জন্য একটা ফোনের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত আমি অন্য কোনো ফোন থেকে যোগাযোগ রাখবো তোমার সাথে। তোমার ফোন করার কোনো দরকার নেই।"
কিংশুক বলেছিল, "শুধু এটুকু জানবে, আমি সবসময় তোমার ফোনের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকবো।"
প্রথম দেড়বছর সুমনা তার কথার এতটুকুও নড়চড় করে নি। মোটামুটি নিয়ম করেই ফোন করে গেছে কিংশুককে। তারপর হঠাৎ করেই একদিন সুমনার দিক থেকে ফোন আসা বন্ধ হয়ে গেল। একদিন...দুদিন...তিনদিন...গোটা একটা সপ্তাহ কেটে গেল। একবারের জন্যও ভেসে এলো না সুমনার কণ্ঠস্বর। কিংশুকের ভাবনায় মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে উৎকণ্ঠা। একটি বিশেষ নম্বর থেকে সাধারণত ফোন আসতো সুমনার। একদিন বাধ্য হয়েই ওই নম্বরে ফোন করলো কিংশুক। ওপাশে ফোনটা বেজেই গেল। কেউ ধরলো না। আবার ফোন করলো কিংশুক। একই ঘটনা ঘটলো আবার। আবারো করলো --- আরো কয়েকবার। পরপর আরো কয়েকদিন। হঠাৎ একদিন ওপাশের রিংটা থেমে গিয়ে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো, "কে বলছেন? .... না না, এটা সুমনা-টুমনার নম্বর নয় .... ভুল নম্বরে করেছেন..." ওই শেষ। তারপর থেকে ওপাশে ফোনটাও আর বাজতো না। কখনো বলতো ---- "স্যুইচড অফ", আবার কখনো বা "উপলব্ধ নেই"। সমস্ত ঘটনাটা কিংশুকের কাছে এতটাই গোলমেলে ঠেকেছিল যে কোনোকিছু আন্দাজ করে নেওয়াটাও যেন সহজসাধ্য ছিল না।। তবে কিছু একটা যে ঘটেছে --- সেটা ধরে নিতে তার কোনো অসুবিধা হয় নি। কিন্তু কী সেটা? রাগ? অভিমান? হঠাৎ করে তেমন কিছু ঘটতেই বা যাবে কেন? তবে কোনো ভারী অসুখ? এতটাই যে ফোনটাও ধরতে পারছে না? তা' সে যা-ই হোক না কেন, কাউকে দিয়েও তো তার ঠিক কী হয়েছে -- সেটা জানিয়ে দেওয়া যেত। তাছাড়া, কিংশুক যে তাকে এতবার ধরে ফোন করে চলেছে -- সেটা কি ও জানতে পারে নি? এমনটা কি সম্ভব? তাহলে? চিন্তা থেকে দুশ্চিন্তা! মন ব্যস্ত হয়ে উঠলো। দিন যত যায়, বেদিশা চিন্তায় আরো তীব্র হয়ে উঠতে লাগলো মনের উচাটন। হঠাৎ মনে পড়লো তার দূরসম্পর্কের এক দাদার কথা। তখন শিলিগুড়িতেই পোস্টিং। অনেক খুঁজেপেতে তার ফোন নম্বর জোগাড় করলো কিংশুক। তারপর ফোন করে সুমনার বাসার ঠিকানা জানিয়ে তার খোঁজখবর নেওয়ার অনুরোধ জানালো তাকে। দিন-দুই বাদেই ওই দাদা খবর নিয়ে ফোন করে জানিয়েছিল যে, ওই ঠিকানায় সুমনারা আর থাকে না। এখন যারা সেখানকার নতুন বাসিন্দা তারা সুমনাদের কোনো খবর জানা তো দূরের কথা, চোখেও দেখে নি কোনোদিন। ওই বাড়ির মালিকও শিলিগুড়িতে থাকে না, থাকে জামশেদপুরে। শিলিগুড়ি থেকে যা অনেক দূরে। তাই সেইসূত্র থেকেও কোনো সংবাদ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। কিংশুক কিছুতেই ভেবে উঠতে পারলো না --- কেন সুমনা আচমকাই বন্ধ করে দিল ফোন করা? তাহলে কি আর কোনরকম সম্পর্কই রাখতে চায় না তার সাথে? কিন্তু কেন? যে সম্পর্ক রাখতেই পারবে না, তা করা কেন? কিংশুক যেন বিশ্বাসই করতে পারে না যে একাজ সুমনা স্বেচ্ছায় করেছে! সুমনা তাকে ভালোবাসে। হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যি বাসে। আচ্ছা, সত্যিই কি বাসে? বিশ্বাসে একটা আলতো টুসকি মেরে যায় সংশয়। কুনালদার কথাই কি তাহলে ঠিক? তাই যদি হবে, তাহলে ভালোবাসা কাকে বলে? মরিয়া হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করেছিল কিংশুক। ভালোবাসা কি শুধুই একটা অলীক শব্দ ---- যা মরীচিকার মত কাছে টানে তারপর উত্তাল সাগরের মত চুবিয়ে-ডুবিয়ে আধমরা করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায় ধূ ধূ বালুকাবেলায়! নাকি বিষ্ণু দের সেই কবিতাটাই সত্যি? ---
"আসল কথাটা আমি যা বুঝি/প্রেম-ফ্রেম বাজে। আসলে আমরা নতুন খুঁজি/নারীকে পুরুষ, পুরুষকে নারী তাই তো খোঁজে --/তার ওপর তো সে জীবনের ধর্ম উপরি আছে।/এরি নাম প্রেম।"
কিন্তু মন যে মানতে চায় না কিংশুকের। মনের মধ্যে বদ্ধমূল যে ভালোবাসার অন্যধারণা! ভালোবাসা যে সেখানে ঈশ্বরের মত। বিশ্বাসকে একেবারে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলেছে। যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়েও তাই সে বিশ্বাস করতে চায় যে সুমনা তাকে ভালোবাসে। সুমনা নিশ্চয়ই আবার একদিন ফিরে আসবে তার জীবনে।
.....(তিন).......
কয়েক পা এগিয়েই কিংশুক বুঝলো শরীরের উপর যথেষ্টই অবিচার করা হয়েছে। বেশ দুর্বল লাগছে। হাঁটতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও কী এক অজানা কারণেই ফেরার পথ ধরলো না। গতি আরো মন্থর করে, থেমে থেমে এগিয়ে চললো।
মানুষের পায়ে পায়ে, চাকার ঘর্ষণে, জলে-ঝড়ে জীর্ণ পথে রোদছায়ার এলোমেলো নকশা। সেই পথ কখনো সরলরেখায়, কখনো ডাঁয়ে-বাঁয়ে বাঁক নিয়ে নিয়ে, অরণ্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে গেছে অনেকদূরে। খানিকটা আনমনা চলে থামলো কিংশুক। দুদণ্ড শ্বাস নিল। কানখাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করলো ঝরনাটাকে। ঠিক ঠাহর হলো না। কখনো মনে হলো ডাঁয়ে, কখনো বা বাঁয়ে। কূহকী ঝরনাটার সাথে কোথায় যেন মিল আছে সুমনার! কথাটা ভাবনায় আসামাত্রই ঝরনাটাকে দেখার জন্য প্রাণের ব্যাকুলতা আরো তীব্র হয়ে উঠলো। ব্যস্ত, অসতর্ক হয়ে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে এলো কিংশুকের। পথের পাশে একটা মোটাসোটা পিয়াশালের গায়ে শরীরটাকে ঠেকনা দিয়ে জোরেজোরে দম নিতে লাগলো। দুটোচোখও বুজে এলো। আশ্চর্য ব্যাপার! এমন রুদ্ধশ্বাস কষ্টের মধ্যেও সেই সুমনাকেই দেখতে পেল। মুখ তার বড়ই অস্পষ্ট। ধোঁয়াটে। সময় কি তাহলে মুছে দিচ্ছে সুমনাকে? দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছরই হয়ে গেল দেখা-ওদেখার ব্যবধান! আশঙ্কিত কিংশুক স্মরণে আলোড়ন তুলে আলোকিত স্পষ্টতায় খুঁজতে লাগলো সুমনার মুখখানি। মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো। আপনাথেকেই খুলে গেল দুচোখের কপাট! সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছে একজন দেহাতি মানুষ।
"এই ঝরনাটা কোনদিকে বলতে পারো?"
চোখ কুঁচকে মানুষটা দেখলো কিংশুককে। তারপর আঙুল নির্দেশ করলো, "উ-ই দিকে...."
কোনদিকে -- কিছুই বুঝলো না কিংশুক। শুধু বুঝলো ঝরনাটাকে তাকেই খুঁজে নিতে হবে। সুমনাকেও? কোথায় খুঁজবে তাকে? এই বিশাল পৃথিবীটাতে? কেন, কেন সে ভাবছে এত সুমনার কথা? অলস দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকালো। একটা নিঃসঙ্গ চিল আকাশময় কী যেন খুঁজে ফিরছে।
আবার এগিয়ে চললো কিংশুক। চলার গতি এখন সংযত। একটু এগিয়ে ডানহাতের বনস্থলী হঠাৎ যেন ফাঁকাফাঁকা। আর তখনি চোখে পড়লো আকাশ লেপ্টে আছে একটা বিরাট পাহাড়। কিন্তু পাহাড়টার কাছে যাবার পথ কোথায়? হয়তো আছে। জানা নেই তার। বেমক্কা খেয়ালেই নেমে এলো পথ ছেড়ে। পাহাড়টাকে তাক করে দীঘল শাল-পিয়ালের পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগিয়ে চললো পথ করে। একটু পরেই ... ঝরঝর .... ঝরঝর ... একটানা....। কিংশুকের বুকের ভিতরে তোলপাড়। একছুটে ঝরনাটার কাছে যাবার জন্য মনটা ছটফট করে উঠলো। সাবধান করলো শরীর। প্রাণের উচ্ছল বাসনা আশাহত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুদবুদের মত লীন হয়ে গেল।
অনেকটাই উপর থেকে গড়িয়ে নামছিল ঝরনাটা। যেন এক চঞ্চলা কিশোরী নূপুরের রুমঝুম ধ্বনি তুলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষেই একফালি নদী। নির্ঝরের উচ্ছ্বাস তার বুকে ঢেউ তুলে ছুটে চলেছে কোনো এক নিরুদ্দেশের ডাক শুনে। সে কী মিলনের আহ্বানে? প্রেমের স্বপ্ন সার্থক করতে? তবে কি চোখের সামনে ওই উচ্ছলা নির্ঝর আর কেউ নয় --- প্রেমের স্বরূপ? আর তার ওই দুরন্ত ছুটেচলা? প্রেমের শাশ্বত সত্য? তাই যদি হয়, তবে কেন তার বুকের ভিতরে এত শীতলতা? এত স্থবিরত্ব? সহসা যেন তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইলো কিংশুক। সে তার সমস্ত সত্তাকে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে তার নিঝুম ভালোবাসার অস্তিত্বকে নতুন করে অনুভব করতে চাইলো। উদভ্রান্তের মত চিৎকার করে উঠলো ---- সু .... ম ..... না .... আ .... আ....। চারপাশের মসৃণ নীরবতায় কেবল একমুহূর্তের ফাটল! তারপর আবার সব ঠিকঠাক আগের মত। আকাশ-বাতাস-অরণ্য আবার সেই আগের মতই প্রতিক্রিয়াহীন। কিংশুকের বুকে হাপরের মত ওঠানামা। সুমনাকে হারানোর ব্যথাটুকু যেন তার একান্তই নিজের।
একটা বড় পাথরের উপর বসলো কিংশুক। পিছনে আরেকটা বড় পাথরে এলিয়ে দিল শরীরটা। বুকের ঝড় শিরায়-উপশিরায়, রুধিরে ছড়িয়ে গিয়ে থিতিয়ে গেল একসময়ে। চোখ খুলে দেখলো নির্ঝরের খুশি ছেয়ে আছে গোটা আকাশের নীলিমায়। হঠাৎ কেন জানি কিংশুকের বুকের গভীরে গুমরে উঠলো সেই কবিতাটা। মুক্তি দিল তাকে। তাকে সুরে-ছন্দে ছড়িয়ে দিতে লাগলো আবিষ্ট নিসর্গের আলোয়-বাতাসে।
"যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে/সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া .... "
একজোড়া বিমুগ্ধ চোখের অনুপস্থিতিতেই কেমন শেষ হয়ে গেল গোটা কবিতাটা। কথাটা ভাবতেই দুটো চোখ ভিজে উঠলো কিংশুকের।
"আপনি তো খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করেন।"
সচকিত হলো কিংশুক। খুব কাছে দাড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখলো। বছর তেত্রিশ-চৌত্রিশের এক যুবা। স্বাস্থ্যবান। দীর্ঘদেহী। কিন্তু দগ্ধ ক্ষতচিহ্নে কদর্য মুখখানি। হাতে লাঠি।
আমি বোধহয় আপনার খুব কাছেই দাড়িয়ে আছি, তাই না? মানুষটা বললো।
কিংশুক বুঝলো, মানুষটা চোখে দেখে না। একটা কষ্ট অনুভব করলো। সুমনা বলতো -- যারা অল্পেই দুঃখ পায়, কষ্ট পায়, তাদের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতিটাও বড্ড প্রবল। সুমনা বোধ হয় জানেও না --- ভালোবাসাও তাদের বড্ড কষ্ট দেয়।
"আমি বোধ হয় আপনাকে বিরক্ত করলাম।"
নিজের আচরণে নিজেই লজ্জা পেল কিংশুক। তার মৌনতায় মানুষটার এমন ধারণা হওয়া খুবই সঙ্গত। বললো, "না না, একি বলছেন, বিরক্ত হবো কেন?"
--- কারণ একা হতেই তো মানুষ নির্জনতায় আসে।
--- আবার একা হবার দুঃখ ভুলতে মানুষ মানুষকেই খোঁজে।
--- দারুণ বলেছেন তো! আসলে কী জানেন, দুঃখ জিনিসটা বড়ই আপেক্ষিক। যে গানে দুঃখ ভোলা যায় সেই গানই আবার বিষাদস্মৃতির ঘুম ভাঙিয়ে মনকে বেদনার্ত করে তোলে, তাই না? যাক ওসব কথা। জায়গাটা কেমন লাগছে বলুন? খুব সুন্দর, না?
--- হ্যাঁ, অদ্ভুত সুন্দর।
মানুষটার গলায় এবার ব্যথার সুর।
"এমন সুন্দরকে দেখার চোখ দুটোই ভগবান আমার কেড়ে নিয়েছেন। তবে অনুভবে ধরতে পারি। তাই তো ছুটে চলে আসি বারবার। যখন দুচোখে আলো ছিল তখন কতবার, কতভাবেই না দেখেছি এখানে এসে। আজ সেই স্মৃতিচিত্রগুলো এই নির্জনতার স্পর্শে, অরণ্যের গন্ধে ফুটিয়ে তুলি আপনকল্পনায়। তারপর চুপচাপ বসে বসে স্বাদ পাওয়ার চেষ্টা করি সেই ভালোলাগার --- যাকে একদিন দুচোখ ভরে দেখেছিলাম। মন্দ লাগে না, জানেন?"
---- কিছু যদি মনে না করেন .....
---- নিঃসঙ্কোচে বলুন।
---- আপনার চোখ দুটো ...
---- অভিশপ্ত এক দুর্ঘটনায়। মুখটা তো দেখতেই পাচ্ছেন, গোটা শরীরটাও এভাবে ঝলসে গেছে।
মানুষটার মুখ দেখে প্রথমে এরকম কিছু একটারই সন্দেহ করেছিল কিংশুক।
"এই দেখুন এত কথা হলো অথচ আপনার নামটাই জানা হলো না।" কিংশুক বললো।
---- আমার নাম অমিতাভ --- অমিতাভ রায়। নিবাস বেহালা। কলকাতায়। আপনার?
---- কিংশুক দত্ত। কলকাতায় ঠিক নয়, তবে কলকাতার কাছেই থাকি --- সোনারপুরে।
অমিতাভ বললো,"ওই কলকাতাই হলো। সোনারপুর আর কলকাতা থেকে কতটুকু! উঠেছেন কোথায় এখানে?"
---- জায়গাটার নাম বলতে পারবো না। তবে আশপাশের লোক বলে 'ডাক্তার বাংলো'।
---- ডাক্তার বাংলোয়?
---- চেনেন নাকি?
---- চিনি মানে! বিলক্ষণ চিনি। এই অরণ্যের আনাচ-কানাচ সর্বত্র আমার চেনা। কতবার এসেছি --- ঠিক ঠিকানা নেই। যখন চক্ষুষ্মান ছিলাম তখনো এসেছি, এখন বিচক্ষু হয়েও আসি। আপনি বুঝি প্রথম এলেন?
---- হ্যাঁ, এই প্রথম।
---- এবার দেখবেন বারবার আসতে ইচ্ছে হবে। এ অরণ্য জাদু জানে বুঝলেন। ... শুকনো মুখে অনেক কথা হলো, আর নয়। বাকি কথা হবে গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে। চলুন দেখি আমার সাথে।
অবাক হলো কিংশুক।
"কোথায়?"
---- সামনেই আস্তানা গেড়েছি। ফরেস্ট বাংলোয়। মিনিট পাঁচেকের পথ।
আবার অবাক হবার পালা কিংশুকের! তবে এবার অন্য একটা কথা ভেবে।
"আপনার সাথে কেউ আসে নি?"
"কে বললো আসে নি, এই যে...." হাতের লাঠিটা উঁচু করে দেখালো অমিতাভ।
কিংশুক আপত্তি জানিয়ে বললো, "আজ থাক, অন্য একদিন যাব।"
---- অন্য একদিন যদি আপনার সাথে আমার দেখা না হয়?
---- কেন হবে না? আমি তো আবার এখানে আসবো। কাল, পরশু, হয়তো প্রতিদিনই -- যতদিন এখানে আছি।
"আমি যদি না আসি?" বলেই হো-হো হেসে উঠলো অমিতাভ। তারপর আবার বললো"নিশ্চয়ই কোনো কাজ নেই। কারণ কাজ নিয়ে কেউ এখানে আসে না। কাজ থেকে পালিয়েই আসে।"
আমতা আমতা করে কিছু একটা বলে কাটিয়ে দিতে চাইলেও সফল হলো না কিংশুক। তাকে থামিয়ে দিয়ে অমিতাভ বলে উঠলো,"আপনার এত আপত্তি কিসের বলুন তো মশাই? ওখানে গেলে এক কাপ চা আর দুটো কথা বই আর তো কিছু নয়।"
মানুষটা শুধু মিশুকই নয় একটু বেশি সরলপ্রাণ। না হলে দুটো কথার আলাপ আর তাতেই চায়ের নিমন্ত্রণ! এ ধরনের মানুষের অনুরোধ ঠেলা বড় দুষ্কর। তাই না গিয়ে আর উপায় থাকলো না কিংশুকের।
"জানেন, আমার স্ত্রী কবিতা খুব ভালোবাসে ....." চলতে চলতে বললো অমিতাভ, ".... আবৃত্তিও করে দারুণ ..."
কিংশুক উৎসাহ প্রকাশ করে বললো, "তাই নাকি!"
দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে অমিতাভ বলে চললো, " সুযোগ পেলেই কবিতার বই কেনে। জানেন, গোপন প্রেমের মত ওর একটা গোপন খাতা আছে। তাতে চুপিচুপি কবিতা লেখে। ও ভাবে, আমি তো চোখে দেখি না, তাই কিছুই জানি না। কিন্তু আমি যে জানি, ওকে জানতে দিই নি। কী দরকার বলুন। ও যেটা করে আনন্দ পায় পাক না। ওর আনন্দেই তো আমার শান্তি।"
শেষ কথাগুলো যেন স্বগতোক্তির মত শোনালো কিংশুকের কানে।
---- আপনি বোধহয় আপনার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন?
---- ওকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।
বিস্ময়ের ঝটকা লাগলো কিংশুকের। পাশে পাশে চলা মানুষটার অন্ধকার চোখের দিকে তাকালো।
মানুষটা ততক্ষণে আবার বলতে শুরু করেছে, "ভাবছেন, এ আবার কেমন কথা! তাহলে খোলসা করেই বলি, কি বলেন? শিলিগুড়িতে মামাতো বোনের বিয়েতে গিয়ে ওকে প্রথম দেখি ...."
কিংশুকের চকিত প্রশ্ন, "কী বললেন? শিলিগুড়ি?"
---- হ্যাঁ,শিলিগুড়ি। কেন বলুন তো?
---- না, এমনি।
'
অমিতাভ আবার আগের কথার সূত্র ধরলো। তারপর একটানা বলে গেল।
".....হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ওই যে বলে না, লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট --- সে রকম ব্যাপার আর কী! আলাপ হলো। বেশ কয়েকদিন ওখানে থাকার সুবাদে মেলামেশার সুযোগ ঘটলো। আর তাতেই ঘটে গেল হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটি। আমাদের মেলামেশাটাকেও ওখানে কেউ খারাপ চোখে দেখলো না। বরং আমাকে সুপাত্র বিবেচনা করে ওর বাড়ির লোকজন আমার সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে পড়লো। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে জামাইআদরে আপ্যায়ন করলো। শুধু তাই নয়, ওর বাবা আমার বড়মামার কাছে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলো। যা হোক, কলকাতায় ফিরে এলাম একরাশ মনখারাপ নিয়ে। যদিও ফোনযোগে দুটি মনের সংযোগ ছিল, তবু অদর্শনজনিত বিরহে, কী বলবো মশাই, বুকের অনুভব যেন তখন ---- যজ্ঞীয় অনলসম প্রাণদাহকারী।" ইতিমধ্যে বড়মামার মধ্যস্থতায় এবং আমার বাবা-মায়ের তৎপরতায় পাকা হয়ে গেল বিয়ে। আর ঠিক তখনি ঘটে গেল সেই ভয়ানক দুর্ঘটনা --- ফ্যাক্টরিতে, আমার ইউনিটে। আমি তখন ডিউটিতে ছিলাম এ্যাজ এ সুপারভাইজিং হেড। মারাত্মক পুড়ে গিয়েছিল আমার গোটাশরীর। বলা চলে, একরকম বাঁচার আশাই ছিল না আমার! তবু বেঁচে গেলাম --- বেঁচে গেলাম দুটি চোখের চিরদিনের অন্ধকার নিয়ে। কে আর অন্ধ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়? ওরা পিছিয়ে গেল। শুধু একজন ছাড়া --- যাকে আমি আমার মন সঁপেছি। সবার অমতেই এক কাপড়ে সে একদিন চলে এল আমার কাছে। কোনরকম সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াই বিয়ে হয়ে গেল আমাদের। আজ ওরই মাঝে আমার বেঁচে থাকার স্বপ্ন। ওর চোখেই আজ আমি পৃথিবী দেখি। ..... এমন মেয়ে সংসারে ক'জন হয়? এবার আপনিই বলুন, ওকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়?"
কিংশুকের মনে হলো, জীবনের সবক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ জিতে গিয়েও প্রেমের পরাক্রমী শক্তির কাছে বারবার এভাবেই বুঝি হার মেনেছে মানুষের দুর্ভাগ্য! অন্ধত্বের অন্ধকার তুচ্ছ হয়ে গেছে প্রেমের স্বর্গীয় আলোর উদ্ভাসে। জীবন সার্থক অমিতাভর। না-ই বা থাকলো দুচোখের আলো!
কথায় কথায় পথটুকু শেষ। বাংলোর ভিতরে ঢুকে অমিতাভ বললো, "দাড়ান, সুমনাকে ডাকি --- সুমনা ..... সুমনা...
প্রচন্ড একটা বিদ্যুতের শক আচমকাই যেন সপাটে ঝাপট মারলো কিংশুককে ---- গোটা শরীরটা ঝনঝন করে উঠলো। দপদপ করে উঠলো মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো। একটা হিমশীতল স্রোত যেন শিরশির করে নেমে গেল গলাবুক চিরে। শরীরের ভিতরটা খটখটে শুকিয়ে উঠলো, তবু কোনক্রমে জানতে চাইলো, "সুমনা কে?"
অমিতাভ হেসে জবাব দিল, " বুঝলেন না, কে আবার ---- এতক্ষণ যার কথা বললাম আপনাকে --- আমার স্ত্রী..."
স্ত্রী! সুমনা!! শিলিগুড়ি!!! কবিতা ভালোবাসে!!!!
টুকরো টুকরো সূত্রগুলো যেন কোনো ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের আগে ছিটকে যাওয়া দু-চারটে ফুলকি! কিংশুক তার বিচূর্ণ ভালোবাসার রক্তাক্ত অনুভবে আর্তনাদ করে উঠতে চাইলো।
"এসে গেছো সুমনা, পরিচয় করিয়ে দিই...."
শব্দে অথবা নিঃশব্দে এসেছিল সুমনা। টের পায় নি কিংশুক।
সৌজন্যের প্রথানুযায়ী দুহাত জোড় করে নমস্কার জানালো সুমনা।
কিংশুকের বুকে তখন বাত্যাবিক্ষুব্ধ দরিয়ার উথাল-পাথাল তাণ্ডব! দুচোখের বিপন্নতায় এক মর্মান্তিক সত্যকে প্রত্যক্ষ করার প্রচন্ড আতঙ্ক! তবু দুচোখ তুলে তাকে দেখতেই হবে! অন্তর্নিহিত যে দুর্জ্ঞেয় শক্তিতে মানুষ অসাধ্যসাধন করে, সেই শক্তিতেই যেন কিংশুক মুখ তুলে তাকালো সেই স্ত্রীলোকটির দিকে, যার নামও সুমনা। তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। তারপর ভদ্রতাবোধে চোখ সরিয়ে নিয়ে আনমনা থাকলো আরো কিছুক্ষণ। এক মনোরম শীতলতায় একটু একটু করে থিতিয়ে আসতে লাগলো বুকের উদ্দাম আলোড়ন। প্রলয়-ক্লান্ত পৃথিবীর চোখে পড়ন্তবেলায়, নির্জন নদীতটে, সূর্যাস্ত দেখার ভালোলাগা একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তার বেবাক মনজুড়ে। ওই মুখ তার চোখের চেনা কোনো মুখ নয়, কিন্তু তার অতি চেনা কোনো এক ভালোবাসার যেন নিটোল মুখচ্ছবি। তার সুমনা আবারো চোখে ভাসে তার। ভাবে ভালোবাসার আরেক নামই বুঝি সুমনা! সেই ভালোবাসার --- যে ভালোবাসা সংশয়হীন, যে ভালোবাসায় মিলনের আশায় বুকবেঁধে প্রতীক্ষা করা যায় অনন্তকাল।
খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রতি নমস্কারটুকু জানাতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ফেললো কিংশুক।
অমিতাভ বলে উঠলো, "কিংশুকবাবু কিন্তু খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন সুমনা।"
---- তাই নাকি! তাহলে তো না শুনে ছাড়ছি না।
অমিতাভ বললো,"উঁহুঁ, আগে গরম চা, তারপর...."
"সে আর বলতে! আমি এখুনি নিয়ে আসছি।"
মিষ্টি হেসে চলে গেল সুমনা।
অমিতাভ হাসতে হাসতে রসিকতার সুরে বললো,"কোন কবিতা শোনাবেন ভাবতে থাকুন। এসেই কিন্তু ধরে বসবে। না শুনিয়ে পার পাবেন না।"
অদ্ভুত হেসে মুহূর্তকাল উদাস থাকলো কিংশুক। তারপর যেন অনেকদূর থেকে ভেসে এলো তার কণ্ঠস্বর ---
"আমি জানি সুমনারা কোন কবিতা ভালোবাসে।"
---------------------------------------------
লেখক- গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
হৃদয়পুর, উত্তর ২৪ পরগনা।